ভূমিকা
একটা সময় ছিল যখন বিয়ে বিষয়টা ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক বিষয়। ছেলে/মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী কিংবা ঘটকের মাধ্যমে পরিবারের কাছে বিয়ের প্রপোজাল আসতো। পাত্র/পাত্রীর বায়োডাটা দেয়া-নেয়া হতো। লিখিত বায়োডাটাতে শুধু পাত্র/পাত্রীর নিজস্ব তথ্য থাকতো তাই নয়, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, মা এবং বাবার পক্ষের আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য থাকতো। ফলে পাত্র-পাত্রীর নিজস্ব যোগ্যতা ছাড়াও দুই পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যেত বায়োডাটা দেখে। বায়োডাটা পছন্দ হলে পাত্র/পাত্রী দেখাদেখির আয়োজনও হতো পারিবারিকভাবে। এরপর দুই পক্ষ রাজি হলে পারিবারিক আয়োজনে বিয়ে হতো। বিয়ের পর কোনো বিপদ-আপদ হলে কিংবা স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে তা সমাধানের জন্য দুই পরিবারের সদস্যরা এগিয়ে আসতো ।
এরপর বিয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তন আসা শুরু হয়। ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই উচ্চশিক্ষা, চাকুরীর জন্য নিজ পরিবার, সমাজের বাইরে গিয়ে অবস্থান করা শুরু করে। ফলে ছেলে ও মেয়ে উভয়েই নিজস্ব পারিবারিক ও সামাজিক গণ্ডির বাইরে ভিন্ন কালচার, ভিন্ন স্ট্যাটাসের বহু ধরনের ছেলে/মেয়ের সাথে মেলা-মেশার সুযোগ পাচ্ছে। ছাত্র জীবনে, কর্মক্ষেত্রে একসঙ্গে চলাফেরা করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ভালো লাগা তৈরি হচ্ছে যা অনেক সময় পরিণতি পাচ্ছে ’বিয়েতে’।
এছাড়া ইন্টারনেটের প্রভাবে ‘বিয়ে’ অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত হয়ে বিয়ে করার জন্য পাত্র/পাত্রী এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে আসছে এমন ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই।
আবার ইদানীং দ্বীন পালনের সুবিধার কথা বিবেচনা করে দ্বীনি কমিউনিটি বা অনলাইন দ্বীনি গ্রুপের মাধ্যমেও বিয়ে হচ্ছে বিস্তর।
এক কথায় ’বিয়ে’ ব্যাপারটা এখন পারিবারিক গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে গেছে ব্যক্তি নির্ভর। পাত্র/পাত্রী নিজেরাই এখন বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেদের জন্য জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের সুযোগ পাচ্ছে।
’সংসার যেহেতু দুজনকেই করতে হবে তাই নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং টাই আসল’— এই নীতিতে বিশ্বাস করে ছেলেমেয়েরা এখন পরিবারকে গৌণ করে নিজেদের পছন্দটাকেই মুখ্য করে দেখছে।
কিন্তু এভাবে বিয়ের পরিণতি কি আসলেই সুখের হয়? গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমায় যেভাবে ধনীর মেয়ে গরীব সহপাঠীকে বিয়ে করে কিংবা অফিসের বস নিম্নবিত্ত কর্মচারীকে বিয়ে করে ভালোবাসার জয় প্রতিষ্ঠিত করে বিয়ের পর কি আসলেই তাদের পরিণতি Happily living ever after হয়?
বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না। বরং বাস্তবতা এই যে, সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে ডিভোর্সের হার বেড়ে যাচ্ছে । আর এর অন্যতম কারণ হচ্ছে – ’বিয়ের পূর্বে বিয়ে নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগা এরপর বিয়ে হয়ে গেলে বাস্তবতার কাছে হেরে যাওয়া।’
ব্যাপারটা এমন না যে, আগের যুগের পারিবারিক বিয়েগুলোতে কোনো ভুল, অসঙ্গতি ছিল না, তখনকার যুগে বিবাহিত জীবনে সবাই শতভাগ সুখী ছিল; তবে এটা ঠিক যে তখনকার বিয়েতে দুই পরিবারের আর্থিক, সামাজিক স্ট্যাটাস দেখে বিয়ে হতো বলে বিয়ের পর এডজাস্টমেন্ট এর ক্ষেত্রে তা ওয়ান স্টেপ এগিয়ে রাখতো। এখন যারা স্ট্যাটাস বিষয়টাকে ইগনোর করে মোহের বশে বিয়ে করছে (ভালোবাসার টানে কিংবা দ্বীনদারীতা রক্ষার স্বার্থে যে কারণেই হোক) তারা বিয়ের পর কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে তা এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য।
প্রথমে একটা বিষয় ক্লিয়ার করে নিতে চাই যে, ‘কুফু বা স্ট্যাটাসের মিল’ বলতে আমরা কি বুঝি ?
আর্থিক অবস্থা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা -এসব বিভিন্ন বিষয়ে মোটামুটি সমতা আছে কিনা তা যাচাই করাই হচ্ছে ‘কুফু বা স্ট্যাটাস মেলানো’।
আর এই সমতা শুধুমাত্র পাত্র এবং পাত্রী দুজনের মধ্যে মিলালে চলবে না, দুই পরিবারের মধ্যে মিলছে কিনা তা দেখাটাও জরুরী। কারণ ’বিয়ে’ মানে শুধু দুটি মানুষের মাঝে বন্ধন তৈরি হওয়া নয়, বরং দুটি পরিবারের মাঝেও সম্পর্ক তৈরি হওয়া। বিয়ের পর স্বামী/স্ত্রী উভয়কেই দুই পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলেমিশে চলতে হয় ।
এমনকি যদি দুজন নিজেদের পরিবার ছেড়ে ভিন্ন শহরে বা ভিন্ন দেশে গিয়ে আলাদা সংসারও করে, তবুও তারা তাদের পরিবারের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না । কারণ প্রতিটি মানুষের চরিত্রকে Shape-up করার ক্ষেত্রে তার পারিবারিক স্ট্যাটাস বিশাল ভূমিকা রাখে। তাই মানুষগুলোকে ছেড়ে গেলেও সে তার আজন্মলালিত মানসিকতাকে ছাড়তে পারে না। এ কারণেই বিয়ের সময় পাত্র/পাত্রীর নিজেদের এবং তাদের উভয়ের পরিবারের কুফু বা স্ট্যাটাস মেলানো’ এত জরুরী।
কুফু বা স্ট্যাটাস মিলিয়ে বিয়ে না করলে যেসব সমস্যা হতে পারে সেগুলোকে আমরা তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।
স্বামী- স্ত্রীর নিজেদের এডজাস্টমেন্ট এর সমস্যা
দুই পরিবারের সদস্যদের এডজাস্টমেন্ট এর সমস্যা
পরবর্তী প্রজন্ম প্রতিপালনের ক্ষেত্রে সমস্যা
পর্ব ১
কুফু বা স্ট্যাটাস মিলিয়ে বিয়ে না করলে স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের এডজাস্টমেন্ট এর সমস্যা
দৃশ্যপট এক
সাব্বির ও নেহা দুজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। ডিপার্টমেন্টের মেধাবী ছাত্র সাব্বিরের প্রতি দুই ব্যাচ জুনিয়র নেহার সব সময় এক ধরনের মুগ্ধতা কাজ করতো। সাব্বিরের নেহাকে ভালো লাগলেও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের সুন্দরী মেয়েকে প্রাপোজ করার সাহস ছিল না তার। পাশ করার পর ভালো রেজাল্টের সুবাদে সাব্বির যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার সুযোগ পেল তখন নেহাই তার পরিবারকে সাব্বিরের ব্যাপারে জানালো। নেহার পরিবারের সবাই শিক্ষিত, চাকুরীজীবী, উচ্চ-মধ্যবিত্ত। অন্যদিকে সাব্বির তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এমনকি গ্রামের মধ্যেও সর্বোচ্চ শিক্ষিত। দুই পরিবারের মধ্যে স্ট্যাটাস এর ব্যাপক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সাব্বিরের উজ্জল ক্যারিয়ারের কথা ভেবে নেহার পরিবার বিয়েতে রাজি হলো।
বিয়ের পর দুজনে শহরে আলাদা বাসা নিয়ে সংসার শুরু করলো। কিন্তু দিন যত গড়াতে লাগলো সাব্বিরের প্রতি নেহার মুগ্ধতা যেন কমতে শুরু করলো। ঘরের ভেতর সাব্বির যখন লুঙ্গি পড়ে ঘুরে বেড়ায় তখন ভার্সিটিতে ফিটফাট পোশাক পরে ক্লাস নিতে দেখা সাব্বিরের সাথে এই সাব্বিরকে সে মেলাতে পারে না। নিজের বাবা, ভাইকে বাসায় শর্টস, ট্রাউজার পরতে দেখা অভ্যস্ত চোখে সাব্বিরকে চরম খ্যাত লাগে নেহার। এছাড়া ঘরের ফার্নিচারের ডিজাইন পছন্দ করা, ঘর সাজানো, ঘর পরিপাটি করে রাখা –এসব অনেক বিষয় নিয়েই সাব্বিরের রুচিবোধের সাথে নেহার যে ব্যাপক পার্থক্য আছে তা ক্রমশ টের পেতে থাকে নেহা।
অন্যদিকে সাব্বিরেরও নেহার সাজানো-গোছানো টিপটপ সংসারে নিজেকে বেমানান মনে হতে থাকে। এমন গোছানো সংসারে থেকে অভ্যস্ত না সে । আবার ভার্সিটিতে নেহার মেকআপ করা চেহারা, স্টাইলিশ চুল, দামি পারফিউম এর গন্ধ সাব্বিরকে যেভাবে আবিষ্ট করে রাখতো এখন যখন সাব্বিরকে এসবের খরচ দিতে হয় তখন নেহার এই সৌন্দর্য চর্চাটাকে বিলাসিতা মনে হয়। নিজের আটপৌরে মা,বোনকে তো কখনো এসবের পেছনে টাকা খরচ করতে দেখেনি সে।
একই ছাদের নিচে থেকেও নেহা ও সাব্বির এর মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে।
দৃশ্যপট – ২
অনলাইনে একটি দ্বীনি গ্রুপে দারুন অ্যাক্টিভ আসমা । জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করা আসমা দুই বছর যাবত দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। তাই বিভিন্ন অনলাইন কোর্সে ভর্তি হয়ে এতদিনের ইলমের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে চায় সে। জেনারেল পড়াশোনার চেয়ে এখন এসব কোর্সের ব্যাপারে অধিক মনোযোগী সে। রেগুলার ক্লাস করা, নোটস নেওয়া, এসাইনমেন্ট জমা দেওয়া, পরীক্ষা দেওয়া– প্রতিটি বিষয়ে দারুন সিরিয়াস আসমা। বরাবর পড়াশোনায় মেধাবী আসমা এখন তার মেধাকে দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের পেছনে ব্যয় করছে।
তবে আসমার পরিবার তার এই পরিবর্তনে খুশি নয়। নামাজ, রোজা, যাকাত, সাদাকাহ এসব ইবাদত নিয়মিত করলেও আসমার মতো একজন মেধাবী মেয়ে জেনারেল লাইনের উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ছেড়ে এভাবে ইসলামী জ্ঞানার্জনে মনোনিবেশ করবে– এটা মেনে নেওয়া তার পরিবারের জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তাই আসমা মনে মনে এমন একজনকে খুঁজছে যে তার এই ইসলামী জ্ঞানার্জনের স্পৃহাকে মূল্যায়ন করবে, তাকে এই পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে।
অনলাইন দ্বীনি গ্রুপে এক বড় আপুর মাধ্যমে আসমা এমন একজন পাত্রের সন্ধান পায়। পাত্র এবং পাত্রের পরিবার যথেষ্ট প্র্যাকটিসিং। এই পরিবারে বিয়ে হলে পরিপূর্ণ পর্দা করা থেকে শুরু করে ইসলামী জ্ঞান অর্জন– সব ব্যাপারে অনুকূল পরিবেশ পাবে এই ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয় ঘটক বড় বোন। বিয়ের পরে পাত্র উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে চলে যাবে, সেখানে গিয়ে মেধাবী আসমাও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে– এই বিষয়গুলো দারুনভাবে আকর্ষণ করে আসমাকে।
পাত্র মোস্তফার পরিবার শুরুতে জেনারেল লাইনে পড়া আসমা ও তার নন প্রাক্টিসিং পরিবারের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ছেলের মতামতের কাছে নতি স্বীকার করে বিয়েতে রাজি হয় তারা।
বিয়ের পর মোস্তফা ও আসমা প্রবাসে নতুন সংসার শুরু করে। দুজনেই দ্বীন পালনের ব্যাপারে সিরিয়াস। নিজেদের মেধা ও জ্ঞানকে মুসলিম উম্মাহর কাজে লাগানোর ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে একসাথে। তবে দিন যতোই এগোতে থাকে সংসার করতে গিয়ে তাদের একে অপরের কাছে এক্সপেক্টেশনগুলো কোথায় যেন অপূর্ণ থেকে যায়। আসমা কাজ চালানোর মতো রান্নাবান্না পারলেও সেই অর্থে পরিপূর্ণ গৃহিণী টাইপ হতে পারে না। রান্নার পর বাকিটা সময় সে জ্ঞানার্জনের পিছনে ব্যয় করতে বেশি আগ্রহী।
এদিকে মোস্তফা নিজের মা, বোনকে সংসারের সব কাজ নিপুণভাবে করতে দেখে অভ্যস্ত। নিয়মিত রান্নাবান্নার পাশাপাশি সেলাই, বাহারি পিঠা, রকমারি আচার বানাতে দেখে অভ্যস্ত। তার বাড়ির পুরুষরা নারী সদস্যদের কাছ থেকে সবকিছু রেডি পাবে এটাই সে দেখে এসেছে সবসময়। সংসারের কাজে আসমাকে সাহায্য করার মতো দক্ষতা বা মানসিকতা কোনটাই না তার।
অন্যদিকে আসমার পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নিজেদের কাজ নিজেরাই করতে অভ্যস্ত। উপরন্ত সংসারে বিভিন্ন কাজে স্ত্রীদের সাহায্য করেও তারা আসমা। মনে মনে মোস্তফার কাছে এক ধরনের হেল্প প্রত্যাশা করলেও মুখে বলতে পারে না সে।
শুধু দ্বীনের ব্যাপারে মিল থাকলেই যে সংসার চলে না এটা দুজনেই উপলব্ধি করতে থাকে ক্রমশ।
উপরের দুটি কেস স্টাডিতে স্বামী -স্ত্রী দুজনের নিজেদের কুফু বা স্ট্যাটাস মিললেও, উভয় ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের পরিবার ছেড়ে দূরে সংসার করলেও পরিবার থেকে প্রাপ্ত আচার- আচরণ, মূল্যবোধ, রুচিবোধকে তারা পরিত্যাগ করতে পারেনি।
শিক্ষা, জীবিকা বা স্থানান্তরের কারণে যারা পরিবার থেকে দূরে থাকে তারা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে কিছুটা পরিবর্তন আনলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাইরের জগতের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। ঘরের ভেতর সংসার করতে গিয়ে তাদের ঘরোয়া, অভ্যন্তরীণ রূপটি প্রকাশ হয়ে পড়ে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজ নিজ পরিবার থেকে প্রাপ্ত। তাই আপাতদৃষ্টিতে Made for each other মনে হওয়া এই দম্পতিগুলোর মনের গহীনে প্রতিনিয়ত একটাই সুর বাজতে থাকে– ”মেলে না, আজ কিছু মেলে না।”
অনেকেই হয়তো বলবেন যে, ভালোবাসার আকর্ষণে কিংবা দ্বীনদারীতা বজায় রাখার স্বার্থে হয়তো এসব অমিলগুলোকে minimize করা, sacrifice করাই যায়। কিন্তু জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি —
যৌবনে হয়তো অনেকেই সংসারের স্বার্থে নিজের পছন্দকে সেক্রিফাইস করে বা অন্যের অপছন্দকে মেনে নেয়, কিন্তু মানুষের যতই বয়স বাড়তে থাকে ততই সে তার শিকড় বা Basic characteristics এর দিকে ফিরে যায়। এটা তার একটা কমন ফিতরাত। খুব কম মানুষই পারে নিজের শিকড়কে নিজের চরিত্র থেকে পুরোপুরি উপড়ে ফেলতে। যৌবনে এডজাস্ট করতে পারলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার এডজাস্টমেন্ট ক্ষমতা কমে যায়। যৌবনে আপাতদৃষ্টিতে সুখী দম্পতিদের অনেককেই তাই পরিণত বয়সে এসে বৈবাহিক সম্পর্কটাকে কোনরকমে একটা সুতার উপর টিকিয়ে রাখতে দেখা যায় ।
আবার যারা জীবনসঙ্গীর পছন্দ/অপছন্দ অনুযায়ী নিজেকে বদলায় বা নিজের পছন্দ/অপছন্দকে চিরতরে স্যাক্রিফাইস করে তারা জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে আফসোস বোধ করা শুরু করে। আর এই আফসোসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে কারোর ক্ষেত্রে বিষণ্ণতায়, কারোর ক্ষেত্রে খিটখিটে মেজাজে আবার কারোর ক্ষেত্রে নির্বাক, নির্লিপ্ততায়।
বিয়ে যেহেতু একটি Long term event, তাই পরিণত বয়সের এই সম্ভাব্য পরিণতিগুলোর কথা যৌবনের শুরুতেই ভাবা উচিত। ’অন্যের মনের মতো হতে গিয়ে নিজের আমিত্বকে বিসর্জন দেওয়া’– শেষ পর্যন্ত আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
পর্ব ২
কুফু বা স্ট্যাটাস মিলিয়ে বিয়ে না করলে পরিবারের সদস্যদের সাথে এডজাস্টমেন্ট এর সমস্যা
দৃশ্যপট – ১
মিতা ও আসিফ দুজন একই অফিসে কাজ করে দুই বছর যাবৎ। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় আসিফের জীবনটা ঝামেলাবিহীন হলেও মিতাকে বেশ স্ট্রাগল করে এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে। মিতার মধ্যবিত্ত বাবা ওদের তিন ভাই-বোনকে সমান সুযোগ-সুবিধা ও শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন। আসিফ যে মিতাকে পছন্দ করে তা বুঝতে পারলেও মিতা সেটাকে পাত্তা দিতে চায় না। কিন্তু মিতার এই আত্মমর্যাদাবোধ ও অনমনীয় ব্যক্তিত্বই আসিফকে যেন বেশি আকর্ষণ করে। বিয়ের পরও মিতা চাকুরী করতে পারবে, নিজের উপার্জন নিজের ইচ্ছামতো খরচ করতে পারবে– এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসিফ মিতাকে কনভিন্স করে।
আসিফ একমাত্র ছেলে হওয়ায় বিয়ের পর মিতা তার শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে যৌথ পরিবারে থাকা শুরু করে। আসিফের ছোট দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বোনরা যথেষ্ঠ শিক্ষিত হলেও ক্যারিয়ার গঠনের প্রতি ওদের কোনো আগ্রহ নেই। রান্নাবান্না, পোশাক, গয়না, টিভি সিরিয়াল– এসব নিয়েই ওদের জগত। অন্যদিকে মিতা দেশ, সমাজ, রাজনীতি নিয়ে সচেতন একটি পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়েছে। মিতার সাথে তাই ওর শ্বশুর বাড়ির নারী সদস্যরা গল্প করার কোনো কমন টপিক খুজে পায় না। নেহায়েত ভদ্রতাসূচক সম্পর্ক বজায় রেখে চলে ও শ্বশুরবাড়ির সাথে। এদিকে ওর শাশুড়ি-ননদ ভাবে চাকুরি করে বলে মিতা অহংকারী, উন্নাসিক। আসলে যে মানসিকতায় মেলে না–এটা ওরা বুঝতে চেয়েও বুঝে না।
এছাড়া আরও একটি বিষয় নিয়ে এই পরিবারের সাথে এডজাস্ট করতে দারুন কষ্ট হয়ে যায় মিতার। মেয়ের বাড়ি থেকে বিভিন্ন উৎসব- পার্বণে শ্বশুরবাড়িতে উপহার পাঠানোর চল রয়েছে এই পরিবারে। গ্রীষ্মে ফলমূল, শীতকালে পিঠাপুলি, রমজানে ইফতার আর ঈদের সময় পোশাক উপহার পাঠান মিতার শাশুড়ি তার দুই মেয়ের বাসায়। আবার বিভিন্ন উপলক্ষে দুই জামাাইকে দাওয়াত করে বিরাট আপ্যায়নের আয়োজনও করেন। মিতা এসব দেখে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলেও সব সময় পারে না ।
তার স্বামী, শাশুড়ি সরাসরি দাবী না করলেও মনে মনে যে তার বাবার বাড়ি থেকেও এ ধরনের আপ্যায়ন, উপহার প্রত্যাশা করে তা মিতা ঠিকই বুঝতে পারে। কিন্তু নিজের রিটায়ার্ড বাবা, যিনি নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে মিতাকে যোগ্য করে বড় করেছেন তার প্রতি এমন অন্যায় আবদার করতে মিতার বিবেকে লাগে। তাই বাধ্য হয়েই সে নিজের উপার্জন থেকে শ্বশুর বাড়ি সদস্যদের উপহার দিয়ে,মাঝে মাঝেই অনলাইনে রেস্টুরেন্টের খাবার অর্ডার করে সংসারে শান্তি বজায় রাখতে চেষ্টা করে।
দৃশ্যপট – ২
শিলা ও শামীমের পরিচয় হয়েছিল একটি অনলাইন সাহিত্য গ্রুপে। দুজনেই লেখালেখি করতো, একজনের লেখায় আরেকজন কমেন্ট করতো। এভাবে পরিচয় থেকে ভালোলাগা। পরিবার থেকে যখন বিয়ের চাপ আসলো তখন দুজনেই নিজ নিজ পরিবারে জানালো তাদের পছন্দের কথা।
শিলা ও শামীমের পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক স্ট্যাটাস প্রায় একই। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো দুই পরিবারের পারিবারিক পেশা নিয়ে। শামীমের পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে রাজনৈতিক পরিবার, সাথে পারিবারিক ব্যবসাও আছে ।পড়াশোনার প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই এই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের। শামীম একমাত্র এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ছোটবেলা থেকে রাজনীতি, ব্যবসার প্রতি আগ্রহ নেই শামীমের। সে বরং আতেল টাইপ, জগত সংসারের জটিলতা থেকে দূরে থেকে বইয়ের রাজ্যে ডুবে থাকতে পছন্দ করে। পরিবারের সদস্যরা তাকে খুব একটা ঘাটায় না।
অন্যদিকে শিলার পরিবারের সবাই শিক্ষিত। চাকুরীজীবী, ব্যাংকার, সরকারি আমলা, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক সব ধরনের পেশার আত্মীয়-স্বজন রয়েছে ওদের পরিবারে। তাই স্বল্প শিক্ষিত রাজনীতিক বা ব্যবসায়ীদের ওরা খুব একটা সমীহের চোখে দেখে না । শিলা যখন এই ধরনের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড এর একটি ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলো তখন ওদের পরিবারের কেউই রাজি হলো না । সবার অমতে অনেকটা জোর করেই শামীমকে বিয়ে করলো শিলা।
বিয়ের পর শিলা ও শামীমের পরিবারের পছন্দ ও রুচিবোধের পার্থক্যটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল ।
শামীমের পরিবারে অতিথি আপ্যায়ন মানেই নানা পদের বাহারি খাবারের আয়োজন, অন্যদিকে শিলার পরিবার পরিমিত খাবারের পদের সাথে পরিচ্ছন্ন পরিবেশন, গৃহসজ্জা, পরিপাটি ড্রেসআপ সবকিছুকেই গুরুত্ব দেয় । বিয়ের পর দুই পরিবার যখন একে অন্যের বাসায় দাওয়াত খেতে গেল তখন সামনাসামনি কিছু না বললেও বাসায় ফেরার পর নিজ নিজ ছেলে /মেয়ের কাছে শ্বশুরবাড়ির সমালোচনা করলো। প্রথমবার বলে শিলা ও শামীম চেষ্টা করলো বিষয়টাকে ইগনোর করার।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো ঈদের সময় পোশাক উপহার প্রদানের বেলায়। এক পরিবার ঝকমকা পোশাক উপহার পাঠালো তো আরেক পরিবার ব্র্যান্ডের সাদামাটা লুকের পোশাক উপহার পাঠালো ।পোশাকের দাম হয়তো উভয় পরিবারেরই এক, কিন্তু রুচির ভিন্নতার জন্য কোন পরিবারেরই অপরপক্ষের উপহার পছন্দ হলো না। মাঝখান থেকে আবার কথা শুনতে হলো শিলা ও শামীমকে ।
এরপর বিভিন্ন উপলক্ষে সুযোগ পেলেই দুই পরিবারের সদস্যরা একে আপরকে কটাক্ষ করে কথা শুনাতে লাগলো শীলা ও শামীমকে। বারংবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় একসময় এর প্রভাব পড়া শুরু হলো ও শামীমের সম্পর্কেও ।
উপরের দুটি কেস স্টাডি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, দুই পরিবারের মধ্যে মনমানসিকতার মিল না থাকলে উভয় পরিবারের সদস্যদের নিজেদের মধ্যে যেমন সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে না তেমনি স্বামী/স্ত্রীকেও শ্বশুরবাড়ির সাথে মানিয়ে নিতে কষ্ট করতে হয়।
এটা আশা করা বোকামি যে ’একটি বিয়ে’কে টিকিয়ে রাখার জন্য পুরো পরিবারের সবাই নিজেদের আমুল বদলে ফেলবে। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পরিবারের নতুন সদস্যটিকে (বউ/জামাই) নিজেদের মতো করে তৈরি করে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করে দেয়। কিন্তু একটা ম্যাচিউরড বয়সে এসে এভাবে নিজেকে বদলে ফেলার চাপ একটা এক্সট্রা স্ট্রেস তৈরি করে বউ/জামাই উভয়ের উপর । এই স্ট্রেসকে ইগনোর করে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মতো ম্যাচিউরিটি খুব কম দম্পতির মাঝে দেখা যায়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘তোমার পরিবার’’ vs আমার পরিবার’ নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়।
এজন্য ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় আগেকার যুগে বিয়ের আগে পরিবারের সদস্যরা পাত্র/পাত্রীর বাসায় গিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার যে প্রচলন ছিল সেটাই অনেক বাস্তবসম্মত ছিল। কারণ একটা বাসায় গেলে সেই পরিবারের সদস্যদের রুচি, আর্থিক সামর্থ্য এবং লাইফস্টাইল সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায়, যা পরবর্তীতে বিয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।আজকাল যেভাবে রেস্টুরেন্ট বা বাসার বাইরে অন্য কোথাও পাত্র/পাত্রী দেখার প্রচলন শুরু হয়েছে তাতে শুধু দুই পরিবারের বাহ্যিক রূপটাই দেখা যায়, কিন্তু সংসারের মূল জায়গা যে ’ঘর’ সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় না ।
আমি আগেও বলেছি ’বিয়ে’ একটি দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক এবং এই সম্পর্ক শুধু দুজন মানুষকে একটি বন্ধনে আবদ্ধ করে না বরং এর সাথে দুটি পরিবারও সর্ম্পকে জড়িয়ে পড়ে। তাই বিয়ের আগে কাছাকাছি মন-মানসিকতার পরিবারের সাথে সম্পর্ক তৈরীর বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।
Marriage & Family Related Books – Ilma Emporium
পর্ব-৩
কুফু বা স্ট্যাটাস মিলিয়ে বিয়ে না করলে পরবর্তী প্রজন্ম প্রতিপালনের ক্ষেত্রে সমস্যা
দৃশ্যপট-১
বাচ্চা হওয়ার পর দুই মাস বাবার বাড়িতে কাটিয়ে ছেলেকে নিয়ে যখন শ্বশুর বাড়িতে ফিরলো আয়শা তখন নাতিকে দেখে ওর দাদি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। তবে নাতির চেহারা দেখে যতটা উৎফুল্ল হলেন আয়েশার শাশুড়ি নাতির কপালের এক কোণে বড় কালো টিপ আর কোমরে বাঁধা কালো সুতা দেখে ততোটাই আতঙ্কিত হলেন। পুত্রবধূকে বললেন এখনই এগুলো খুলে ফেলতে। বাচ্চার নিরাপত্তার জন্য সকাল- সন্ধ্যার মাসনুন দোয়া, আয়তুল কুরসি ও চার কুল পড়ে ফুঁ দেওয়াই যে ইসলামসম্মত সেটা পুত্রবধূকে বুঝিয়ে বললেন তিনি।
আয়েশা শাশুড়ির সামনে কিছু না বললেও রাত্রে বাচ্চার বাবা বাসায় ফিরলে তাকে এই ঘটনা বর্ণনা করল। সাথে এটাও বললো, বাচ্চাকে বদনজর থেকে রক্ষা করার জন্য যুগ যুগ ধরেই তো এসবের ব্যবহার হয়ে আসছে। আয়েশার হাসবেন্ড আব্দুল্লাহ যথেষ্ট দ্বীনদার, সেই সাথে দ্বীনের বেসিক কনসেপ্টগুলো সম্পর্কে তার ক্লিয়ার ধারণা রয়েছে। তাই আয়েশার কথায় আবার নতুন করে হতাশ হলো সে। বিয়ের পর থেকে আয়েশার সাথে ওর দ্বীনের বেসিক কিছু বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য চলে আসছে।
এমনিতে আয়েশাও দ্বীনদার পরিবারের মেয়ে। পর্দা করে চলে, ফরজ ইবাদতের ব্যাপারেও সিরিয়াস। এসব দেখেই আব্দুল্লাহর মা আয়েশাকে ঘরের বউ করে এনেছিলেন। কিন্তু বাইরে থেকে দ্বীনদার মনে হওয়া এই ফ্যামিলির বেসিক ইসলামিক জ্ঞানে যে সমস্যা আছে তা কে জানতো? পারিবারিকভাবেই আয়েশারা একজন হুজুরের মুরিদ। যে কোনো বিপদ-আপদে সেই হুজুরের কাছ থেকে পানি পড়া, তেল পড়া, তাবিজ আনা তাদের পারিবারিক কালচার। বিয়ের পর এসব জানার পর আব্দুল্লাহ ওকে যতবারই বোঝাতে চেয়েছে যে এসব কাজ ইসলামে সুস্পষ্ট নিষিদ্ধ, ততোবারই তার আয়েশার সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। এমনকি আব্দুল্লাহকে অনুগত রাখার জন্য আয়েশা যে বিভিন্ন সময় হুজুরের কাছ থেকে চিনি পড়া, পানি পড়া এনেছে তা ,আব্দুল্লাহ বুঝতে পেরেছে কিন্তু সংসারে অশান্তির ভয়ে সেসব খাবার আয়েশার অগোচরে ফেলে দিয়েছে সে।
তবে এতদিন এভাবে চললেও এবার নিজেদের বহু কাঙ্খিত সন্তানের বেলায় এই ইসলাম বিরুদ্ধ ব্যাপার গুলো কিছুতেই মেনে নেবে না আব্দুল্লাহ— এ ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল সে। এবার সে কঠোর হবে তা সংসারে যতোই অশান্তি হোক না কেন।
দৃশ্যপট-২
চাকরি করে বলে মায়ের বাসার কাছে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে মিথিলা। দুই সন্তানকে সারাদিনের জন্য মা, বোনের কাছে রেখে যায়। নানি, খালার কাছে একটা ডিসিপ্লিনড লাইফ মেইনটেইন করে বড় হয়ে উঠছে ওর সন্তানরা। ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে, বাসায় ভালো টিউটর এসে প্রাইভেট পড়ায়। ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের smart, disciplined, well-mannered হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি মিথিলা। বিপত্তি বাঁধে তখন, যখন বাচ্চারা ঈদের ছুটিতে দাদা-দাদির কাছে গ্রামে বেড়াতে যায়।
বছরের অন্তত একটি ঈদে বাবা-মার সাথে গ্রামের বাড়িতে পরিবার নিয়ে ঈদ করতে চায় ফয়সাল। মিথিলাও বাধা দিতে পারে না; যেহেতু সারা বছর ও নিজের পরিবারের কাছাকাছি থাকে। কিন্তু গ্রামে গেলে বাচ্চা দুটো যেন বাঁধনহারা হয়ে ওঠে। গ্রামের বাচ্চাদের সাথে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো, গাছে উঠে ফল পাড়া, পুকুরে নেমে গোসল করা— এসব নিয়ে এতটাই মেতে উঠে যে খাওয়া, গোসল, ঘুম সবকিছুতে অনিয়ম হয়ে যায় ।ওদের দাদা-দাদীও ওদের এসব কান্ডকারখানায় প্রকাশ্যে প্রশ্রয় দেন আর ফয়সাল চুপ করে থাকে। আবার সন্ধ্যা হলেই দাদা-দাদীর সাথে হিন্দি চ্যানেল দেখতেও বসে যায় ওরা।
ফলাফল হিসেবে প্রতিবারই গ্রাম থেকে ফেরার পর অসুখ-বিসুখ বাধায়, সেই সাথে মুখের ভাষা ও আচার-আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে ওদের । মিথিলা না পারে সন্তানদের এই উচ্ছনে যাওয়া মেনে নিতে, না পারে ওদের প্রশ্রয়দাতা দাদা-দাদীর সাথে বেয়াদবি করতে । মাঝখান থেকে বাচ্চাগুলোর সাথে অহেতুক মেজাজ গরম করে সে।
তবে এবার মিথিলা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে কোনো একটা অজুহাতে এবার আর গ্রামে যাবে না ঈদ করতে, শ্বশুর-শাশুড়িকেই বলবে ওদের বাসায় আসতে। সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তা করে মা হিসেবে একটু কৌশলী হতেই হবে তাকে। নিজে যদিওবা ফয়সালের সাথে এত বছর মানিয়ে নিয়েছে কিন্তু নিজের সন্তানদের আনস্মার্ট হয়ে বেড়ে উঠতে দেবে না সে কিছুতেই, এত কষ্ট করে চাকরি করছে তো ওদের বেটার লাইফ স্টাইল মেইনটেইন করার জন্যই!!
উপরের দুটি কেস স্টাডি থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, কুফু বা স্ট্যাটাস মিলিয়ে বিয়ে না করলে সবচেয়ে বেশি প্রবলেম ফেস করতে হয় সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে। স্বামী বা স্ত্রী একজন বা কোন কোন ক্ষেত্রে দুজনেই হয়তো সংসারের স্বার্থে পরস্পরের অনেক অপছন্দনীয় বিষয়ের সাথে এডজাস্ট করে নেয়। দুই পরিবারের সদস্যদেরও হয়তো একটা সময় নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ, যোগাযোগ হয় না কিন্তু নাতি- নাতনি তথা পরবর্তী প্রজন্মের সাথে যেহেতু উভয় পরিবারেরই রক্তের সম্পর্ক থাকে তাই তাদের উপর উভয় পরিবারেরই হক বা অধিকার রয়েছে । তাদেরকে উভয় পরিবারের সাথেই সম্পর্ক মেইনটেইন করতে হয়।
এক্ষেত্রে যদি দুই পরিবার (দাদা /নানা বাড়ির) কুফু বা স্ট্যাটাসে বিস্তর পার্থক্য থাকে তবে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের সাথে মিশতে গিয়ে কনফিউজড হয়ে যায়। তারা যেহেতু ভালো/ মন্দ বিচার করার বয়সে থাকে না তাই তারা নিজের অজান্তেই দুই পরিবার থেকে অনেক কিছু ক্যাপচার করে নেয়। আবার জিনগত ভাবেও অনেক বৈশিষ্ট্য তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের যে বিষয়টা চরম অপছন্দের ছিল সেটাই যখন নিজের সন্তানের মধ্যে প্রতিফলিত হয় তখন বাবা-মা নিজেরাও অসহায় হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এটা তাদের চিরস্থায়ী মনো:কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সন্তানের উপর রাগ প্রকাশ করে। ফলশ্রুতিতে সন্তানের কাছে নিজেরাই ভিলেন হয়ে যায়।
এক কথায় জীবনসঙ্গী ও তার পরিবারের অনেক শারীরিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অবধারিতভাবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হবে- এটা মাথায় রেখেই জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে হবে। ইনফ্যাক্ট বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য যেহেতু পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করা সেহেতু বিয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে জীবনসঙ্গীর কুফু বা স্ট্যাটাস নির্বাচন করতে হবে। প্রতিটি মা/বাবাই চায় সন্তানদেরকে বেটার লাইফস্টাইল দিতে (সেটা আর্থিক, সামাজিক, চারিত্রিক সবদিক দিয়েই)। আর এক্ষেত্রে জীবনসঙ্গী ও তার পরিবার যেন সহযোগীর ভূমিকা পালন করে সেটা নিশ্চিত করার জন্য বিয়ের সময়ই সচেতন হতে হবে।
শেষ পর্ব
গত পর্বগুলোতে আমরা কুফু বা স্ট্যাটাস মিলিয়ে বিয়ে না করলে কি কি সমস্যা হতে পারে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র/পাত্রীর নিজেদের এবং দুই পরিবারের কুফু শতভাগ মিলবে এমন আশা করাটা বাস্তবসম্মত নয়। সে ক্ষেত্রে বরং ’ঠগ বাছতে গা উজাড়’ হয়ে যাবার উপক্রম হবে । তাই কিছু বিষয়ে উভয় পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। তবে কে কোন বিষয়ে ছাড় দিবে এটা পরিবার অনুযায়ী differ করে। কেউ আর্থিক অবস্থান ছাড় দিতে পারে, কেউ শিক্ষা ক্ষেত্রে আবার কেউ সামাজিক অবস্থান/ পরিচয় এর ব্যাপারে ছাড় দিতে পারে। আর যে বিষয়ে ছাড় দেওয়া হচ্ছে সে বিষয়গুলো নিয়ে বিয়ের আগেই মাইন্ড সেট করে নিতে হবে যে বিয়ের পর এগুলো নিয়ে অপর পক্ষ থেকে কোনো expectation থাকবে না এবং অপর পক্ষকে কোনো কথা শোনানো হবে না ।
পাত্র/পাত্রীর বায়োডাটায় যেসব তথ্য উল্লেখিত আছে সেগুলো সত্য কিনা তা শুধু ঘটকের কথার উপর নির্ভর না করে নিজেদেরও খোঁজ খবর নিতে হবে। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী, সহকর্মী প্রভৃতি বিভিন্ন সোর্স থেকে তথ্য নিয়ে যাচাই করতে হবে। আবার তাদের দেওয়া তথ্য গুলো সঠিক কিনা (অনেক ক্ষেত্রে হিংসা, প্রতিহিংসা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য দিতে পারে) সেটা বোঝার জন্যও নিজেদের হিকমাহ প্রয়োগ করতে হবে।
পাত্র/পাত্রী দেখার জন্য বাসায় যাওয়ার যে কালচার আগে ছিল সেটাতে কিছু পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে পাত্রীকে পাত্রপক্ষের সবার সামনে এনে নানা ধরনের বিব্রতকর প্রশ্ন করা, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা ইসলামসম্মত নয় এবং এটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অপমানজনক। তাই এই কালচারে পরিবর্তন করতে হবে ।
এই কালচারের অনেক নেগেটিভ দিক ছিল বলেই তা পাত্র-পাত্রীদের নিজেদের পরিবার অগ্রাহ্য করে নিজেরাই নিজেদের জীবনসঙ্গী পছন্দ করার ব্যাপারটাকে উৎসাহিত করেছিল। বিশেষ করে সাহিত্য, নাটক, সিনেমায় এই নেগেটিভ দিকগুলোকে এত বেশি করে হাইলাইট করা হয় বিধায় আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন পাত্র-পাত্রীরা এই কালচারকে এভোয়েড করা শুরু করে। অথচ বিয়ের ক্ষেত্রে দুই পরিবারের অংশগ্রহণ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আগের পর্বগুলোতে উল্লেখ করেছি ।তাই অভিভাবকদের উচিত পারিবারিকভাবে পাত্র/পাত্রী দেখার আয়োজনগুলোকে সম্মানজনক ও অনাড়াম্বর করা। তাহলে সন্তানরাও বিয়ের ব্যাপারে সবাইকে ইনভলভ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে।
বিয়ের ক্ষেত্রে কুফু বা স্ট্যাটাস মিলিয়ে দেখার বিষয়টা আসলে অনেকটা উটের রশি বাঁধার মতো। উটের রশি বেঁধে রাখার পরও যদি তা হারিয়ে যায় তবে তা যেমন তাকদীর বলে মেনে নিতে হবে, তেমনি বিয়ের আগে কুফু বা স্ট্যাটাস মেলানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও যদি বিয়ের পর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তবে তা ভাগ্য বলে মেনে নিতে হবে ।
কুফু বা স্ট্যাটাস এর ব্যাপক পার্থক্য আছে এমন পরিবারের বিয়ে হলে এই ঘটনার পেছনে আল্লাহর হিকমাহ বোঝার চেষ্টা করাও জরুরী। অনেক সময় আল্লাহ চান এক পরিবারের নেয়ামত দিয়ে অন্য পরিবারকে সমৃদ্ধ করতে বা এক পরিবারের দুর্বলতাগুলো অন্য পরিবার দ্বারা দূরীভূত করতে কিংবা উভয় পরিবারের পজেটিভ দিকগুলো নিয়ে একটি বেটার পরবর্তী প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটাতে (অনেকটা হাইব্রিড গাছের মতো)। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই স্বামী/ স্ত্রী উভয়পক্ষকে তাদের গোল বা টার্গেট পয়েন্টে ফোকাস থাকতে হবে। বৃহত্তর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিজেদের ক্ষুদ্রতর স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হবে। তাহলেই কুফু বা স্ট্যাটাসে পার্থক্য থাকা সত্বেও একটি বিয়েকে সার্থক করা সম্ভব।
আদতে বিয়ে এমন একটি সম্পর্ক যেটাকে In the long run সাকসেসফুল করতে হলে সবাইকেই কৌশলী হতে হয়। বিয়ের পর প্রথম দুই /এক বছর ’অবজারভেশন মোডে’ থাকতে হয়। শুরুতেই action/reaction না দেখিয়ে জীবনসঙ্গী ও তার পরিবারের strength and weakness গুলো অবজারভ করতে হয়। এরপর তাদের strength গুলোকে appreciate করা এবং weakness গুলোকে ignore করার ability অর্জন করতে হয়।
সেই সাথে নিজের strength and weakness গুলোকে identify করে নিজের weakness গুলোকে improve করার এবং strength গুলোকে stublish করার চেষ্টা করতে হয়। তবে এসব কিছুই করতে হবে ধৈর্য্য নিয়ে, সময়, সুযোগ বুঝে। ’বিয়ে’ কোনো টি-টোয়েন্টি ম্যাচ নয় যে মাঠে নেমেই চার /ছক্কা মেরে বাহবা কুড়াতে হবে বা আউট হয়ে গিয়ে নিন্দিত হতে হবে । এটা বরং টেস্ট ম্যাচের মতো ধীরে সুস্থে ছাড়ার বল ছেড়ে, মারার বল মেরে খেলতে হয়। তাহলেই বিয়ের মতো একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক সুস্থভাবে টিকে থাকবে ।
সবশেষে বলতে চাই উত্তম জীবনসঙ্গী, উত্তম শ্বশুরবাড়ি এবং চক্ষু শীতলকারী সন্তানের জন্য দোয়া করে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। দোয়া এমন এক শক্তি যা তাকদীর পরিবর্তন করতে পারে।
মহান আল্লাহ আমাদের ’বিয়ে’র মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সার্থক করার মতো হিকমাহ দিন এবং সব ধরনের সম্পর্কগুলোতে বারাকাহ দান করুন। আমিন।