বর্তমান সময়ে প্যারেন্টিং এর যে নেগেটিভ দিকটা বেশি আলোচিত হয় তা হলো সন্তানের কাছে অভিভাবকদের উচ্চমাত্রায় প্রত্যাশা। অভিভাবকের প্রত্যাশার ভার সহ্য করতে না পেরে অনেক সন্তান আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে অনেক সময়। নিঃসন্দেহে সন্তানদের ওপর নিজেদের প্রত্যাশার দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়, তবে এর বিপরীতে সন্তানদের দায়িত্ব জ্ঞানহীন পরজীবী হিসেবে বড় করাটাও কিন্তু গুড প্যারেন্টিং নয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন একটি পরিবারকে কাছ থেকে দেখেছি, যে পরিবারের সব সদস্য একজন ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল। এমনকি নিজেদের বিয়ে, সংসার-সন্তান হয়ে যাওয়ার পরও আর্থিক ও মানসিকভাবে তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেনি। নিজেদের কোনো আইডেন্টিটি গড়ে তুলতে পারেনি। নিজেদের যতটুকু মেধা, প্রতিভা আছে সেটাও তারা ব্যয় করে সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করে কিভাবে তার প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠা যায় সেই ব্যাপারে। অন্যের কাছে পরিচয় দেওয়ার সময়ও আমি অমুক ব্যক্তির ছেলে/ মেয়ে/ জামাই/ নাতি/ নাতনি পরিচয় দিতে তারা গর্ববোধ করে।
আর এই পরনির্ভরশীল প্রবণতার একটা After effect হলো যখন তারা কোনো কারণে এই প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিচিতির গন্ডীর বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয় তখন তারা দিশেহারা বোধ করে। তাদের চরিত্রের ঘাটতিগুলো এমন তীব্রভাবে প্রকাশিত হয় যে তখন তারা সম্মান তো দূরের কথা বরং সমালোচনা, উপহাসের পাত্র হয়ে ওঠে। আর এক্ষেত্রে কিন্তু সেই বৃক্ষ যিনি তার সন্তানদের ছায়ায় রেখে তাদের ব্যক্তিত্ব বিকশিত করার সুযোগ দেননি. তাদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধের বীজ বপন করেননি তার দায়-দায়িত্বও কম নয়। কারণ তিনি এটা ভুলে গেছেন যে, পৃথিবীতে কেউই অমর নয়। তাই উত্তরাধিকারীদের জন্য আর্থিক সম্পদ নয় বরং চারিত্রিক লীগ্যাসি তৈরি করে দিয়ে যাওয়াটা বেশি জরুরী।
এক্ষেত্রে হয়তো তার মনে এই আশঙ্কা কাজ করে যে, সন্তানরা বেশি যোগ্য হয়ে গেলে তার অবাধ্য হয়ে যাবে । কিন্তু অবাধ্যতা বা অন্ধ আনুগত্য দুটোই আসলে প্রান্তিক পর্যায়ের আচরণ। আর এই দুইয়ের মাঝে ব্যালেন্স করতে শেখানো অভিভাবকদেরই দায়িত্ব।
অনেক অভিভাবক আছেন যারা নিজেদের জীবনের সব শখ-আহ্ণাদ বিসর্জন দিয়ে, নিজেদেরকে কষ্ট দিয়ে সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করেন এই আশায় যে বৃদ্ধ বয়সে সন্তান তাদের সবরকমের দায়িত্ব পালন করবে। পরবতীতে সন্তান যখন উচ্চপদে চাকুরী পায়, অভিজাত ফ্যামিলিতে বিয়ে করে- এক কথায় সে যখন উচ্চতর স্ট্যাটাসে চলে যায় তখন অনেকেই বাবা-মাকে ব্যাকডেটেড হিসেবে অবজ্ঞা করে, অনেক ক্ষেত্রে শুধু অর্থ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। এই ধরনের উদাহরণও সমাজে কম নয়। আর এই ধরনের উদাহরণ দেখেই হয়তো অনেক অভিভাবক নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে সন্তানদের যোগ্য করে না তুলে বরং তাদের জন্য আর্থিক সম্পদ তৈরিতে মনোযোগী হন, যেন সন্তানরা বৃদ্ধ বয়সে তাদের অনুগত থাকতে বাধ্য হয়।
আদতে এই দুই ধরনের আচরণই Extreme আচরণ। সন্তানদের জন্য নিজের চাওয়া- পাওয়া গুলোকে বিসর্জন দেওয়া মানে নিজেকে ঠকানো। প্রতিটা বয়সের একটা নিজস্ব চাহিদা থাকে, ফিজিকাল ও মেন্টাল ডিমান্ড থাকে। যে বয়সের যেটা ডিমান্ড সেটা পূরণ না করলে তা মনের গভীরে একটা দীর্ঘ মেয়াদী stress তৈরি করে, যা পরবর্তীতে বৃদ্ধ বয়সে বিভিন্ন ধরনের অসংলগ্ন আচরণ (যেমন- সন্তানদের সুখে ঈর্ষা বোধ করা, সবকিছুতেই তাদের ভুল ধরা, তাদের বদ দুআ দেয়া) এর মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
অাবার অনেক সন্তান মা-বাবার এই স্যাক্রিফাইসকে Taken for granted ধরে নেয়, তাদের মূল্যায়ন করে না। তাই সন্তানের জন্য নিজের জীবনের চাহিদাগুলোকে উপেক্ষা করা একটা Risky investment যার outcome প্রফিট/ লস দুটোই হতে পারে।
তাহলে ব্যালেন্স প্যারেন্টিং এর ধরন কেমন হবে?
এখানেও সমাধান রয়েছে ইসলামের কাছে। ইসলাম সবসময় আমাদের মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে শেখায়।
আমরা যদি দাউদ (আ:) এর প্যারেন্টিং থেকে শিক্ষা নেই তবে দেখব, তিনি কিভাবে নিজে রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের সন্তানের মাঝে রাজ্য পরিচালনার গুণাবলী সঞ্চারিত করার জন্য দূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছেন।
বিচারকার্য পরিচালনার সময় তিনি কিশোর সুলেমান (আ:) কে রাজসভায় বসিয়ে রাখতেন, যেন সে স্বচক্ষে বিচারকাজ দেখে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। এমনকি তিনি অনেক সময় সুলাইমান এর দেওয়া রায় মেনে নিয়েছেন- এমন উদাহরণও আছে। এভাবে তিনি শৈশব থেকেই সন্তানের মাঝে তার নিজস্ব বিচক্ষণতার উন্মেষ ঘটানোর সুযোগ করে দিয়েছেন এবং তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করেছেন।ফলশ্রুতিতে সুলাইমান (আ:) একসময় পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে রাজকর্ম পরিচালনা করেছেন এবং তার সাম্রাজ্যকে আরো বিস্তৃত করেছেন।
বিপরীতক্রমে প্রবল পরাক্রমশালী রাজার সন্তানরা উত্তরাধিকারসূত্রে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পাবার পর নিজের অযোগ্যতার কারণে পদ, রাজত্ব –দুইই হারিয়েছেন এমন উদাহরণও ইতিহাসে প্রচুর পাওয়া যায়।
তাই সন্তানের মধ্যে perfect legacy তৈরির উপায় হচ্ছে তার মধ্যে যে প্রতিভা আছে তা Identify করে তা বিকশিত করার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা এবং একটা পর্যায়ে তাকে নিজের জীবনের দায়িত্বগুলো নিজে পালন করতে দেয়া, তার উপর থেকে কর্তৃত্ব Withdraw করে নেয়া।
যদি সন্তান আসলেই বিচক্ষণ হয় তবে সে তার যোগ্যতা দিয়ে নিজের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনা করবে এবং প্রয়োজনে বাবা-মার কাছে পরামর্শ চাইবে ,আলাপ-আলোচনা করবে। আর বাবা-মা এই সময় সন্তানের জন্য দোয়া করবেন এবং তার সিদ্ধান্তের উপর আস্থা রাখবেন।
সেই সাথে নিজেদের বৃদ্ধ বয়সে নিজেরা চলার জন্য কিছু সঞ্চয় করে রাখাও বুদ্ধিমান অভিভাবকদের কর্তব্য ।সন্তানের জন্য একসময় সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে পরবর্তীতে তার উপর পুরো মাত্রায় নির্ভরশীল হওয়া আত্মসম্মান বোধের পরিচায়ক নয়। একইভাবে সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের চিন্তায় তাদের জন্য অর্থের পাহাড় গড়ে তোলাও সুবিবেচকের পরিচয় নয় কারণ সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পাহাড় ও একসময় ধ্বসে পড়ে যায়।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সুবিবেচনার সাথে মধ্যমপন্থায় সন্তান পালনের তৌফিক দান করুন। আমীন।