আমার মেয়ের সপ্তম শ্রেণির পাঠ্য বইগুলোর মধ্যে যে বইটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো ‘জীবন ও জীবিকা’ বইটি। কিশোর-কিশোরীদের বাস্তবজীবনে কাজে লাগবে এমন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে বইটিতে। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে পারিবারিক বাজেট কিভাবে তৈরি করা যায় এই বিষয়ে একটা গাইডলাইন। অনেকের মনে হতে পারে কিশোর বয়সেই পারিবারিক বাজেট নিয়ে আলোচনা করার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা!!
এই বিষয়ে আমার অভিমত হলো, আমরা যদি চাই আমাদের সন্তান ভবিষ্যতে পরিবার ও সমাজে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখুক, তবে টিনএইজ বয়স থেকেই তাকে নিজ পরিবারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়া শুরু করতে হবে।
প্রথমেই সন্তানকে বোঝাতে হবে একটি পরিবারের Fixed cost কোনগুলো এবং Variable cost কোনগুলো। বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যুত বিল, পানির বিল, ইন্টারনেটের বিল, গৃহকর্মীদের বেতন, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বেতন, গৃহশিক্ষকের বেতন, —– এই খরচগুলো Monthly fixed cost এবং এগুলো যে সবার আগে পরিশোধ করতে হয় এটা তাকে জানাতে হবে।
সেই সাথে তাকে এটাও বোঝাতে হবে যে, এই খরচগুলো সময়মতো পরিশোধ করার সাথে অন্য ব্যক্তির হক আদায়ের ব্যাপার জড়িত। অন্য ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান এই অর্থের উপর নির্ভরশীল
— এই সেন্স ডেভেলপ করলে সে যখন বড় হয়ে নিজের সংসার চালাবে তখন সেও এই Fixed cost গুলো সবার আগে পরিশোধ করে অন্যের হক আদায়ের ব্যাপারে সচেতন হবে।
এরপর তাকে জানাতে হবে Variable cost সম্পর্কে। খাবার খরচ, যাতায়াত ভাড়া, পোশাক, চিকিৎসা, বিনোদন, সামাজিকতা— এই খরচগুলো Variable cost ; যা প্রতিমাসে সমানভাবে খরচ নাও হতে পারে। আমার মতে এই খরচগুলো বুদ্ধিমত্তার সাথে Maintain করতে পারার skill শেখানোটা খুব জরুরি। কারণ এই খরচগুলো যেহেতু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির প্রভাবে পরিবর্তিত হয় সেহেতু এই খরচগুলো নিয়ন্ত্রণ করার টেকনিক শেখাতে পারলে ‘আয় অনুযায়ী ব্যয় করা’র যে বেসিক Life skill প্রতিটা মানুষের জানা দরকার তা ডেভেলপ হবে। ফলে দামী রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ব্যয়বহুল ট্যুরে যাওয়া কিংবা জাঁকজমকের সাথে সামাজিক অনুষ্ঠান পালন করার মতো শো-অফ করার প্রবণতা কন্ট্রোলে থাকবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিয়মিত সাদাকাহ করা এবং সঞ্চয় করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা দেয়া। সাদাকাহ করলে যে শুধু পরকালের খাতায় পূণ্য জমা হয় তা নয় বরং ইহকালেও অনেক বিপদ দূর হয়, রিজিকে বরকত আসে এটা বোঝাতে হবে।
তবে এরপরও ইহকালীন জীবনে নানা রকম আথির্ক পরীক্ষা আসবেই এবং সঞ্চয় করার অভ্যাস থাকলে তা বিপদের দিনে অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে রক্ষা করবে। তাই সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলার ব্যপারে উৎসাহিত করতে হবে।
বর্তমান সময়ে ধনী-মধ্যবিত্ত-দরিদ্র সবধরনের পরিবারগুলোর মাঝে একটি বিপজ্জনক প্রবণতা হলো ঋণ করে শো-অফ করা। অনেকেই ঋণ করে হলেও সন্তানদের দামী মোবাইল কিংবা মোটর সাইকেল কিনে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ হলো সন্তানরা ঋণ করার ব্যাপারটাকে লজ্জাজনক মনে করে না। ঋণ করে শো-অফ করা যে গৌরবের নয় বরং আত্মসম্মানহানিকর এই বোধ সন্তানদের মাঝে প্রোথিত করতে হবে। তাছাড়া ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যু হলে কবরে তার শাস্তি কতটা ভয়াবহ হবে সে বিষয়েও ধারণা দিতে হবে।
সবশেষে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলবো, সন্তানের কাছে নিজের হালাল ও বৈধ আয়ের উৎস ও পরিমাণ সম্পর্কে তথ্য দিতে কুন্ঠিত বা লজ্জিত হবেন না। আপনি সৎ পথে যে পরিমাণ অর্থই উপার্জন করুন না কেন —- তা নিয়ে কনফিডেন্ট থাকুন, সন্তানদের সাথে তা শেয়ার করুন এবং সন্তানদের সেই আয় অনুযায়ী Life style Maintain করার শিক্ষা দিন। সন্তানের উচ্চাভিলাষী আবদারকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে নিজে দুর্নীতি করে পাপের ভাগীদার হবেন না। শেষ পর্যন্ত যার যার আমলনামার হিসেব তাকেই দিতে হবে। তাই সন্তান যেন আমাদের পাপ বৃদ্ধির কারণ না হয়ে বরং সাদকায়ে জারিয়া হয় সেজন্য সততার বাস্তব উদাহরণ নিজেকেই হতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদের সঠিকভাবে সন্তান প্রতিপালনের তৌফিক দিন। আমীন।