অন্যের ভুল ধরা যতটা সহজ, নিজের সমালোচনা করা ততোটাই কঠিন।
নি:সন্দেহে স্বাধীনতার পর জাতি হিসেবে আমরা সবচেয়ে বড় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। স্বাধীন দেশে কয়েকদিনের ব্যবধানে সাধারণ মানুষের এত মৃত্যু, এত রক্ত এর আগে দেখিনি আমরা।
এই বিপর্যয়ের দায় কি শুধুই শাসকগোষ্ঠীর আর তার অনুগতদের?
প্রজা হিসেবে আমাদের কি কোনো দায় নেই? আত্মোয়ন্নয়নের সুযোগ নেই?
নিজেদের ভুলগুলোকে খুঁজে বের করে সংশোধনের এটাই সময়। এই সিরিজে আমি সেই চেষ্টাই করেছি।
যদিও মানসিক এই অস্থিরতা নিয়ে লেখালেখি করা কঠিন। তবে যার যার অবস্থানে থেকে এই লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে।
পর্ব – ১
গাজাবাসীদের তবু সান্ত্বনা আছে তাদের যারা হত্যা করছে তারা ভিনদেশী, ভিন্ন ধর্মের।
মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ, নির্যাতিত হয়েছে তাদেরও সান্ত্বনা আছে তাদের যারা আক্রমণ করেছিল তারা ছিল ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন জাতির।
কিন্তু ২০২৪ এ আমাদের যারা হত্যা, নির্যাতন করছে তারা আমাদেরই স্বধর্মের, স্বদেশী।
তাহলে আমাদের সান্ত্বনা কোথায়?
আমাদের কোনো সান্ত্বনা নেই, আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন আছে।
আমরা কি এতদিন মৌন থেকে, স্বার্থপর থেকে এই স্বৈরাচারকে উদ্ধত হতে প্রশ্রয় দেইনি?
আমরা কি আদতেই ন্যায়পরায়ণ শাসক পাবার যোগ্য?
পর্ব – ২
এই সময়ে দেশবাসীর অধিকাংশেরই মনের গহীনের একমাত্র চাওয়া হচ্ছে এই যুগের ফেরাউনের যেন পতন হয়। কিন্তু ফেরাউনের পতন হলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে আমরা নিশ্চিত?
আল্লাহ তো মুসা (আঃ) এর সময় বনী ইসরাইলকে ফেরাউনের দুঃশাসন থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু তারপরও কেন তাদের জেরুজালেম প্রবেশের অনুমতি দেননি? কেন তাদের চল্লিশ বছর মরুভূমিতে নির্বাসনে শাস্তি দিয়েছিলেন?
কারণ তারা এই পবিত্র ভূমিতে প্রবেশের যোগ্য ছিল না।
অথচ ৪০ বছর পর ইউশা ইবনু নুনের নেতৃত্বে বনি ইসরাইলের পরবর্তী প্রজন্ম জেরুজালেমে প্রবেশের সৌভাগ্য অর্জন করেছিল।
যদিও বিশিষ্টতার বিচারে মুসা (আঃ) স্থান ইউশা ইবনু নুনের চেয়ে অনেক ওপরে অথচ তার সময়ে বনি ইসরাইল তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি কারণ নেতা যেমনই হোক না কেন, সাধারণ মানুষেরা যদি আল্লাহ ভীরু, সৎ না হয় তাহলে আল্লাহ ঐ জাতিকে নেতৃত্ব বা ক্ষমতা প্রদান করবেন না।
তাই আসুন ব্যক্তি পর্যায়ে একজন উন্নত মুসলিম হওয়ার চেষ্টা করি। তাহলেই আমরা একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের দাবিদার হবো।
পর্ব – ৩
জাতি হিসেবে আমরা যে এখনও ন্যায়পরায়ণ শাসকের যোগ্য দাবিদার হয়ে উঠতে পারিনি তার একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ দেই।
গত সপ্তাহে কারফিউ এর কারণে যখন বাস, ট্রেনসহ সব ধরনের যাতায়াত মাধ্যম বন্ধ ছিল তখন একমাত্র মাধ্যম ছিল বিমান। আর এই সুযোগ নিয়ে বেসরকারি বিমানের টিকেটের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। অভ্যন্তরীণ রুটে যে টিকিটের দাম ছিল পাঁচ হাজার টাকা তা বাড়িয়ে ১১ হাজার টাকা করা হয় ।
এই যে অন্যের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজে লাভবান হওয়ার প্রবণতা তা শুধু শাসক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত মানুষরাই করছে তা নয় বরং তা করছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষরাও।
তাই অন্যের দিকে আঙ্গুল তোলার সময় নিজেকেও প্রশ্ন করা দরকার
“Am I a perfect muslim?”
দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে শাসকের পরিবর্তন চাইবার পাশাপাশি আসুন নিজেকেও পরিবর্তন করার চেষ্টা শুরু করি আজ থেকেই।
ফিরে যাই কুরআনের কাছে, দিক নির্দেশনা নেই কুরআন থেকে।
সর্বকালের সেরা স্বৈরশাসক ফেরাউনের সময়কালে আল্লাহ মূসা (আ:) কে দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেছিলেন
”আমি মূসা আর তার ভাইয়ের প্রতি ওয়াহী করলাম যে, ‘‘মিসরে তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য ঘর তৈরি করো আর তোমাদের ঘরগুলোকে ‘ইবাদাত গৃহ করো, আর নামায প্রতিষ্ঠা করো এবং মু’মিনদেরকে সুসংবাদ দাও।” (সূরা ইউনুস: ৮৮)
পর্ব – ৪
গত সপ্তাহের ঘটনায় যারা নিহত, আহত হয়েছে তারা সবাই যে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়েছিল ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। অনেকেই বিভিন্ন প্রয়োজনে রাস্তায় বের হয়ে আচমকা গুলির শিকার হয়েছে, কয়েকজন শিশু তো নিজের বাসার বারান্দা, ছাদ, জানালায় হঠাৎ ছুটে আসা গুলিতে নিহত হয়েছে ।
এসব দেখে আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে,কি অপরাধ ছিল এই নিষ্পাপ শিশুদের? তারা তো কোনো অপরাধ করেনি। তবে তাদের কেন এই নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হলো?
এর উত্তর পেতে আমরা ফিরে যাবো চৌদ্দশ বছর আগে রাসূল (সা:) এর কাছে।
একবার যাইনাব (রা:) রাসুল (সা:) কে জিজ্ঞেস করলেন , “যখন কোনো জাতির মাঝে অল্প কিছু খারাপ লোক থাকে তখন কি আল্লাহ তাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিতে পারেন?”
রাসূল (সা:) উত্তরে বলেছিলেন, ”হ্যাঁ ,এমনটা হতে পারে যদি মন্দ বা খারাপের মাত্রাটা খুব বেশি হয়ে যায়। “ (সহিহ বুখারি: ৩৩৪৬)
এবার এই হাদিসটা নিজের দেশের প্রেক্ষিতে চিন্তা করি। আমাদের দেশে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পাপের মাত্রা যে বহুগুণ বেড়ে গেছে এই বিষয়ে কি সন্দেহের অবকাশ আছে?
প্রেম, পরকীয়া, যিনা, সমকামিতা থেকে শুরু করে ঘুষ, দুর্নীতি, মজুদদারীতা, অসততা বহুবিধ পাপের মহামারী চলছে।
এমন একটা দেশে যখন গজব নেমে আসে তখন তার ভিকটিম যে নিরপরাধ শিশুরা হবে তা আমাদের মেনে নিতেই হবে, তা যতোই হৃদয়বিদারক হোক না কেন।
আরেকটা পয়েন্ট হচ্ছে, ইসলাম ব্যক্তিকেন্দ্রিক কোনো ধর্ম নয় বরং এটি একটি সামাজিক ধর্ম। আশেপাশের বিপথগামী মানুষদের সতর্ক করা এবং তাদের সৎ পথে আহবান করা আমাদের ধর্মের অপরিহার্য অংশ। আমরা কয়জন এই দায়িত্ব পালন করি? যারা পাপ করে তারা তো আমাদেরই পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী কয়জনকে আমরা দ্বীনের দাওয়াত দেই?
পর্ব – ৫
সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা খুব উৎসাহ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বদদুআ দিয়ে যাচ্ছি। তাদের ইনকাম হালাল হচ্ছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন করে যাচ্ছি । অথচ এরা সবাই কিন্তু আমাদেরই কারও না কারও ভাই, পিতা, স্বামী কিংবা পুত্র। এদের ইনকাম এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কিন্তু এরা একা ভোগ করে না, আমরাও করি ।
এরা যদি এখন অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে এই মুহূর্তে চাকুরী ছেড়ে দেয় তবে তাদের পরিবারগুলো কেও আর্থিক, সামাজিকভাবে সাফার করতে হবে । এই সাফারিং মেনে নেওয়ার জন্য আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত তো? কিংবা আমরা যারা সরাসরি তাদের ইনকামের উপর নির্ভরশীল না , কিন্তু তারা যদি আমাদের আত্মীয়, পরিচিত হয় তবে আমরা কি তাদের পারিবারিক, সামাজিক অনুষ্ঠানে বয়কট করতে প্রস্তুত?
তাছাড়া আমরা যারা অন্যান্য পেশায় আছি, তারাও কি নিশ্চিত যে আমাদের ইনকাম শতভাগ হালাল?
যদি ইনকাম হালাল না হয় তবে কিন্তু কোনো দুআই কবুল হবে না, সেটা জালিমদের জন্য বদদুআ কিংবা মাজলুমদের জন্য দুআ যেটাই হোক।
তাই আসুন অন্যের দিকে আঙগুল তোলার সময় চেক করি নিজেও সৎ আছি কিনা।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)