সন্তানকে ‘সামাজিক মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলবেন যেভাবে . . .

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

আজকের লেখাটি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। আমি শিক্ষক হিসেবে একটি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ৬ বছর চাকুরী করেছি। এই ৬ বছরে নার্সারি, কেজি-১, কেজি-২ এর অসংখ্য ছোট বাচ্চাদের সাথে মেশার, তাদের আচরণ অবজার্ভ করার এবং তাদের এই আচরণের পেছনের মনস্তাত্বিক কারণ নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ হয়েছে। মূলত সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কিছু টিপস শেয়ার করতে চাই প্যারেন্টদের সাথে।

বর্তমান যুগের অধিকাংশ বাচ্চাদের একটি কমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের মধ্যে শেয়ার করার প্রবণতা অনেক কম, `জেলাসি’ অনেক বেশি । ইদানীং অধিকাংশ পরিবারেই একটি-দুটি সন্তান থাকে এবং অধিকাংশ বাচ্চাই একক পরিবারে বড় হয় । তাই তারা যখন পরিবারের বাইরে গিয়ে স্কুলে অন্য একাধিক বাচ্চার সাথে একত্রে সময় কাটানো শুরু করে তখন তারা এমন অনেক অনাকাঙ্খিত আচরণ করে ফেলে যা হয়তো তারা যখন পরিবারে একা থাকে তখন করার সুযোগ পায় না। যেমন- অন্যের পেন্সিল, রাবার লুকিয়ে রাখা, অন্যের বই, খাতা, পোশাকে দাগ দেয়া, অন্যের টিফিন ফেলে দেয়া ইত্যাদি। আর যেসব বাচ্চারা এসব পরিস্থিতির শিকার হয় তারা এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কখনও ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলে, কখনও বা রেগে গিয়ে হাতা-হাতি, ধাক্কা-ধাক্কি বা চুল টানা-টানির মতো কাজে জড়িয়ে পড়ে। ফলে ক্লাসরুমে কান্নাকাটি, মারামারি-সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়।

সবচেয়ে দু:খজনক বিষয় হলো, প্যারেন্টরা যখন স্কুল ছুটির পর বাচ্চার কাছে এসব কাহিনী শোনেন তখন বাচ্চারা সুকৌশলে নিজের দোষ গোপন করে অন্যের উপর দায় চাপিয়ে দেয় এবং অভিভাবকরাও ”আমার বাচ্চা কখনও এমন করতেই পারে না, সব দোষ অন্য বাচ্চার, শিক্ষকরা ঠিকমতো বাচ্চা হ্যান্ডেল করতে পারে না’’ — এসব ভেবে নিজেরা আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন। ফলে নিজের বাচ্চার চরিত্র সংশোধনের ব্যাপারে তারা কোনো উদ্যোগ নেন না এবং সমস্যাগুলোরও কোনো সমাধান হয় না।

এক্ষেত্রে প্যারেন্টদের উচিত বাচ্চার এধরনের আচরণের পেছনের মনস্তাত্বিক কারণ নিয়ে চিন্তা করা এবং তা সমাধানের চেষ্টা করা। আমি নিজে যেসব কারণ চিহ্নিত করেছি, এবার তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। ইদানীং বাসায় বাচ্চাদের অধিকাংশ সময় কাটে বিভিন্ন ধরনের খেলনা নিয়ে কিংবা মোবাইলে বিভিন্ন ধরনের কার্টুন দেখে । এই খেলনা নির্ভরতা তাদেরকে বস্তুপ্রেমী করে তোলে । অর্থ্যাৎ তারা ব্যক্তির চেয়ে বস্তুকে বেশি ভালোবাসতে শেখে। আবার মোবাইল/ টিভি তে তারা যেসব কার্টুন দেখে তার অধিকাংশই মারামারি নির্ভর। এই দুইয়ের যে এফেক্ট বাচ্চাদের উপর পড়ে তা হলো, সে যখন অন্য বাচ্চাদের সাথে একত্রিত হয় তখন সে বস্তু (নিজের খেলনা, বই, কালার পেন্সিল প্রভৃতি) অন্য বাচ্চাদের সাথে শেয়ার করতে চায় না, অন্যকে ধরতে, ব্যবহার করতে দেখলে রেগে যায়, কখনও কখনও সেটা শারীরিক আঘাতের পর্যায়ে চলে যায়। এটা যে শুধু স্কুলে ঘটে তা নয়, নিজের কাজিন, প্রতিবেশী বা অন্য যে কোনো বাচ্চার সাথেও তারা এমন করে।

মা-বাবা হয়তো তার আপাত শান্ত বাচ্চার এই পরিবর্তিত আচরণ দেখে হতবাক/বিব্রত হয়ে যান, কিন্তু তারা এই সাইকোলোজী বুঝতে পারেন না যে, একাকী থাকা অবস্থায় মানুষের চরিত্রের অনেক দিক অপ্রকাশিত থেকে যায়, যা দলগতভাবে কাজ করতে গেলে প্রকাশ পায়। আর দলগতভাবে কাজ করা/সময় কাটানোর ক্ষেত্রে বাচ্চার এই সহিংস আচরণকে সাময়িক/ব্যতিক্রমী ভেবে উপেক্ষা করে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কারণ বাচ্চার এই আচরণ তার পারিবারিক শিক্ষাকে রিপ্রেজেন্ট করে। তাছাড়া প্রতিটি মানুষকেই জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অন্য অনেক মানুষের সাথে কাজ করতে হবে। তাই ছোটবেলা থেকে সন্তানকে সামাজিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব প্যারেন্টকেই নিতে হবে।

এক্ষেত্রে প্যারেন্টরা যা যা করতে পারেন তা হলো-

প্রথমত: বাচ্চাকে কাউন্সেলিং করে বোঝাতে হবে যে, বস্তুর চেয়ে ব্যক্তি বেশি আপন। খেলনা, বই, কালার পেন্সিল প্রভৃতির চেয়ে বেশি আপন হলো বন্ধু, কাজিন, প্রতিবেশী এরা। তাই তারা যদি খেলনা দিয়ে খেলতে গিয়ে তা নষ্টও করে ফেলে তবু বন্ধু, কাজিনের সাথে মারামারি না করে তাকে ক্ষমা করে দিয়ে তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। যে কোনো বস্তু (খেলনা, বই প্রভৃতি) আবার দোকান থেকে ‍কিনতে পাওয়া যাবে কিন্তু বন্ধু, কাজিনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলে সে হয়তো আর মিশতে চাইবে না। অনেকের কাছেই এই বিষয়টাকে শিশুদের জন্য অনেক High thought এর মনে হতে পারে, মনে হতে পারে বাচ্চারা হয়তো এসব কথার মর্মার্থ বুঝবে না কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার ছোটবেলায় বাচ্চাদের মন থাকে কাদামাটির মতো, তাই বস্তুর চেয়ে ব্যক্তির সাথে সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি ছোটবেলা থেকে শেখালে এবং চর্চা করালে তারা এই মানসিকতা নিয়েই বেড়ে উঠবে।

দ্বিতীয়ত: বাচ্চাকে নিজের দোষ স্বীকার করার বিষয়টি শেখাতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনার দায় অপর পক্ষের উপর চাপিয়ে দেয়া বাচ্চাদের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। দোষ স্বীকার করলে শাস্তি পাওয়ার ভয়েও অনেকে এমন কাজ করে। তা বাচ্চারা যদি দোষ স্বীকার করে তবে তাদের ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হবে না — এই নিশ্চয়তা দিয়ে তাদের মুখ থেকে সত্য ঘটনা বের করে আনতে হবে এবং দোষী, নিদোষ উভয়কেই বুঝিয়ে বলতে হবে যেন তারা পরে আর এধরনের ঘটনা না ঘটায়।

তৃতীয়ত: একাধিক বাচ্চা যখন একত্রিত হবে তখন তাদেরকে দলগত খেলায় Involve করতে হবে। যেমন-লুকোচুরি, লুডু, কানামাছি প্রভৃতি খেলা। এসব খেলায় অংশগ্রহণের সুবিধা হলো প্রত্যেক বাচ্চাই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে, Attention deficiency তে ভুগবে না, physical activities এর ফলে ক্লান্ত হবে, ক্ষুধা লাগবে এবং খেলা শেষে জয়-পরাজয় মেনে নেয়ার শিক্ষাও পাবে।

চতুর্থত: সন্তানকে নিয়ে বাচ্চা আছে এরকম বাসায় বেড়াতে যেতে হবে আবার নিজের বাসায়ও বাচ্চা আছে এমন পরিবারকে ইনভাইট করতে হবে। এই উভয়মুখী যাওয়া-আসার ফলে বাচ্চার মধ্যে সামাজিক গুণ ডেভেলপ করবে। বাচ্চা যখন দেখবে অন্যের বাসায় গেলে তাকে খেলনা ধরতে দিচ্ছে না তখন সে মন খারাপ করলেও এই বিষয়টা পরবর্তীতে তাকে Empathetic করে তুলবে, সে feel করতে পারবে যে, সে যদি নিজের বাসায় অন্য বাচ্চাকে নিজের খেলনা ধরতে না দেয় তবে সেই বাচ্চারও একইভাবে মন খারাপ হয়।

বিপরীতক্রমে সে যদি দেখে অন্যের বাসায় গেলে তাকে খেলনা ধরতে, খেলতে দিচ্ছে তবে সেও এটা শিখবে যে, তার নিজের বাসায় যখন অন্য বাচ্চা বেড়াতে আসবে তখন তার সাথে খেলনা শেয়ার করতে হবে। এভাবেই বাচ্চাদের মধ্যে শেয়ারিং মনোভাব গড়ে উঠবে।

পঞ্চমত: বাচ্চাদেরকে নিয়ে নিয়মিত প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরতে যেতে হবে। প্রকৃতির মাঝে গেলে মন এমনিতেই উদার হয়। আকাশে দল বেঁধে পাখিদের উড়ে যাওয়া, পুকুরে দল বেঁধে হাঁসদের ঘুরে বেড়ানো কিংবা ঘাসের বুকে পিঁপড়াদের হেঁটে বেড়ানো দেখলে বাচ্চারাও শিখতে পারবে যে, দলগতভাবে থাকাতে অন্যরকম আনন্দ আছে। কৃত্রিমভাবে তৈরি ফ্যান্টাসি পার্কগুলোর চেয়ে এভাবে প্রকৃতির মাঝে বেড়ানো শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য বেশি উপযোগী কারণ ফ্যান্টাসি পার্কএর রাইডগুলো হয়তো সাময়িক উত্তেজনা দেয় কিন্তু মনে দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলে না।

সবশেষে বলতে চাই, ফিতরাতগতভাবেই মানুষ সামাজিক জীব। কিন্তু বস্তু ও প্রযুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, খেলার জায়গার অভাব, সমবয়সী সঙ্গীর অভাব আমাদের সন্তানদের ক্রমশ সংকীর্ণমনা, খিটখিটে স্বভাবের করে ফেলছে। তাদেরকে সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্যরেন্টদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন