শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্ক মেইনটেইন করার টিপস

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

’বিয়ে’ মানে শুধু একজন মানুষের সাথে সম্পর্ক নয় বরং একটি পরিবারের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া। আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন মেয়েকে বিয়ের পর ছেলের বাড়িতে গিয়ে তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে থাকতে হয় তাই তাকে একটা বিশাল মনস্তাত্ত্বিক এডজাস্টমেন্ট করতে হয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন মানসিকতা নিয়ে বড় হওয়া একজন মানুষ যখন অন্য পরিবেশে অন্য মানসিকতার মানুষের সাথে বসবাস করা শুরু করে তখন তার মনে ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয় । এই চাপ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগেই কিছু মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া এবং সেখানে যাবার পর কৌশলী আচরণ করা।

কি ধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে এবং কি কি কৌশল প্রয়োগ করতে হবে তার কিছু টিপস

প্রথমত: ’বউ কখনো মেয়ে হয়ে উঠতে পারে না, যেমন এক গাছের ছাল আরেক গাছে লাগে না’— এটা মেনে নিয়েই সংসার জীবন শুরু করতে হবে । প্রথম থেকেই তাই মেয়ে হয়ে ওঠার বৃথা আশা এবং চেষ্টা করার দরকার নেই। শ্বশুর বাড়ির মানুষদের জন্য আপনি যদি জান দিয়েও সেবা করেন তবুও আপনি কখনই তাদের শতভাগ সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবেন না। তাই আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য যা করবেন সওয়াবের আশায় করবেন। তাদের প্রশংসা পেলেও আলহামদুলিল্লাহ, না পেলেও আলহামদুলিল্লাহ। ’

’মানুষকে সন্তুষ্ট করা কঠিন, কিন্তু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা সহজ’-এই কথাটি শ্বশুরবাড়ির ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য।

দ্বিতীয়ত: নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দেবেন না। যেহেতু বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মেয়ে একটা Matured বয়সে বিয়ে করে, তাই এতদিনে তার একটি নিজস্ব ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। এই ব্যক্তিত্ব নিজের পছন্দের লাইফস্টাইল, খাবার, পোশাক,শখ- সব কিছুকেই ধারণ করে। বিয়ের পর অন্য পরিবারের ’মনের মতন বউ’ হওয়ার জন্য নিজের এই পছন্দের বিষয়গুলোকে পরিবর্তন করবেন না।

আমি যদি বলি আমার ১৫ বছরের শ্বশুর বাড়ি জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা কি? তবে সবার আগে এটাই বলব যে, আমি আমার নিজের পার্সোনালিটি বিসর্জন দেইনি। সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতার একদল বিভিন্ন বয়সী নারীদের সাথে থেকেও আমি আমার ’আমিত্ব’কে ধরে রেখেছি এবং নিজের সন্তানের মাঝেও সেই পার্সোনালিটি বিল্ডআপ করার চেষ্টা করছি।

বেয়াদবি করে নয় বরং ইগনোর করে, তর্ক করে নয়, বরং মৌন থেকে আমি আমার নিজস্বতা বজায় রেখে যাচ্ছি এত বছর আলহামদুলিল্লাহ। একটা কথা মনে রাখবেন, অন্যকে খুশি করতে গিয়ে যে মানুষ তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে দিনশেষে তার বোবা কান্নার সঙ্গী কিন্তু কেউই হয় না। তাই এ ব্যাপারে অবশ্যই স্বার্থপর হতে হবে।

তৃতীয়ত: শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে জানতে হবে, তাদের আত্মীয় স্বজনদের সাথে মিশতে হবে বিশেষ করে বয়স্ক মুরব্বি যারা আছেন বিয়ের পর প্রথম দিকে তাদের সাথে একটা গুড রিলেশন বিল্ডআপ করতে হবে নিজের স্বার্থেই। এক্ষেত্রে কার্যকরী একটা টেকনিক হচ্ছে ’মনোযোগী শ্রোতা’ হওয়া।

বয়স্ক মানুষেরা গল্প করতে পছন্দ করেন, তাই তাদের কথা শুনতে চাইলে তারা আগ্রহী হয়ে নিজে থেকে অনেক পুরানো কথা, ইতিহাস বলা শুরু করেন ।এই তথ্যগুলো আপনাকে আপনার শ্বশুর বাড়ির মানুষ সম্পর্কে একটা ধারণা দিবে- যেটা তাদের সাথে deal করার জন্য খুবই জরুরী।

এমনকি আপনার spouse সম্পর্কে জানতে, তার অনেক আচরণের পিছনের ব্যাখ্যা বুঝতে আপনাকে সাহায্য করবে এই তথ্যগুলো। প্রতিটি মানুষের চরিত্রে কিন্তু তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড এর একটা বিশাল এফেক্ট থাকে। তাই পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড জানা খুব জরুরী।

তবে এসব তথ্য জানার পর তা স্পাউসের সাথে ভুলেও শেয়ার করবেন না ।বিশেষ করে ঝগড়াঝাটি বা রাগ করার সময় এসব কথার রেফারেন্স দিবেন না। যা জেনেছেন তা নিজের মধ্যে রেখে সেই অনুযায়ী নিজের আচরণ কাস্টমাইজ করে নিবেন এবং এ ক্ষেত্রে নিজের হিকমাহ প্রয়োগ করবেন।

চতুর্থত: নিজের পরিবারের কাছে শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের সব ইনফরমেশন শেয়ার করবেন না। অনেক মেয়ে বিয়ের পর নিজের husband / Inlaws দের সম্পর্কে সব তথ্য নিজের মা-বোনদের সাথে গল্প করে। এটা চরম পর্যায়ের বোকামি। আপনি হয়তো গল্পচ্ছলে কোনো কথা কিছু mean না করেই শেয়ার করলেন, কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল বেয়াইনরা নিজেরা গল্প করার সময় সেই টপিক্স তুলে এমন সব কথা আদান-প্রদান হলো যা থেকে দুই পরিবারের মধ্যে একটা misunderstanding তৈরি হলো। তাই শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে তথ্য যা জানবেন সেটা নিজের এডজাস্টমেন্ট এর জন্য কাজে লাগাবেন, প্রচার সম্পাদক হয়ে যাওয়ার দরকার নেই।

তবে একান্তই মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন করলে সেটা নিজের পরিবারকে অবশ্যই জানাতে হবে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন যদি বুঝে যায় আপনি ’সাত চড়েও রা করেন না’’ টাইপ বউ তাহলে তারা সেটার সুযোগ নিবে। নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবে ।তাই এক্ষেত্রেও সিচুয়েশন অনুযায়ী নিজেকে ডিসিশন নিতে হবে।

পঞ্চমত: শ্বশুরবাড়িতে নিজের মান -সম্মানকে পণ্য দিয়ে পরিমাপ করার সুযোগ করে দেবেন না ।আমাদের সমাজে বিভিন্ন অকেশনে মেয়ের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে উপহার পাঠানোর রেওয়াজ এখনো প্রচলিত আছে– এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো মেয়েরা নিজেরাও এই উপঢৌকন পাঠানোকে নিজের মান -সম্মানের বিষয় হিসেবে মনে করে। তারা এটা ভাবে না যে- একজন মানুষের সম্মান তার বাপের বাড়ি থেকে পাঠানো গ্রীষ্মের ফলমূল/ রমজানের ইফতার/ ঈদের শাড়ি ,পাঞ্জাবি /কুরবানীর পশু দিয়ে মূল্যায়ন করা মানে পণ্যের বিনিময়ে মানুষ হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে বিসর্জন দেওয়া। তাই নিজের সম্মান নিজেই নষ্ট করবেন না প্লিজ।

শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপ দিলে বা কথা শুনালে এই একটা ব্যাপারে প্রতিবাদ করবেন, নিজের ফ্যামিলিকে ডিফেন্ড করবেন। ’শক্তের ভক্ত, নরমের যম’–এই কথাটি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ষষ্ঠত : শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক বিষয়গুলোতে উপযাজক হয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করতে যাবেন না । তারা যদি আপনার মন্তব্য/ সিদ্ধান্ত জানতে চায় তবে দিতে পারেন, তবে সাথে এই মেসেজটাও দিয়ে দিবেন যে, আপনার কথা মানতেই হবে– এমন কোনো বাধ্যকতা নেই। এটা ভবিষ্যতে নিজেকে সেভ রাখার দূরদর্শী টেকনিক ।

আমার ১৫ বছরের শ্বশুরবাড়ি জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বোধহয় এটাই যে, একটা সময় আমি পারিবারিক বিষয়গুলোতে নিজের মতামত প্রকাশ করতাম , অনেকের চাপাবাজি দেখলে তা সহ্য করতে না পেরে সত্য প্রকাশ করে দিতাম। কিন্তু পরে নিজেই Blame game এর শিকার হতাম । তাই এখন চোখের সামনে ভুল হতে যাচ্ছে দেখেও চুপ থাকি, সতর্ক করি না, নিজের মতামত দেই না ।এটা হয়তো স্বার্থপরতা। কিন্তু অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাকে এই স্বার্থপরতা শিক্ষা দিয়েছে।

তবে এখনো আমি আমার শ্বশুরবাড়ির যেসব সদস্যের মঙ্গল চাই, তাদের জন্য নিয়মিত দোয়া করি। হয়তো তারা অনেকেই জানেনা যে তাদের জন্য আমি দোয়া করি ,হয়তো তাদের জন্য আমার এই দোয়ার ফলাফল জীবদ্দশায় দেখা হবে না –তবুও তাদের জন্য কিছু একটা করতে পারছি এটাই আমার নিজস্ব আত্মতৃপ্তি ।

সপ্তমত: নিজের Quality/ Skill ইম্প্রুভ করবেন নিজের প্রয়োজনে। রান্না করা, ঘর গোছানো, নিজে পরিপাটি থাকা, ইবাদতে সময় দেওয়া, সন্তানকে উত্তম আখলাক শিক্ষা দেওয়া—- এ কাজগুলোতে নিজের যেসব Lackings আছে নিজেই সেগুলো Identify করে নিজেকে upgrade করে তুলবেন ।

কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয় বরং নিজের self confidence বাড়ানোর জন্য skillful হওয়া জরুরী। মনে রাখতে হবে যে, perfection level একেকজনের কাছে একেক রকম। তাই অন্যের মানদন্ডে নিজের pefection কে মাপার সুযোগ না দিয়ে নিজের Best effort দিয়ে নিজেকে improve করতে হবে।

হয়তো এরপরও শ্বশুরবাড়ির মানুষ ভুল ধরবে,আপনার shortcomings গুলোকে highlight করে judge করতে চাইবে কিন্তু তাদের comments পাত্তা দেওয়া যাবে না । নিজের mental health sound রাখার জন্য এটা খুব জরুরী।

অষ্টমত: শ্বশুরবাড়িতে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতায় Participate করবেন না। একাধিক ছেলের বউ /ননদ আছে এমন শ্বশুরবাড়িতে এটা খুব কমন যে তাদের মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা তৈরি করে দেয় শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরাই। কিন্তু বউ হিসেবে আপনি ভুলেও এই ফাঁদে পা দিবেন না। তারা তুলনা করে আপনাকে প্রতিযোগিতায় নামাতে চাইলেও আপনি সচেতনভাবে তা এড়িয়ে যাবেন।

আমার শ্বশুর বাড়িতে একটা কমন ট্রেন্ড হলো, বাড়ির কোনো নারী সদস্যের কোনো রান্না যখন হিট হয় তখন বাকি নারী সদস্যরাও সেই আইটেম রান্না করার কম্পিটিশন শুরু করে দেয়। এরপর শুরু হয় তুলনামূলক বিচার- কার রান্না বেশি ভালো হয়েছে ইত্যাদি।

কিন্তু আমি বরাবরই এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি ।আমি বরং সবসময় চেষ্টা করেছি ভিন্ন কোনো আইটেম রান্না করে পরিবেশন করতে- যেটা আমার সিগনেচার আইটেম হয়ে থাকবে ।এভাবে কমন ট্রেন্ড এ গা না ভাসিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র বজায় রাখার চেষ্টা করেছি সব সময়।

সবশেষে বলতে চাই পৃথিবীতে যেকোনো রিলেশনশীপ Long term maintain করতে চাইলে রিলেশনশীপের মাঝখানে স্পেস রাখতে হয়। এই স্পেস অনেকটা লবণের মতো। পরিমাণে খুব বেশিও না আবার কমও না। শ্বশুর বাড়ির সাথেও একটা balance space রেখে রিলেশনশীপ maintain করতে হবে। তাদের সাথে আন্তরিকভাবে ’মিশতে’ হবে, কিন্তু একেবারে’ মিশে’ যাওয়া যাবে না। জলের গ্লাসে তেল এর মতো ভেসে থাকতে হবে নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে।

’আজকে কি রান্না হলো’, ’কোন পোশাক কত দাম দিয়ে কিনলাম’, ’কোন ফার্নিচার কোথা থেকে কিনলাম ——এসব আটপৌরে আলাপ না করে নিয়মিত বিরতিতে কুশল বিনিময় করা, কারও জন্ম, বিয়ে তথা আনন্দের উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানানো, উপহার দেয়া, পারিবারিক গেট টুগেদারগুলোতে এটেন্ড করা, অসুস্থতা বা মৃত্যুর সংবাদে খোঁজখবর নেয়া, দেখতে যাওয়া— That’s enough for maintaining balance relationship. খুব বেশি আদিখ্যেতাও নেই ,আবার খুব বেশি দূরত্বও নেই।

সত্যি কথা বলতে balance distance সব সম্পর্ককে দীর্ঘমেয়াদে continue করার একটা ফলপ্রসু টেকনিক। আয়নায় কিন্তু নিজের প্রতিবিম্ব খুব কাছ থেকে দেখলে সেটাও বীভৎস লাগে। তাই নিজেকেও একটা ideal distance maintain করে দেখতে হয়। সর্বাধিক নৈকট্য হওয়া উচিত স্রষ্টার সাথে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, আপনার strength and weakness গুলো জানেন এবং এগুলো মেনে নিয়েইআপনাকে ultimately judge করবেন।

মহান আল্লাহ যেন আমাদের সব ধরনের দুনিয়াবী সম্পর্কগুলোকে সুন্দর রেখে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার তৌফিক দান করেন, আমাদের মৃত্যুর পর সবাই যেন আমাদের জন্য দোয়া করে, কারো বদ দোয়ার সম্মুখীন হতে না হয়। আমীন।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন