প্যারেন্ট যখন সন্তানের অকল্যাণ ডেকে আনে !!

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

লেখার শিরোনাম পড়ে হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে মা-বাবা কি আদৌ কখনও সন্তানের অকল্যাণ চাইতে পারে? দু:খজনক হলেও সত্যি যে, বাবা-মা সজ্ঞানে সন্তানের  অমঙ্গল কামনা না করলেও তাদের অনেক কথা ও কর্মকান্ড তাদের অজান্তেই সন্তানের জীবনে দুর্দশা ডেকে আনতে পারে। কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যাক।

প্রতিটি মা-বাবা তার সন্তানের যে কোনো সাফল্যে গর্বিত হন, সন্তান ভালো কিছু অর্জন করলে সবাই তার প্রশংসা করবে এটা মনে মনে প্রত্যাশা করেন। কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন মা-বাবা নিজেরাই সার্বক্ষণিক অন্যের সামনে নিজের সন্তানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে থাকেন। আমার ছেলে/মেয়ে পড়াশুনায়/ খেলাধুলায়/ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে খুব ভালো, আমার ছেলে/মেয়ে খুব শান্ত/বাধ্য, আমার ছেলে/মেয়ে খুব ধার্মিক ইত্যাদি ইত্যাদি…প্রশংসা যখন মা-বাবা অন্যদের সামনে বিশেষ করে অন্য অভিভাবকদের সামনে বারংবার করতে থাকেন তখন তাদের অজান্তেই তাদের সন্তানদের উপর বদ নজর লাগে। বিশেষত: যাদের নিজের সন্তান নেই বা যাদের সন্তানের জীবনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই তাদের সামনে বারবার নিজের সন্তানের প্রশংসা করলে সন্তানের বদ নজর লাগার সম্ভাবনা প্রবল ।

এছাড়াও একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, শয়তানের অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে হিংসা। হিংসার আগুন জ্বালিয়ে অন্যের ক্ষতি করার জন্য শয়তান সবসময় মানুষকে প্ররোচিত করে। সবাই এই ফাঁদে পা দিয়ে অন্যের ক্ষতি করতে তৎপর না হলেও অনেকের হৃদয় নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাস অনেক সময় সফল ব্যক্তির জীবনে দুর্দশা বয়ে আনতে পারে। এ কারণেই আল্লাহ’তাআলা `সূরা ফালাক’ এ হাসাদ বা হিংসা থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলেছেন । তাই সচেতন মা-বাবার উচিত সন্তানের উচ্ছসিত প্রশংসা করে অন্যের মনে হিংসার আগুন উসকে না দিয়ে বরং সন্তানের সাফল্যের জন্য তাকে নীরবে পুরস্কৃত করা, তাকে বিনয়ী হতে শেখানো এবং সর্বপরি মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা।

বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সন্তান, বিশেষ করে শিশুদের বিভিন্ন ছবি, ভিডিও পোস্ট করার মাধ্যমে অভিভাবকরা তাদের জীবনে অকল্যাণ বয়ে আনার কারণ হতে পারেন। সন্তানদের সুন্দর ছবি, ভিডিও পোস্ট করার কিছুদিন পরেই সে অসুস্থ হয়েছে এমন উদাহরণ বাস্তব জীবনে বহুবার ঘটেছে। তাই অভিভাবকদের উচিত সন্তানের মঙ্গলের স্বার্থেই সন্তানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় শো-অফ করার লোভ সংবরণ করা।

এছাড়া সন্তানকে বদ নজর থেকে রক্ষা করার জন্য সকাল-সন্ধ্যা মাসনুন দোয়া, আয়তুল কুরসি, তিন কুল পড়ার অভ্যাস নিজে করা এবং সন্তানকে শেখানো অভিভাবক হিসেবে আমাদের অবশ্য কর্তব্য।

দ্বিতীয় যে উপায়ে মা-বাবা সন্তানের জীবনে অকল্যাণ ডেকে আনতে পারেন তা হলো, বদদুআর মাধ্যমে। অনেক সময় সন্তানের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত/ ক্ষুব্ধ হয়ে আভিভাবকরা তাকে বদদুআ দিয়ে ফেলেন। “তুই আমাকে যেভাবে জ্বালাচ্ছিস, তোর সন্তানও তোকে এভাবে জ্বালাবে, আমাকে কষ্ট দেয়ার ফল তুই জীবদ্দশাতেই পাবি”— এরকম অনেক অভিশাপমূলক কথা মা-বাবা রাগের বশে সন্তানকে বলে ফেলেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নাবালক অবুঝ সন্তানকেও তারা এ ধরনের কথা বলে ফেলেন, যা পরবর্তীতে সন্তানের জীবনে সত্য হয়ে যায়।

 বাবা- মা যখন বলেন তখন হয়তো রাগ করে বলেন, মন থেকে বলেন না কিন্তু তাদের মুখ নিঃসৃত এসব কথা যখন সত্যি হয়ে যায় তখন আফসোস করেও কোন লাভ হয় না। মনে রাখা জরুরী যে, সন্তানের জন্য মা-বাবার ভালো দুআ যেমন কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তেমনই তাদের বদদুআ/ অভিশাপও কবুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সাময়িক রাগ/ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে কখনোই সন্তানকে বদদুআ দেওয়া উচিত নয়।

সবশেষে যে উদাহরণটা দিব, তা হয়তো অনেক বাবা-মা’ই মানতে চাইবেন না, কিন্তু এটা সত্যি যে সম্পূর্ণ ভুল বিশ্বাসের কারণে মা-বাবা সন্তানের সুরক্ষা এবং সাফল্যের নিয়তে এমন কিছু কাজ করেন যা আদতে তাদের ইহকাল ও পরকাল উভয়ের জন্য একটা অকল্যাণের চক্র তৈরি করে। আর এসব কাজ হলো সন্তানকে কালো টিপ দেয়া, গিট দেয়া কালো/লাল সুতা পরানো, তাবিজ ঝুলানো, পাথর বসানো আংটি, লকেট পরানো ইত্যাদি ।

এগুলো পরালে হয়তো সাময়িকভাবে কিছু সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়া যায় কিন্তু একবার বিপদ কেটে গেলে কেউ যদি এগুলো পরা বন্ধ করে দেয় তবে তার জীবনে একটার পর একটা বিপদ এমনভাবে আসতে থাকে যে, সে তখন বাধ্য হয়ে আবার এসবের শরণাপন্ন হয়। এভাবে বিপদের একটা চক্রের মধ্যে সে পড়ে যায়। যেসব বাবা-মা সন্তানের মঙ্গল এবং নিরাপত্তার আশায় পীর হুজুরদের কাছে গিয়ে এসব বস্তু নিয়ে আসেন এবং সন্তানকে পরতে বাধ্য করেন তারা নিজেরাও জানে না তারা কিভাবে সন্তানের ক্ষতি করছেন।

এছাড়া অনেক মায়েরা তাদের সন্তান বিশেষত ছেলে সন্তানকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য (অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিয়ের পর) চিনি পড়া, পানি পড়া খাওয়ান বা খাবারের সাথে অন্য কিছু মিশিয়ে তাদের জাদু করে রাখেন। এর ফলে সন্তান হয়তো আপাতদৃষ্টিতে মায়ের বাধ্য থাকে কিন্তু অন্য দিক দিয়ে তার জীবনে বিভিন্ন রকম ক্ষতি হতে থাকে। মা হয়তো বুঝতেও পারেন না সন্তানের জীবনের এসব বিপদ-আপদ মায়ের যাদু টোনার সাইড এফেক্ট।

 (বি:দ্র: অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাবিজ, জাদু টোনার যে সাময়িক ফলাফল দেখা যায় তা কিভাবে হয় এবং এসবের সাথে পারলৌকিক ক্ষতির কি সম্পর্ক? এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন আমাদের ওয়েবসাইটের এই সিরিজটি।)

সবশেষে মা-বাবা তথা প্যরেন্টসদের অনুরোধ করবো, নিজেদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে এমন কিছু করবেন না যার ফলে সন্তানদের জীবনে অকল্যাণ বয়ে আসে। নিঃসন্দেহে সন্তান জন্মদান থেকে প্রতিপালন করা পর্যন্ত প্রতিটি মা বাবাই অসম্ভব ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেন। মহান সৃষ্টিকর্তার পর মা-বাবা তার সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, তার মঙ্গল কামনা করেন । কিন্তু নিজের কোন ভুল কাজ যেন সন্তানের জীবনে বুমেরাং হয়ে না যায় সেজন্য মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে, সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মহান আল্লাহতায়ালা যেন আমাদের সু-বুদ্ধিসম্পন্ন মা-বাবা হওয়ার তৌফিক দেন।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন