ইসলামে নারী নেতৃত্বকে উৎসাহিত করা হয়নি। মসজিদ, যুদ্ধক্ষেত্র বা রাজ্য পরিচালনা কোনো ক্ষেত্রেই নারীকে নেত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়নি।
তাই বলে কি নারীর মধ্যে নেতৃত্ব গুণ থাকা অবশ্যক নয়?
একজন সফল নেতার যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার সেগুলো কি একজন নারী ধারণ এবং চর্চা করতে পারবে না?
ইসলামে নারীকে বলা হয় ’রাব্বাতুল বাইত’ বা ঘরের রানী। তো এই ঘরের সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য, পরিবারের সদস্যদের মাঝে মেলবন্ধন রচনা করার জন্য কিন্তু একজন নারীর মধ্যে নেতৃত্ব গুণ থাকা জরুরী।
একজন নারী উচ্চতর ডিগ্রিধারী না হয়েও, সফল ক্যারিয়ারিস্ট হয়ে অনেক টাকা ইনকাম না করেও তার পরিবারে নিজের আলাদা অবস্থান তৈরি করতে পারে যদি সে তার নেতৃত্ব গুণে পরিবারের সদস্যদের মাঝে একটি Team spirit তৈরি করতে পারে।
বর্তমান সময়ে পরিবারের সদস্যরা যখন একই ছাদের নিচে থেকেও Individualism এ অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে তখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র/ ব্যক্তি স্বাধীনতা বজায় রেখেও পরিবারের সদস্যদের একই সুতার গেঁথে একটি মালা তৈরির জন্য প্রয়োজন একজন নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন নারী।
আজকের লেখায় আমরা আলোচনা করবো, একজন সফল নেতা/নেত্রী হওয়ার জন্য নারী–পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ কি কি টেকনিক ফলো করতে পারে—
প্রথমত: একজন নেতা/ নেত্রীকে তার দলের বা পরিবারের প্রতিটি সদস্যের Strength এবং Weakness সম্পর্কে জানতে হবে। সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনো বিষয়ে দক্ষতা/ দুর্বলতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। একজন দলনেতার কাজ হচ্ছে, যার যে বিষয়ে দক্ষতা আছে তা আইডেন্টিফাই করে তাকে সেই কাজের দায়িত্ব দেওয়া।
যেমন- একটা দলীয় এসাইনমেন্টে কেউ হয়তো কন্টেন্ট তৈরি করবে, কেউ সেটা সুন্দর করে লিখবে, কেউ তাতে ডিজাইন করে সেটাকে আকর্ষণীয় করে তুলবে এবং সবশেষে আরেকজন সেই রেডি অ্যাসাইনমেন্টকে সাবলীল ভাবে টিচারের সামনে উপস্থাপন করবে। এভাবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সফল গ্রুপ এসাইনমেন্ট তৈরি হবে। এক্ষেত্রে যার যে বিষয়ে দক্ষতা আছে, তাকে সেটা প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া দলনেতা/ নেত্রীর দায়িত্ব।
দ্বিতীয়ত: দলের প্রতিটি সদস্যের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতে হবে।
স্বভাবগতভাবে কেউ হয়তো ফাঁকিবাজ প্রকৃতির আবার কেউ কর্মঠ প্রকৃতির। যে Proactive তাকে অতিরিক্ত কাজের বোঝা দেওয়া এবং যে ফাঁকিবাজ তাকে কাজ করতে বাধ্য না করা—এটা একটা Bad practice. দীর্ঘমেয়াদে এই চর্চা অব্যাহত থাকলে যে বেশি কাজ করে তার মধ্যে এক পর্যায়ে হতাশা চলে আসে আর যে কিছুই করে না তার মধ্যে যেটুকু প্রতিভা ছিল তাও চর্চার অভাবে মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। তাই দলনেতাকে কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে হলেও দলের Inactive সদস্যকে Active করে তুলতে হবে ,যেন সেও নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা শুরু করে এবং দলীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে।
উদাহরণস্বরূপ,বাসায় কোনো দাওয়াত অনুষ্ঠান থাকলে কেউ একই সাথে রান্না -বান্না, ঘর গোছানো সব কাজই করবে আবার কেউ মোবাইল নিয়ে টাইম পাস করবে—এমনটা হতে দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে গৃহকত্রীর দায়িত্ব হচ্ছে পরিবারের সব সদস্যকে এই প্রোগ্রামে ইনভল্ভ করা।
কাউকে রান্না করা, কাউকে বাজার করা, কাউকে ঘর গুছানো আবার কাউকে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া। সবাইকে এই বলে কাউন্সিলিং করা যে, সবাই মিলে কাজ ভাগ করে কাজ করলে অতিথিদের সামনে পরিবারের গুড ইমেজ তৈরি হবে।
এভাবে সবাইকে কাজে ইনভলভ করার আরেকটি উপকারিতা হলো, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জেলাস মনোভাব তৈরি হবে না বরং কোঅপারেটিভ মেন্টালিটি গড়ে উঠবে।
তৃতীয়ত: দল বা পরিবারের যে কোনো বড় প্রোগ্রাম বা ইভেন্ট শেষ হওয়ার পর সেই অনুষ্ঠানের সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে মিটিং করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। আর এই দায়িত্ব পালন করতে হবে দলনেতা/ নেত্রীকেই।
সাফল্যের পর দলের সদস্যদের প্রশংসা করা এবং ব্যর্থতার পর তিরস্কার না করে সবাই মিলে সেটার কারণগুলো খুঁজে বের করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে দলের সদস্যদের মধ্যে পরাজয়কে মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়, পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে কিভাবে পরেরবার জয়ী হওয়া যায় তার কর্মকৌশল নির্ধারণ করা সহজতর হয়। এছাড়া যে কোনো দলীয় সাফল্যের পর সবাই মিলে সেটাকে উদযাপন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।
আমরা যদি পারিবারিক পরিমন্ডলে চিন্তা করি, পরিবারের কোনো সদস্য পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া কিংবা দর্শনীয় কোথাও ঘুরতে যাওয়া যেতে পারে। এর ফলে পরিবারের একজন সদস্যের আনন্দের অনুভূতি বাকি সদস্যদের মাঝেও সঞ্চারিত হবে।
অন্যদিকে পরিবারের কোনো সদস্য যদি অসুস্থ হয় বা কেউ চাকুরী হারিয়ে আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় তবে বাকি সদস্যরা কে কিভাবে তাকে মেন্টাল, ফাইনান্সিয়াল এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে পারে তা পারিবারিক আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে।
উভয় ক্ষেত্রেই একজন গৃহকত্রীর দায়িত্ব হবে- পরিবারের একজন সদস্যের আনন্দ বা বিপদের উপলক্ষ পরিবারের অন্যদের সাথেও শেয়ার করে তাদের মধ্যে সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত করা এবং সবাইকে নিয়ে পারিবারিক মিটিং এরেঞ্জ করা। এভাবে পরিবারের সদস্যদের মাঝে একটা সুন্দর পারিবারিক বন্ডিং গড়ে উঠবে।
পারিবারিক পরিমন্ডলে এভাবে সহমর্মী হওয়া এবং আলোচনা করার অভ্যাস থাকলে তা পরবর্তীতে বৃহত্তর সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা কর্মক্ষেত্রেও পরিবারের সদস্যদের এই গুণ চর্চা করতে সাহায্য করবে। মনে রাখতে হবে মানুষ পরিবারের অভ্যন্তরে যা শিখে, তা তার বহির্জগতের কর্মকান্ডে প্রভাব ফেলে।
এইতো গেলো দল /পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন নেতা–নেত্রীর কি কি টেকনিক ফলো করতে হবে সেই আলোচনা। এবারে একজন নেতা/ নেত্রীর নিজস্ব কি কি গুণ থাকতে হবে সেই বিষয়ে ফোকাস করবো।
প্রথমত: যে কোনো দলীয় বা পারিবারিক কাজে নেতা/ নেত্রীকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে, যাকে বলে Leading from the front.
একজন লিডার যদি নিজের দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করতে না পারে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে দলের অন্য সদস্যদের মোটিভেট করা নৈতিক মনোবল হারিয়ে ফেলে।
তাই একজন নেতা শুধু অন্যদের মাঝে কাজ ভাগ করে দিয়ে এবং সেটা মনিটর করে ক্ষান্ত থাকলেই হবে না ক্ষেত্রবিশেষে তাকে অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ কাজ করে নেতা হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
নেতার মনে রাখতে হবে যে, নিজে কাজ না জানলে / না পারলে অন্যের কাজের তদারকিও সঠিকভাবে করা যায় না।
তাই কেউ যদি উত্তরাধিকার সূত্রে বা অন্য কোনো উপায়ে by default নেতৃত্ব পেয়ে যায় তবে তার করণীয় হবে দ্রুত নিজেকে যোগ্য করে তোলা, যেন কেউ তার নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে।
দ্বিতীয়ত: একজন নেতা/নেত্রীর ব্যবহার/ আচরণ হতে হবে বন্ধুসুলভ। দলের/ পরিবারের বাকি সদস্যরা যেন সহজেই তাদের সমস্যা বা নিজস্ব চিন্তা ভাবনা নেতার সাথে শেয়ার করতে পারে সেই স্পেস রাখতে হবে নেতাকে।
আবার তাই বলে অতি নমনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারীও হওয়া যাবে না ,যেন প্রয়োজনীয় মুহূর্তেও নেতার কমান্ড কেউ অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস দেখায়।
মোটকথা নেতার ব্যক্তিত্ব হবে ব্যালেন্সড। অহংকারীও না, আবার অতি নমনীয় না।
দলের অন্য সদস্যদের সাথে একটা সীমারেখা বজায় রেখে নিজের পার্সোনালিটির অনন্যতা Show up করতে হবে।
তৃতীয়তঃ একজন নেতার মধ্যে তার নেতৃত্বের যোগ্য উত্তরসূরী তৈরি করার মানসিকতা থাকতে হবে।
অনেক নেতা/ নেত্রী আছেন যারা নিজের পদ হারানোর ভয়ে অন্য কারোও প্রতিভার উন্মেষ ঘটুক সেই সুযোগ দিতে চান না। কিন্তু এটা আদতে নিজের দল/ পরিবারের জন্য একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যদি সত্যিই একজন নেতা/ নেত্রী চান তার অবর্তমানে তার দল/ পরিবার আগের মতোই ভালো পারফর্ম করুক বা আরও বেটার কিছু করুক তবে তিনি তার জীবদ্দশাতেই পরবর্তী নেতৃত্বের উপযোগী ব্যক্তিকে নির্বাচন করে তাকে তৈরি করে যাবেন।
তার দল/ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নেতৃত্ব গুণ আছে এমন এক বা একাধিক জনকে আইডেন্টিফাই করে তাকে মাঝে মাঝেই বিশেষ কোনো দায়িত্ব দিতে হবে। কখনো কখনো নেতা/ নেত্রীর নিজের নির্ধারিত কাজ তাকে দিয়ে করাতে হবে, যেন তার সংকোচ, জড়তা কেটে যায় এবং সে মানসিকভাবে প্রিপেয়ার হয়।
এতক্ষণ যেসব গুণাবলী/ বৈশিষ্ট্যের কথা বললাম, সেগুলো নেতৃত্বের বেসিক কিছু Requirements ,যা নারী- পুরুষ নির্বিশেষে যে কারও ঘরে/ বাইরে যে কোনো ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রয়োজন।
এটা ঠিক যে, সবার নেতা/ নেত্রী হওয়ার প্রয়োজন নেই। আবার সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে যে কোনো পরিবার/ প্রতিষ্ঠান/ রাষ্ট্র সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উন্নতি করতে পারে না -এটাও সত্য।
তাই নারী /পুরুষ যার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো Potential আছে, তাকে তা Nourish করার সুযোগ দেওয়া উচিত। একজন সুযোগ্য নেতা/ নেত্রীর পরিচালনায় একটি পরিবার/ প্রতিষ্ঠান/ রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।