নির্বাচন,রাজনীতি,ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও আমাদের করণীয়………
আমাদের শৈশব কৈশোরের যে পজিটিভ দিকগুলো থেকে সামিন বা ওর সমবয়সী প্রজন্ম বঞ্চিত হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা এবং উৎসমূখর ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ।
সামিনের যেহেতু এখন টিনএজ বয়স, তাই ওর সাথে ইদানিং প্রায়ই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাজনীতি নিয়ে ওকে কোনো আদর্শ উদাহরণ দিতে পারি না। ওর জন্মের পর থেকে ও দেশে একটিমাত্র রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমতায় দেখছে, পাঠ্য বইয়ে, মিডিয়ায় -সর্বত্র একটি দল সম্পর্কে পড়তে পড়তে ওর ধারণা হয়ে যাচ্ছিল দেশে বোধহয় একটাই রাজনৈতিক দল আছে। বিশেষ করে এবারের নির্বাচন দেখে ওর এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে।
বিগত দুইদিন সান্ধ্যকালীন নাস্তার সময় তাই ওকে আমাদের শৈশব -কৈশোরের নির্বাচন এর গল্প শোনালাম। তখন নির্বাচন মানে ছিল নৌকা, ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লা, লাঙ্গল –এই চারটি প্রতীকের মধ্যে তীব্র লড়াই। প্রত্যেক প্রতীকের প্রার্থী নির্বাচনের আগে মিছিল নিয়ে এলাকায় জনসংযোগে আসতেন, তাদের কর্মীরা বাসায় এসে লিফলেট দিয়ে ভোট চাইতেন। ভোটার নম্বর, ভোটকেন্দ্রের নাম বলে যেতেন ।তখন উচ্চ ভলিউমে শব্দ দূষণ হতো না কিন্তু নির্বাচনের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল।
ভোটের দিন আমাদের সরকারি কলোনির আংকেল, আন্টিরা সবাই দল বেঁধে ভোট দিতে যেতেন। আর আমরা ছোটরা মনে মনে ভাবতাম কবে আমরাও ভোটার হবো, আঙ্গুলে অমচোনীয় কালির দাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াবো। তখন বিটিভি ছিল ভোটের রেজাল্ট দেখার একমাত্র মাধ্যম। সারা বছর বিটিভি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা থাকলেও ভোটের সময় সারারাত খোলা থাকতো। সুন্দর সুন্দর সিনেমা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতো বিকালের পর থেকে। ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ ভোটের ফলাফল দেখানোর জন্য স্টুডিওতে নিয়ে যেতো।
গম্ভীর চেহারার সংবাদ পাঠকরা হাতে স্টিক নিয়ে ম্যানুয়াল বোর্ডে প্রতীক অনুযায়ী প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা দেখাতেন। আমরাও রাত জেগে সিনেমা, সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার লোভে এসব ফলাফল দেখতাম। পরদিন দুপুরে চূড়ান্তভাবে কোন দল বিজয়ী হলো তা না জানা পর্যন্ত একটা টানটান উত্তেজনা কাজ করতো দেশবাসীর মধ্যে। তখনকার সময় নির্বাচন ছিল সারা দেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় উৎসব, যেখানে প্রতিটা জনগণ নিজেদেরকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি মনে করতো।
সেই দিনগুলো আজ শুধুই সোনালী অতীত!!!
একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনের যে উদাহরণ সামিনদের মতো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবার চোখের সামনে দেখলো, তা তাদেরকে ভবিষ্যতে রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন করবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
অথচ রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য না হলেও রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। নাগরিকরা যখন রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যায় তখন-
# দেশে ক্ষমতার পালাবদল হয় না
# একই দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে থাকতে জবাবদিহিতার ঊর্ধে চলে যায়
# ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা নিজেরাই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আন্ত:কলহে লিপ্ত হয়
# প্রতিপক্ষ দলগুলো নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে না পেরে হঠাৎ হঠাৎ সহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্বের জানান দেয় ।
অলরেডি উপরের সবগুলো ঘটনাই আমাদের দেশে ঘটা শুরু হয়ে গেছে।
আদর্শ রাজনৈতিক পরিবেশের চর্চা না থাকায় তরুণ প্রজন্ম ইতিমধ্যেই টিকটক, ভিডিও গেম, ট্রল, মিমস প্রভৃতি আনপ্রোডাক্টিভ ,অরুচিকর বিষয়ে ইনভল্ভড হয়ে গেছে। রাজনীতি তাদের কাছে এখন অগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ।
তবে কি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে রাজনীতি একটি প্রহসনের বিষয় হিসেবে পরিগণিত হবার এই দায়ভার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর শতভাগ চাপিয়ে দিয়েই আমরা পার পেয়ে যাবো?
নাকি অভিভাবক হিসেবে ’রাজনীতি সচেতন’ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরিতে আমাদেরও সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিত?
আমি বলবো আমাদের অভিভাবকদেরই এখন সচেতন এবং কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। টিন এইজ বয়স থেকে সন্তানদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অতীত ইতিহাস, বর্তমান গতিপ্রকৃতি এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। তাদের সাথে নিয়মিত রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। যদিও রাজনীতির মতো একটি জটিল এবং গুরুগম্ভীর বিষয়ে টিনএইজ বয়সীরা আগ্রহ পাবে না, তাদের কাছে বোরিং লাগবে— এটাই স্বাভাবিক; তবে এই ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। তাদের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য নিয়মিত নিউজ দেখা, পত্রিকা পড়া উৎসাহিত করতে হবে। রাজনীতি বিষয়ক বই পড়তে দিতে হবে।
আমি সম্প্রতি গা*জা*য় সংঘটিত হওয়া ই#স%রাই*ল- হা*মা*স যুদ্ধ নিয়ে সামিনকে আপডেট রাখার
জন্য ওকে দিয়ে ভিডিও সিরিজ তৈরি করানোর উদ্যোগ নিলাম। যদিও ভিডিওর কন্টেন্ট আমি লিখে দিয়েছি কিন্তু সেগুলো দিয়ে স্লাইড তৈরি করা, ভয়েস দেওয়া, এডিট করা এসব করতে গিয়ে ওর মাথায় ফি*লি*স্তি*ন- ই#স#রা#ইলের এ যাবতকালের ইতিহাস মোটামুটি গেঁথে গেছে আলহামদুলিল্লাহ।
এরপর ওকে সাইমুম সিরিজের প্রথম ভলিউম কিনে দিলাম। পড়তে গিয়ে ও সিরিজের গল্পগুলো রিলেট করতে পারল, রাজনীতির সাথে সাথে এডভেঞ্চারও পড়া হলো।
গা*জা*য় এত বড় হ.ত্যা.য.জ্ঞ চলছে দেখেও কেন বিশ্বের মুসলিম দেশগুলো বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করছে না, যে আমেরিকা গা*জা*য় নিরীহ শিশু ও নারীদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে জেনেও ই#স#রা#ইলকে সমর্থন দিচ্ছে সেই আমেরিকাই আবার বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে—- এসব সমীকরণ বোঝার জন্য ওকে বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কেও ধারণা দিলাম। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিটি দেশ যে একে অপরের সাথে কানেক্টেড, দেশীয় রাজনীতি যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয় এই বিষয়গুলো ওকে বোঝালাম।
উদ্দেশ্য একটাই। ও যেন রাজনৈতিক কর্মী না হলেও রাজনীতি সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।
চোখের সামনে যা দেখা যাচ্ছে, দেখানো হচ্ছে, তার নেপথ্যে যে অনেক কিছু ঘটে সে বিষয়গুলো বোঝার জন্য একটা চিন্তাশীল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করাটা খুব খুব দরকার।
আমরা যেন ভুলে না যাই, সময় যতো এগিয়ে যাচ্ছে দাজ্জালের আবির্ভাবের সময়ও তত ঘনিয়ে আসছে ।আমাদের জীবদ্দশায় না হলেও আমাদের সন্তানদের জীবদ্দশায় বা তাদের সন্তানদের জীবদ্দশায় দাজ্জালের আগমন ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
আমাদের পরবর্তী বংশধররা যেন দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে, কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা–তা নির্ণয় করতে পারে, কোন ঘটনার নেপথ্যে কোন স্বার্থ রয়েছে– তা আন্দাজ করতে পারে সেজন্য তাদেরকে রাজনীতি সচেতন হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
আমরা যেন ভুলে না যাই শেষ পর্যন্ত আমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আমরা অভিভাবকরাই দায়িত্বশীল, রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্র নয়।