পূণ্যভূমি জেরুজালেম

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

লেখিকা পরিচিতি:

উম্মে মারইয়ামের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি একজন দ্বীন শিক্ষার্থী। ‘ইক্বরা’ শব্দটিকে জীবনে ধারণ করার এক অদম্য ইচ্ছে তার মাঝে। সাথে শখ করে কিছু লেখালিখি করেন। পেশাগত জীবনে তিনি একজন চিকিৎসক। চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি তিনি মেডিকেল ফিক্বহ ও ইসলামের মৌলিক জ্ঞান অর্জনেও সচেষ্ট। তার এই যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ‘শিকড়ের সন্ধানে’ ও Mubashera Sisters কর্তৃক আয়োজিত ‘কুরআনের বর্ণণাশৈলী বুঝার কৌশল’ কোর্সটি। মূলত এই কোর্সের পরেই তিনি কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং আমাদের জীবনে কুরআনের প্রভাব নিয়ে পড়াশুনা ও লেখালিখিতে মনোযোগী হন। ইলম অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানআল্লাহু তাআ’লার নিকটবর্তী হওয়া তার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য।

সম্পাদনা করেছেন- হামিদা মুবাশ্বেরা, লেখিকা, ‘শিকড়ের সন্ধানে’

পর্ব – ১

জেরুজালেম।

পৃথিবীর মাঝে যে ভুখন্ড নিয়ে চলছে শত বছরের দ্বন্দ্ব। ই|হুদী, খ্রিষ্টান এবং মুসলিম, সবার জন্যই এই ভূমি গুরুত্বপূর্ণ। সবাই চায় এই ভূমিতে তাদের ক্ষমতা ও রাজত্ব থাকুক।

কিন্তু কেন?

সারা পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে কেন জেruজালেমেই ইহু|দিদের বসত গড়ার এত ইচ্ছে? কেন ক্রুসেডের মাধ্যমে খ্রিষ্টানরা জেরুজালেমের মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করলো? কেন উমর (রাদ্বীয়াল্লাহু আনহু) সুদূর মদীনা থেকে জেরruজালেমের চাবি নিতে এসেছিলেন? কেন কা’বা, মসজিদে নববীর মত ঐতিহাসিক স্থান থাকা সত্ত্বেও জেruজালেমের বুকে আল আ|ক্বসা মুসলিমদের জন্য এত বেশি অর্থবহ?

জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে অতীতে, যখন ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) তার সম্প্রদায়ের লোকেরা পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিলো এবং আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। তখন আল্লাহর নির্দেশে তিনি স্ত্রী সারাহ, ভ্রাতুষ্পুত্র লুত আলাইহিস সালাম এদেরকে নিয়ে কেনানে (শাম দেশ বা বর্তমানের প্যালেস্টাin, লেবা|নন, জর্ডান, সিরিয়ার কিছু অংশ নিয়ে একটা বৃহত্তর এলাকা) হিজরত করেন। কুরআন একে উল্লেখ করছে এমন জায়গা হিসেবে যেখানে বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণ রয়েছে (সূরা আম্বিয়া আয়াত ৭১)।

ওল্ড টেস্টামেন্টও আমরা অনুরূপ তথ্য পাই –

“The LORD had said to Abram, “Leave your country, your people and your father’s household and go to the land I will show you.” ( Genesis 12:1)

এবং এই ভূমির কিছু বৈশিষ্ট্যও আছে –

“A land flowing with milk and honey,” the soil was rich for agriculture and shepherding, the mountains provided security and protection from the elements and their enemies, and the arid climate provided perfect conditions for livestock to thrive. (Exodus 3:17; Numbers 13:27, Deuteronomy 8:6-9)

এখানে একটা বিষয় খেয়াল করা জরুরী। ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের প্রসঙ্গে কিন্তু এই ভূমিকে promised land হিসেবে উল্লেখ করা হয় নাই। হ্যাঁ, এই ভূমিকে কুরআন pro*mised land হিসেবে অবশ্যই উল্লেখ করছে, তবে সেটা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম নয় বরং অন্য একজন নবীর সাথে তার সম্প্রদায়ের কথোপকথন প্রসঙ্গে, সামনের পর্ব গুলোতে দেখবো ইনশাআল্লাহ।

ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের সাথে ভূমি সংক্রান্ত কোনো আলোচনা কি কুরআনে আছে? জ্বী আছে। কী সেটা?

“আর এও স্মরণ করো যে, ইবরাহীম দোয়া করেছিলঃ “হে আমার রব! এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানিয়ে দাও। আর এর অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ‌ ও আখেরাতকে মানবে তাদেরকে সব রকমের ফলের আহার্য দান করো।” জবাবে তার রব বললেনঃ “আর যে মানবে না, দুনিয়ার গুটিকয় দিনের জীবনের সামগ্রী আমি তাকেও দেবো কিন্তু সব শেষে তাকে জাহান্নামের আযাবের মধ্যে নিক্ষেপ করবো এবং সেটি নিকৃষ্টতম আবাস।” ( সূরা বাকারাহ, আয়াত ১২৬)

কোন শহরের জন্য ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম দুআ করেছিলেন এখানে? নিচের আয়াত থেকে বোঝা যায় কি?

“হে আমাদের রব! আমি একটি তৃণ পানিহীন উপত্যকায় নিজের বংশধরদের একটি অংশকে তোমার পবিত্র গৃহের কাছে এনে বসবাস করিয়েছি। পরওয়ারদিগার! এটা আমি এ জন্য করেছি যে, এরা এখানে নামায কায়েম করবে। কাজেই তুমি লোকদের মনকে এদের প্রতি আকৃষ্ট করো এবং ফলাদি দিয়ে এদের আহারের ব্যবস্থা করো, হয়তো এরা শোকরগুজার হবে।”(সূরা ইব্রাহীম: আয়াত ৩৭)

এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি যে এখানে কোন শহরের কথা বলা হচ্ছে? জ্বী, আমাদের প্রাণের শহর মক্কা, যেটা একসময় জনমানবহীণ ছিল, তারপর আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম উনার স্ত্রী হাজর আলাইহিস সালাম ও প্রথম সন্তান ইসমাইলকে দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় এখানে নির্বাসনে রেখে গেলেন। যমযম কূপ সৃষ্টির মাধ্যমে কিভাবে এই জায়গা জনবহুল নগরীতে পরিণত হয়েছিল সেই ঘটনা আমরা সবাই জানি। মক্কায় তো তাহলে লালিত পালিত হচ্ছিলো ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের এক বংশধারা যার শুরু ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে দিয়ে।

আর কেনানে?

ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের অপর স্ত্রী সারাহর গর্ভে আরেক বংশধারার সূচনা হয় এই ‘Blessed Land’ এ। তাহলে কি আমরা বুঝতে পারছি যে আমাদের মুসলিমদের যে তিনটা পবিত্র জায়গা (মক্কা, মদীনা ও মাসজিদুল আক্বসা) সেটার দুটোর উৎস কিভাবে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের দুই বংশধারার সাথে সম্পর্কিত?

ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের বংশধরদের নিয়ে আল্লাহর কি কোনো প্রতিশ্রুতি আছে? নিজের প্রাণাধিক পুত্রকে কুরবানী দেয়ার নির্দেশ যখন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মেনে নিতে রাজি হলেন তখন সেটার পুরষ্কার হিসেবে উনি আল্লাহর কাছে কী পেলেন? কুরআন থেকেই জানা যাক?

“স্মরণ করো যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সেসব পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উৎরে গেলো, তখন তিনি বললেনঃ “আমি তোমাকে সকল মানুষের নেতার পদে অধিষ্ঠিত করবো।” ইবরাহীম বললোঃ “আর আমার সন্তানদের সাথেও কি এই অঙ্গীকার?” জবাব দিলেনঃ “আমার এ অঙ্গীকার যালেমদের ব্যাপারে নয়।” (সূরা বাকারাহ, আয়াত ১২৪)

প্রায় একই কথা –
“I will surely bless you, and I will multiply your descendants like the stars in the sky and the sand on the seashore. Your descendants will possess the gates of their enemies.” (Genesis 22:17 )

পার্থক্যটা ঠিক কোথায় ধরতে পারছেন? কুরআনে আল্লাহ বলে দিয়েছেন যে তার অংগীকার যালেমদের জন্য নয়। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে কুরআন অনুযায়ী আল্লাহ ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) কে মনোনীত করেছিলেন, তাঁকে ও তাঁর সন্তানদেরকেও নেতা বানাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যদি না তারা যালিম হয়।

আচ্ছা ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের বংশধরদের সাথে কি Pro*mised Land এর কোনো সম্পর্ক আছে? ওল্ড টেস্টামেন্টে এ ব্যাপারে কী বলছে?

“The LORD appeared to Abram and said, “To your offspring [or seed] I will give this land.” (Genesis 12:7)

The whole land of Canaan, where you now reside as a foreigner, I will give as an everlasting possession to you and your descendants after you; and I will be their God.” Then God said to Abraham, “As for you, you must keep my covenant, you, and your descendants after you for the generations to come. (Genesis 17:8-9)

আচ্ছা এখানে কোন covenant এর কথা বলা হচ্ছে? এই বংশধরই বা কারা? এই সন্তান কি শুধুই ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ঔরসজাত সন্তান? মুফাসসিরদের মতে, এই সন্তান তারাই, যারা তাঁরই মতো এক আল্লাহর ইবাদাত করবে, তাদেরকেই আল্লাহ নেতার পদে অধিষ্ঠিত করবেন। একই সুর কিন্তু আমরা তাদের বইতেও দেখি-

“the promise, that he should be the heir of the world, was not to Abraham, or to his seed, through the law, but through the righteousness of faith.” (Romans 4:13)

তাহলে সমস্যা কোন জায়গায়? উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সময় থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ ম্যাণ্ডেটের আগ পর্যন্ত (মাঝখানে ক্রুসেডের ৯০ বছর বাদ দিলে) মাসজিদুল আ|ক্বসা তো মুসলিম, যারা কী না ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ধর্মীয় আদর্শের অনুসারী, তাদের দখলেই ছিলো……হিসাব তো ঠিকই আছে………

যা|য়োনি*স্টদের বক্তব্য তাহলে কী? কোন যুক্তিতে ইউরোপিয়ান ইhuদিরা ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে স্থানীয়দেরকে জোরপূর্বক সরিয়ে জেruজালেমে এসে বসতি স্থাপন করা শুরু করলো এবং ১৯৪৮ সালে অফিসিয়ালী ইস/রাই*ল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো?

পর্ব – ২

কথা হচ্ছিলো যা*য়োনি|স্টদের বক্তব্য নিয়ে। আচ্ছা আমরা যা*য়োনি|স্ট কারা সেটা জানি তো? যায়ো*নিসম হচ্ছে একটা রাজনৈতিক চেতনা যা ‘ধর্ম’কে ব্যবহার করে, এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে ফি*লিস্তি|নে ই@হুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ।

এখানে উল্লেখ্য যে যা*য়োনি|স্ট হওয়ার জন্য কিন্তু ইহুদি হওয়া শর্ত না। প্রচুর খ্রিষ্টান আছে যারা যা*য়োনি|জমের সমর্থক ও কর্মী, অন্যদিকে অনেক অর্থ*ডক্স ইহুদি আছে যারা যা*য়োনিজ|মের বিরোধিতা করেন।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কেন ই@হুদিদের একটা আলাদা রাষ্ট্র দরকার আর কেনই বা এটা ফি*লিস্তি|নেই হতে হবে, অন্য কোথাও নয় কেন। বক্ষ্যমাণ সিরিজে আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ।

প্রথমে আসি ফি*লিস্তি|নেই কেন। যা*য়োনিস্টদের বক্তব্য হচ্ছে

‘Children of Israil’ হচ্ছে Cho*sen People. তাদেরকে God এই ভূমি Promise করেছেন। এটা তাই Children of Israil কে দেয়া ‘Pro*mised Land’, তাই এই ভূমির উপরে শুধু তাদেরই অধিকার।

আচ্ছা এই প্রতিশ্রুতি কবে দেয়া হয়েছিল?

প্রায় ৩৫০০ বছরেরও আগে……

আগের পর্বের ওল্ড টেস্টামেন্টের বক্তব্য মনে আছে? সেখানে কাদেরকে এই ভূমির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল? ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের বংশধরদের, তাই না? আবারও উল্লেখ করেছি সেই অংশঃ

“The LORD appeared to Abram and said, “To your offspring [or seed] I will give this land.” (Genesis 12:7)

The whole land of Canaan, where you now reside as a foreigner, I will give as an everlasting possession to you and your descendants after you; and I will be their God.” Then God said to Abraham, “As for you, you must keep my covenant, you, and your descendants after you for the generations to come. (Genesis 17:8-9)

এই জায়গায় আমরা একটু বিরতি নেই।

আমি কোনো জায়গায় গিয়ে বর্তমান অধিবাসীদের সরিয়ে তাদের জায়গা কি এই দাবীতে দখল করতে পারি যে আমার পূর্বপুরুষদেরকে এখানে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আল্লাহ? আজকের মুসলিমরা কি গিয়ে স্পেন দখল করতে পারে? হাস্যকর না?

মনে রাখবেন যে ফি*লিস্তি|নের উপর যা*য়োনিস্টদের যে দাবী, পুরো ইস|রাই|ল রাষ্ট্রটার অস্তিত্ব, তাদের কাজ কর্ম সেগুলো যে কত বড় মিথ্যা ও ভণ্ডামীর উপর প্রতিষ্ঠিত সেটা বোঝার জন্য মুসলিম হবার দরকার নেই, নুন্যতম কমন সেন্স থাকাই যথেষ্ট! তবুও আমাদের সিরিজে আমরা চেষ্টা করবো যা*য়োনি|স্টদের দাবী বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে খণ্ডন করতে। যা*য়োনি|স্টদের দাবী বুঝতে হলে আমাদের কয়েকটা টার্ম বুঝতে হবে-

১) Children of Israil

২) Chosen People

৩) Promised Land

প্রথমেই জানার চেষ্টা করবো Children of Israil/ বনী ইস|রাই|ল কারা। এখানে উল্লেখ্য যে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে বনী ইস|রাই|লের কাহিনী, তাদের ভুলগুলো বর্ণিত হয়েছে। আমরা যদি সেগুলো না জানি তাহলে সেটা চরম লজ্জার ব্যাপার। আমরা দেখেছি যে আল্লাহ ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের সন্তানদের শামদেশের/ কেনানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং এখানে সন্তান বলতে উনার মতাদর্শের অনুসারীদেরকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু ওদের দাবী হচ্ছে এখানে ঔরসজাত সন্তানের কথা বলা হচ্ছে।

এখন তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই যে আসলেই এখানে ঔরসজাত সন্তানের কথা বলা হচ্ছে, তাহলেও বা সমস্যা কোথায়? ফি*লিস্তি|নের যারা ই@হুদি অভিবাসনের আগ থেকে বাস করে আসছে, সেইসব আরবদের অনেক গোত্রই তো বনী ইসমাঈল, মানে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের বংশধর, তাহলে ওদেরকে উৎখাত করতে হবে কেন?

এই জায়গাতেই আসল টুইস্ট!

আমাদের দেখতে হবে যে কিভাবে ওরা এই বংশধরের ধারণাকে বিকৃত করেছে। ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের দুই বংশধারার মাঝে সম্পর্কের ব্যাপারে ওল্ড টেস্টামেন্টে কী আছে?

হাজর আলাইহিস সালামকে জেনেসিসে চিহ্নিত করা হয়েছে সারা (আ) এর Maid servant হিসেবে।

যখন ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) এর বয়স ১৩ বছর তখন ইসহাক (আলাইহিস সালাম) এর জন্ম হয়। ইসহাক (আলাইহিস সালাম) এর বয়স যখন ২ বছর তখন একদিন তারা দুইজন একসাথে খেলছিলেন। এই দৃশ্য দেখে সারা (আলাইহিস সালাম) ভাবেন যে Maid servant এর পুত্রকে তিনি কখনোই তার স্বামীর উত্তরাধিকার হিসেবে মেনে নিবেন না। তাই তার কথায় ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) তাদের দুইজনকে মরুভূমিতে রেখে আসেন।

অর্থাৎ, হাজেরা (আলাইহিস সালাম) কে ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া দূরের কথা! সারা (আলাইহিস সালাম), একজন নবীপত্নীর মানসিকতাকে এমন অদ্ভুতভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং সাথে ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) কেও তার কথায় সায় দিয়ে একজন নারীকে তার সন্তানসহ মরুভূমিতে ফেলে আসার মত কাজের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অথচ কুরআনে হাজেরা (আলাইহিস সালাম) এর তাওয়াক্কুল, ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) কে করা আল্লাহর পরীক্ষা ও সর্বোপরি শিশু ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) কে জনমানবশূন্য মরুভূমিতে আবাদ করার পেছনে আমাদের জন্য একটি গভীর শিক্ষা রয়েছে।

এখানেই কি শেষ?

না। যা কিছু গৌরবময় তার সব কিছু নিজেদের দাবী করার এক অদ্ভূত মানসিকতা থেকেই ওরা ওল্ড টেস্টামেন্ট বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে যে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম যাকে কুরবানী করতে গিয়েছিলেন সেটা ছিল ইসহাক আলাইহিস সালাম, ইসমাইল না। অথচ এভাবে ওরা নিজেদের লেখাকেই প্রশ্নের সম্মুখীন করে! ওল্ড টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর একমাত্র পুত্রকে কুরবানী করতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ইসহাক আলাইহিস সালাম ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় ছেলে, স্বাভাবিকভাবেই তিনি একমাত্র পুত্র হতে পারেন না।

কুরআন কী বলছে এ ব্যাপারে? কুরআনে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর নাম উল্লেখিত নেই কিন্তু এটা স্পষ্ট যে ইসমাঈল আলাইহিস সালামকেই ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম কুরবানী করতে নিয়ে গিয়েছিলেন।

‘তারপর আমি তাকে ইসহাক ও ইসহাকের পরে ইয়াকুবের সুখবর দিলাম।’ ( সূরা হুদ: আয়াত ৭১)

ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে একই সাথে তার ছেলে ও নাতির জন্ম সম্পর্কে সুখবর দেয়া হয়। যার ভবিষ্যৎ বংশধর সম্পর্কেও আল্লাহ ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে সুখবর দিয়েছেন, সেই মানুষকে কেন আল্লাহ কুরবানী করতে বলবেন? 

এখানে উল্লেখ্য যে হাজেরা আলাইহিস সালাম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে মক্কায় রেখে আসার ঘটনার পর ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টের কোথাও আর তাদের কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই। এমনকি ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) এর ব্যক্তিত্ব নিয়েও খুবই প্রশ্নযুক্ত কিছু মন্তব্য আছে জেনেসিসে যা একজন নবীর শানে অত্যন্ত অসম্মানজনক।

এভাবে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ও তার বংশধারাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ইসহাক আলাইহিস সালাম থেকে উদ্ভূত বংশধারাকেই একমাত্র ‘উপযুক্ত বংশধারা’ হিসেবে দাবী করে।

আমরা কি ধরতে পারছি কেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তৎকালীন ই@হুদিরা মেনে নিতে পারেনি? কারণ তিনি ছিলেন ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধর। যাকে তারা চেনে ইব্রাহীম (আ) এর স্ত্রীর Maid Servant হিসেবে। জন্মপরিচয় ও বংশ তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আচ্ছা তাহলে যা*য়োনি|স্টরা কি ঠিক আছে বংশধারার দিক থেকে? ওরা কি ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ‘উপযুক্ত বংশধর?’

বর্তমান ইস|রাই|লের অধিবাসীদের প্রায় সবাই কিন্তু ইউরোপিয়ান ই@হুদি! ইউরোপে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের বংশধররা কোথা থেকে এলো? আর এই ই@হুদি টার্মটার মানেই বা কী? বনী ইস|রাই|ল আর ই@হুদি মানে কি একই?

বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে আবার গোড়ায়!

পর্ব – ৩

আমরা দেখছিলাম যে কিভাবে যা*য়োনিস্ট|রা ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ও তার বংশধারাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ইসহাক আলাইহিস সালাম থেকে উদ্ভূত বংশধারাকেই একমাত্র ‘উপযুক্ত বংশধারা’ হিসেবে দাবী করে।

আচ্ছা কিন্তু বনী ইস*রাইল কারা সেটা কি আমরা জানি?

ইসহাক আলাইহিস সালামের ছেলে ইয়াকুব আলাইহিস সালামের আরেক নাম ছিলো ইস*রাইল যার ভাবার্থ হচ্ছে আল্লাহর বান্দা (আরবী আব্দুল্লাহ শব্দের মত)। উনার যে ১২ জন ছেলে ছিলো এটা আমরা জানি। সেই ১২ জন ছেলে থেকেই বনী ইস*রাইলের ১২টা গোত্রের উদ্ভব ঘটেছে। তবে এখানেও বংশ অহমিকার বিষয় আছে কারণ এই ১২ জন ছেলে একই মায়ের গর্ভে ছিলেন না। ইউসুফ আলাইহিস সালাম আর বিন ইয়ামিন (সর্ব কনিষ্ঠ দুইজন)ছিলেন ভিন্ন স্ত্রীর সন্তান। বাকি ১০জন এইজন্যই ইউসুফ আলাইহিস সালামকে সহ্য করতে পারতো না, দাবী করতো যে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ইউসুফকে বেশী ভালোবাসেন। এই ভ্রান্ত ধারণা তাদের কোন পর্যায়ের অপরাধ করতে প্রলুব্ধ করেছিলো এটা আমরা সবাই জানি। তবে জেনে রাখা জরুরী যে বৈমাত্রেয় ভাইদের দল প্রথমে ইউসুফকে হত্যা করতে চাইলেও একজন বাধা দেন, তার নাম ছিলো জুডাহ। এই নাম ব্রেনে গেঁথে নেয়া দরকার, সামনে বারবার আসবে ইনশাআল্লাহ!

জুডাহ হত্যার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে কী করতে বলেন? ইউসুফকে  কুয়ায় ফেলে দিতে বলেন, যেন অন্তত

তিনি বেঁচে থাকেন । বাকিরাও তাতে সম্মত হয় এবং সেইমতো সুকৌশলে খেলতে যাওয়ার কথা বলে তাকে কূপে ফেলেও দেয়। এক বাণিজ্য কাফেলা পথিমধ্যে ওই কূপে পানি নিতে গেলে ইউসুফকে খুঁজে পায়, দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয় মিশরে। তারপর ইউসুফ আলাইহিস সালাম কিভাবে নিজেই একসময় প্রভাবশালী মন্ত্রী হলেন, এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ থেকে মিশরবাসীকে রক্ষা করলেন এবং সেই উসীলায় ভাইদের সাথে দেখা হয়ে কিভাবে পরিবারের সবার সাথে পুনর্মিলন হল, সেই শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা আমরা অনেকেই হয়তো সূরা ইউসুফের মাধ্যমে জানি।

কিন্তু এটার মাধ্যমে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ঘটে গেছে সেটা কি আমরা লক্ষ্য করেছি?

কী সেটা?

ইউসুফ আলাইহিস সালামের সমস্ত পরিবার মানে তৎকালীন বনী ইস*রাঈলীয়দের সবাই কেনান থেকে বেরিয়ে মিশরে বসতি স্থাপন করলো। অর্থ্যাৎ ছোট্ট ইউসুফের সাথে তার ভাইরা যে অন্যায় করেছিলো সেটা সফল হওয়ার পেছনে আল্লাহর একটি গভীর প্রজ্ঞা ছিল যা তখন আপাতদৃষ্টিতে বোঝা কঠিন।

ইউসুফ আলাইহিস সালামের পরিবার হিসেবে বনী ইসরাইলীয়রা মিশরে ভিভিআইপি মর্যাদা পেতেন, খুবই ভালোভাবে জীবনযাপন করছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে তখন মিশরের রাজা যে ছিলো সে মিশরীয় ছিল না। তাই ইউসুফ আলাইহিস সালামের মতো একজন বিদেশীকে এমন উচ্চ মর্যাদা পূর্ণ পদ দিতে সে দ্বিধা করে নি, সে দেখেছিলো শুধু মেধা। অমিশরীয় হিসেবে বনী ইস*রাঈল কোনো বৈষম্যের শিকার হয় নাই, তাই কেনানের মরু অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার কোনো তাড়না ওদের ছিলো না বরং মিশরেই বংশবিস্তার করতে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী ইয়াকুব (আ) মৃত্যুর আগে তাঁর ছেলেদের বলে যান তাঁকে যেন কেনানে সমাহিত করা হয়। এবং তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীত করেন জুডাহকে। কুরআনে কি এমন কিছু পাই?

মজার ব্যাপার হচ্ছে কুরআনে একমাত্র যে নবীর মৃত্যুশয্যা নিয়ে কথা বলা হয়েছে সেটা হল ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। কুরআন কোন তথ্যটি আমাদেরকে দিচ্ছে?

“তোমরা কি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়াকুব এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছিল?মৃত্যুকালে সে তার সন্তানদের জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার পর তোমরা কার বন্দেগী করবে?’ তারা সবাই জবাব দিল, ‘আমরা সেই এক আল্লাহর বন্দেগী করবো, যাকে আপনি এবং আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক ইলাহ হিসেবে মেনে এসেছেন আর আমরা তাঁরই অনুগত- মুসলিম।’ (২:১৩৩) 

অর্থাৎ কুরআন জানাচ্ছে যে ইয়াকুব (আ) মৃত্যুর সময় তাঁর ছেলেদের কাছ থেকে আল্লাহর ইবাদাত করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি নেন। মানে মারা যাওয়ার পর কোথায় কবর দেয়া হবে সেটা না, বরং একটা অমুসলিম রাষ্ট্রে উনার উত্তরসূরীরা তাওহীদের উপর অটল থাকবে নাকি এটাই ছিলো উনার মূল চিন্তা।

আয়াতটা আবার পড়ি, আরবী অথবা অনুবাদ। এটা পড়ে কি আমরা বুঝতে পারছি যে তখনকার বনী ইসরাইলই ছিলো মুসলিম?

যাই হোক, ইউসুফ (আ) এর কর্ম তাঁর নামকে অনেকদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল। এভাবে কেটে যায় কয়েক শতাব্দী। তারপর শাসন ক্ষমতার পালা বদল হলো, শুরু হলো ফারাওদের রাজত্ব, যারা মিশরের স্থানীয় মানুষ। কোনো রাজা নতুন শাসনভার নিলে সাধারণত প্রথমেই যা করে তা হলো তার রাজত্ব ও শাসনের প্রতি হুমকিগুলোকে খুঁজে বের করা। নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করতে ওরা Divide and Rule পলিসি প্রয়োগ করতে থাকে, মানে জনগণকে নানা গ্রুপে ভাগ করে দুর্বল করে রাখতে চায় যেন নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে ব্যস্ত থেকে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযোগ না থাকে। ফেরাউনের এমন রোষানলের স্বীকার সবচেয়ে বেশী হয়েছিল বনী ইস*রাইলরা, বিদেশী হিসেবে। মনে আছে ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ইমিগ্র্যান্টদের বিরুদ্ধে লেগেছিলো? ঠিক তেমনি ভাবে। আবার আমাদের দেশে যেভাবে এক পক্ষ ক্ষমতায় আসলে আরেক পক্ষের ইতিবাচক অবদানের সব কিছু ইতিহাস থেকে মুছে যায়, সেভাবে ফিরাউনের সময়ে মুছে দেয়া হয়েছিলো মিশর রক্ষায় ইউসুফ আলাইহিস সালামের অবদান। তাহলে বনী ইস*রাইলের প্রতি সফট কর্নার তৈরি হবে যে!

এভাবে একটা সময় বৈষম্যের মাত্রা এই পর্যায়ে পোঁছায় যে বনী ইস*রাইল পরিণত হয় মিশরীয়দের দাসে। শুধু তাই নয়, এক স্বপ্নের ভিত্তিতে বনী ইস*রাইলের উপর নেমে আসে অত্যাচারের স্টিম রোলার যা ছিলো অভাবনীয়। এই পুরো চিত্র আমরা কুরআন থেকে পাই সংক্ষেপেঃ

”প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, ফেরাউন পৃথিবীতে বিদ্রোহ করে এবং তার অধিবাসীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে দেয়। তাদের মধ্য থেকে একটি দলকে সে লাঞ্ছিত করতো, তাদের ছেলেদের হত্যা করতো এবং মেয়েদের জীবিত রাখতো। আসলে সে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমি সংকল্প করেছিলাম, যাদেরকে পৃথিবীতে লাঞ্ছিত করে রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্র‍হ করবো।তাদেরকে নেতৃত্ব দান করবো, তাদেরকেই উত্তরাধিকার করবো। পৃথিবীতে তাদেরকে কর্তৃত্ব দান করবো।”  [সূরা ক্বাসাস:আয়াত ৪-৬]

আল্লাহ জানাচ্ছেন যে এই অত্যাচারিত জাতির প্রতি অনুগ্রহ করবেন। সেই অনুগ্রহ হিসেবে উনি কাকে পাঠালেন?

আন্দাজ করতে পারছি?

জ্বী, মুসা আলাইহিস সালামকে।

শুধু তাই না, নিজের সাম্রাজ্য বাঁচাতে যে শত শত শিশু হত্যা করেছিলো, সেই ফেরাউনের ঘরেই লালিত পালিত হতে লাগলেন উনি!

তারপর নানা ঘটনা প্রবাহে কিছু সময়ের জন্য মাদইয়ানে থাকলেও মিশরে ফিরে আসলেন আল্লাহ প্রদত্ত মিশন নিয়ে।

কী ছিলো সেই মিশন?

পর্ব – ৪

পর্ব – ৫

পর্ব – ৬

গত পর্বে আমরা বনি ই*স*রা*ঈলের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি-ব্যাবিলনীয়দের দ্বারা জুডাহ রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়া আর যারা বেঁচে ছিল তাদের দাসত্বের জীবন শুরু হওয়া। এইসময় তারা তাওরাতের মূল ফলকগুলো হারিয়ে ফেলে, শুরু হয় তাওরাত মৌখিকভাবে সংকলন আর স্মৃতি থেকে আবছা ও বিকৃত উপায়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়া।

এই ন্যাক্কারজনক রাজনৈতিক পরাজয় তাদের মনোজগতে একটা স্থায়ী প্রভাব রেখে যায়, যার ফলে ঘটে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন।

কী সেটা?

তাদের জাতির নাম ‘বনী ইস*রা*ইল’, কিন্তু তারা তাদের রাজ্য ’কিংডম অফ জুডাহ’ থেকে আসায় নিজেদের নাম রাখে ‘Yehudi’  যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘Men of Judah’। অর্থাৎ পৈতৃকভিত্তির পরিচয় বদলে তাদের পরিচয়টা হয়ে গেল স্থানভিত্তিক। কালের পরিক্রমায় তাদের ধর্মের নাম হলো  ‘Judaism’ বা ‘ইহুদীবাদ’।

কিন্তু কেন? পরিচয় বদলে ফেলে কী লাভ?

ফেসবুকে কিছুদিন পর পর নতুন কিছু ট্রেন্ড শুরু হয়। তার মাঝে অন্যতম হলো ‘Comment/text your name and I’ll tell you how I feel about you’। আমি যদি এখন ‘সাকিব আল হাসান’ এর নাম নিই, অবধারিতভাবে আপনার মনে বাংলাদেশ ক্রিকেট টীমের জার্সি পরিহিত মানুষটির ছবি ভেসে উঠবে।

সুতরাং আমরা দেখছি ‘নাম দিয়ে যায় চেনা’ প্রবাদটি ভুল নয়। কারো নাম শুনলেই তার সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ইমেজটাই স্মরণ হবে, তার সবচেয়ে Defining character টাই আমাদের মনে পড়বে, একধরনের পূর্বধারণা তৈরী হবে। একে বলে ‘Prejudice’।

প্রথমে আসিরীয় ও তার ১৫০ বছর পর ব্যাবিলনীয়দের হাতে কিংবদন্তির সাম্রাজ্য হারানোর পর বনী ই*স*রাইলের নাম শুনলেই পরাজিত বন্দী দশা মানুষের মনে ভেসে উঠতো। যাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে, দাস হিসেবে টেনে- হিঁচড়ে আনা হয়েছে। ‘ই*হু*দী’ পরিচয় দিয়ে তারা মানুষের মনের সেই প্রেজুডিস থেকে বাঁচতে চাইতো।

প্রশ্ন উঠতে পারে এতে সমস্যাটা কোথায়?

ধরুন, আপনাকে জিজ্ঞেস করা হলো “আপনার মূল পরিচয় কী? আপনার উত্তর দেবার কথা “ইসলাম/মুসলিম”। কিন্তু আপনি উত্তর দিলেন “আমি বাংলাদেশী”। এটা কি প্রশ্নের সঠিক উত্তর হলো?

হ্যাঁ, এতে লাভ হবে যে মুসলিম মানেই জ*@ঙ্গী, ৯/১১ এ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর মিডিয়া সুকৌশলে যে একটা ইমেজ তৈরি করেছে সেটা থেকে আপনি হয়তো বাঁচবেন কিন্তু একই সাথে আপনাকে ধর্মীয় আচার ব্যবহারও ছেড়ে আসতে হবে, তাই না? হয়তো আগে আপনি বোরখা পরতেন, পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে শিরক মানতেন, এখন বাংগালী প্রমাণের জন্য আপনার শাড়ি, চুড়ি পরে টিপ দিতে হবে, হাজার বছরের তথাকথিত বাঙ্গালী সংস্কৃতি সক্রিয়ভাবে ধারণ করতে হবে। আগে হয়তো কাউকে মদ খেতে দেখলে বলতেন এটা তো হারাম, এখন আর সেটা বলতে পারবেন না কারণ তাহলে মানুষ আপনাকে ওই মুসলিমই ভাববে!

এভাবে নামের পরিবর্তন কিভাবে আচার ব্যবহার, লাইফ স্টাইল সব কিছুতে পরিবর্তন আনে সেটা কি আমরা বুঝলাম? 

ই*স*রা*ইল নামের অর্থ ছিল ‘আল্লাহর বান্দা/দাস’। নিজেদের জাতির জন্য নতুন পরিচয় গ্রহণ করার ফলে আল্লাহর সাথে তাদের যে নাম জুড়ে ছিল, তারা সেটাকেও প্রত্যাখ্যান করলো।

তবে হ্যাঁ, ইসলাম পালন ও সেটা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব থেকে সরে আসলেও Chosen people এর কনসেপ্ট থেকে কিন্তু তারা সরে আসেনি! তারা নিজেদের আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠ জাতি ভাবতো যাদের হাতে থাকবে সুগৌরব ও সফলতার চাবি। এই Chosen people এর ধারণার মাঝেও নিজেদের গোত্রকে আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর মৃত্যুর সময়কার কথোপকথন মুখে মুখে ছড়িয়ে দিতে লাগলো, যেখানে জুডাহকে তিনি তাঁর পরে উত্তরাধিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন। অথচ কুরআনে কিন্তু ইয়াকুব (আ) এর মৃত্যুর সময়কার কথা আল্লাহ উল্লেখ করেছেন (সূরা বাকারাহ, আয়াত ১৩৩) যেখানে এমন কিছু নেই বরং বলা আছে যে (৩য় পর্বে এটা নিয়ে বলা হয়েছে) ইয়াকুব (আ) এর ছেলেরা তাঁকে কথা দিয়েছিল যে তারা তাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক (আ) এর ইলাহ এক আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং অনুগত মুসলিম হয়ে থাকবে।

আমরা কি টের পাচ্ছি যে কিভাবে ওদের ফোকাস বদলে গিয়েছিলো?মৃত্যুশয্যায় মুসলিম হবার বিষয়টা চেপে গিয়ে ওদের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছিলো নিজেদের গোত্রকে বিশিষ্ট প্রমাণ করা! 

এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, ১৯৪৮ সালে তারা ই*হু*দিদের স্থায়ী বাসস্থানের জন্য ফিলিস্তিন দখল করে দেশটির একটি নতুন নাম দেয় – ‘State of Is*ra*el’। দেশের নাম হিসেবে ‘Judea’ নামটি উপস্থাপন করা হলেও তারা সেটিকে নাকচ করে দেয়। কারণ ওদের উদ্দেশ্য সেই প্রাচীন ‘United Kingdom of I*s*ra*el’ তৈরী করা, কিংডম অফ জুডাহ ছিল যার একটি বিভক্ত অংশ। Judea নাম দিয়ে যদি তারা ফিলিস্তিনে সেই প্রাচীন রাজ্য স্থাপন করতে চাইতো তাহলে খুব কম জায়গা দখল করতে পারতো কিন্তু ইউনাইটেড কিংডম অফ ইসরায়েলের পরিধি আরো বিস্তৃত।

মানে ওদের যখন যে পরিচয় দরকার হবে সেটাতে ফোকাস করা আর কী!

ই*হু*দীরা যে Chosen people, এই ধারণা মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে চাইতো। তাইতো আমরা দেখি যে নবীজীর সময়ে ই*হু*দীদের জন্য মদীনাবাসীর মধ্যে এক ধরণের সম্ভ্রম কাজ করতো। ওরা শিক্ষিত, ওদের কাছে একসময় ওহী আসতো এইসব বলে বড়াই করা ছিল ইহুদীদের নিত্যদিনের কাজ। ওরা অহংকার করে বলে বেড়াতো যে, শীঘ্রই ওদের মাঝে একজন নবী আসবেন যার নেতৃত্বে যুদ্ধ করে ওরা মদীনাবাসীকে হারিয়ে দিবে।

আমরা কি একটা প্যাটার্ণ দেখতে পাচ্ছি?

ওরা কিন্তু মদীনাবাসীর মধ্যে দাওয়াতী কাজ করে নাই অথচ ফুটানি করা ছাড়ে নাই! অর্থাৎ এমন এক শ্রেষ্ঠত্ব যেখানে কোনো দায়িত্ব নেই, আছে শুধুই অধিকার!

মজা না?

দায়িত্ববিহীন এই Chosen people এর কনসেপ্ট ওদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে দুনিয়ার অন্য সবাইকে, বিশেষ করে প্যা*লে*স্টি*নিয়ানদেরকে sub human হিসেবে দেখতে। ওরা তীব্রভাবে বিশ্বাস করে যে ওদের সাথে যা খুশী করা যায় কারণ ওরা Chosen people। এই পর্বের কমেন্টে একটা ভিডিওর লিংক দিচ্ছি যেখানে একজন ই*স*রা*ইলি সাংবাদিক বর্ণনা করছেন কেমন ব্যবহার নিয়মিত করে প্যালেস্টিনিয়ানদের সাথে!

এর ফলে সবচেয়ে বড় অন্যায়টা ওরা কী করেছে জানেন? ওরা আল্লাহকে সাম্প্রদায়িক, এক চোখা হিসেবে উপস্থাপন করেছে যিনি এক দল মানুষকে যা খুশী করার লাইসেন্স দিয়ে রেখেছে। ভাবলেই বুকটা কেঁপে ওঠে কিন্তু!

এখানে আরেকটা বিষয় বোঝা খুব জরুরী। তৎকালীন ই*হু*দীরা তাওহীদের বাণী জীবনে ধারণ ও সেটা অন্য মানুষের মাঝে সরিয়ে দেয়ার স্পিরিট থেকে একেবারেই সরে গিয়েছিলো বলেই ঈসা আলাইহিস সালাম প্রথমে এসে ধর্মীয় সংস্কারের কাজ শুরু করেছিলেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন সম্ভব না যদি না সাধারণ মানুষ দ্বীনের পথ থেকে সরে যায়। বর্তমান প্যা*লে*স্টাই*ন ইস্যুতে এই বিষয়টা বোঝা খুব জরুরী। আমরা আরব নেতাদের কার্যক্রমে ওদেরকে গালিগালাজ করছি কিন্তু ভুলে যাচ্ছি যে আমাদের নেতারা আমাদের অবস্থারই প্রতিফলন। মুসা আলাইহিস সালামের সময়ে কিন্ত জেরুজালেম জয় সম্ভব হয় নাই কারণ তখনকার বনী ইসরাইল দাসত্বের জীবন থেকে মানসিকভাবে বের হয়ে আসতে পারে নাই। ফিরাউনের অত্যাচারে বিপযর্স্ত বনী ইস*রাই*লের একাংশ মুসা আলাইহিস সালামকে বিরক্তিভরে বলেছিলোঃ

“তারা বলল, আমাদের কষ্ট ছিল তোমার আসার পূর্বে এবং তোমার আসার পরে। (৭:১২৯)”

অর্থাৎ মুসা আলাইহিস সালামের আসার পরও ফিরাউনের কবল থেকে উদ্ধার মেলেনি এই দিকে ইঙ্গিত করছিলো। উত্তরে নবী মুসা কী বললেন?

“তিনি বললেন, তোমাদের পরওয়ারদেগার শীঘ্রই তোমাদের শক্রদের ধ্বংস করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দেশে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কেমন কাজ কর।”

খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কথা কিন্তু! রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়তো শীঘ্রই হবে, কিন্তু সেই বিজয় ধরে রাখা সহজ কিছু না। মূসা (আ) যেমন বলেছিলেন যে আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিনিধিত্ব দিবেন এরপর দেখবেন তোমরা কেমন কাজ করো – এটা কিন্তু আমাদের সবার জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ আমাদের সবাইকে জীবনের একটি পর্যায়ে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতা দেন সেটা হতে পারে মা হিসেবে সন্তানের উপর, স্বামী হিসেবে স্ত্রী, গৃহিণী হিসেবে বাসার সাহায্যকারীর উপর, অফিসের বস হিসেবে কর্মচারীদের উপর ইত্যাদি৷ আমাদের নিজস্ব ক্ষমতা বলয়ে আমরা কেমন আচরণ করছি সেটা কিন্তু বলে দেয় আরো বড় পরিসরে ক্ষমতা পেলে আমরা কেমন করবো।

নিজেরা ভালো মুসলিম হতে হবে – এই কথা শুনলে আমাদের কেন যেন ভালো লাগে না, নিজেদের circle of influence এ ছোট ছোট পরিবর্তন দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাতে আমরা আগ্রহী নই! আমি চিন্তা করি যে আমরা যদি ঈসা আলাইহিস সালামের সময়ে থাকতাম, আমরাও কি বলতাম না যে উনি রাতারাতি David’s kingdom পুনরুদ্ধার করছেন না অতএব উনি প্রতিশ্রুত মাসীহ না? সুদী ঋণের টাকায় বাড়ি, গাড়ী আর স্ট্যাটাস সিম্বল প্রদর্শনের যে বিভিন্নরকম হারামে আসা আরামের জীবনে আমরা অভ্যস্ত, সেটার গদি ধরে কেউ টান দিলে আমরা প্রচন্ড বিরক্ত হই।

যাই হোক, বনী ই*স*রাইলের ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা কিন্তু কুরআন উল্লেখ করছে!

“তারপর আমি নিজের কিতাবে বনী ই*স*রাইলকে এ মর্মে সতর্ক করে দিয়েছিলাম যে, তোমরা দু’বার পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমরা অতিশয় ঔদ্ধত্যকারী হবে। অতঃপর এই দু’য়ের প্রথমটির নির্ধারিত কাল যখন উপস্থিত হলো তখন আমি তোমাদের মোকাবিলায় নিজের এমন একদল বান্দার আবির্ভাব ঘটালাম যারা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তারা তোমাদের দেশে প্রবেশ করে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এটি একটি প্রতিশ্রুতি ছিল, যা পূর্ণ হওয়াই ছিল অবধারিত।” (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত ৪-৫)

স্কলারদের মতে এটা ছিল ব্যবিলীনীয়দের সময়কার কথা।

“এরপর আমি তোমাদেরকে তাদের উপর বিজয় লাভের সুযোগ করে দিয়েছি এবং তোমাদের সাহায্য করেছি অর্থ ও সন্তানের সাহায্যে আর তোমাদের সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়িয়ে দিয়েছি। তোমরা যদি ভাল কর, তবে নিজদের জন্যই ভাল করবে এবং যদি মন্দ কর তবে তা নিজদের জন্যই। এরপর যখন পরবর্তী ওয়াদা এল, (তখন অন্য বান্দাদের প্রেরণ করলাম) যাতে তারা তোমাদের চেহারাসমূহ মলিন করে দেয়, আর যেন মসজিদে ঢুকে পড়ে যেমন ঢুকে পড়েছিল প্রথমবার এবং যাতে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয় যা ওদের কর্তৃত্বে ছিল।” (আয়াত ৬-৭)

এতদিন পর্যন্ত স্কলারদের মত ছিল যে, দ্বিতীয় বারের সময়টি ছিল ৭০ খ্রিষ্টাব্দ। কারণ কুরআনের তাফসীর করার সময় ও তার অনেকদিন পর পর্যন্ত ই*হু*দিরা বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে যাযাবরের মত ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু ১৯৪৮ সালের পর আস্তে আস্তে এই ধারণা পরিবর্তিত হয়। এখন ই*হু*দিদের সংখ্যা অনেক বেশি। সব দেশের ব্যাংকিং সিস্টেম কোনো না কোনো ভাবে ই*হু*দিদের সাথে যুক্ত। এক ইউ এস এ ইস*রা*য়েলকে চার বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেয়। গত দুই হাজার বছরে এরকম ভালো অবস্থানে ই*হু*দিরা আসতে পারেনি। তাই বর্তমান বেশ কিছু মুফাসসিরগণ ধারণা করেন যে এই সেই দ্বিতীয়বার। তবে এই বারের শেষে তারা পরাজিত হবেই এবং তারা কোনোদিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।

কিন্তু এইভাবে ই*হু*দীদের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হল কিভাবে? ৭০ ক্রিস্টাব্দে রোমানদের দ্বারা জে*রু*জা*লেম থেকে বহিষ্কৃত হবার পর সব জায়গায় ওরা এত নির্যাতিতই বা হতো কেন?

(চলবে . . . . .)


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *