ঘটনা ১:
আন্টিঃ আল্লাহই তো আমার ভাগ্যে এখানে বিয়েটা রেখেছিলেন তাই না? তোর আঙ্কেলের সাথে বিয়ে হল বলেই তো আমার দ্বীন পালনে এত কষ্ট হয়!এখানে আমার কি দোষ, বল!
নিতুঃ কিন্তু আন্টি আপনিও তো বিয়ের সময় দ্বীন পালন করে নাকি এটাকে কোনো গুরুত্ব দেননি, তাই না?
আন্টিঃ কোথায় আমার বিয়ে হবে না হবে সেটা তো আল্লাহই লিখে রেখেছেন। আমি দেখলেই বা কি করতাম, বিয়েটাতো আর ঠেকাতে পারতাম না, তাই না?
ঘটনা ২:
নিতুঃ আপা, তুই যে এখনো নামায শুরু করছিস না, একবার ভেবে দেখেছিস যে এখন হুট করে যদি মরে যাই আমরা তাহলে কি অবস্থা হবে? কিসের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা?
আপাঃ আল্লাহ যখন হিদায়াত দিবেন তখনই শুরু করব। আল্লাহ তো কুরআনে বলেই দিয়েছেন যে আমি যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত দেই…
ঘটনা ৩ :
প্রভাঃ অ্যাপোলোতে যদি সাথে সাথে নিয়ে যাইতি, তাহলে এমনটা হইত না……এবারের মত আঙ্কেলের জানটা বেঁচে যাইতো……
উপরের ঘটনাগুলি সবই কাল্পনিক। কিন্তু এগুলো খুব ‘কমন’ কথা যা আমরা আশে পাশে হরহামেশাই শুনি। তাক্বদীরে বিশ্বাস আমাদের ঈমানের ছয়টা পিলারের একটা। আর ঈমানের যে স্তম্ভটা মানুষের কাছে সবচেয়ে ঘোলাটে লাগে সেটা সম্ভবত তাক্বদীরে বিশ্বাস। আল্লাহ সবকিছু লিখে রেখেছেন, আবার আমি আমার কাজের জন্য জবাবদিহি করব, এটা আপাত দৃষ্টিতে কেমন যেন সাংঘর্ষিক লাগতে থাকে অনেকের কাছেই।
আমি প্রায়ই মানুষকে বলি যে আমরা যারা মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি তাদের আসলে ঈমানের স্তম্ভগুলো নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা অর্জন করা দরকার সবার আগে। কারণ ঈমানই যদি ঠিক না থাকে তাহলে আমলগুলো খুব ফাঁপা, ভিত্তিহীণ হয়ে যায়। নিচের হাদীসটা পড়লে আমার খুব ভয় লাগে-
যায়দ বিন সাবিত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
“তুমি যদি আল্লাহর পথে ওহুদ পাহাড় সামান সোনা ব্যয় কর, তবে তা আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করবেন না, যতক্ষণ না তুমি তাক্বদীরের উপর ঈমান আনবে। আর জেনে রাখ যে, যা তোমাকে পৌঁছবে, তাতে ভুল হবে না। আর যা তোমার ব্যাপারে ভুলে যাওয়া হয়েছে (অর্থাৎ, যে সুখ-দুঃখ তোমার ভাগ্যে নেই) তা তোমাকে পৌঁছবে না। এর বিপরীত বিশ্বাসের উপর তোমার মৃত্যু হলে, তুমি অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (আহমদ ২১৫৮৯, ২১৬১১, আবূ দাউদ ৪৭০১, বাইহাক্বী, ২০৬৬৩ ইবনে হিব্বান ৭২৭নং)
আর তাই আজকে আমরা তাক্বদীরে বিশ্বাসের ব্যাপারটা একটু সহজভাবে বোঝার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ। আপাত দৃষ্টিতে এটা গোলকধাঁধার মত লাগতে পারে, কিন্তু এটা মোটেও রকেট সাইন্স নয়। আমার বিশ্বাস একটু আন্তরিকতা পড়লে আর শয়তানের ওয়াস ওয়াসা থেকে আশ্রয় চাইতে থাকলে ব্যাপারগুলো একদম স্বচ্ছ হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।
তাক্বদীরে বিশ্বাসের মূলত চারটা অংশ রয়েছে—
এখন আমরা এই অংশগুলো একটু ব্যাখ্যা করব..
.
আল্লাহর জ্ঞান
ধরুন শিল্পী একটা কলেজে পড়ায়। ওর ক্লাশে মাত্র ১০জন ছাত্রী। সবার স্বভাব, দুর্বলতা, পারদর্শীতার ব্যাপারে ওর বিস্তারিত জ্ঞান আছে। ওর একজন ছাত্রী হল নীরা। মেয়েটার একদমই পড়াশোনায় কোনো মন নেই। ওকে একদিন ডেকে নিয়ে শিল্পী সাবধান করে বলল যে ও যদি এভাবেই অমনোযোগী থাকে, তবে ও লিখে দিতে পারে যে টেস্টে নীরা ফেল করবে।
শিল্পীর অনুমান ভুল হয় নি। টেস্ট পরীক্ষার বৈতরণীই পার হতে পারল না নীরা………
আচ্ছা এখন নীরা যদি দাবী করে যে শিল্পী ওকে বাধ্য করেছে ফেল করতে তবে কি এটা ঠিক? শিল্পীতো শুধু শিক্ষক হিসেবে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের ভিত্তিতে নীরাকে সাবধান করেছে মাত্র, তাই না? কিন্তু এটা ভুলও হতে পারত……তাই না? কারণ শিল্পী একজন মানুষ এবং তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। হয়তো নীরা অপমানিত বোধ করে জিদ করে ভালোভাবে পড়াশোনা করতো ফলে শিল্পীর অনুমান ভুল প্রমাণিত হত।
এবার এই উপমাটা দিয়ে আমরা তাক্বদীরের ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করব। আমরা কে কী করব না করব……এগুলা সবই আসলে আল্লাহ জানেন কারণ তাঁর জ্ঞান অসীম এবং পারফেক্ট। এই জ্ঞানের মাঝে শুধু যা বাস্তবে হচ্ছে সেগুলোই অন্তর্ভুক্ত নয়, যা হতে পারত,কিন্তু আদতে হয়নি (Counterfactual) সেগুলোও বিদ্যমান। যেমন আল্লাহ কুরআনে বলছেন যে যারা সীমালঙ্গনকারী, তারা পরকালে আল্লাহকে দেখার পর আরো একবার দুনিয়াতে ফিরে আসার সুযোগ চাইবে, কিন্তু আল্লাহ জানেন যে ওদেরকে আবার সুযোগ দেয়া হলেও ওরা প্রথমবারের মতই আচরণ করবে। কুরআনে আছে-
আর আপনি যদি দেখেন, যখন তাদেরকে দোযখের উপর দাঁড় করানো হবে! তারা বলবেঃ কতই না ভাল হত, যদি আমরা পুনঃ প্রেরিত হতাম; তা হলে আমরা স্বীয় পালনকর্তার নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপ করতাম না এবং আমরা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।এবং তারা ইতি পূর্বে যা গোপন করত, তা তাদের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। যদি তারা পুনঃ প্রেরিত হয়, তবুও তাই করবে, যা তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল। নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী। (৬ঃ ২৭-২৮)
এই যে কী হলে কী হবে, এটাও আল্লাহ জানেন, কিন্তু এই জানার অর্থ কখনোই না যে তিনি আমাদের কোনো কাজ করতে বাধ্য করেন!
লিখে রাখা
কী হবে না হবে এটা সবই আল্লাহ লিখে রেখেছেন এটাও তাক্বদীরে বিশ্বাসের অংশ। তবে ব্যাপারটা অবশ্যই এমন না যে আল্লাহ ভুলে যাবেন বলে লিখে রেখেছেন…উনি সকল সৃষ্টিগত দুর্বলতা থেকে মুক্ত। এটা স্রেফ আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন, তাই লিখে রেখেছেন।
কী হবে না হবে সেটাতো আল্লাহ লিখেই রেখেছেন, আবার বলা হয় যে আমরা কেমন আমল করবো সে ব্যাপারে আমাদের স্বাধীনতা আছে, আমাদের কাজের জন্য আমাদের জবাবদিহিতা করতে হবে ইত্যাদি……দুটো ব্যাপার তাহলে সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে না?
না। আমরা যদি পুরো ব্যাপারটা MCQ প্রশ্নের সেটিং এ চিন্তা করি, তাহলে বুঝতে সহজ হবে। আমরা কোন উত্তর টিক দিবো, সেই স্বাধীনতা আমাদের আছে, কিন্তু প্রশ্নের অপশন ঠিক করার স্বাধীনতা নেই। ধরুন আল্লাহ হয়তো এভাবে লিখে রেখেছেন যে কারো আয়ূ-
ক)কিছুই না করলে ৪৫ বছর
খ) ৫০ বছর যদি ওষুধ খায়
গ) ৫৫ বছর ওষুধ + দুআ
এখন আপনি কী করবেন তার উপর নির্ভর করছে ক, খ নাকি গ। ব্যাপারটা একটা ডায়াগ্রামের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি-
দেখুন যে অপশন খ এবং অপশন গ এর মাঝে পার্থক্য শুধুই দুআ করা। আর এজন্যই হাদীসে এসেছে যে দুআ ভাগ্য বদলাতে পারে-সালমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
দু’আ ব্যতীত অন্য কোন কিছুই ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে না এবং সৎকাজ ব্যতীত অন্য কোন কিছুই হায়াত বাড়াতে পারে না।
হাসান, সহীহাহ (১৫৪)। তিরমিযী ২১৩৯, হাদীস সম্ভার ৩৬৪৪ সহীহুল জামে’ ৭৬৮৭) সহিহাহ ১৫৪ ইবনে মাজাহ ৯০-৪০২২ আহমাদ ২১৮৮১, ২১৯০৭, ২১৯৩২
এখানে খেয়াল করলে দেখবো যে অপশনের মাঝে ৬০ বছর নাই। আমরা যত কিছুই করি না কেন আয়ু ৫৫ বছরের বেশী বাড়বে না। এখানেই আমাদের মানবীয় সীমাবদ্ধতা যে আমরা অপশনগুলোর মাঝে বেছে নিতে পারি, অপশন নির্ধারণ করতে পারি না।
আবার ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে পরিণতি একই হবে কিন্তু সেটাতে পৌঁছাতে আপনি কোন পথ বেছে নিবেন এটা আপনার ইচ্ছা। একটা উদাহরণ দেই-ধরুন একবার এক ব্যক্তি আরেক লোককে বলল যে ঊনার রিকশাটা যেন একটু দেখে রাখে, সে একটু বাসা থেকে আসতেসে। রিকশার মালিক মনে মনে ভাবল যে ফিরে এসে লোকটাকে ১০০ টাকা দিবে কাজটা করার জন্য। কিছুক্ষণ পর এসে দেখে লোকটা রিকশার সিটটা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। লোকটা বাজারে গিয়ে ওই ১০০টাকা দিয়েই রিকশার সিটটা বেঁচে দিল।
এখানে দেখেন যে আল্লাহ লোকটার ভাগ্যে ১০০ টাকা লিখে রেখেছিলেন। কোন পথে পাবে সেই সিদ্ধান্ত লোকটা নিজে নিয়েছে। এই ব্যাপারটা আমরা বুঝিনা বলেই হারাম উপায়ে উপার্জনে লিপ্ত হই। আমাদের বোঝা দরকার যে হারামভাবে আমরা যেটা অর্জন করি আল্লাহ আসলে ওই পরিমাণই তার জন্য নির্ধারিত করে রেখেছিলেন, হয়তো অন্য কোনোভাবে। এমন না যে হারাম পথে সে তার রিযিক্ব বাড়ায়। তবে অবশ্যই এই দুইভাবে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণের টাইমিং একই নাও হতে পারে। হালাল পথে উপার্জিত টাকা হয়তো একটু দেরীতে আসে, সেজন্য ধৈর্য্য ধরতে হয়। এই ধৈর্য্যটা আমাদের থাকে না বলেই আমরা হারাম পেশায় লিপ্ত হয়ে যাই (যেমন সুদী ব্যাংকে চাকরী)
আচ্ছা তাহলে যে বলা হয় যে ভাগ্যের লিখন বদলানো যায় না? হ্যাঁ এটাও সত্যি এবং সহীহ হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আর এ কথা জেনে রাখ যে, যদি সমগ্র উন্মত তোমার উপকার করার জন্য একত্রিত হয়ে যায়, তবে ততটুকুই উপকার করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার (ভাগ্যে) লিখে রেখেছেন। আর তারা যদি তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়ে যায়, তবে ততটুকুই ক্ষতি করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার (ভাগ্যে) লিখে রেখেছেন। কলমসমূহ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং খাতাসমূহ (ভাগ্যলিপি) শুকিয়ে গেছে।(তিরমিযী ২৫১৬নং)
আমাদের বুঝতে হবে যে আল্লাহ লিখে রেখেছেন সেটার কয়েকটা স্তর আছে। উপরোক্ত হাদীসে আসলে লাওহে মাহফূজের লেখার কথা বলা হয়েছে, সেটা অপরিবর্তনীয়, কারণ এখানে একদম বিস্তারিত লেখা আছে যে কী কী অপশন ছিলো, বান্দা কোন অপশন বেছে নিল, কোন পথে বেছে নিলো সব।
এখন কি আমরা বুঝতে পারছি যে কিভাবে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত, কর্মপ্রচেষ্টা এগুলোর জন্য দায়িত্বশীল? প্রথম ঘটনাতে আন্টি যদি দ্বীনের কথা বিয়ের সময় চিন্তা করতেন, হয়ত তাহলে দ্বীনদার কারো সাথে তার বিয়ে হত বা তার আন্তরিক ইচ্ছা, দুআ এগুলোর কারণে হয়তো আল্লাহ তার স্বামীর মাঝে পরিবর্তন আনতেন…
তবে এখানে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যা অতীতে হয়ে গেছে, তা আমরা কোনোভাবেই বদলাতে পারব না।তাই এটা নিয়ে হা হুতাশ করা ইসলামে খুবই অপছন্দনীয়।আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
“(দেহমনে) সবল মু’মিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা বেশী প্রিয়। আর প্রত্যেকের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। তুমি ঐ জিনিসে যত্নবান হও, যাতে তোমার উপকার আছে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর ও উৎসাহহীন হয়ে না। যদি তোমার কিছু ক্ষতি হয়, তাহলে এ কথা বলো না যে, ‘যদি আমি এ রকম করতাম, তাহলে এ রকম হত।’ বরং বলো, ‘আল্লাহর (লিখিত) ভাগ্য এবং তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন।’ কারণ, ‘যদি’ (শব্দ) শয়তানের কাজের দুয়ার খুলে দেয়।” (মুসলিম ৬৯৪৫নং)
এই কী হলে কী হত, হা হুতাশ করা এগুলার প্রবণতা মানুষের প্রোডাক্টিভিটি ভীষণভাবে কমিয়ে দেয়। তাই ৩য় ঘটনাটায় প্রভা যে বলছিল যে ওর আঙ্কেলকে অন্য হসপিটালে নিলে বেঁচে যেত, এটা একটা ভুল দৃষ্টিভঙ্গী। উনার আয়ূ ঠিক ততটুকুই ছিলো, এক সেকেণ্ড বেশীও না, কম ও না। তাই আমরা যা হয়ে গেছে সেটা বদলানো যেত এমন কথা বলবো না, তবে অবশ্যই সেখান থেকে শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করবো যেমন ১ম ঘটনার আন্টির দরকার নিজের ছেলে মেয়েদের সময় দ্বীনদার সঙ্গী খোঁজা। কারণ ভবিষ্যতের ব্যাপারে এখনো আমাদের অপশন ক, খ, গ ইত্যাদির মাঝে বেছে নেয়ার সুযোগ আছে। তাই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে……
আল্লাহর ইচ্ছা
মনে আছে যে ২য় ঘটনাটাতে নিতু দাবী করছিলো যে আল্লাহর ইচ্ছা হচ্ছে না দেখেই ও হিদায়াত পাচ্ছে না? আল্লাহ কি তাহলে ইচ্ছা করেন যে মানুষ খারাপ কাজ করুক? আমাদের বুঝতে হবে যে আল্লাহর ইচ্ছা দুই ধরণের।
ক) সৃষ্টিগত ইচ্ছা
খ) শরঈ ইচ্ছা
সৃষ্টিগত ইচ্ছা হচ্ছে এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে কোনো কিছুই তার ইচ্ছার বাইরে ঘটছে না। এটা তাঁর ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট। কোনো কিছু তাঁর ইচ্ছার বাইরে ঘটতে পারে না, অস্তিত্বই লাভ করতে পারে না। আমরা যখন বলি যে আল্লাহ না চাইলে তো গাছের পাতাও নড়ে না…তখন আমরা আল্লাহর সৃষ্টিগত ইচ্ছার কথা বলি। কিন্তু তার অর্থ এটা না যে যা ঘটছে তার সব কিছু তিনি পছন্দ করেন। Approve করা আর Allow করা এক না।
যা ঘটা তিনি পছন্দ করেন বা চান যে ঘটুক, সেটাকে বলে শরঈ ইচ্ছা (Approve করেন)। যেমন তিনি চান যে সব মানুষ ইসলাম পালন করুক। তাই যখন কেউ বলে যে আল্লাহ চাচ্ছেন না তাই আমি হিদায়াত পাচ্ছি না……সে এখানে আল্লাহর সৃষ্টিগত ইচ্ছার কথা রেফার করছে (Allows to happen)। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আল্লাহর এই সৃষ্টিগত ইচ্ছা আল্লাহর ন্যায়বিচারের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন না, সে হিদায়াত পাওয়ার মত কাজ করে না বা শর্ত পূরণ করে না বলেই দেন না……আমরা যদি আগে উল্লেখিত ডায়াগ্রামের আলোকে নিতুর বোনের ব্যাপারটা চিন্তা করি, ওর ভাগ্যে হয়তো এভাবে লেখা আছে-
আল্লাহর সৃষ্টি
আমরা যখন আল্লাহর সৃষ্টিজগতের কথা ভাবি, তখন মাথায় রাখি না যে আমাদের চেষ্টা, ইচ্ছা করার ক্ষমতা, কাজ সবই আবার আল্লাহর সৃষ্টি। শুধু মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি না, মানুষের কাজও আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষ চাইলেও কোনো কাজ করতে পারে না, তার জন্য যে ক্ষমতা দরকার সেটাও আল্লাহর কাছ থেকে আসতে হয়। নিচে ব্যাপারটা ছবির মাধ্যমে বুঝানোর চেষ্টা করা হল-
অর্থ্যাৎ মানুষকে সীমিত আকারে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, একটা নিয়ন্ত্রণ রেখার বলয়ের মধ্যে (MCQ প্রশ্নের ফরম্যাটের মত)। এই সীমিত স্বাধীনতা বা সিদ্ধান্তের জন্যই সে জিজ্ঞাসিত হবে, যা তার সাধ্যের বাইরে সেটার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে না।
এখন প্রশ্ন হতে পারে যে মানুষ যা খারাপ কাজ করে, বা মানুষের জন্য খারাপ কিছু আল্লাহ সৃষ্টি করলেন কেন বা সৃষ্টিগত ইচ্ছার মাঝে মানুষের জন্য খারাপ এমন কিছু পড়ে কেন। উত্তর হচ্ছে absolute evil বলে কিছু নেই। ডাক্তার যখন হাত কাটে চিকিৎসার জন্য, আমাদের ব্যাথা লাগে, সেটা কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু আসলে এটা ভালো। আমাদের জীবনে এমন বহু ঘটনা আছে যেগুলো প্রথমে আমাদের কাছে খারাপ লেগেছে, পরে বুঝেছি যে সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো ছিল। সূরা কাহফে মুসা আলাইহিস সালামের সাথে খিদির আলাইহিস সালামের ঘটনাটার মাঝে এরকম একাধিক উদাহরণ আছে।তাইতো আমরা বলে থাকি যে আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন, যদিও বা কী ভালো, সেটা আমরা আমাদের সীমিত বুদ্ধি দিয়ে টের নাও পাই………
শেষ কথা
তাক্বদীরে বিশ্বাসের নানা দিকের মূল নির্যাস আসলে আল্লাহ কে, কেমন এই ব্যাপারটা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি। আল্লাহকে না চেনার কারণেই আসলে যত সংশয়ের জন্ম হয়। সেই সাথে আমাদের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিৎ যে আমরা কি ফাঁকিবাজি করার জন্য এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি? কারণ আপনি দেখবেন যে দুনিয়ার বিষয়ে কিন্তু আমরা এভাবে প্রশ্ন তুলি না। আমরা বলি না যে ভাগ্যে থাকলে চাকুরী হবেই সেজন্য ইন্টারভিউ দেয়ার বা চাকরির দরখাস্ত করার দরকার কী। আমরা তখন কিন্তু চেষ্টার কমতি রাখি না বা কোনো রিস্ক নিতে চাই না। অনুরূপভাবে দুনিয়াতে কোনো খুনী যদি আদালতে এসে বলে যে আমার ভাগ্যে লেখা ছিলো তাই আমি খুন করেছি, এখানে আমার কোনো দোষ নাই, তাহলে দুনিয়ার কোনো আদালতই সেটা গ্রহণ করবে না, ভেঙ্গে পরবে সকল বিচার ব্যবস্থা। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে নিজের কৃতকর্মের দায় অন্যের উপর চাপানো ইব্লিশের একটা বৈশিষ্ট্য। কুরআনে আল্লাহ ইবলিশের সাথে কথোপকথন উল্লেখ করছেন-
তিনি বললেন — ”কি তোমাকে বাধা দিয়েছিল যেজন্য তুমি সিজদা করলে না যখন আমি তোমাকে আদেশ করেছিলাম?’’ সে বললে — ”আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ, আমাকে তুমি আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছ, আর তাকে তুমি সৃষ্টি করেছ কাদা দিয়ে।’’ তিনি বললেন — ”তবে এখানে থেকে রসাতলে যাও, তোমার জন্য নয় যে তুমি এখানে অহংকার করবে। কাজেই বেরিয়ে যাও, তুমি আলবৎ অধমদের মধ্যেকার।’’ সে বললে — ”আমাকে সময় দাও সেইদিন পর্যন্ত যখন তারা পুনরুত্থিত হবে।’’ তিনি বললেন — ”বেশ, তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের মধ্যেকার।’’ সে বললে — ”তবে তুমি যেমন আমাকে বিপথে যেতে দিয়েছ, আমিও তেমনি ওত পেতে থাকবো তাদের জন্য তোমার সহজ- সঠিক পথে। (সূরা আরাফঃ ১২-১৬)
খেয়াল করলে দেখবো যে ইবলিশ সুস্পষ্টভাবে বলছে যে সে নিজেকে আদম আলাইহিস সালামের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবে, তাই তাকে সিজদা করে নি, পরে আবার বলছে যে আল্লাহই তাকে পথভ্রষ্ট করেছে। অথচ আদম আলাইহিস সালাম কিন্তু উনার কৃতকর্মের দায়ভার নিজেই নিয়েছেন, সাথে সাথেই তাওবা করেছেন।
আল্লাহ আমাদেরকে একটি প্রোডাক্টিভ জীবন যাপনের তৌফিক্ব দিন যেখানে আমরা আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা রেখে ইতিবাচক কিছুর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাই। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো কাজের ফলাফল কেমন হয়েছে সেটা না, বরং আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছি নাকি সেটার জন্য আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।