জুলাই-আগস্টে ‘ছাত্র আন্দোলন’ চলাকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাহসিকতা, একতা, অভিনব স্লোগান দেখে বিভিন্ন সময় ওদের ছবি, ভিডিও শেয়ার করে পোস্ট দিয়েছিলাম-
’Proud of being an ex DU student’.
এরপর বন্যার সময় ছাত্রদের নিরলস পরিশ্রম ও মানবিকতা দেখে সেগুলোর ছবি, ভিডিও শেয়ার করেছিলাম আনন্দমিশ্রিত আবেগের সাথে ।
কিন্তু গত পরশু রাতে ঢাবি ও জাবি তে যা ঘটেছে তা দেখে গতকাল সারাদিন মনটা খারাপ ছিল নিঃসন্দেহে। গতকাল সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাত্রদের এই পৈশাচিক কর্মকান্ডের নেপথ্যের কারণ হিসেবে পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের পোস্ট পড়লাম।
ঢাবি, জাবিতে যারা পড়ে তারা নিজেদের superior মনে করে, দেশের জনগণের টাকায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে তারা অহংকারী হয়ে যায়, মাত্র এক ঘণ্টার একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চান্স পায় বলেই তারা যে মেধাবী হিসেবে প্রমাণিত হয়ে যায় তা নয়—– এ ধরনের নেতিবাচক পোস্ট যেমন পড়লাম তেমনি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেরা ঢাকার মতো ব্যয়বহুল শহরে এসে এডজাস্ট করতে গিয়ে কতটা মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়, হলের ছোট রুমে গাদাগাদি করে থেকে, ডাইনিং এ নিম্নমানের খাবার খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে করতে তারা নিজেরাও কিভাবে অমানবিক হয়ে ওঠে সে ধরনের পোস্টও পড়লাম।
এছাড়া ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দেশটা নতুন করে স্বাধীন করার আত্মতৃপ্তিতে তারা যে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে, জালিম সরকারকে উৎখাত করার পর তারা নিজেরাই যে জালিম হয়ে উঠছে— এ ধরনের পোস্টও চোখে পড়ল।
সোশ্যাল মিডিয়া যেহেতু স্বাধীন মত প্রকাশের জায়গা তাই এখানে সবাই যে যার ব্যক্তিগত মতামত দিতেই পারে। আর প্রতিটি মতামতের পেছনেই হয়তো নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
তো এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি কি?
আমি কি আন্দোলন কিংবা বন্যার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অবদানে গর্বিত হবার জন্য অনুতপ্ত হবো?
নাকি চোর সন্দেহে পিটিয়ে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করার জন্য লজ্জিত হবো?
অধিক সংখ্যক মানুষের ভালো কাজ কি অল্প সংখ্যক মানুষের মন্দ কাজের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে? এক ফোঁটা চুন যেমন এক গ্লাস দুধকে খাবার অনুপযোগী করে দেয় তেমনি একটি হলের কিছু সংখ্যক ছাত্রদের পৈশাচিকতা কি পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অবদানকে ম্লান করে দিয়ে তাদেরকে বাতিল করে দেয়?
বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম, সারাদিন ভাবলাম ।
বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সংশ্লিষ্ট হলের ছাত্রদের ইন্টারভিউ দেখলাম, পত্রিকায় এই জেনারেশন এর Mob mentality, attitude এবং এর behind the reason নিয়ে আর্টিকেলও পড়লাম।
শেষ পর্যন্ত আমি ফিরে গেলাম কুরআনের কাছে।
দেখলাম, ফেরাউনের কাছ থেকে মুক্তি লাভের পর লোহিত সাগর পfর হয়ে অপর পাড়ে পৌঁছাতেই
বনি ইসরাইল যখন মূর্তি পূজক অধ্যুষিত এক লোকালয়ে অতিক্রম করছিল, তখন তাদের দেখে তারা মুসা (আঃ) এর কাছে এক অবিশ্বাস্য আবদার করে বসেছিল।
” তারা বলতে লাগলো, হে মুসা! আমাদের উপাসনার জন্য তাদের মূর্তির মতো একটি মূর্তি নির্মাণ করে দিন। তিনি বললেন, তোমরা আসলে একটি মূর্খ সম্প্রদায়।”
(সূরা আরাফ:আয়াত ১৩৮)
যারা মাত্র আল্লাহর মুুযিজা স্বচক্ষে দেখে সাগর পার হয়ে এসেছে তারা কিনা নিরাপদ স্থানে এসে আল্লাহর সাথে শিরক করতে চাইলো? মূর্তি পূজা করতে চাইল?
ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই ঘটেছিল।
আর তাদের এই আচরণের পিছনে যে সাইকোলজিক্যাল কারণ আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি তা হলো
Desensitization of Evil. অর্থাৎ পাপের ব্যাপারে সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া।
মিশরে বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের মাঝে থাকতে থাকতে মূর্তি পূজা তাদের কাছে এতটাই নরমাল হয়ে গিয়েছিল যে তারা এর ভয়াবহতার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। আর এখানেই শয়তানের সার্থকতা। শয়তান মানুষকে দিয়ে একবারেই ভয়াবহ পাপ করায় না। সে বহুদিন ধরে চোখের সামনে ছোট ছোট পাপ দেখাতে দেখাতে এমন ভাবে অভ্যস্ত করায় যে মানুষ নিজেই একসময় ভয়াবহ পাপে জড়িয়ে পড়ে।
এবার আলোচ্য প্রেক্ষাপটের সাথে বিষয়টা মেলানোর চেষ্টা করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বিগত ১৫-১৬ বছর যাবৎ ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন কর্তৃক বিরোধী ছাত্র সংগঠন, সাধারণ ছাত্র, বিশেষ করে জুনিয়র ছাত্রদেরকে র্যাগিং বা অন্য যেকোনো কারণে মারধর করা এবং এরপর ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে খাওয়ানো (সবক্ষেত্রে অবশ্য খাওয়ানোর ব্যাপারটা ছিল না) এমন একটা কালচারে পরিণত হয়ে গিয়েছে যে, নির্যাতিত এবং নির্যাতনকারী উভয় পক্ষের কাছেই এটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিটি আদৌ দোষী কিনা,( যেমন -এক্ষেত্রে তোফাজ্জল আদৌ মোবাইল চুরি করেছিল কিনা) তা যাচাই না করা, দোষী হলেও তাকে বিচারের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর না করা (যেমন এই ক্ষেত্রে প্রোক্টরিয়াল বডি এবং হাউস টিউটরদের অনুরোধ সত্বেও থানায় নিতে না চাওয়া) এবং সর্বোপরি চোখের সামনে এরকম নির্মম নির্যাতন দেখার পরেও নির্যাতনকারী ছাত্রদের সম্মিলিতভাবে বাধা না দেওয়া এবং মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও ভাবলেশীন থাকা (ইন্টারভিউ এ ছাত্রদের অভিব্যক্তি দেখে আমার এমনটাই মনে হয়েছে)—— এসব কিছুই প্রমাণ করে যে ছাত্ররা এসব ঘটনার সাথে বছরের পর বছর ধরে অভ্যস্ত এবং এই ব্যাপারগুলোতে তারা Desensitize তথা অসংবেদনশীল হয়ে গেছে ।
এবার এক্ষেত্রে করণীয় কি? তারা Desensitize হয়ে গেছে বলেই কি তাদের এই কর্মকাণ্ডকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ আছে?
জবাব পেতে আমরা আবার ফিরে যাবো বনি ইসরাইলের ঘটনায়।
বনী ইসরাইলের মূর্তি তৈরীর আবদারকে মুসা (আ:) তাদের মূর্খতা হিসেবে অভিহিত করে সাময়িকভাবে উপেক্ষা করে গেলেন। তবে শয়তান কিন্তু তার প্রচেষ্টা বন্ধ রাখল না। মুসা (আ:) যখন আল্লাহর সাথে কথোপকথনের জন্য তুর পাহাড় এ গেলেন এবং সেখানে ৪০ দিন অবস্থান করলেন তখন মুসা (আ:) এর ভাই হারুন (আ:) এর নিষেধ সত্ত্বেও বনী ইসরাইলের একটি অংশ ঠিকই বাছুর পূজায় লিপ্ত হলো।
সামেরি গোত্রের একজন স্বর্ণ দিয়ে একটি বাছুর তৈরি করলো এবং তার পূর্ব জ্ঞান কাজে লাগিয়ে জ্বীনদের সাহায্য নিয়ে সেই বাছুরটাকে জীবন্ত প্রাণীর মতো আওয়াজ করাতে সক্ষম হলো। বনি ইসরাইলদের একটি অংশ এ মিরাকল দেখে পথভ্রষ্ট হয় শিরকে লিপ্ত হলো। মুসা (আ:) তুর পাহাড় থেকে ফিরে এসে তাদের এই কর্মকাণ্ড দেখে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হলেন এবং সামেরি গোত্রের ঐ ব্যক্তিকে নির্বাসনের শাস্তি দিলেন। সাথে এটাও জানালেন যে, মৃত্যুর পূর্বে সে মানুষকে বলতে থাকবে, ”আমাকে স্পর্শ করো না।”
অর্থাৎ সে কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। মুসা (আ:) এরপর উপাসনা করা বাছুরটাকে আগুনে পুড়িয়ে দিলেন এবং আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে উপাসনাকারী বনি ইসরাইলদের মৃত্যুদন্ডের শাস্তি দিলেন।
অর্থাৎ যে বনি ইসরাইলদের আল্লাহ তাআলা ফেরাউনের দুঃশাসন থেকে মুক্ত করে নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে এসেছিলেন সেই বনি ইসরাইলদের একটা অংশই আল্লাহর সাথে শিরক করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলো। What an irony !!!!!
বনী ইসরাইলদের এই পদস্খলনের ঘটনা থেকে আমাদের জন্য একটা বিরাট অশনি সংকেত আছে। যে স্বাধীনতা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত হিসেবে এসেছে আমরা যদি সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে স্বৈরাশাসন আমলের পাপগুলোর পুনরাবৃত্তি করি, তবে তার শাস্তি হিসেবে হয়তো আগের চেয়ে আরো বেশি খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে।
দীর্ঘ সময় পর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে থাকার সুযোগ পেয়ে ছাত্ররা যে নিয়ামত লাভ করেছে তারা যদি সেটার জন্য শুকরিয়া আদায় না করে নিজেরাই উন্মত্ত আচরণ শুরু করে তবে তার পরিণতি পূর্বের চেয়েও খারাপ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তোফাজ্জল হত্যাকান্ড তাই দেশের ছাত্র সমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রিমাইন্ডার। এই ঘটনা তাদের জন্য একটি স্পিড ব্রেকার এর মতো, যা তাদের স্মরণ করিয়ে দিল যে–
রাস্তায় অবাধে চলাচলের স্বাধীনতা পেয়ে যদি তারা বেপরোয়া গতিতে যান চালায় তবে তা থেকে দুর্ঘটনা হতে বাধ্য। তাই রাস্তায় ট্রাফিক থাকুক বা না থাকুক, তাদের নিজ দায়িত্বেই তাদের আচরণের লাগাম টেনে ধরতে হবে।
সেই সাথে তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়কে আমলে নেওয়া যাবে না, খুনি হিসেবেই তাদের ট্রিট করতে হবে ।
সবশেষে একটা কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, নিঃসন্দেহে দেশের এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা এসেছে আল্লাহর তরফ থেকে। তিনি চেয়েছিলেন এই সময় স্বৈরাচারের পতন হবে– তাই তিনি ছাত্রদের ’কোটা আন্দোলনে’র মাধ্যমে একটি উসিলা তৈরি করে দিয়েছিলেন।
তিনি চেয়েছিলেন বলেই ৫ ই আগস্ট ছাত্র, জনতা নির্বিশেষে সবধরনের মানুষ প্রাণের মায়া উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে এসেছিল, যারা রাস্তায় নামতে পারেনি তারা ঘরে বসে নামাজ পড়ে, রোজা রেখে, তাহাজ্জুদে কান্নাকাটি করে তাদের দায়িত্ব পালন করেছিল, তিনি চেয়েছিলেন বলেই সেনাবাহিনী সরকারের আদেশ পালন না করে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এবং সর্বোপরি তিনি চেয়েছিলেন বলেই স্বৈরাশাসকের মনে ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল, শেষ মূহূর্তে পালিয়ে যেতে রাজি হয়েছিল।
এসবকিছু একসাথে ঘটেছিল বলেই সেদিন বিজয় সংঘটিত হয়েছিল। তাই এই বিজয়ের যদি কোনো সমন্বয়ক থেকেই থাকে, তবে সেটা স্বয়ং মহান আল্লাহতালা। The best of planners.
বিজয়ের পর এই বিজয়ে কার কতটুকু অবদান ছিল তার হিসাব কষতে গিয়ে আমরা যেন আত্ম অহংকারী হয়ে না যাই, আল্লাহ অসন্তষ্ট হন এমন কাজে লিপ্ত না হয়ে যাই।
মহান আল্লাহ আমাদের এই বিজয়কে সমুন্নত রাখার তৌফিক দিন। আসুন, সবাই একযোগে এই দুআ অব্যাহত রাখি।
অনেক সুন্দর লিখেছেন আপু।
তবে এমনটাও হতে পারে তোফাজ্জলকে পরিকল্পিতভাবেই ভিক্টিম বানানো হয়েছে।ওর মৃত্যুর পর ছাত্ররাজনীতি যেন নিষিদ্ধ করা যায়।
নিজেরা তো ক্যাম্পাসে কিছু করতে পারছে না,অন্যরাও যেন কিছু করতে না পারে।