আমরা যখন সন্তানদের মাঝে তুলনা নিয়ে আলোচনা করি তখন স্বাভাবিকভাবেই ছেলে এবং মেয়ে সন্তানের মাঝে বৈষম্য নিয়ে বেশি ফোকাস করা হয়। কিন্তু যে বিষয়টি তেমন আলোচিত হয় না বলে যুগ যুগ ধরে অসমাধানযোগ্য রয়ে যায়, তা হলো একই লিঙ্গের সন্তান অর্থাৎ ছেলে-ছেলে বা মেয়ে- মেয়ের মাঝে বৈষম্য বা comparison করা। জন্মের পর থেকে শুরু করে বড় হওয়া, বিয়ে হওয়া এমনকি তাদের সন্তান হওয়া/ না হওয়া পর্যন্ত এই তুলনা চলতে থাকে।
মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দ্বিতীয় মেয়ে জন্মানোর পরপরই শুরু হয়ে যায় প্রথম মেয়ের সাথে গায়ের রং, চেহারা, চুল এসব নিয়ে তুলনা। এরপর আরেকটু বড় হলে কোন মেয়ে সংসারী (রান্না, ঘর গোছানো গৃহকর্মে পটু ) আর কোন মেয়ে বহির্মুখী (বন্ধু-বান্ধব, আড্ডাবাজি, সাজগোজে আগ্রহী) এসব নিয়ে comparison শুরু হয়। বিয়ের পর কার শ্বশুর বাড়ি অভিজাত, কার জামাইয়ের ইনকাম বেশি, কোন জামাই মেয়ের বেশি বাধ্য — এসব নিয়ে তুলনা চলতে থাকে। এরপর নাতি-নাতনি হলে আবার তাদের চেহারা, স্বভাব, মেধা নিয়ে তুলনার এই পরম্পরা অব্যাহত থাকে।
একইভাবে ছেলে সন্তানরাও `তুলনা’র এই মনস্তাত্ত্বিক চাপ থেকে মুক্তি পায় না। একাধিক ছেলে সন্তান থাকলে কে বেশি দুরন্ত, কে বেশি মেধাবী, কার ইনকাম বেশি, কার বউ বেশি সুন্দরী, শিক্ষিতা, কার শ্বশুরবাড়ির স্ট্যাটাস উচ্চ — এসব নিয়ে তুলনা চলতে থাকে।
আর এই তুলনা যে শুধু আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী বা সমাজের মানুষজন করে তা নয়; খোদ জন্মদাতা/দাত্রী মা-বাবাই একই লিঙ্গের সন্তানদের মাঝে এই তুলনা করে যায় জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
অথচ মা-বাবা তথা প্যারেন্টসদের এই তুলনা বা বৈষম্যমূলক আচরণ সন্তানদের সাইকোলজিতে যে কি মারাত্মক প্রভাব ফেলে তা হয়তো অনেক বাবা-মা অনুধাবন করতে পারেন না। প্রতিটা সন্তান জন্মাবার পর মা-বাবা হয় তার প্রাথমিক আশ্রয়স্থল। এই নির্ভরশীলতা যে শুধু খাদ্য, বাসস্থান তথা ভরণপোষণের জন্য তা নয় বরং মেন্টাল সাপোর্টের ক্ষেত্রেও মা-বাবার উপর নির্ভরশীল থাকে প্রতিটা সন্তান।
মা-বাবার অবহেলা, অবজ্ঞার কারণে কোনো সন্তান হয় Inconfident. Insecurity তে ভুগতে ভুগতে নিজের যা সহজাত বৈশিষ্ট্য আছে/ছিল সেগুলোকেও flourish করতে পারে না । আবার কোনো সন্তান মা-বাবার প্রশ্রয়, প্রশংসা পেয়ে হয়ে ওঠে Overconfident, অহংকারী।
এছাড়া আরও একটি ভয়ংকর ব্যাপার অনুপ্রবেশ করে বোন-বোন কিংবা ভাই-ভাইদের মাঝে তা হলো `হিংসা’। মা-বাবা যে সন্তানের প্রতি বেশি পক্ষপাতিত্ব করেন সেই সন্তানের প্রতি অপর ভাই, বোনের মনে হিংসার উদ্রেক হয়, যা অনেক সময় ক্ষতিকর পর্যায়ে চলে যায়।
সন্তানের সুস্থ মানসিক গঠন তৈরীর জন্য এবং বোন-বোন কিংবা ভাই-ভাইয়ের মাঝে শ্রদ্ধা, স্নেহসুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য সব ধরনের বৈষম্য বা তুলনার ঊর্ধ্বে উঠে সন্তানদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে মা-বাবাকে সমতা বজায় রাখতে হবে।
যদিও মা-বাবাও রক্ত-মাংসের মানুষ এবং সন্তানদের স্বভাব, আচরণ অনেক সময় তাদেরকে পক্ষপাত মূলক আচরণ করার ক্ষেত্রে প্ররোচিত করে তবে যেহেতু অভিভাবক হিসেবে তাদের দায়িত্ব বেশি তাই তাদেরকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
একই লিঙ্গের সন্তানদের মাঝে তুলনা করার আগে মা-বাবাকে কিছু বিষয় নিজেদের মাইন্ডসেট ঠিক করে নিতে হবে। হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান হয় না, তেমনি সব সন্তানের শারীরিক,চারিত্রিক, আর্থিক সক্ষমতা একই হবে না– এটা মা-বাবাকে মেনে নিতে হবে।
সেই সাথে এটাও মেনে নিতে হবে যে, প্রতিটি আঙ্গুলের যেমন ভিন্ন ভিন্ন কার্যকারিতা রয়েছে তেমনি প্রতিটি সন্তানের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানোর পেছনে স্রষ্টার ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। তিনি হয়তো কাউকে দিয়ে আর্থিক পারপাস সার্ভ করাবেন, কাউকে দিয়ে সামাজিক সম্মান দিবেন, আবার কেউ হয়তো নীরবে মা-বাবার পাশে থেকে তাদের শারীরিক সেবা করবে, মানসিক সাপোর্টের উৎস হবে।
এক্ষেত্রে কোনো সন্তানের Role বা অবদানকে প্রায়োরাটাইজ করে সেই অনুযায়ী তাদেরকে মূল্যায়ন করা যাবে না বরং প্রত্যেকের স্ব স্ব অবদানকে স্বীকার করে তাদের সাথে সমতাসূচক ব্যবহার করতে হবে।
একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, মুসলিমদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদান এবং প্রতিপালনের আল্টিমেট উদ্দেশ্য হলো সন্তান যেন নিজেদের জন্য সাদকায় জারিয়া হয় তা নিশ্চিত করা। দুনিয়ার জীবনে সৌন্দর্যে, সম্মানে বা আর্থিকভাবে সফল সন্তানের চেয়ে বরং সচ্চরিত্রবান, ধার্মিক সন্তানই পরকালে মা-বাবার বেশি উপকারে লাগবে। তাই মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে সন্তানদের দুনিয়াবী সাফল্য নয় বরং চারিত্রিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। দুনিয়ার জীবনে সফল সন্তানকে বেশি ‘দাম’ না দিয়ে বরং পরকালের প্রতি মনোযোগী সন্তানের জন্য বেশি বেশি ‘দোয়া’ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত সন্তান যেন আমাদের চিরস্থায়ী নাজাতের উসিলা হয় সেজন্য মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে। মহান আল্লাহ যেন আমাদের সন্তানদের মাঝে অসম তুলনা নয় বরং সঠিক ইনসাফ করার তৌফিক প্রদান করেন।