পর্ব-১
দলগত কাজের বাস্তব চিত্র
নতুন শিক্ষা কারিকুলামে প্রতিটি বিষয়ে দলগত কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নিঃসন্দেহে দলগত কাজের বেশ কিছু উপকারী দিক রয়েছে। যেমন- দলগত কাজের মাধ্যমে শেয়ারিং মনোভাব তৈরি হয়, যার যে বিষয়ে দক্ষতা আছে সে সেই বিষয়ে অবদান রেখে দলীয় কাজকে সমৃদ্ধ করতে পারে, দলের সবাই নিজ নিজ মতামত প্রকাশ করে বলে অনেক নতুন আইডিয়ার উদ্ভব ঘটে প্রভৃতি।
তবে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সারা বাংলাদেশের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাচ্চাদের পক্ষে দলগত কাজ করা আদৌ কতটুকু সম্ভব?
বা এই বছরে তা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে?
না হয়ে থাকলে তা কেন হয়নি?—এগুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি।
প্রথমত: ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাচ্চারা দলগত কাজ করার জন্য মানসিকভাবে যথেষ্ট ম্যাচিউরড নয়। দলের সকলের মতামত নেয়া, তা থেকে যাচাই-বাছাই করে সঠিক তথ্যগুলো নির্বাচন করা, দক্ষতা অনুযায়ী কাজ ভাগ করে দেওয়ার মতো পরিপক্কতা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাচ্চাদের নেই।
দ্বিতীয়ত: দলগত কাজ করার জন্য দলের সদস্যদের একসাথে বারবার মিটিং, আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন হয়, যা স্কুলের নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। আবার এই বয়সের বাচ্চারা স্কুলের বাইরে অন্য সময়, অন্য জায়গায় দেখা করার মতো যথেষ্ট বড় না, সবার বাসা কাছাকাছিও নয়।
তাই দলগত কাজের নামে এই বছর বাস্তবে যা হয়েছে তা হলো-
# ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণির বাচ্চারা ফেসবুক,হোয়াটসঅ্যাপ এ গ্রুপ খুলতে বাধ্য হয়েছে। স্কুল থেকে ফেরার পর থেকেই তারা এই গ্রুপগুলোতে দলগত এসাইনমেন্ট নিয়ে আলোচনা করেছে, ফলে অভিভাবকদের স্মার্টফোন অধিকাংশ সময় বাচ্চাদের কাছেই থেকেছে, মোবাইল আসক্তি বেড়েছে।
# বাচ্চারা যে সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে গ্রুপে আলোচনা করেছে এমনটা নয়, সেটা সম্ভবও নয়।( কারণ শয়তান সর্বদা বিপথে নেওয়ার জন্য সচেষ্ট)। তারা গ্রুপে পড়াশোনার বাইরে অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করে প্রচুর সময় নষ্ট করেছে।
# স্কুল থেকে দল গুলোকে এমন ভাবে গঠন করা হয়েছে যেখানে ভালো স্টুডেন্টদের সাথে খারাপ স্টুডেন্টদের মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতিটি দলে দুই থেকে তিনজন ভালো স্টুডেন্ট অধিকাংশ কাজ করেছে এবং বাকিরা ফাঁকিবাজি করেছে। ইন্ডিভিজুয়াল পরীক্ষা দিলে যেখানে প্রতিটি বাচ্চা পাস করার জন্য কিছুটা হলেও পড়াশোনা করতো, এবার সেখানে অল্পসংখ্যক সিরিয়াস বাচ্চা যা শেখার শিখেছে, যা কাজ করার করেছে। বাকিরা কিছুই না শিখে স্রেফ পাস করে যাবে।
এভাবে সিরিয়াস /ভালো স্টুডেন্ট এবং ফাঁকিবাজ/ খারাপ স্টুডেন্টদের মাঝে একটা বিরাট পার্থক্য তৈরি হয়েছে।
মোট কথা, দলগত কাজ এর যা মূল উদ্দেশ্য তা কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি এবং এই বয়সী বাচ্চাদের কাছ থেকে তা আশা করাও বাস্তবসম্মত নয়।
পর্ব-২
একক কাজে’র বাস্তব চিত্র
নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেক বিষয়ে ‘একক কাজ’ হিসেবে এসাইনমেন্ট করতে দেওয়া হয়েছিল । এই এসাইনমেন্টের প্রশ্নের উত্তরগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকে দেওয়া ছিল না। যেমন-’ ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী কয়েকজন বিদেশি বন্ধুর নাম, ছবি ও পেশার কথা উল্লেখ করা ছিল, কিন্তু একক কাজের এসাইনমেন্ট হিসেবে একেকজন ছাত্র/ছাত্রীকে ভিন্ন ভিন্ন বিদেশী বন্ধুদের ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন-জন্মসাল, জন্মস্থান. মুক্তিযুদ্ধে কিভাবে তারা সাহায্য করেছিল তার বিস্তারিত বিবরণ লিখতে বলা হয়েছিল।
এখন এইসব পাঠ্যপুস্তক বহির্ভূত তথ্য শিক্ষার্থীরা কোথায় পাবে?
যেহেতু বলা হচ্ছে , এই শিক্ষাক্রমে গাইড বই, প্রাইভেট টিউশনি কিংবা কোচিং সেন্টারের প্রয়োজন পড়বে না তাহলে এসব তথ্য পাওয়ার উৎস কি ?
উত্তর হচ্ছে- ইন্টারনেট।
বাধ্য হয়ে ছাত্রছাত্রীরা আবার সেই স্মার্টফোন ব্যবহার করে ইন্টারনেট ঘেঁটে এসব তথ্য বের করেছে এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার জন্য।
এছাড়া যেসব বিষয়ের এসাইনমেন্ট এ (গণিত, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শিল্প সংস্কৃতি ) ক্রাফটিং এর কাজ করতে হয়েছে, বিভিন্ন জিনিসের মডেল বানাতে হয়েছে, সেগুলোর মেকিং প্রসিডিউর শেখার জন্য ইউটিউব এর ভিডিও দেখতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের।
এখানে উল্লেখ্য যে, নতুন কারিকুলামকে কেন্দ্র করে অলরেডি বেশ কিছু ইউটিউব চ্যানেল চালু হয়েছে যাদের কাজই হচ্ছে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর এসাইনমেন্ট এর সমাধান নিয়ে ভিডিও তৈরি করা।
যেহেতু ক্লাসের সীমিত সময়ে স্কুলের শিক্ষকদের পক্ষে প্রতিটা ছাত্রছাত্রীকে এসব প্রসিডিওর শেখানো বাস্তবে সম্ভব হয়নি, তাই শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্যেই বলে দিতেন ইউটিউব এর ভিডিও দেখার জন্য।
এভাবে শিক্ষার্থীরা আবার সে মোবাইল, ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হয়েছে এবং এই উসিলায় মোবাইলে আসক্তি বেড়ে গেছে। বইমুখী পড়াশোনার বদলে ডিভাইসমুখী পড়াশোনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে বর্তমান কারিকুলাম।
পর্ব-৩
মূল্যায়ন উৎসবের বাস্তব চিত্র
বর্তমান কারিকুলামের পজিটিভ দিক হিসেবে যে কথাগুলো বারবার বলা হচ্ছে তা হলো- এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার কোন মানসিক চাপ নেই, তাদের কোনো কিছু মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে গিয়ে লিখতে হবে না, পরীক্ষায় কে কত নম্বর পেল সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকবে না —–ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথাগুলো শুনতে যতটা আকর্ষণীয় লাগে বাস্তবে কি তা আসলেই প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে?
আদতে এই বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর মূল্যায়ন উৎসবে কি হয়েছে?
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ব্যাখ্যা করছি।
এই বছরের পরীক্ষায় গতানুগতিক নিয়মে প্রশ্ন- উত্তর লেখার পরিবর্তে যা করতে হয়েছে তা হলো- পোস্টার পেপারে দলগত কাজ করা, এসাইনমেন্ট করা, অভিনয় করা বা মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করা ইত্যাদি। এভাবে পরীক্ষা দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার দিনগুলোতে যা করেছে তা হলো-
# পরীক্ষার হলে বাসা থেকে পোস্টার পেপার, কালার পেপার, রং, কাচি, আঠা, স্ট্যাপলার প্রভৃতি উপকারণ বহন করে নিয়ে গেছে।
# যেহেতু পাঠ্যপুস্তক থেকে কোনো প্রশ্ন আসবে না তাই শিক্ষার্থীদের বই খাতা নিয়ে বসার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। পড়াশোনা সংক্রান্ত কোনো সিরিয়াসনেস তাদের মধ্যে ছিল না।
# পরীক্ষার হলে দলগত যে কাজ করতে হবে তার সমাধান আগের রাতে youtube চ্যানেলগুলোতে আপলোড দেয়া হয়েছে। যারা সিরিয়াস শিক্ষার্থী তারা এসব ভিডিও দেখে পরীক্ষায় কি করতে হবে সে সম্পর্কে পূর্ব ধারণা নিয়ে গেছে, আর যারা সিরিয়াস নয় কিংবা যাদের স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সুবিধা নেই তারা কোনো রকম প্রিপারেশন ছাড়াই পরীক্ষা দিতে গিয়েছে। পরীক্ষার হলে শিক্ষকরা এসব শিক্ষার্থীদের অনৈতিকভাবে সাহায্য করেছে যেন স্কুলের পাশের হার ঠিক থাকে। (তিক্ত হলেও বাস্তব সত্য)
এভাবে পরীক্ষার পরিবর্তে মূল্যায়ন উৎসব করায় ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর নব্বই শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী এই বছর তাদের পাঠ্যপুস্তকের সবগুলো অধ্যায় পড়েনি এমনকি পাঠ্যপুস্তকে আদৌ কি আছে তা ভালোভাবে না জেনেই তারা নতুন ক্লাসে উঠে যাচ্ছে ।
আনন্দের বিষয় নয় বরং পরীক্ষা কারও জন্য বিরক্তির, আবার কারও জন্য ফাঁকিবাজির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাগজে-কলমে নতুন কারিকুলাম নিয়ে উচ্চাকাঙ্খা আর বাস্তবে যা হয়েছে তার মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য।