Disclaimer: এই লেখাটি আমি আমার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমার মেয়েকে তার সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে উল্লেখিত ছেলে ও মেয়েদের জেন্ডার রোল বিষয়ক আলোচনার বিপরীতে নারী ও পুরুষের বেসিক ফিতরাতের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছি তার লিখিতরূপ। যেহেতু এই যুগে বাচ্চারা পাঠ্যবই থেকে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক তথ্য পায় না তাই আমি কিভাবে আমার মেয়েকে বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আরেকটি ’প্যারালাল থট’ দেই, তা শেয়ার করার জন্যই লেখা।
—————————————————————————————————–
মহান আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষকে এই পৃথিবীতে দুটি ভিন্ন ভিন্ন রোল প্লে করার জন্য পাঠিয়েছেন। আর এই উদ্দেশ্যে তিনি তাদের শুধু ভিন্ন ভিন্ন শারীরিক গঠন দিয়ে তৈরি করেছেন তা নয়, বরং তিনি তাদের বেসিক স্বভাবেও কিছু ভিন্নতা দিয়েছেন। আর এই স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যগুলো স্রষ্টা প্রদত্ত বলেই সপ্তম শ্রেণীর বইয়ের খুশি আপা যখন ক্লাসের ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন সাজসজ্জার জিনিস, পোশাক বেছে নিতে বললেন- তখন মেয়েরা এক ধরনের জিনিস বেছে নিল আর ছেলেরা অন্য ধরনের জিনিস বেছে নিল। এছাড়া বইয়ে আরো উল্লেখ করা হয়েছে মেয়েরা ঘর কন্নার কাজ বেশি করে, ছেলেরা বাইরের কাজ বেশি করে। মেয়েরা সাজগোজ করতে পছন্দ করে, তাদের লজ্জা বেশি ,তাদের মন নরম হয়। অন্যদিকে ছেলেরা তাদের আবেগ প্রকাশ কম করে, লজ্জা কম পায় ইত্যাদি।
বইয়ের পরবর্তী অংশে ছেলে ও মেয়েদের এই স্বভাবজাত বৈপরীত্যকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে ,ছেলে-মেয়ে উভয়ে পরস্পরের কাজ করতে পারে, তাদের পৃথক জেন্ডার রোল নেই। তো এই ধারণার বিপরীতে আমি আমার মেয়েকে যে যে পয়েন্ট বোঝালাম তা হলো-
প্রথমত: ছেলে ও মেয়ে উভয়কে যখন তাদের ফিতরাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে কোনো কাজ শেখানো হয়, তখন তারা সেটা দ্রুত ধরতে পারে এবং শিখতে পারে । যেমন- ঘর গুছানো ও পরিষ্কার করা, খাবার রান্না করা ও পরিবেশন করা– এই কাজগুলো একই বয়সের একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে শেখাতে গেলে একটি মেয়ে যত দ্রুত শিখতে/ আয়ত্ত্ব করতে পারবে একটি ছেলের তার চেয়ে বেশি সময় লাগবে।
দ্বিতীয়ত: ছেলে ও মেয়ে উভয়েই তাদের ফিতরাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজগুলো অধিক পারফেশনের সাথে করতে পারে। যে কোন কাজ কোনমতে করা আর পারফেকশনের সাথে করার মধ্যে ব্যাপক গুণগত পার্থক্য রয়েছে এবং পারফেক্ট কাজের ফলাফল বা প্রতিক্রিয়া সবসময়ই অনেক এফেক্টিভ হয়। যেমন- পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে একটি মেয়ে পারফেক্টলি তার সেবা-যত্ন করতে পারে । কারণ ফিতরাতগতভাবে মেয়েরা মমতাময়ী স্নেহশীল ও ধৈর্যশীল ।
অপরদিকে ছেলেদের কাজের ক্ষেত্রেও এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়; যে কাজগুলো ছেলেরা যতটা দ্রুততার সাথে শিখতে পারে এবং পারফেক্টলি করতে পারে মেয়েরা তা পারে না।
এরপর যে বিষয়ে আলোচনা করলাম তা হলো, নারী–পুরুষ যদি দিনের পর দিন তাদের নিজ ফিতরাতের বিরুদ্ধে গিয়ে ভিন্নধর্মী কাজ করে তবে তার ফলাফল কি হতে পারে?
প্রথমত: নারী-পুরুষ উভয়েই তাদের নিজস্ব জেন্ডার রোল প্লে করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা হারাতে থাকে । যেমন-মেয়েদের ক্ষেত্রে তাদের শারীরিক সক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। ফলশ্রুতিতে তাদের সন্তান ধারণ ও সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
দ্বিতীয়ত: নারী -পুরুষ উভয়েরই আচরণগত নানা পরিবর্তন হয়। যেমন- একজন সিঙ্গেল মা যদি অর্থ উপার্জন করার পাশাপাশি গৃহস্থালির কাজ করা, বাজার করা, সন্তান প্রতিপালন এসব করতে বাধ্য হন তখন তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, না চাইতেও অন্যের সাথে এমনকি সন্তানের সাথেও দুর্ব্যবহার করে ফেলেন।
তৃতীয়ত: মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও নানা রকম অসংগতি দেখা দেয়। নিজে সব কাজে পারদর্শী হলে বিপরীত জেন্ডারের মানুষকে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে থাকে। একসাথে থাকার জন্য যে সহনশীলতা, উদারতা ও স্যাক্রিফাইসের দরকার হয় তা করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় অহংকার বা ইগো। ফলাফলস্বরূপ সে একাকী থাকতে পছন্দ করে এবং এই একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে শয়তান বিভিন্ন ধরনের পাপ কাজ করতে প্ররোচিত করে। উদাহরণ- বর্তমান সময় ডিভোর্স ও পরকীয়া বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো; স্বনির্ভরশীলতা—ইগো—-একাকীত্ব।
তবে কি ছেলে- মেয়ে অপজিট জেন্ডার এর কোন কাজই শিখবে না? বর্তমান বাস্তবতায় এটা কতটুকু যৌক্তিক?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমি যা আলোচনা করলাম তা হলো- বেসিক কিছু লাইফ স্কিল ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই শেখা উচিত এবং সেটা কৈশোর থেকেই। যেমন- ছেলেদের ক্ষেত্রে- নিজের কাপড় ধোয়া, নিজের ঘর গুছানো, মৌলিক কিছু আইটেম রান্না করতে শিখে রাখা। মেয়েদের ক্ষেত্রে- বাজার করা, ব্যাংক/হসপিটাল এ যাওয়া, ড্রাইভিং শেখা প্রভৃতি। এসব বেসিক লাইফ স্কিল জানা থাকলে জীবনের সংকটময় মুহূর্তে তা অনেক হেল্প করে।
পড়াশোনা/জীবিকার প্রয়োজনে কখনও যদি পরিবার থেকে দূরে একা থাকতে হয় কিংবা পরিবারের কোনো সদস্য যদি অসুস্থ হন বা কোন কারণে অনুপস্থিত থাকেন তখন বেসিক লাইফ স্কিল জানা থাকলে ছেলে-মেয়ে যে কেউ যে কোন দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
জেন্ডার রোল প্লে করার ক্ষেত্রে কিভাবে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়?
ইসলাম সবসময় আমাদের একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা মেইনটেইন করতে বলে। একইভাবে জেন্ডার রোল প্লে করার ক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষ উভয়কেই ব্যালেন্স করে চলতে হবে। ছেলে ও মেয়ে উভয়কে যেমন বেসিক কিছু লাইফ স্কিল শিখতে হবে তেমনি এই স্কিলগুলো পারফর্ম করার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বুঝে তা প্রয়োগ করতে হবে ।
আমি সব পারি- বলেই যে তা সব সময় করে দেখাতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়। ঘরের কাজে নারীর ভূমিকা হবে প্রধান আর বাইরের কাজে পুরুষের ভূমিকা হবে প্রধান —– এই মূলনীতি অনুসরণ করে চললে পরিবার হবে শান্তিময়।
বাস চালানোর সময় যেমন ড্রাইভার এর কাজ ড্রাইভিং করা আর হেলপারের কাজ পাশে থেকে সাহায্য করা —– এর ব্যতিক্রম ঘটলে (হেলপার নিজেই ড্রাইভিং করা শুরু করলে) যেমন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে তেমনি নারী-পুরুষ উভয়েই ঘরে-বাইরে সমান তালে সব পারফরম্যান্স করতে গেলে পরিবার ও সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তাই যার যার ফিতরাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজকেই প্রায়োরিটি দিয়ে করতে হবে, সবার সুপারম্যান বা সুপারওমেন হওয়ার দরকার নাই।
মহান আল্লাহ যেন আমাদের সন্তানদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে বোঝা ও পালন করার তৌফিক দেন, তাদেরকে শেষ যমানার ফিতনা থেকে রক্ষা করেন।