প্যারেন্ট হওয়ার পর নিজের প্যারেন্টদের সাথে আচরণ

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

প্যারেন্টিং এর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, আমি আমার সন্তানদের সামনে আমার প্যারেন্টদের সাথে কেমন আচরণ করছি সেটা। শিশুদের স্বভাবের দুটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা `দেখে শিখে’ এবং তারা `অনুকরণপ্রিয়।’ তাই আমি আমার প্যারেন্টদের সাথে কেমন আচরণ করছি তা দেখে আমার সন্তানদের মনে একটা মাইন্ডসেট তৈরি হবে এবং ভবিষ্যতে তারাও সেই অনুযায়ী আমার সাথে একই রকম ব্যবহার করবে —– এই সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং নিজের সন্তানদের সামনে নিজের প্যারেন্টদের সাথে ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে।

মানুষের যত বয়স বাড়ে ততোই সে শিশুর মতো হয়ে যায়— সমাজে প্রচলিত এই কথাটি সত্য হলেও শতভাগ সত্য নয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মা-বাবা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়, শিশুদের মতোই তারা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে – এই ব্যাপারটি সত্য হলেও শিশুদের সাথে তাদের পার্থক্য হলো, শিশুদের মধ্যে ইগো বা আত্মসম্মানবোধ ততোটা নেই কিন্তু বৃদ্ধ মা-বাবার মধ্যে এই বোধটি প্রবলভাবে কাজ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা তাদের চাওয়া-পাওয়াগুলো মন খুলে প্রকাশ করতে পারে না বা তারা যেটা বাইরে প্রকাশ করে সেটা তাদের মনের আসল অনুভূতি নয়। আর এই জায়গাতেই সন্তানদের সাথে তাদের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়।

আমাদের একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে, আমাদের জেনারেশনের মা-বাবাদের অধিকাংশই Self-made জেনারেশন। তারা গ্রাম থেকে শহরে এসে চাকুরি, ব্যবসা করে নিজেদের সংসার চালিয়েছেন, সন্তানদের শিক্ষিত করেছেন, মা-বাবা, ছোট ভাই-বোনদের আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন আবার শেষ বয়সে নিজেদের থাকার জন্য একটা মাথা গোঁজার ঠাঁইও করেছেন। তো এই জেনারেশনের ইগো, আত্মসম্মানবোধ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আজ হয়তো বয়সের ভারে তাদের শরীর চলে না, সমবয়সী প্রিয়জনদের অনেককেই হারিয়ে ফেলায় তাদের মানসিকভাবে একাকীত্ববোধ হয় কিন্তু প্রবল আত্মসম্মানবোধের কারণে তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করতে সংকোচবোধ করেন। আর এভাবে প্রকৃত অনুভূতি গোপন করতে করতে একসময় তাদের প্রকাশভঙ্গী হয়ে যায় মনের অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। কখনও অভিমানের মাধ্যমে, কখনও বা খিটখিটে মেজাজের মাধ্যমে তারা তাদের আবেগ প্রকাশ করেন।

তাই এধরনের আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন প্যারেন্টদের সাথে Deal করার জন্য নিজেদেরকে কৌশলী হতে হবে। তাদের জন্য ভালো কোনো খাবার রান্না করে নিয়ে গেলে কিংবা ভালো ব্র্যান্ডের পোশাক কিনে নিয়ে গেলে তারা হয়তো সেটা দেখে উচ্ছাস প্রকাশ করবে না, টাকার অপচয় বলে তিরস্কার করবে, কিন্তু তাদের এই আচরণে হতাশ হওয়া যাবে না। বরং এটা নিশ্চিত থাকতে হবে যে, তাদের সামনে থেকে চলে আসার পরপরই তারা এই বিষয়গুলো নিয়ে নিজের ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে গল্প করবে। অন্যদেরকে ঠিকই আনন্দিত চিত্তে বলবে যে, তাদের কোন ছেলে-মেয়ে তাদের জন্য কি কি করেছে। এই যে অন্যদের কাছে গল্প করতে পারার সুখ – এটাতেই তাদের আনন্দ।

দ্বিতীয় যে কৌশল প্রয়োগ করতে হবে তা হলো, নিজের সন্তানদের সাথে অর্থ্যাৎ নাতি-নাতনিদের সাথে তাদের সময় কাটাতে দিতে হবে, বন্ডিং তৈরি হতে দিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো তাদের মানসিকতার সাথে হয়তো আমাদের মানসিকতা মিলবে না, তারা নানা-নানী, দাদা-দাদী হিসেবে তাদের যে লেসন দিতে চাইবে আমরা হয়তো মা-বাবা হিসেবে নিজের সন্তানদের সেই শিক্ষা দিতে চাইবো না, তবে এ ক্ষেত্রেও সন্তানদের সামনেই তাদের Grandparent দের সামনে কিছু না বলে পরে সন্তানদের আলাদা করে এমনভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে যেন তাদের সম্মান নষ্ট না হয়।

আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ নষ্টালজিক হয়ে যায়। শৈশব-কৈশোরে বড় হওয়ার স্থান, সেখানকার পরিবেশ, মানুষজন সবকিছুর স্মৃতি তাদের মনে আবার উজ্জল হয়ে উঠতে থাকে। তাই সেসব জায়গায় ফিরে যাওয়ার জন্য, সেসব মানুষের সাথে কথা বলার জন্য তাদের মন উচাটন হয়। সম্ভব হলে তাদের স্মৃতিবিজড়িত জায়গায় ঘুরতে ‍নিয়ে যাওয়া বা তাদের পরিচিত মানুষদের সাথে নতুন করে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হতে পারে তাদের জন্য অন্যরকম উপহার।

এমনকি তাদের আচার-আচরণ, পোশাক, সাজ-সজ্জাতেও তারা পুরনো সময়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন নিজেদের অজান্তেই। তাই হয়তো আমাদের শৈশব-কৈশোরে অর্থাৎ তাদের যৌবনে আমরা যাদেরকে ফিটফাট, স্মার্ট হিসেবে দেখেছি, বৃদ্ধ বয়সে তাদের অনেক চাল-চলনেই একটা ঢিলেঢালা ভাব এসে পরে। আমাদের, আমাদের সন্তানদের চোখে তখন তাদের খ্যাত, আনস্মার্ট লাগে। এক্ষেত্রে নিজেকে তো বটেই, নিজের সন্তানদেরও বোঝাতে হবে যে, বয়স হয়ে গেলে পুরনো চালচলনে ফিরে যাওয়া মানবজীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং আমাদের সবাইকে একদিন এই পর্যায়ে পোঁছতে হবে। তাই নিজেদের মানসম্মানের কথা চিন্তা না করে বরং এই সময় তাদের মেন্টাল এবং ফিজিকাল Relaxation কে প্রাধান্য দিতে হবে।

সবশেষে বলতে চাই, প্যারেন্ট হিসেবে সন্তান প্রতিপালন যতটা challenging তার চেয়েও বেশি challenging হলো নিজের বয়স্ক প্যারেন্টদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। তাদের বৃদ্ধ বয়সের মনস্বত্ত্ব বুঝে তাদের সাথে সেই অনুযায়ী সদ্ব্যবহার করা খুবই tough. আর এজন্যই বোধহয় বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা করার জন্য আল্লাহ তায়ালা এতটা সওয়াব রেখেছেন, কারণ যে পরীক্ষা যত কঠিন, তার পুরষ্কারও ততো লোভনীয়।

মহান আল্লাহ যেন আমাদের সন্তানদের সামনে নিজেদেরকে আদর্শ সন্তানের ভূমিকা সঠিকভাবে পালনের তৌফিক দান করেন।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন