‘গোছানো বা অর্গানাইজড’ থাকা কেন প্রয়োজন??

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

টপিকটা পড়ে অনেকেরই মনে হতে পারে, এটা আবার লেখার কোনো বিষয় হলো নাকি? তবে ’গুছিয়ে থাকতে পারা’—-একটা অন্যতম Life skill, যা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখানো হয় না।

প্রথমেই লেখার সাথে সংযুক্ত ছবি দুটি লক্ষ্য করি। ১ নং ছবিতে সবকিছু এলোমেলো, অগোছালো আর ২ নং ছবিতে সবকিছু গোছানো, পরিপাটি। কোন ছবির দিকে তাকিয়ে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে?

নিঃসন্দেহে ২ নং ছবিটি।

আচ্ছা, আমরা তো দেখছি চোখ দিয়ে কিন্তু প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে হৃদয়ে। কখনো কি ভেবে দেখেছি কেন এমন হয়?

উত্তরটা হলো, আমরা চোখ দিয়ে যা দেখি আর হৃদয়ে যা অনুভব করি – তার একটা গভীর যোগসূত্র রয়েছে। তাই যখন আমরা গুছানো ,পরিপাটি কোন কিছু দেখি ( ঘর, অফিস, মানুষ বা কোনো দৃশ্য) তখন আমাদের মনে ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়। অপরদিকে এলোমেলো কিছু দেখলে নিজের অজান্তে মনে একটা বিরক্তি চলে আসে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।

আমরা যদি সূরা আল ফুরকান এর ৭৪ নং আয়াত লক্ষ্য করি, যেখানে আল্লাহ আমাদের কেমন জীবনসঙ্গী, সন্তান চাইতে হবে সে ব্যাপারে দোয়া শিখিয়ে দিচ্ছেন, সেখানে তিনি ’চক্ষু শীতলকারী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ এমন জীবনসঙ্গী ও সন্তান চাইতে হবে যাদের দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় এবং মনে ভালোবাসার অনুভূতি তৈরি হয়। নিঃসন্দেহে এখানে শারীরিক সৌন্দর্য না বুঝিয়ে উত্তম আখলাকের সৌন্দর্য বোঝানো হয়েছে। তবে আমরা যা দেখি –তা যে আমাদের হৃদয়ে প্রভাব ফেলে এই আয়াতের শব্দচয়ন থেকে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, ভালো লাগার অনুভূতি দিয়েছেন তিনি যে আমাদের চোখ ও হৃদয়ের এই কানেকশনের ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো জানবেন তা নিয়ে তো সন্দেহের কোনো অবকাশ নাই।

এতক্ষণ ধরে যা বোঝাতে চাইলাম তা হলো, ’গোছানো ব্যাপারটা’র সবচেয়ে বড় উপকারিতা এই যে, এটি আমাদের আমাদের মনে প্রশান্তির অনুভূতি তৈরি করে ।

এই তো গেল ’গোছানো ব্যাপারটা’র মনস্তাত্ত্বিক উপকারিতার কথা। এবার কিছু প্র্যাকটিক্যাল বা বাস্তব উপকারিতার কথা বলি।

প্রথমত: ‘গোছানো’ থাকলে যে কোন জিনিস সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। গোছাতে যতটা সময় লাগে এলোমেলো জায়গা থেকে কোনো কিছু খুঁজে বের করতে তার চেয়ে বেশি সময় লাগে‌। বিশেষ করে কারও অনুপস্থিতিতে যদি তার সংসার, কর্মক্ষেত্র এমন কি ল্যাপটপ থেকেও কোনো কিছু খুঁজে বের করতে হয় আর তার জিনিস/কাজ যদি গোছানো থাকে তাহলে সহজেই অন্য কেউ তা খুঁজে বের করে কাজ চালিয়ে নিতে পারে।

দ্বিতীয়ত: ’গোছানো’ স্বভাব থাকলে প্রতিদিন জিনিসপত্র গোছাতে যে ফিজিক্যাল মুভমেন্ট হয় তা শরীরকে, ফিট ঝরঝরে রাখতে সাহায্য করে। ইদানিং কায়িক পরিশ্রমের অভাবে অনেকেই স্থুলতাজনিত সমস্যায় ভোগেন এবং ওজন কমাতে শুধু খাবার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেন। অথচ ফিট থাকার জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট মাত্রার কায়িক পরিশ্রম করা; যা বাসা, কর্মক্ষেত্র গোছানোর মাধ্যমে অনেকটাই হয়ে যায়।

তৃতীয়ত: পরকালের জন্য কিছু নেকি সঞ্চয়ের সুযোগ পাওয়া যায়। এই কথাটা শুনতে অবাক লাগলেও ব্যাপারটা অনেকটা ’এক এর ভিতর দুই’ এর মতন। কেউ যখন গোছানোর কাজ করতে থাকে তখন তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একটিভ থাকলেও ব্রেন এবং জিহবা অবসরে থাকে। তাই হাত, পা দিয়ে গোছানোর সাথে সাথে যদি জিহ্বা দিয়ে জিকির, ইস্তেগফার করা যায়, কুরআন তেলাওয়াত বা প্রোডাক্টিভ কোনো ইসলামিক অডিও শোনা যায় তবে তা আমলনামায় নেকির পাল্লাকে সমৃদ্ধ করবে ইনশাআল্লাহ। বিশেষ করে যারা প্রতিদিন ঘর গোছানোকে সময়ের অপচয় মনে করেন, তাদের জন্য এই টিপসটি বেশ উপকারী। গোছানো মানে সময়ের অপচয় নয় বরং তা সময়ের সদ্বব্যবহার এবং সময় সাশ্রয়ীও বটে।

গুছিয়ে রাখা কি কেবল একজনের দায়িত্ব?

কখনোই না।

প্রাথমিকভাবে একটা বাসা বা অফিস এর একটি ’গুছানো সেটআপ’ তৈরির মূল দায়িত্ব হয়তো একজন পালন করবে কিন্তু এরপর সেটা মেইনটেইন করার ক্ষেত্রে বাকি সদস্যদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। প্রত্যেকে যদি’ যেখানকার জিনিস সেখানে’ আবার গুছিয়ে না রাখে তবে গোছানো জায়গা মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে যাবে এবং একজনকে বারবার সব গোছাতে হবে। এটা তার মনে বিরক্তি ও হতাশার উদ্রেক করবে। তাই একবার গোছানোর পর সেটা মেইনটেইন করার জন্য অন্যদেরও সহযোগিতা করতে হবে।

কিভাবে পরিবার বা কর্মক্ষেত্রে অন্য সদস্যদেরও গোছানো হওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা যায়?

প্রথমত : মৌখিকভাবে Counselling করতে হবে । গোছানো থাকলে যে তা চোখ ও হৃদয়কে প্রশান্তি দেয় এ ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে হবে।

দ্বিতীয়ত: বাসা বা কর্মক্ষেত্রের কোথায় কি গুছিয়ে রাখা আছে তা বাকি সদস্যদের দেখিয়ে দিতে হবে, জানিয়ে রাখতে হবে। ব্যবহারের পর প্রতিটা জিনিস নির্দিষ্ট স্থানে গুছিয়ে রাখার ব্যপারে উৎসাহ/ নির্দেশ দিতে হবে। পরবর্তীতে তারা যখন নিজেরাই আবার নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট জিনিস খুঁজে পাবে তখন গোছানো ব্যাপারটার উপকারিতা বুঝতে পারবে এবং নিজেরাও এ ব্যাপারে সচেতন হবে।

তৃতীয়ত: পরিবারের শিশুদের ছোটবেলা থেকে শেখাতে হবে যে গুছিয়ে রাখা/ থাকাটা একটা লাইফ স্কিল। ছোটবেলা থেকেই খেলনা, বই,খাতা সারা ঘরে না ছড়িয়ে ঘরের একটা নিদিষ্ট কর্ণারে খেলা, টেবিল-চেয়ারে খাওয়া এবং পড়াশোনা করা, নিজের বিছানা, কাপড় গুছিয়ে রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, তাহলে তা বাকী জীবনেও অব্যাহত থাকবে।

• যে কোনো ঘর গোছানোর ক্ষেত্রে প্রথমেই সেই ঘরের প্রধান ফার্নিচার গুছিয়ে ফেলতে হবে। যেমন- বেডরুমের ক্ষেত্রে বিছানা, ড্রয়িং রুমের ক্ষেত্রে সোফা, ডাইনিং রুমের ক্ষেত্রে ডাইনিং টেবিল, কিচেনের ক্ষেত্রে এটো থালা-বাসন, হাঁড়ি -পাতিল প্রভৃতি । তাহলে At first look এ একটা পজিটিভ ইম্প্রেশন তৈরি হবে। হঠাৎ মেহমান আসার খবর পেলে চটজলদি এলোমেলো ঘর গোছানোর জন্য এটি একটি ত্বরিৎ সমাধান ।

• ফার্নিচার কেনার সময় বেশি সংখ্যক তাক বা শেলফ সমৃদ্ধ ফার্নিচার কিনতে হবে, তাহলে সেগুলো জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

• কেনাকাটার থেকে মিনিমালিস্ট হতে হবে । অনলাইনে কেনাকাটার সুযোগ থাকায় ইদানীং অনেকেই শখের বশে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও শপিং করেন। জিনিস যত বেশি, তা গুছিয়ে রাখার ততই ঝামেলার। তাই পণ্য কেনা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিনিমালিস্ট হওয়া দরকার।

• নির্দিষ্ট সময় পর পর পুরানো জিনিস ডিক্লাটার করা উচিত( বিশেষ করে পোশাক, জুতা ,ব্যাগ প্রভৃতি)। ’আলমারি ভতি জিনিস অথচ পরার সময় কিছুই খুঁজে পাই না’– এই অভিযোগ যারা করেন তারা অধিকাংশই অব্যবহৃত জিনিস ডিক্লাটার করেন না। অথচ এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ।

উপসংহারে বলতে চাই, মহান সৃষ্টিকর্তার একটি অন্যতম গুণবাচক বৈশিষ্ট্য হলো এ বিশ্ব জগতের সব কিছুই তিনি সুবিন্যাস্তভাবে সৃষ্টি করেছেন। মানবদেহে অঙ্গ-প্রতঙ্গের বিন্যাস কিংবা মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথে অবস্থান লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, এগুলো সুবিন্যাস্তভাবে গোছানো আছে বলেই সব কিছু সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাই আমাদেরও উচিত স্রষ্টার এই গুণবাচক বৈশিষ্ট্যকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করা, কারণ এটা আমাদের বেসিক ফিতরাতেরই অংশ।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন