প্যারেন্টিং কি বই পড়ে/ লেকচার শুনে/ কোর্স, ওয়ার্কশপ করে শেখার মতো কোনো বিষয়? আমাদের নানী-দাদীরা কি এসব না করেই ১২-১৩টা বাচ্চা লালন-পালন করেন নাই? তাদের বাচ্চারা কি মানুষ হয় নাই? কেন এই জেনারেশনের মা-বাবাকে ১-৩ টা বাচ্চা প্রতিপালন করতেই পেরেশান হতে হচ্ছে? কেন এই বিষয় নিয়ে এত তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করতে হচ্ছে? এটা কি মা-বাবাদের ব্যর্থতা নাকি এ যুগের বাচ্চারাই বদলে গেছে? প্যারেন্টিং নিয়ে এত মাতামাতি কি Alarming নাকি Positive?
—–এই প্রশ্নগুলোর কোনো ’ইয়েস/ নো’ উত্তর নেই, বরং প্রশ্নগুলো নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ আছে।
আমার নিজের অনলাইন পেইজ থেকে প্রচুর প্যারেন্টিং বিষয়ক বই সেল হয় আলহামদুলিল্লাহ। এইসব ক্রেতাদের বয়স, পেশা প্রভৃতির ট্রেন্ড দেখে একটা বাস্তবতা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি যে, আসলেই এই জেনারেশনের মা-বাবারা প্যারেন্টিং নিয়ে suffer করছেন। তাই তারা এই বিষয়ক রিসোর্স খুঁজছেন গুড প্যারেন্ট হওয়ার জন্য। এবার এই বাস্তবতার পেছনের কারণগুলো একটু পর্যালোচনা করার চেষ্টা করি, লেখার শুরুতে করা প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করি।
আমাদের নানী-দাদীদের আমলে তারা ১২-১৩ জন বাচ্চার মা/বাবা হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তারা একা হাতে তাদের সবাইকে বড় করেছেন ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা প্রথম ৩-৪ জন বাচ্চার take care নিজেরা করেছেন এবং পরের বাচ্চাদের take care তাদের বড় ভাই-বোনরা করেছেন। এজন্য দেখা যায় আমাদের নানী-দাদী দের সাথে বড়/মেঝ, সেজো মামা/খালা/চাচা/ফুপুদের যে বন্ডিং ছিল পরবর্তী ছেলে-মেয়েদের সাথে ততোটা ছিল না। ছোটরা বরং তাদের বড় ভাই-বোনদের সাথেই বেশি comfortable. যদিও সেই যুগে তারা early age এই মা-বাবা হতেন, তারপরও শেষের দিকের ছেলে-মেয়েদের বড় করার সময় তারা নিজেরাও বয়স্ক হয়ে যেতেন, সাংসারিক নানা দায়িত্ব ও কর্তব্যের ভীড়ে জর্জরিত হয়ে থাকতেন। তাই শেষের দিকের ছেলে-মেয়েদের তারা নিজেরা take care করার এনার্জি থাকতো না।
এছাড়া তাদের সবচেয়ে বড় পজিটিভ সাপোর্ট ছিল তারা একক পরিবারে থাকতেন না, যৌথ পরিবারে থাকতেন। প্রতিটি সন্তানের সাথে One to one প্যারেন্টিং করতে না পারলেও পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়দের কাছ থেকে, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে, সার্বিকভাবে সামাজিক আবহ থেকেই তাদের সন্তানরা ভালো মানুষ হবার শিক্ষা পেত। বড়দের শ্রদ্ধা করা, ছোটদের যত্ন নেয়া, ভদ্রতা, নম্রতা, সততা ও নৈতিকতার মতো বেসিক মূ্ল্যবোধগুলো তাদের চরিত্রে প্রোথিত হয়ে যেত সহজেই। আমি খুব অবাক হয়ে খেয়াল করে দেখি, আমাদের নানী/দাদীরা তথাকথিত শিক্ষিত, উপার্জনক্ষম, উজ্জল ক্যারিয়ারের নারী না হয়েও আমাদের বাবা/চাচা/ মামাদের কাছ থেকে যে সম্মান পেতেন, তারা তাদের ‘মা’ বলতে যেভাবে অজ্ঞান ছিলেন এই যুগের উচ্চশিক্ষিত, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী, সফল ক্যারিয়ারের নারীরাও তাদের সন্তানদের কাছ থেকে সেই সম্মান/ভালোবাসা পান না। এর কারণ বোধহয় এটাই যে, মায়ের পা এর নিচে বেহেশত—এটা তারা অন্তরের গভীর থেকে বিশ্বাস করতেন।
তবে গুড প্যারেন্ট হতে না পারার শতভাগ দায় কি এই জেনারেশনের উপর পুরোপুরি বর্তায়? আমার তা মনে হয় না। মাঝখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। আমাদের মা-বাবাদের জেনারেশনের অপারগতার কিছুটা দায় আছে। আমাদের মা-বাবাদের অধিকাংশই তাদের শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন গ্রামে/মফস্বলে। তারা নিজেরা ঠিকই অনেক ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের মাঝে বড় হয়েছেন, একটা সুশৃঙ্খল পারিবারিক ও সামাজিক আবহের মাঝে থাকায় বেসিক চারিত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে উঠেছেন। কিন্তু এরপর যৌবনে পড়াশোনা এবং কর্মসূত্রে তারা যখন শহরে এ্সে settle হয়েছেন, শহরের প্রতিযোগীতামূলক জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য ২-৩ জন সন্তান নিয়ে একক পরিবার গঠন করেছেন তখন তারা ভেবে নিয়েছেন তাদের সন্তানরাও তাদের মতোই বেসিক লাইফ স্কিল ও চারিত্রিক মূল্যবোধগুলো By default শিখে যাবে। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই তারা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শহরে বাড়ি, গাড়ি করতে এতটাই মনোযোগী থেকেছেন যে, প্যারেন্টিং এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত রয়ে গেছে। সন্তানদের ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানো, ভালো ক্যারিয়ার করার জন্য অন্যান্য দক্ষতা শেখানোই তাদের কাছে মূখ্য হয়ে উঠেছিল।
ফলাফলস্বরূপ তাদের সন্তানরা অর্থ্যাৎ এই জেনারেশনের মা-বাবারা শিক্ষা-দীক্ষায়, ক্যারিয়ার গঠনে চৌকস হলেও নিজেরা পারিবারিক জীবনে সন্তান প্রতিপালন করতে গিয়ে দেখছে যে, এইসব বিষয়ে তাদের বেসিক জ্ঞান নেই। তারা নিজেরাই একক পরিবারে প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে বড় হওয়ায় অনেক মৌলিক বিষয় জানে না। আজ যখন তারা সন্তান প্রতিপালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তখন সবচেয়ে বেশি কটাক্ষের শিকার হচ্ছে আবার তাদের মা-বাবার কাছ থেকেই। তারাই এই ডায়লগ দিচ্ছে যে, ‘বাচ্চা পালা আবার টাকা খরচ করে শিখতে হয় নাকি!! আমরা, আমাদের মা-বাবারা তো এমনি এমনিই পারছি!!!” কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন যে, এমনি এমনিই কেউ কিছু শেখে না, বেসিক লাইফ স্কিল ও চারিত্রিক মূল্যবোধ এর লিগ্যাসি পরবর্তী জেনারেশনের মাঝে কন্টিনিউ করতে পারাটাও প্যারেন্টিং এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেটা মাঝের জেনারেশন মিস করে গেছেন।
আমি বরং তাই এই জেনারেশনের মা-বাবাদের প্রতি sympathy ফিল করি। তাদের এই গুড প্যারেন্ট হওয়ার জন্য effort দেয়াটাকে পজিটিভ ভাবে দেখি। তাছাড়া এটাতো স্বীকার করতেই হবে যে, এই সময়ের মা-বাবাদের যা যা চ্যালেঞ্জ ফেইস করতে হচ্ছে তা আগে ছিল না। ফ্রি-মিক্সিং, স্ক্রিন অ্যাডিকশন, পর্নোগ্রাফি, সমকামীতা, তথ্য বিকৃতির মতো বিষয়গুলো যেহেতু আগে এতটা সহজলভ্য ছিল না তাই এসব থেকে সন্তানদের বাঁচানোর জন্য প্যারেন্টিং এর Tips and Tricks শেখার কোনো বিকল্প নেই। সেই সাথে লাইফ স্কিলের মতো আপাতদৃষ্টিতে গৌণ কিন্তু নিজে সংসার করতে গেলে মূখ্য হয়ে ওঠা বিষয়গুলো সন্তানদের শেখানোর জন্যও গাইডলাইন দরকার।
সময়ের সাথে পরিস্থিতি বদলায়। আর এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সময়োপযোগী কর্ম -কৌশল অনুসরণ করাও সচেতন ও স্মার্ট প্যারেন্টিং এর লক্ষণ। তাই এই জেনারেশনের মা-বাবাদের বলবো, “আমি ভালো মা-বাবা নই”— এই ডিপ্রেশনে না ভুগে বরং ভালো মা-বাবা হওয়ার চেষ্টাটুকু করি, স্রষ্টার কাছে দুআ করি। বাকীটুকু আল্লাহ ভরসা ইনশাআল্লাহ।