একজন নিলার গল্প

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

৮ ই মার্চ নারী দিবস’ আসলেই যে বিষয়গুলো নিয়ে তর্ক-বিতকের ঝড় ওঠে তার মধ্যে কিছু সাধারণ বিষয় হলো-নারীদের নারীবাদী হয়ে ওঠার পিছনের সাইকোলোজী কি? কর্মজীবী হয়ে আথিকভাবে স্বাবলম্বী হলেই কি নারীরা স্বাধীনতা অর্জন করে? যারা বাইরে কাজ না করে ফুলটাইম ঘরে সাভিস দেয় তারা কি আসলেই পরাধীন? সত্যিকারের নারী স্বাধীনতা কি আদৌ পাওয়া সম্ভব?
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে পড়তে পারেন নিচের গল্পটি।
১.
ছোটবেলা থেকেই যে নির্মম সত্যটি শুনতে শুনতে নিলা বড় হয়েছে তা হলো, সে মেয়ে হিসেবে জন্মগ্রহণ করাতে নাকি তার বাবা মন থেকে খুশি হয়নি। প্রথম সন্তান ছেলে হবে—এটা নিয়ে তার বাবার প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। প্রথম সন্তান ছেলে হলে অফিসের কলিগদের মিষ্টি খাওয়ানোর অগ্রিম প্রতিশ্রুতিও দিয়ে রেখেছিল নীলার বাবা। এরপর যখন জানতে পারলো, ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়েছে তখন মনের দু:খে মেয়ের মুখ পর্যন্ত দেখতে যাননি তিনি। একসময় নিলার নানা তাকে বললেন, “ মন খারাপ করো না। দেখবে একদিন এই মেয়েই বড় হয়ে তোমাদের মুখ উজ্জল করবে।” এই কথা শোনার পর নিলার বাবা নিলাকে কোলে তুলে নেন।

বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মায়ের মুখে এই গল্প নিলা এতবার শুনেছে যে, ছোট বয়সেই এই ঘটনা তার মনে গভীর ছাপ ফেলতে শুরু করে। ওর জন্মের ১১ মাস পরে জন্ম নেয়া বহু আকাঙ্খিত পুত্র সন্তানের প্রতি মা-বাবার পক্ষপাতীত্ব সে ছোটবেলা থেকেই অনুভব করতে পারতো। তবে এই পক্ষপাতীত্ব কখনই তার মনে ভাইয়ের প্রতি হিংসার জন্ম দেয়নি। বরং তার নানা যে কথাটি তার বাবাকে বলেছিল সেই কথাটিকে সে নিজের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে নিয়েছিল। তাই সে সবসময় নিজেকে লক্ষী মেয়ে হিসেবে প্রমাণ করতে চাইতো। ‘জন্ম হোক যথা, তথা কর্ম হোক ভালো’-এটাকে বেদবাক্য মনে করে সে ভাবতো মেয়ে হিসেবে জন্মগ্রহণ করায় যেহেতু তার কোনো হাত নেই, তাই সে তার কাজ দিয়ে প্রমাণ করবে সে কতটা ভালো সন্তান।

সমবয়সী মেয়েরা যখন বিকেলবেলা খেলতো নিলা তখন বাসায় থেকে ঘরের কাজকর্ম করে মাকে খুশী করার চেষ্টা করতো। স্রষ্টা তাকে যতটুকু মেধা দিয়েছিলেন নিজের পরিশ্রম দিয়ে সেটাকেই সে শাণিত করার চেষ্টা করতো পড়াশোনায় ভালো ফল করার জন্য। বাসার সবাই যখন ঘুমিয়ে পরতো .নিলা তখন বাথরুমের আলোয় পড়াশোনা করতো কিংবা খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে হেঁটে হেঁটে পড়া মুখস্থ করতো। ফলাফল হলো এই যে, সে ছিল দেশের স্বনামধন্য একটি গার্লস স্কুলের First girl. এস.এস.সি তেও সে চমৎকার রেজাল্ট করে পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের কাছে ব্যাপক প্রশংসা পেল। বাবার গর্বিত চেহারা দেখে সে আনন্দিত হলো এই ভেবে যে, নানার কথায় মোটিভেটেড হয়ে জীবনের যে লক্ষ্য সে ঠিক করেছিল, সেই লক্ষ্য পূরণের পথে সে সঠিকভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে।

২.
দেশের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করার পর নিলা একটি বেসরকারী এনজিও তে যোগ দিল জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বিভাগে। এখানে কাজ করতে গিয়ে সে ‘নারী স্বাধীনতা’ বিষয়ক দারুণ কিছু তত্ত্বের সাথে পরিচিত হলো। আমাদের সমাজে পুত্র (Son) হলো (Sun) এর মতো, যাকে কেন্দ্র করে পরিবারের নারীরা উপগ্রহের মতো আবর্তিত হয়, নারীদের নিজের কোনো আলো (পরিচয়) নেই, তারা পুরুষের আলোয় (পরিচিত) হয়—জেন্ডার স্টাডিজ এর এই কনসেপ্টগুলো তাকে দারুণভাবে আলোড়িত করলো। ছোটবেলা থেকেই পরিবারে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হওয়া নিলার মনে এই তত্ত্বগুলো যেন শান্তির প্রলেপ দিল। নিজের একটা আইডেন্টিটি তৈরি করে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার আশৈশব স্বপ্ন এবার তাকে মনে মনে নারীবাদী করে তুললো। অফিসের কাজের সূত্রে নারী অধিকার বিষয়ক বিষয়ক বিভিন্ন সভা, সেমিনার এ যোগ দিতে হতো। ওদের নিজের অফিসেও বিভিন্ন ট্রেনিং, কর্মশালার আয়োজন হতো। দেশের নামকরা নারী নেত্রীরা যারা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতো তাদের সামনাসামনি দেখতে পেরে, তাদের মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা শুনে সে তখন রীতিমতো বিমোহিত। নিজের কর্মদক্ষতার গুণে অফিসেও সে অল্পসময়েই জনপ্রিয় হয়ে গেল। সবমিলিয়ে নিলার দিনগুলো যেন স্বপ্নের মতো কাটছিল।

৩.
এভাবে দুই বছর কেটে যাওয়ার পর নিলা কর্মজীবী নারী জীবনের শুভংকরের ফাঁকিটা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারলো। ততদিনে পরিবার থেকেও বিয়ের জন্য চাপ দেয়া শুরু হয়েছে। বিবাহিত নারীরা পারিবারিক জীবন ও কর্মজীবন একসাথে কিভাবে সামাল দেয় তার বাস্তব অভিজ্ঞতা সে জানবার চেষ্টা শুরু করলো তার সহকমীদের কাছ থেকে। তার অফিসের বস নারী, কলিগদের অধিকাংশ নারী, এমনকি প্রতিষ্ঠান প্রধানও নারী। তাই তাদের কর্মজীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনের গল্পগুলোও সে শুনতো কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

তাদের অভিজ্ঞতা শুনে সে বুঝতে পারলো, নারীরা যতই কাজের জায়গায় সফল বা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হোক না কেন নারী হিসেবে পারিবারিক যে দায়িত্বগুলো রয়েছে সেগুলো থেকে তার কোনো অব্যাহতি নেই। গৃহস্থালীর কাজের জন্য তাকে গৃহকমীর উপর, সন্তানকে বাসায় রেখে আসার জন্য তাকে মা বা শাশুড়ির উপর, সন্তানের পড়াশোনার জন্য তাকে গৃহশিক্ষিকার উপর নির্ভর করতে হয় এবং সবাই যে সবসময় তা সানন্দে পালন করে এমনটাও নয়। এককথায় নারী হিসেবে তার পারিবারিক দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে অনেকগুলো নারীর উপর নির্ভর করতে হয়।

সবচেয়ে নির্মম যে বিষয়টি তাকে শোকাহত করলো তা হলো, যে প্রতিষ্ঠান নারী উন্নয়নের কথা বলে বিদেশ থেকে ফান্ড নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠানেই নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নেই। তার অফিসের এক নারী কলিগ যখন প্রেগনেন্ট হলো, মর্নিং সিকনেস এর জন্য যখন তার অফিসের এন্ট্রি টাইম শিথিল করার পারমিশন দেয়া হলো তখন এটা নিয়ে পুরুষ সহকমীদের বাঁকা মন্তব্য তাকে রীতিমতো অবাক করলো। এরপর যখন দেখলো, ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিতেও তার কলিগকে বাসায় থেকে অফিসের নানাধরনের কাজ পরিচালনা করতে হচ্ছে, ছুটি শেষ হওয়ার পর দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে অফিসে আনার বা লাঞ্চ টাইমে বাসায় গিয়ে ব্রেস্টফিডিং করানোর কোনো সুযোগ দেয়া হচ্ছে না, সন্তানকে বাসায় রেখে এসে অফিসেও মা কাজে মন বসাতে পারছে না, অপরাধবোধে ভুগে বারবার অশ্রুসজল হয়ে পড়ছে —তখন নিলার মনোজগতে আবার একটা আলোড়ন তৈরি হলো।
এতদিন নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নিলা হঠাৎ করেই তার সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার ছেড়ে গৃহিণী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। একদিকে স্বাধীনতা অর্জন করতে গেলে যে অন্য অনেকদিকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়—এই উপলব্ধি থেকে সে ঠিক করলো তার সংসার সে নিজেই সামলাবে, সন্তানকে একাই নিজ হাতে বড় করবে, তাকে নিজেই পড়ালেখা করাবে। তাই নিলা চাকরি ছেড়ে, পরিচিত পরিবেশ, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে, বিয়ে করে পাড়ি জমালো অন্য শহরে।

৪.
বিয়ের পরে নিলা যে পরিবারে আসলো সেই পরিবারের নারী সদস্যরা কেউ কর্মজীবী না, এমনকি শিক্ষিত হলেও চাকরি করার ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। বিয়ের আগে বাবা, বিয়ের পরে স্বামী, এরপর ছেলে -নারীদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করবে এই বিষয়টিকে এই পরিবারের নারীরা রীতিমতো তাদের অধিকার হিসেবে মনে করে। তাই পরিবার ও কর্মক্ষেত্র সামলানোর দ্বিমুখী চাপ না থাকায় তারা অনেকটা রিলাক্স মুডে থাকে। বিয়ের আগে কর্মজীবী নারীদের যৌথ দায়িত্ব পালনের চাপে হাঁপিয়ে ওঠা লাইফস্টাইল দেখে অভ্যস্ত নিলা তাদের এই রিলাক্স জীবন দেখে নিজেও কিছুটা চাপমুক্তি অনুভব করলো।

কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই আবার আশাহত হলো নিলা। দু:খের সাথে সে অবজার্ভ করলো এই পরিবার এমনকি আত্মীয়দের মাঝেও সবাই গৃহিণী নারী হওয়াতে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু খুবই একঘেয়ে। রান্না, পোশাক, সাজগোজ, পরচর্চা ছাড়া তাদের আলোচনায় কোনো বৈচিত্র নেই। এরা ঘরের বাইরের বৃহত্তর জগৎ নিয়ে চিন্তা করতে পারে না, করতে চায়ও না। সবচেয়ে কষ্টকর ব্যাপার হলো যেহেতু তারা আর্থিকভাবে পরিপূর্ণরূপে পুরুষ সদস্যদের উপর নির্ভরশীল তাই তাদেরকে নিজেদের কন্ট্রোলে রাখার জন্য তারা নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। তারা নিজেদের অজান্তেই একধরনের Sense of insecurity তে ভোগে। তাই পরিবারের পুরুষদের নিজেদের কন্ট্রোলে রাখতে পারাকে নিজের credit মনে করে।

নিলা এ ধরনের মানসিকতার সাথে পূর্ব-পরিচিত ছিল না। মা, স্ত্রী বা কন্যা হিসেবে দায়িত্ব পালন এক কথা আর তাদেরকে কন্ট্রোলে রাখার জন্য কূটকৌশল অবলম্বন করা ভিন্ন কথা। শুধু তাই নয় , বাড়ির পুরুষরা তাদেরকে কত ভালোবাসে/ কেয়ার করে সেটার বহি:প্রকাশ বোঝানোর জন্য তারা তাদেরকে কত দামী গিফট দিল, কতবার রেস্টুরেন্টে খেতে বা দর্শনীয় জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেল এসব নিয়ে প্রতিযোগীতা করে। তাদের এই শো-অফের প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকার জন্য তারা অনেকসময় পরিবারের পুরুষ সদস্যদের উপর সাধ্যাতীত চাপ প্রয়োগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। পুরুষরাও তখন গৃহশান্তি বজায় রাখার জন্য হালাল/হারাম যে কোনো পন্থায় তাদের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করে। এ যেন অধিকার আদায়ের নামে মানসিক নির্যাতনের আরেক রূপ।

এতদিন শুধু নারীর অধিকার আদায় নিয়ে আন্দোলন করা নিলা এবার নারীর স্বেচ্ছাচারিতার এই রূপ দেখে বিব্রত হলো। সমাজে এ ধরনের নারীর অস্তিত্বও যে কম নয়, তা এই পরিবারে বিয়ে না হলে নিলা বুঝতে পারতো না। নিজের চরিত্রের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এসব নারীদের সাথে মিশতে গিয়ে নিলা হাঁপিয়ে গেল। সে সিদ্ধান্ত নিল শুধু আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য যেটুকু প্রয়োজন তার বেশি সময় সে এদের সাথে কাটাবে না। ধরি মাছ , না ছুঁই পানি—এই নীতিতে সে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা শুরু করলো। এভাবে অনেকের মাঝে থেকেও নিলা ক্রমশ একা হয়ে পড়লো।
৫.
নিলার জীবনের একাকীত্ব দূর হলো যখন সে একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের মা হলো। মেয়ে হওয়াতে যথারীতি নিলার শ্বশুরবাড়ির লোকজন মন খারাপ করলো যেহেতু তাদের একমাত্র ছেলের বংশের প্রদীপ রক্ষা হলো না। কিন্তু নিলা তাদের দু:খবোধকে পাত্তা দিল না। সে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিল এই ভেবে যে, তার নি:সঙ্গ জীবনে তার কন্যা সন্তান হবে তার বন্ধুর মতো। তাকে সে তার নিজস্ব আদর্শ দিয়ে বড় করে তুলবে, নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো রিপিট হতে দিবে না।

’মা’ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে গিয়ে নিলা আরও অনেকগুলো বিষয় উপলব্ধি করলো। ‘মা’ হওয়া যে শুধু নারী হিসেবে প্রাকৃতিক দায়িত্ব পালন তা নয় বরং মাতৃত্ব যে একটা উপভোগের বিষয় এটা সে অনুধাবন করতে পারলো। ’ব্রেস্ট ফিডিং’ করানোর সময় সন্তানের সাথে যে ইন্টিমেসি তৈরি হয়, সন্তানকে হাসতে দেখলে, হাঁটতে দেখলে, কথা বলতে দেখলে মনে যে আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয়, সন্তান কাঁদলে, অসুস্থ হলে মনে যে উদ্বেগের অনুভূতি তৈরি হয়—এগুলো উপভোগ করার জন্য একজন নারীর জীবনের এই সময়ের ফোকাসটা পূর্ণরূপে সন্তানের প্রতি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন।
হয়তো স্বল্প সময়ের জন্য অন্য কেউ সন্তান প্রতিপালনের কাজে হেল্প করতে পারে , তবে মা যদি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে সন্তানকে জন্মের পর থেকে অন্তত তার শৈশব পর্যন্ত নিজে প্রতিপালন করেন তবে সন্তানের সাথে তার যে বন্ডিং তৈরি হয় তার সুফল বাকী জীবন পাওয়া যায়। এই উপলব্ধিগুলো নিলাকে অন্যরকম প্রশান্তি দিল। সামাজিক চাপকে উপেক্ষা করে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলা যে ভুল করেনি তা সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করলো।

৬.
এভাবে ৪ বছর কেটে গেল। নিলার মেয়েকে এখন স্কুলে দেয়ার বয়স। যেহেতু নিলা নিজেই বরাবর ভালো ছাত্রী ছিল তাই ভালো রেজাল্ট করার টেকনিকগুলো তার জানা ছিল। কিন্তু এত বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে । তাই মেয়েকে নিজে পড়াতে হলে আগে নিজেকে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পকে জানতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে নিলা মেয়েকে যে স্কুলে ভর্তি করলো নিজেও সেখানে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলো। ৬ বছরের গৃহিণী জীবন শেষে আবার কর্মজীবনে প্রবেশ করা, তাও আবার ভিন্ন পেশায় -এটা ছিল নতুন একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বরাবরই নতুন চ্যালেঞ্জ জয় করতে ভালোবাসা নিলা তার নতুন পরিচয়ের সাথেও এডজাস্ট করে নিল। মা-মেয়ে একসাথে স্কুলে যায়, আসে, সন্ধ্যায় একসাথে পড়াশোনা করে –এই রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে গেল নিলা। এভাবেই কেটে গেল আরও ৬ বছর।

কিন্তু জীবন তো কোনো নি:স্তরঙ্গ নদী নয়, যে একইভাবে বয়ে যাবে। বরং জীবন এক উত্তাল সমুদ্রের মতো যেখানে একের পর এক ঢেউ এসে তীরে গড়ে তোলা সাজানো ঘরকে ভেঙ্গে দিয়ে যায়। তাই নিলার জীবনেও আবার ছন্দপতন ঘটলো।

৬ বছর দক্ষতার সাথে শিক্ষকতা করার পর নিলাকে এবার স্কুল থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হলো কো-অর্ডিনেটর হিসেবে। এই দায়িত্ব পেয়ে নিলা স্কুলের পড়াশোনার মাননোন্নয়ন ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিল। এছাড়া স্কুলের নারী শিক্ষিকাদের সুবিধার জন্য বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন সময়ে তারা যেন special preference পায় সেজন্য কিছু নিয়ম প্রবর্তন করার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার এসব সাহসী পদক্ষেপ স্কুলের শিক্ষকদের অনেকেই পছন্দ করলো না। বিশেষ করে সিনিয়র কিছু পুরুষ শিক্ষক তার বিরোধীতা করলো এবং জুনিয়র কিছু নারী শিক্ষিকাও তাদেরকে সাপোর্ট দিল। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ও সহকারী প্রধান শিক্ষিকা নারী হলেও তারা নিলার এসব পদক্ষেপের পক্ষ না নিয়ে বরং নিশ্চুপ থাকলেন।
সবার অসহযোগীতায় হতাশ নিলা আবারও বুঝতে পারলো জেন্ডার স্টাডিজ এর সেই তত্ত্বের কথা-”অবস্থা আর অবস্থান এক নয়। আর্থিক স্বচ্ছলতা অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে কিন্তু অবস্থানের পরিবর্তন তখনই ঘটে যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। ”

বাস্তবিকই Decision making position এ নারীরা যে কত পিছিয়ে আছে নিলা তা আবারও অনুভব করলো। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদগুলোতে নারীদের আসন অলংকার করা যে শুধুমাত্র শোভা বর্ধন মাত্র, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো যে পর্দার অন্তরালে থেকে পুরুষরাই নেন—এই তিক্ত সত্যের বাস্তব উদাহরণ দেখতে পেল নিলা। কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন লড়াই করার বিরক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য নিলা আবারও চাকরি ছেড়ে দিল। মেয়েকেও অন্য স্কুলে ট্রান্সফার করে নিল।

এভাবে বারবার কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রকৃত অবস্থার স্বরূপ দেখে ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়া নিলা তবে কি এবার ডিপ্রেশনে ডুবে যাবে? নিজের জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে যাবে? নাকি ফিনিক্স পাখির মতো আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে??

৭.
ঘরে ও বাইরে বিবিধ নারীদের বিবিধ স্বরূপ দেখে অভিজ্ঞ নিলা এখন চল্লিশোর্ধ ধীর স্থির এক রমণী, সমাজের নির্ধারণ করে দেওয়া তথাকথিত সফল নারীর মানদণ্ডে যে নিজেকে আর পরিমাপ করে না। নিজের সুখের সংজ্ঞা এখন সে নিজেই রচনা করে।
জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে সে বুঝে গেছে, একজন মেয়ে কখনোই নারীবাদী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না। পরিবারে লিঙ্গ বৈষম্যের তিক্ত অভিজ্ঞতা তার মনে নারীবাদের বীজ বপন করে, তারপর সামাজিক চাপ, মিডিয়ার প্রভাব সেই বীজকে আরো ডালপালা বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। কিন্তু আদতে সমাজের সংজ্ঞায়িত নারীবাদের মূল কনসেপ্টটাই ভুল। নারীবাদ তাকে পুরুষের সমকক্ষ হবার জন্য প্ররোচিত করে; অথচ সৃষ্টিগতভাবে নারী ও পুরুষের শারীরিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলাদা। তাই নারী হয়ে পুরুষের মতো হতে চাওয়া জলের মাছ হয়ে আকাশের পাখির মত উড়তে চাওয়ার মতোই অবাস্তব একটা যাত্রা, যে যাত্রার কোন সফল সমাপ্তি নেই। মাঝখান থেকে নারীর জীবনীশক্তিটুকু নি:শেষ হয়ে যায়।

যেখানে নারীবাদ এর মূল ফোকাস হওয়া উচিত ছিল নারীর নিরাপত্তা, সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সেখানে নারীদের ফোকাস পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার মতো একটি অসম্ভব বিষয়ের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বরং নারীত্বকে অবমাননা আর পুরুষকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। নিলা এখন আর এই ভ্রান্ত নারীবাদেরদের প্রলোভনে প্রলব্ধ হয় না।
সে বিশ্বাস করে রিজিকের মালিক আল্লাহ আর তিনি পুরুষ জাতিকে নারীদের জন্য সে রিজিক সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদেরকে দ্বিগুণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করেছেন এজন্য যে, সে নিজের স্ত্রী, সন্তানের পাশাপাশি মা ,বাবা ,ভাই, বোনের দায়িত্বও পালন করবে। কিন্তু তাই বলে পুরুষ জাতিকে নিজেদের চেয়ে সুপার Superior ভেবে তাদের মতো হতে চাওয়া বা ছলে-বলে-কৌশলে তাদেরকে নিজেদের কন্ট্রোলে রাখতে চাওয়ার চেষ্টা করা নারীর জন্য বরং অপমানজনক।

কোনো পুরুষ যদি নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে বা তার বিনিময়ে নির্যাতন, অপমান করে তবে তাকে উপেক্ষা করে সরাসরি রিজিকের মালিকের কাছে দোয়া করতে হবে। তিনি যে কোনো মাধ্যমে ধারণাতীত উৎস থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করে দিতে সক্ষম। অর্থাৎ ’মাধ্যমে’র প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে ’মালিকে’র সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে সচেষ্ট হতে হবে । তাহলে তিনিই তার সৃষ্টির দায়িত্ব নিবেন ।

একজন নারীকে গৃহিনী বা কর্মজীবী যে ভূমিকাই বেছে নিতে হোক না কেন তার নিয়ত যদি থাকে স্রষ্টার সন্তুষ্টি তবে স্রষ্টাই তার জীবনে বারাকাহ ঢেলে দিবেন। অনেক নারী অর্থ উপার্জন না করেও সম্মান পান আবার অনেকে অর্থ ব্যয় করেও সম্মান পান না। সম্মান দেয়ার মালিক যিনি তার কাছে সম্মান চাইতে হবে।
জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এই শিক্ষাগুলো গ্রহণ করে নিলা এখন বেশ ভালো আছে। সমাজের চোখে তার অবস্থান যাই হোক না কেন, তার মনে একটা অদ্ভূত ‘সুকুন’ আছে। সৃষ্টিকর্তা তাকে যে মেধাটুকু দিয়েছিলেন সেটা কাজে লাগিয়ে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে এমন কিছু কাজ করার যা মৃত্যুর পর তার জন্য সাদকায়ে জারিয়া হবে।

৮.
নিজের মেয়েকে সে কৈশোর থেকেই একজন কনফিডেন্ট নারী হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, যে নারী হিসেবে কখনও অন্যের মতো হতে চাইবে না বরং নিজের নারী পরিচয় নিয়ে গর্বিত হবে। সে তাকে শেখাচ্ছে—
• তাকে রান্না করা, ঘর গোছানোর মতো কাজগুলো শিখতে হবে এজন্য যে- এগুলো তার নিজের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। এজন্য না যে, এগুলো ভালো মতো পারলে তার ভালো বিয়ে হবে, শ্বশুরবাড়িতে কথা শোনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
• তাকে নিজের চুল, ত্বক, শরীরের যত্ন নেয়া, পরিপাটি হয়ে সাজগোজ করা শিখতে হবে এজন্য যে- এগুলো তার শরীর ফিট রাখবে, মনকে প্রফুল্ল রাখবে। এজন্য না যে, সুন্দর, আকর্ষণীয় হলে পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টি অর্জন করা যাবে।
• তাকে বাজার করা, ব্যাংক, হাসপাতাল ম্যানেজ করা শিখতে হবে এজন্য যে- এগুলো তাকে যেকোনো বিপদজনক পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাহায্য করবে। এজন্য না যে, এগুলো তাকে পুরুষের সমকক্ষ করে তুলবে।
• তাকে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রযুক্তি এসব বিষয়েও জ্ঞান রাখতে হবে এজন্য যে- এগুলো তাকে চলমান বিশ্ব সম্পর্কে আপটুডেট রাখবে। এজন্য না যে, এই জ্ঞান তাকে প্রগতিশীল নারীর তকমা দিবে।
• তাকে একটা নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, একটা স্পেশাল স্কিল ডেভেলপ করে মিনিমাম একটা অ্যামাউন্টের অর্থ উপার্জনে সক্ষম হতে হবে এজন্য যে, এই অর্থ দিয়ে সে তার শখ পূরণ করতে পারবে, প্রিয়জনকে উপহার দিতে পারবে, কাউকে সাদাকাহ করতে পারবে। এজন্য না যে, অর্থ উপার্জনের সক্ষমতা তাকে ডেসপারেট করে তুলবে।

এককথায় নারীর সকল দক্ষতা, যোগ্যতা অর্জন হবে তার নিজের ভালো থাকার জন্য। তার ভালো লাগার নিয়ন্ত্রণ থাকবে তার নিজের কাছে। Do not put the key to your happiness in someone else’s pocket.
আর দাসত্ব বা জবাবদিহিতা যদি করতেই হয় তবে তা হবে একজন মহান স্বত্ত্বার কাছে। যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার কাছে শেষ পর্যন্ত তাকে ফিরে যেতে হবে। মাঝখানের এই সময়টুকুতে তার ভালো থাকার নিয়ন্ত্রক হবে সে নিজেই। আর চূড়ান্ত ও অনন্ত স্বাধীনতা—সে তো জান্নাতে পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

Disclaimar: যারা জানতে চেয়েছেন, ‘একজন নিলার গল্প’, লেখিকার নিজের জীবনকাহিনী কিনা, তাদের জন্য বলছি, এটা একজনের জীবনের সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা। এত বৈচিত্র্যময় জীবনের চিত্রনাট্য লেখা মানুষের পক্ষে সম্ভব না, যদি না স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা কারও জীবনকে এভাবে ডিজাইন করেন। এটা জানা জরুরী নয় যে, গল্পের নিলার বাস্তব পরিচয় কি? আমরা বরং নিলার জীবনের গল্প থেকে কিছু শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করতে পারি।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন