রমাদ্বান মাস, কুরআন নাযিলের মাস। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে রমাদ্বানকে কুরআন নাযিলের মাস হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন (২:১৮৫), রোজার মাস হিসেবে নয়। তাই এই মাসে কুরআনের সাথে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা আমাদের সবার মাঝেই কম বেশি থাকে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, প্রচণ্ড আন্তরিকতা থাকা সত্বেও গাইডলাইনের অভাবে এই যাত্রায় আমরা বেশী দূর আগাতে পারি না, কুরআনের অনুবাদ পড়তে গিয়ে কেমন যেন একটা খেই হারিয়ে ফেলার মতো অনুভূতি হয়। কারও কম, কারও বেশি। কেনো এমন লাগে?
খুব সম্ভবত কারণটা এই যে, কুরআনে বর্ণিত ঘটনাগুলো আপাতদৃষ্টিতে বিক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য বইয়ের মতো এটার ১ম চ্যাপ্টারে আদম আলাইহিস সালামের পুরো কাহিনী একসাথে, ২য় চ্যাপ্টারে নুহ আলাইহিস সালামের কাহিনী এভাবে বর্ণনা করা হয়নি। ইন ফ্যাক্ট, সূরা ইউসুফ ছাড়া আর কোনো সূরাতে কোনো কাহিনী ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয় নি।
এর ফলে অন্যান্য বইয়ের মতো কুরআনও কেউ ধারাবাহিকভাবে পড়তে গেলে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শুরুতেই সূরা বাক্বারা পড়তে গেলে ৪০ আয়াতের দিকে পৌঁছলেই একজন কৌতূহলী পাঠকের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক-
# বনি ইসরাইল কারা?
# আল্লাহ কোন নিয়ামতের কথা বলেছেন যা তাদের দেয়া হয়েছিল?
# এই বাছুর পূজার ঘটনা কি?
# কোনটা আগে ঘটেছে বাছুর পূজা নাকি ফেরাউনের পতন?
# এসব ঘটনা জেনে এই সময়ের আমি কী করবো?
এগুলোর উত্তর না পেলে সামনে আগানো বা আগ্রহ ধরে রাখা খুব মুশকিল হয়ে যায়। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না, তাই না? সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ যার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এটার ভাষাগত অলৌকিকত্ব, সেটা তো এমন খাপছাড়া হওয়ার কথা না… সমস্যাটা তাহলে কোথায় হচ্ছে?
এবারের রমাদ্বানে Mubashera Sisters পেইজ থেকে আমাদের আয়োজন কুরআনের বর্ণনা শৈলীটা উপস্থাপন করা যাতে আমরা কুরআন পড়ার একটা কংক্রিট গাইডলাইন পাই। প্রতিদিনের জীবনে কুরআনকে জীবন্ত করার এ এক বিনম্র প্রয়াস ইনশাআল্লাহ।
পর্ব- ১
ভূমিকাতে বলেছিলাম কুরআনের বর্ণনা শৈলী বোঝা এবং এটার অনুবাদ পড়তে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলা প্রসঙ্গে।
আমরা কি কখনো ভেবেছি যে কুরআনে কেন ঘটনাগুলো আপাতদৃষ্টিতে বিক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ?
কারণ….. কুরআন কোনো ইতিহাসগ্রন্থ না….এটা একটা হিদায়াত গ্রন্থ। এখান থেকে মনি মুক্ত আহরণ করতে হলে কুরআনের স্টাইলটা বোঝা অপরিহার্য। কী সেই স্টাইল?
কুরআনে আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেছেন! এটার বর্ণনাশৈলীটা আসলে কথোপকথনের ভঙ্গীর মত!
আমরা যখন কারো সাথে কোনো টপিকে গল্প করি তখন কিন্তু ধারাবাহিকভাবে কোনো কাহিনীর ক্রম বর্ণনা করি না। কুরআনেও তাই একটি সূরাতে কোনো কাহিনীর শুধু সেই অংশটুকুই উল্লেখ করা হয়েছে যেটা ওই সূরার থিমের সাথে প্রাসঙ্গিক। যেমন সূরা বাকারাহর প্রাইমারী অডিয়েন্স হচ্ছে মদীনার ইহুদীরা। তারা যে নবীজিকে মেনে নিচ্ছে না, এইটা যে কতো অনুচিত কাজ হচ্ছে সেটা সূরা বাকারাহ’তে নানা ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সূরা বাকারাহ’তে তাই মূলত মুসা আলাইহিস সালামের কওমের করা অমার্জনীয় অপরাধগুলোর কথাই বারবার উঠে এসেছে। মুসা আলাইহিস সালামের জন্ম, বেড়ে ওঠা, নবুয়্যত লাভ এগুলোর কোনো উল্লেখ আমরা সূরা বাকারাতে পাই না।
কুরআনের এই স্টাইলের জন্যই একটি সূরা পড়ে কোনো ঘটনার ব্যাপারে সামগ্রিক চিত্র পাওয়া সম্ভব না। তাহলে করণীয় কী?
কুরআন বোঝা শুরু করার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে আমরা একটা গাইডলাইন প্রস্তুত করেছি। এই অ্যাপ্রোচের নাম আমরা দিয়েছি ‘ঘটনা ভিত্তিক কুরআন’।
ঘটনাভিত্তিক কুরআন বলতে কী বোঝায়?
আমরা কুরআন পড়া শুরু করবো ইনশাআল্লাহ কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা দিয়ে। কুরআনে যেহেতু অসংখ্য ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে তাই আপাতত আমরা ফোকাস করবো ‘শিকড়ের সন্ধানে’ বইটিতে কুরআনের যতটুকু অংশ কাভার করা হয়েছে (মুসা আলাইহিস সালামের জন্ম থেকে ঈসা আলাইহিস সালামকে তুলে নেয়া পর্যন্ত) ততটুকুতে। এইটুকু পড়া হলে ইনশাআল্লাহ কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সাথে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
ঘটনাভিত্তিক কুরআনিক এপ্রোচে আমরা কুরআনের উপরেল্লেখিত অংশকে ছোট ছোট খণ্ডে ভাগ করেছি। যেমন-
১) মুসা আলাইহিস সালামের জন্ম
২) মূসা(আ:) এর মিশর ত্যাগ
৩) মূসা(আ:) এর বিয়ে
৪) আল্লাহর সাথে মূসা(আ:)এর কথোপকথন
৫) ফিরাউনের সাথে মূসা(আ:) এর কথোপকথন
৬) যাদুকরদের সাথে মূসা(আ:) এর প্রতিযোগিতা
৭) মিশরবাসী ও বনী ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া
৮) মিশরবাসীর উপর আযাব ও তাদের প্রতিক্রিয়া
৯) ফিরাউনের পতন
ইত্যাদি……
এই খণ্ডিত অংশগুলো আমরা কিভাবে পড়বো?
১) আমরা ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে পড়বো ইনশাআল্লাহ।
২) কোনো ঘটনা যে সব জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো একসাথে করে পড়বো। যেমন-
- মূসা(আ:) এর জন্ম- সূরা ক্বাসাস (৭-১৩ নং আয়াত),সূরা ত্বাহা (৩৮-৪০ নং আয়াত)
- মূসা(আ:) এর মিশর ত্যাগ- সূরা ক্বাসাস (১৫-২২ নং আয়াত
- মূসা(আ:) এর বিয়ে- সূরা ক্বাসাস (২৩-২৮ নং আয়াত)
- আল্লাহর সাথে মূসা(আ:)এর কথোপকথন- সূরা ক্বাসাস (২৯-৩৫ নং আয়াত), সূরা ত্বাহা (৯-৪৬ নং আয়াত), সূরা নামল (৭-১২ নং আয়াত)
- ফিরাউনের সাথে মূসা(আ:) এর কথোপকথন- সূরা ক্বাসাস (৩৭-৩৮নং আয়াত), সূরা ত্বাহা (৪৭-৫৭ নং আয়াত), সূরা শুআরা (১৬-৩৪ নং আয়াত),সূরা আরাফ (১০৪-১০৯ নং আয়াত) ,সূরা ইউনুস (৭৫-৭৮নং আয়াত)
- যাদুকরদের সাথে মূসা(আ:) এর প্রতিযোগিতা- সূরা আরাফ (১১০-১২৬ নং আয়াত), সূরা ত্বাহা (৫৭-৭৬ নং আয়াত),সূরা শুআরা (৩৪-৫১ নং আয়াত), সূরা ইউনুস (৭৯-৮৮নং আয়াত)
- মিশরবাসী ও বনী ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া-সূরা আরাফ (১২৬-১২৯ নং আয়াত), সূরা ইউনুস (৮৩-৮৮নং আয়াত)
- মিশরবাসীর উপর আযাব ও তাদের প্রতিক্রিয়া- সূরা আরাফ (১৩০-১৩৫ নং আয়াত)
- ফিরাউনের পতন- সূরা শুআরা (৫২-৬৮ নং আয়াত),সূরা ত্বাহা (৭৭-৭৮ নং আয়াত), সূরা ইউনুস (৯০-৯২নং আয়াত), সূরা আরাফ (১৩৬-১৩৭ নং আয়াত)
ইত্যাদি……
এইভাবে একসাথে করে কেন পড়বো? আমরা কেউ কি ধারণা করতে পারছি?
পর্ব- ২
‘ঘটনা ভিত্তিক’ কুরআন শিরোনামে কুরআন পড়ার স্টাইলে আমরা কুরআনের একটি ঘটনা বিভিন্ন সুরা থেকে একত্রিত করে পড়বো ইনশাল্লাহ। কেন এভাবে একত্রিত করা প্রয়োজন? করবোই বা কিভাবে? এ ব্যাপারে যে উদাহরণটি আমার সবচেয়ে প্রিয় সেটি হলো আদম আঃ এবং ইবলিশের ঘটনা। এটা কুরআনের কয়েকটি সূরার বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো-
১. সূরা বাক্বারাহ: ৩০-৩৮ নং আয়াত
২. সূরা আরাফ : ১১-২৫ নং আয়াত
৩.সূরা হিজর: ৩২-৪২ নং আয়াত
৪.সূরা ইসরা : ৬১-৬৫ নং আয়াত
৫. সূরা কাহাফ:৫০ নং আয়াত
৬. সূরা সা’দ: ৭১-৮৫ নং আয়াত
এখন উপরে উল্লেখিত আয়াতগুলো একসাথে করে না পড়ে যদি শুধু সূরা বাকারার প্রাসঙ্গিক আয়াতগুলো পড়ি? সূরা বাকারাহ’র ৩৪ নং আয়াত পড়ে কি এমন ধারণা তৈরি হতে পারে যে শুধু একবার আল্লাহর আদেশ অমান্য করার জন্য ইবলিশকে এমন চিরস্থায়ী শাস্তি দেয়া হয়েছে? আমাদের রব কি এমন যে উনি শাস্তি দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন? আস্তাগফিরুল্লাহ। এতে কি ইবলিশের প্রতি একটা সফট কর্ণার সৃষ্টি হতে পারে যেখানে মনে হবে বেচারা সামান্য একটা ভুলের জন্য এত বড় শাস্তি পেল?
আমার কাছে মনে হয় সম্ভব।
কিন্তু আমরা যদি সূরা আরাফের সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো পড়ি তাহলে দেখবো যে, ব্যাপারটা মোটেও সেরকম না। শয়তানের অপরাধ মূলত এটা ছিল না যে সে আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিল, বরং সে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, তার আদেশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। আমাদের রব যিনি রাহমানুর রাহিম তিনি ইবলিসকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েছিলেন, তার দোয়া কবুল করেছিলেন। তওবা করার জন্য যথেষ্ট অবকাশ পাওয়া সত্ত্বেও ইবলিশের দাম্ভিকতাপূর্ণ আচরণের পূর্ণচিত্র আমরা পাই সূরা আরাফে। এই বিষয়ক আয়াত গুলো আপনাদের কেমন লাগে জানি না কিন্তু আমার এই রবকে খুব, খুব আপন লাগে আলহামদুলিল্লাহ। কুরআনের অন্যান্য অংশে যেখানে পরকালের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেই অংশের মিল পাই কারণ আমি দেখি আল্লাহ মানুষকে বরাবর আত্মপক্ষ সমর্থনে সুযোগ দিচ্ছেন। সেদিন উপায়ন্তর না দেখে মানুষ সমানে মিথ্যা কথা বলতে থাকবে। একটা পর্যায়ে মানুষের জিহবা সিল করে দেওয়া হবে যাতে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে পারে।
এতো গেলো সূরা আরাফ না পড়ে যদি শুধু সূরা বাকারার প্রাসঙ্গিক আয়াতগুলো পড়ি তাহলে কিভাবে আল্লাহর সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে সেই কাহিনী। কিন্তু শুধু যদি সূরা আরাফ পড়ি তাহলে কেমন লাগতে পারে?
আমি যখন সূরা আরাফের ১৬-৩৩ আয়াত পড়ি তখন আমার খুব হতাশ লাগে। মনে হয় শয়তানের চক্রান্ত থেকে বাঁচার কোনো উপায়ই বুঝি নেই। তারপর সূরা বনী ইসরাইলের ৬২ নং আয়াত মিলিয়ে পড়লে আমি যেন বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি….আমি প্রাণপণে দোয়া করতে থাকি যে আমি যেন তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি যাদের ওপর শয়তানের কোন প্রভাব কাজ করবে না।
শুধু তাই না, এই আয়াত পড়তে গিয়ে আমার একটা প্রিয় এক্সারসাইজ হচ্ছে শয়তানের উল্লেখ করা কৌশল গুলোর সমসাময়িক উদাহরণ বের করা। যেমন ইবলিশ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে তার আওয়াজ দ্বারা ,পদাতিক বাহিনী নিয়ে আমাদের আক্রমণ করবে। আমাদের অর্থ সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে শরিক হবে। আমি চিন্তা করতে থাকি –
১) শয়তান সন্তান সন্ততিতে শরীক হবে এটার উদাহরণ কী হতে পারে?
২) শয়তান অর্থ সম্পদে শরীক হবে এটার উদাহরণ কী হতে পারে?
৩) বর্তমান সময়ে শয়তানের আওয়াজের উদাহরণ কী হতে পারে? ইত্যাদি…. এভাবে চিন্তা করলে প্রতিদিনের জীবনে কুরআন জীবন্ত হয়ে ওঠে আলহামদুলিল্লাহ। আর আমরা পাই একটি অনন্য ইবাদাত করার সুযোগ… কী সেটা?
পর্ব- ৩
একটা ঘটনার ব্যাপারে কুরআনের যতগুলো আয়াত আছে সেগুলো সব একসাথে করে পড়বো- ঘটনাভিত্তিক কুরআন অধ্যায়নের এই স্টাইলটা কি ২য় পর্বের উদাহরণের থেকে স্পষ্ট হয়েছে?
এভাবে কুরআন পড়ার আরও সুবিধা হচ্ছে-
১) কুরআনের এক অংশের সাথে আরেক অংশের সংযোগ পাওয়া যায়।
২) কুরআন ধারাবাহিকভাবে পড়লে যে খেই হারিয়ে ফেলার অনুভূতি হয় সেটা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। পাজেল এর টুকরাগুলো জোড়া লাগাতে পেরে সামগ্রিক একটা চিত্র প্রতিভাত হয়ে ওঠে।
৩) একটা ঘটনা নিয়ে পড়া শেষ হলে একটা sense of accomplishment এর অনুভূতি জাগ্রত হয়। ধরেন, আপনি মুসা আলাইহিস সালামের জন্ম সংক্রান্ত সবগুলো আয়াত একসাথে করে পড়লেন। এতে হয়তো আপনার মাত্র ৭/৮টা আয়াত পড়া হবে, কিন্তু তাও মনে হবে যে এই ঘটনাটার ব্যাপারে আল্লাহ যা যা বলেছেন তার সবটুকু অন্তত আমি জানি। ফলে হাঁটি হাঁটি পা করে হলেও কুরআন জানার পথে এগিয়ে যাচ্ছি এমন একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়। তখন যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় সেটা আমাদের আরো এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।
তবে এই স্টাইলে কুরআন পড়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা কি জানেন?
একটি ঘটনার সামগ্রিক চিত্র বুঝার পর আমরা নিজের বা আশেপাশে মানুষের জীবনের নানা ঘটনা সাথে মিল খুঁজতে পারি। তারপর সেখান থেকে মনি মুক্ত আহরণ করে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, এইসব ঘটনার রেফারেন্স টেনে দুআ করতে পারি।
এবং….
একটা অনন্য সাধারণ ইবাদত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কী সেটা?
কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা!
আমরা যখন একটা ঘটনা নিয়ে জানবো, সেটার নানা আঙ্গিক বিশ্লেষণ করবো, সেগুলোর সাথে আমাদের জীবনের মিল খুঁজবো, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করবো, দুআ করবো… চিন্তা না করলে সেটা কি কখনো সম্ভব?
কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা সম্পর্কে আল্লাহ কী বলেছেন সেটা কি আমরা জানি? ৪৭:২৪ আয়াতে আল্লাহ আমাদের জানাচ্ছেন যারা কুরআন নিয়ে চিন্তা করে না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ!
ভাবছেন কিভাবে করবো এসব?
Let’s say Bismillah and start!
মুসা আলাইহিস সালামের জন্মের কাহিনী দিয়েই শুরু করা যাক? এটার উল্লেখ আছে নিচের আয়াত গুলোতে:
১) সূরা ক্বাসাসের ৭-১৩ ( ২৮ নং সূরা)
২) সূরা ত্বাহা ৩৮-৪০ ( ২০ নং সূরা)
আসুন প্রথমে এই আয়াতগুলোর অনুবাদে চোখ বুলাই।
এবার একটু চিন্তা করি?
পুরো ব্যাপারটাকে একটু কল্পনা করার চেষ্টা করি। ফিরাউন বনী ইসরাঈলের ছেলে শিশু হলেই তাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। এই যখন তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা তখন ফিরাউন তার প্রাসাদের নিকটস্থ নদীতীরে একটা বাক্স ভেসে আসতে দেখলো যেটার ভিতরে ছিল একটা ফুটফুটে ছেলে শিশু। এই শিশু যে বনী ইসরাঈলীয়দের কেউ সেটা বোঝা তো খুবই স্বাভাবিক ছিল, তাই না?
যে কোনও অনুসন্ধিৎসু মনে তাহলে প্রশ্ন জাগবে যে ফিরাউন কেন শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে হত্যা করলো না?
আপনাদের কী মনে হয়?
কুরআন কি আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে?
(বি: দ্র: ২য় পর্ব থেকে শুরু করে আমরা কুরআনের আয়াতের রেফারেন্স দেয়া শুরু করেছি, ইচ্ছা করেই আয়াতগুলো এখানে তুলে দেই নাই। কারণ আমরা চাই যারা এই সিরিজ পড়ছেন, তারা যেন কুরআন খুলে সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো পড়েন এবং নিজেরা চিন্তা করা শুরু করেন। প্রথম প্রথম ব্রেন একটু হ্যাং হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা দারুণ মজা পাওয়া শুরু করবো ইনশাআল্লাহ্। )
কুরআন বুঝে পড়ার অনাস্বাদিত আনন্দ উপভোগের মাস হোক এই রামাদ্বান, আমীন!
পর্ব-৪
গত পর্বে প্রশ্ন করেছিলাম কেন ফিরাউন শিশু মুসাকে হত্যা করল না যদিও তার মতো সুচতুর, নিষ্ঠুর শাসকের জন্য এটা বোঝা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে এটা বনি ইসরাইলের কোনো শিশু!
যদি এই সংক্রান্ত আয়াতগুলোর অর্থ মন দিয়ে পড়ি তাহলে দেখবো যে আল্লাহ কুরআনেই এটার উত্তর দিচ্ছেন!
হ্যাঁ, সূরা ত্বাহার ৩৯ নং আয়াতে আল্লাহ কারণটা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দিচ্ছেন- উনি ফেরাউনের অন্তরে শিশু মুসার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন…
এই আয়াতের সাথে সূরা ক্বাসাস এর ৯নং আয়াত মিলিয়ে পড়লে আমরা বুঝি যে উদ্ধারকৃত শিশুটিকে হত্যার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, এহেন পরিস্থিতিতে ফেরাউনের স্ত্রীর প্রস্তাব ছিল শিশুটিকে সন্তান হিসেবে দত্তক নেওয়া অথবা কাজের ছেলে হিসেবে গ্রহণ করা ( যাতে ফুট ফরমাশ খাটানো যায়)। শিশু মুসাকে দেখে স্নেহপ্রবণ হয়ে গিয়েছিল বলেই ফেরাউন প্রথম প্রস্তাবটি মেনে নিয়েছিল যদিও এটা ছিল তার মতো একজন ব্যক্তিত্বের জন্য খুবই অস্বাভাবিক একটি বিষয়।
এখন আসুন আমরা সমগ্র ঘটনাচিত্র আবার একটু ঝালাই করি।
একজন মা, যিনি সদ্য একটি ছেলে শিশু জন্ম দিয়েছেন তিনি চরম আতঙ্কিত অবস্থায় আছেন কারণ যে কোনো সময় ফেরাউনের সৈন্যরা টের পেয়ে গেলে ছেলে শিশুটিকে হত্যা করবে। এই সময় উনার কাছে ওহী আসলো তিনি যেন শিশু মুসাকে দুধ খাওয়াতে থাকেন। যখন বিপদের আশঙ্কা করবেন তখন যেন সদ্যজাত শিশুটিকে একটি বাক্সের মধ্যে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেন….
এই জায়গায় আসুন আমরা একটু বিরতি নেই।
আচ্ছা আল্লাহর দেওয়া অপশনটা কী ছিল? একটা বাচ্চাকে বাক্সের মধ্যে বন্দি করে নদীতে ভাসিয়ে দিলে তার কি বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা থাকে? একজন মায়ের পক্ষে কি এই কাজটা কখনো করা সম্ভব?
কিন্তু মূসা আলাইহিস সালামের মা কিভাবে পেরেছিলেন?
কারণ তার সাথে আল্লাহর ওয়াদা ছিল!
কী সেই ওয়াদা? (যারা সিরিয়াসলি এই সিরিজ পড়ছেন তারা ২৮:৭ নং আয়াত পড়ে লিস্ট করুন। আরবিতে তিলাওয়াত করে ২৫:৭৪ আয়াতের সাথে মিল খুঁজে পান নাকি দেখেন)
কিন্তু এ কাজ করতে কি উনার কষ্ট হয়নি? বুকটা ফেটে যায়নি? উনার মন কি উৎকন্ঠিত ছিল না?
অবশ্যই ছিল!
আর উনার কেমন লাগছিল সেই অনুভূতিটা আমাদের রবের কাছে এতটাই দামি যে সেটার কথা আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন (২৮:১০)!
আচ্ছা, আল্লাহ মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের অন্তর দৃঢ় করে দিলেন, এটার মানে কি? (অনুরূপ শব্দের ব্যবহার কি ১৮:১৪ আয়াতে পাই? আরবিতে তেলাওয়াত করলে বোঝা যাবে ইনশাআল্লাহ)
এটার একাধিক মানে হতে পারে-
১) সদ্যজাত সন্তানকে বাক্সবন্দী করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ভয়ংকর কঠিন কাজটা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে করার তৌফিক দিলেন।
২) উনাকে আল্লাহ কী নির্দেশ দিয়েছেন বা সন্তানটিকে উনি কী করেছেন তা পরিবারের বাইরে আর কারও কাছে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকলেন।
৩) ভাসিয়ে দেওয়ার পর বাক্সবন্দী বাচ্চাটির কী পরিণতি হল তা দেখার জন্য নিজেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন না বরং নিজের নাবালক কন্যা সন্তানকে পাঠালেন। বনি ইসরায়েল গোত্রের একজন প্রসূতি মা যদি নদীতে ভাসতে থাকা বাক্স অনুসরণ করতে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তা ফেরাউনের সৈন্যদের চোখ এড়াবে না। কিন্তু একটা বাচ্চা মেয়ে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়ালে সেটা হয়তো সন্দেহের উদ্রেক করবে না।
অথবা এই সবগুলোই…নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালো জানেন!
আচ্ছা এই যে নবী মুসার মা আল্লাহর নির্দেশ মেনে এমন ভয়ংকর একটা কাজ করলেন এর প্রাথমিক ফলাফল কী হল? স্বস্তিদায়ক কিছু কি ঘটলো?
নাকি ‘পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে” এই প্রবাদ বাক্যের মতন যার কবল থেকে বাঁচতে এত আয়োজন তার প্রাসাদের তীরে গিয়েই থামলো বাক্সটা?
বাক্সটা ফিরাউনের প্রাসাদে গিয়ে থামা দেখলে কি আত্মা উড়ে যাওয়ার কথা না ভয়ে? আল্লাহর উপর আস্থা রাখার পরিণতি নিয়ে কি সংশয় সৃষ্টি হওয়ার কথা?
যদিও তাই হওয়ার কথা। কিন্তু না, অভাবনীয় পরিণতি দেখার জন্য দরকার আর একটু ধৈর্য্য!
ফিরাউনের চোখে বাক্সটা পড়ার পর কী ঘটলো সেটা আমরা আগে থেকে জানি দেখে হয়তো আমরা ঐভাবে ব্যাপারটা অনুভব করতে পারছি না! কিন্তু সত্যি তো এই যে, আল্লাহর অসামান্য নিদর্শন হিসেবে ফিরাউন হেরে গেলো নিজের অনুভূতির কাছে। যাকে হত্যার জন্য এত আয়োজন, সেই বাচ্চা, নিজের ভবিষ্যত ধ্বংসের রূপকারকে বুকে তুলে নিল পরম মমতায়! (এই বিষয়টার দিকে আল্লাহ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ২৮:৮-৯ আয়াতে)
এরপর কী হলো?
দত্তক হিসেবে গ্রহণ করা শিশু মুসা তখন ভিআইপি সেবা পাচ্ছেন। উনাকে খাওয়ানোর জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে, কিন্তু উনি কারোটাই খাচ্ছেন না!
এই সময় মঞ্চে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলো একজন….
কে সে? আন্দাজ করতে পারছি কুরআনের আয়াতগুলো পড়ে?
পর্ব-৫
শিশু মুসা, যে কী না এখন ফিরাউনের পালিত সন্তান, তাকে খাওয়ানো নিয়ে প্রাসাদের সবাই যখন হয়রান তখন একজনের উপস্থিতি পুরো ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
কে ছিল সে?
জ্বী, কুরআন থেকেই আমরা জানতে পারি যে, সেই মানুষটি ছিল মুসা আলাইহিস সালামের বোন, যাকে উনার মা দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাক্সটাকে নদীর তীর দিয়ে অনুসরণ করতে…(অনেক মুফাসসিরদের মতে মুসার এই বোনের নাম ছিল মারইয়াম। বর্ণনার সুবিধার্থে আমরা তাকে এই নামেই ডাকবো)
কী করেছিলো মারইয়াম?
বাক্সটাকে ফেরাউনের প্রাসাদের তীরে ভিড়তে দেখে আতঙ্কিত হয়ে তার মাকে আপডেট জানাতে ছুটে গিয়েছিল?
না, বরং সে অপেক্ষা করেছিল ঘটনার শেষ দেখা পর্যন্ত!
শুধু তাই না, সাহসের সাথে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সমাধানও বাতলে দেয়ার চেষ্টা করলো, প্রস্তাব করলো এক সম্ভাব্য ধাত্রীর নাম!
কে ছিল সেই মহিলা?
হ্যাঁ, আর কেউ নয়, নিজের মায়ের কথাই বলেছিল মারইয়াম। নিজের প্রত্যুৎপন্নমতিতা দিয়ে সে বুঝতে পেরেছিল যে শিশু মুসা নিজের মায়ের দুধ খেতে কখনোই অস্বীকার করবে না।
কিন্তু ব্যাপারটাকে মারইয়াম কিভাবে উপস্থাপন করেছিল? সে কি বলেছিল যে এটা ওর/শিশু মুসার মা?
অবশ্যই না! তাহলে তো শিশু মুসার আসল পরিচয় প্রকাশ পেয়েই যেতো! ২৮:১২ আয়াতে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে মুসার বোন নিজের পরিবারের পরিচয় গোপন রেখে এমন ভাবে বিষয়টা উপস্থাপন করেছিল যেন এটা জাস্ট এমনি একটা চেনা পরিবার যার কথা ওর হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেছে! (সিরিয়াস পাঠকরা এই আয়াত থেকে বেবিসিটারের দুইটি ইউনিক কোয়ালিটি খুঁজে বের করতে পারেন, একজন মা মাত্রই এই বিষয়টার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবেন!)
তারপর কী হলো?
ফেরাউনের সৈন্যরা মুসার মায়ের কাছে গেলো…
কেন?
মুসার পরিচয় জেনে গিয়ে তার মায়ের সামনেই তাকে হত্যা করতে?
অবশ্যই না!
বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় শিশু মুসাকে স্তন্যপান করানোর প্রস্তাব দিতে।
আচ্ছা ফিরাউনের সৈন্যদের নিজের বাড়িতে আসতে দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল উম্মে মুসার?
প্রচণ্ড ভয়ে আর আতঙ্ক কি তাকে গ্রাস করেনি? তারপর যখন বুঝলেন কী অভাবনীয় ভাবে আল্লাহ তার বুকে শিশু মুসাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তখন কেমন লেগেছিল উনার?
নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্যি, আমাদের শুধু দরকার ধৈর্য্য ধরার।
সেটা কি পারি আমরা?
আচ্ছা এই ঘটনা প্রবাহ কি রুদ্ধশ্বাস কোন থ্রিলারের চেয়ে কোন অংশে কম?
অবশ্যই না।
কিন্তু এগুলো কি নিছকই এক গল্প? এই কাহিনী জেনে আজকের আমার কী লাভ?
এইভাবে ঘটনা ভিত্তিক কুরআন পড়ার স্টাইলের উপকারিতা হিসেবে বলেছিলাম যে, নিজেদের বা আশেপাশে মানুষের জীবনের সাথে মিল খুঁজতে পারি, এসব ঘটনার রেফারেন্স টেনে দোয়া করতে পারি।
এতক্ষণ যে কাহিনী বর্ণনা করলাম সেটাকে কিভাবে জীবনে প্রয়োগ করতে পারি আমরা? আমাদের জীবনে তো কখনো বাক্সবন্দীর সদ্যজাত সন্তানকে নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে না ইনশাআল্লাহ।
তাহলে ?
আসলে বাচ্চা সংক্রান্ত যেকোনো পরীক্ষায় (যেমন তাদের অসুস্থতা বা দ্বীন থেকে দূরে যাওয়া) আমরা উম্মে মুসার রেফারেন্স টেনে দোয়া করতে পারি যে, ”ইয়া রাব্বি তুমি তো মুসা আলাই সালাম এর মায়ের কোলে অভাবনীয়ভাবে তার বাচ্চাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে, সেভাবে আমার সন্তানকে সুস্থ এবং নেককার অবস্থায় আমার কোলে ফিরিয়ে দাও।”
আমরা যদি কখনো সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত থাকি তাহলেও এভাবে দোয়া করতে পারি যে, ”আল্লাহ তুমি যেভাবে বাক্স বন্দি অবস্থায় নদীতে কিংবা ফেরাউনের কোলে শিশুকে যেভাবে নিরাপদ রেখেছিলে আমার সন্তানকেও সেভাবে নিরাপদ রেখো।”
আচ্ছা এ ঘটনা থেকে আমরা কি শুধু বাচ্চা সংক্রান্ত দোয়াই বানাতে পারি? আর কিছু না? আপনাদের কী মনে হয়?
পর্ব- ৬
কুরআনে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো নিয়ে যত চিন্তা করবো ততো নানা দিক উন্মোচিত হবে এবং আমরা দুআ বানানোর খোরাক পাবো ইনশাআল্লাহ।
আসুন উম্মে মুসার সঙ্গে যা ঘটেছিল সেটার নির্যাস বোঝার চেষ্টা করি। উনার সামনে দুটো অপশন ছিল-
১. ফেরাউনের সৈন্যরা তার সদ্যজাত শিশু পুত্রকে হত্যা করে ফেলবে, অসহায়ের মতন সেখানে তার আর করার কিছু থাকবে না। ক্ষমতায় পারবে না ওদের সাথে
অথবা
২.বাক্সবন্দী অবস্থায় সদ্যজাত সন্তানকে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া।
খেয়াল করলে দেখবো যে ,দুইটা অপশনই প্রচন্ড কঠিন কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে দ্বিতীয় অপশনে সাথে আল্লাহর ওয়াদা রয়েছে।
এরকম কোন পরিস্থিতির কথা কি আমাদের কারও মনে পড়ে?
আমার এক ফ্রেন্ডের একবার এমন হয়েছিল যে, পাঁচ মাসের আল্ট্রা সাউন্ডে ধরা পড়েছিল যে তার অনাগত সন্তান প্রতিবন্ধী হবে। ডাক্তার বলেছিল Abort করতে।
আসুন চোখ বন্ধ করে এই পরিস্থিতিটা একটু চিন্তা করি। নূন্যতম মানবিক বোধ সম্পন্ন একজন হবু মায়ের পক্ষে প্রথম সন্তানকে Abort করা কোন সহজ সিদ্ধান্ত নয়। আবার Abort না করে সারা জীবনের জন্য একটা অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে দিন কাটানো খুবই ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার।
এখানেও দুটো অপশনের মাঝে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। গর্ভকালীন ৫ মাসের সময় abortion করা ইসলামী শরীয়তে একেবারে নিষিদ্ধ যদি না এতে মায়ের জীবনে ঝুঁকি থাকে। তাই বলা যায় দ্বিতীয় অপশনে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশা আছে প্রথম অপশনের ক্ষেত্রে যা অনুপস্থিত।
আমরা কি উম্মে মুসার সাথে মিল পাচ্ছি?
জীবনের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যখন সামনে থাকা সবগুলো অপশনই অনেক কঠিন মনে হয় তখন আমরা উম্মে মুসার রেফারেন্স টেনে দুআ করতে পারি যে, “আল্লাহ তুমি উম্মে মুসার হৃদয় যেমন দৃঢ় করে দিয়েছিলে, তোমার ওয়াদা সাথে আছে এমন অপশন বেছে নেয়ার তৌফিক দিয়েছিলে, আমাকেও সেভাবে দৃঢ় করে দাও ইয়া রাব্বি ।”
উম্মে মুসার এই ঘটনার রেফারেন্স টেনে আমি আরও দুআ করতে পারি যখন আমি অবস্থার অবিশ্বাস্য পরিবর্তন চাই। ফিরাউনের সৈন্যদের হাতে সদ্যজাত শিশু পুত্রকে হারাতে হবে এটাই যখন সম্ভাব্য পরিণতি তখন কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ফিরাউনের সৈন্যদের ঘরে আগমন সেই শিশুপুত্রকে স্তন্যপান করানোর প্রস্তাব নিয়ে…ঘটনার মোড় এভাবে নাটকীয়ভাবে ঘুরে যাওয়া দেখে আমি আশায় বুক বাঁধি যে আল্লাহ চাইলে প্রতিকূল পরিস্থিতি বদলে গিয়ে অনুকূল হয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না!
আচ্ছা এই ঘটনা থেকে কি শুধু উম্মে মুসার রেফারেন্স টেনেই দুআ করা যায়?
নাহ, মুসা আলাইহিস সালামের জন্ম সংক্রান্ত এই কাহিনীতে আমার অসম্ভব প্রিয় একটা চরিত্র হচ্ছে উনার বোন, মারইয়াম। এই ছোট মেয়েটার উপস্থিত বুদ্ধি আর শক্তিশালী নার্ভ আমাকে বিস্ময়াভিভূত করে।
কল্পনা করুন, প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় যখন মুসলিম নিধন বা ব্যাপক ধরপাকড় চলছে তখন White house বা অনুরূপ কোনো জায়গায় ডোনাল্ড ট্রাম্প বা এমন কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির সামনে কিশোরী এক মেয়ে নির্ভীকভাবে কোনো সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় বাতলে দিচ্ছে! আমি বা আপনি হলে বাক্সটা ফিরাউনের প্রাসাদে গিয়ে ঠেকেছে এবং ওই মুহূর্তে ফিরাউন সস্ত্রীক ওই জায়গাতেই উপস্থিত, এই দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ভয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতাম না?
অথচ এই মেয়েটা কী করেছে?
নিজের ও শিশু মুসার পরিচয় গোপন করে নিজের মাকে ধাত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে যার ফলশ্রুতিতে মুসার মায়ের বুকে ফিরে আসার রাস্তা পরিষ্কার হয়েছে… এটা চিন্তা করলে আমার মুগ্ধতার আবেশ যেন আর কাটতে চায় না।
তাই আমি আমার মেয়ের জন্য দুআ করি – ’ইয়া রাব্বি, তুমি আমার মেয়েটাকে মারইয়ামের মত শক্ত নার্ভ আর প্রত্যুৎপন্নমতি করো!” সাথে নিজেও উম্মে মুসার মত মা হওয়ার তৌফিক চাই যে মেয়েকে দায়িত্ব নেয়া শিখিয়েছে! এইভাবে দুআ করা নিরাপদ লাগে কারণ মুসার বোন এমন একটা চরিত্র যাকে আল্লাহ নিজেই রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
শেষ- পর্ব
মুসা আলাইহিস সালামের জন্ম সংক্রান্ত আয়াতগুলো থেকে আমার সবচেয়ে প্রিয় দুআটার কথা তো এখনও বলিই নাই! পুরো ঘটনা জানার পর আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি যে এখানে game changer ছিল ফিরাউনের মনে শিশু মুসার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি। এই ব্যাপারটা যখন আমি চিন্তা করি আমার বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতে চায় না। এই সৃষ্টি জগতের সবকিছু আল্লাহর সৈন্য সেটা আমরা জানি(৪৮:৪)। তাই তো বাক্সবন্দী মুসার নদীর পানিতে কোনো ক্ষতি হয় নাই বরং নদী ভাসাতে ভাসাতে তাকে সেইখানে নিয়ে গেছে যেখানে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী সৈন্য সম্ভবত আমাদের অনুভূতি। জীবনে যখন এমন কোন পরিস্থিতি আসে যখন দেখি কিছুতেই কোন উন্নতি হচ্ছে না ,একমাত্র সমাধান সংশ্লিষ্ট মানুষের হৃদয় পরিবর্তন, তখন আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, ”ইয়া রাব্বি তুমি যেভাবে ফেরাউনের অন্তরে শিশু মুসার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিলে তেমনি অমুক মানুষের হৃদয়ে অমুক পরিবর্তন এনে দাও।”
কী শক্তিশালী একটা কনসেপ্ট তাই না?
আচ্ছা আমরা কি কখনো ভেবেছি যে, এত মানুষ থাকতে আল্লাহ ফেরাউনের প্রাসাদেই কেন মুসা আলাই সালাম কে লালন পালনের ব্যবস্থা করলেন? অন্য কোন ভাবেও তো তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন, তাই না?
কী মনে হয় আপনাদের?
এর মাধ্যমে বিশাল যে উপকার হয়েছে সেটা হচ্ছে মুসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনকে খুব ভালোভাবে চিনে বড় হয়েছিলেন। ফেরাউনের মতো নিষ্ঠুর,শক্তিশালী শাসকের মোকাবেলায় মুসা আলাই সালাম যথেষ্ট হতেন না ,যদি না তার অন্দরমহলে মুসার প্রবেশাধিকার থাকতো। ব্যাপারটা যেন অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো।
তবে কুরআনের আয়াত (২৮:৮,৯) যে বিষয়টার দিকে বারবার হাইলাইট করছে সেটা হচ্ছে যে, ফিরাউনের কোনো ধারণা ছিল না সে কী করছে!
মানে এটা ছিল আল্লাহর ক্ষমতার একটা নিদর্শন, আল্লাহ যদি কাউকে নিরাপদ রাখতে চান, কাউকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নিতে চান তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে রহিত করতে পারবে না। যে ফিরাউন শত শত শিশুকে হত্যা করেছিল নিজের সাম্রাজ্য বাঁচাতে, যে ফেরাউন নিজেকে রব দাবি করতো, তার মানবীয় সীমাবদ্ধতা এতটাই বেশি ছিল যে সে নিজের ভবিষ্যত ধ্বংসের কারণকে সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে বুকে তুলে নিয়েছে। অন্য কাউকে দোষ দেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
এখান থেকে আমি কি দুআ করি জানেন?
ফেরাউনের মতো এমন কোনো কিছুর প্রতি টান অনুভব না করি যেটা/ যে আমার দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর।
সাথে আরো দুআ করি, যে আমার কোনো কাজ, কথা যেন আমার বিরুদ্ধে পরকালে সাক্ষী না হয়!
আচ্ছা কুরআনে বর্ণিত ঘটনাগুলোকে নানা আঙ্গিক থেকে বিশ্লেষণ করে সেগুলো রেফারেন্স টেনে দুআ বানানোর এই কৌশলটা কেমন লাগছে আপনাদের?
এটা আমার এত ভালো লাগে যে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। কুরআন পড়াটা তখন আমার কাছে একটা two way conversation পরিণত হয় আলহামদুলিল্লাহ। যখন কুরআনের ঘটনাগুলো পড়ি তখন মনে হয় আল্লাহ আমার সাথে কথা বলছেন আর যখন আমি দুআ বানিয়ে দুআ করি তখন মনে হয় আমি আল্লাহর সাথে কথা বলছি! কী অপার্থিব একটা অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না।
আচ্ছা এভাবে দুআ বানানোর ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ কী?
মূল চ্যালেঞ্জটা কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক- আমাদের অধিকাংশের কাছেই কুরআনের চরিত্রগুলোকে দূর আকাশের তারার মতো মনে হয়, যাদের ধরা যায় না কিংবা ছোঁয়া যায় না ইত্যাদি। আমাদের হয়তো মনে হতে থাকে,” আরে আমি কি নবীর মা নাকি যে এভাবে ধৈর্য ধরবো অথবা উনার রেফারেন্স টেনে দোয়া করব?”
এমন চিন্তা যদি আসে তাহলে বুঝতে হবে আমরা আকন্ঠ ভুলের সাগরে নিমজ্জিত আছি। কারণ এহেন মনোভাব দ্বারা পরোক্ষভাবে বা নিজেদের অজান্তে আমরা এই দাবি করছি যে আল্লাহ কুরআনে এমন মানুষদের উদাহরণ তুলে ধরেছেন যাদের অনুসরণ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু আসলেই কি তাই?
আল্লাহর উপর ভরসা করে উনার ওহী মত কাজ করার পরেও উম্মে মুসার প্রচন্ড অস্থির লাগছিল, বাক্স বন্ধী ছেলের পরিণতি দেখার জন্য যে উনি নিজের মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন বাক্সটা অনুসরণ করতে….এসব ঘটনা তো আমাদের কুরআনই জানাচ্ছে, তাই না?
তবে এভাবে কুরআন পড়তে গিয়ে একটা প্র্যাক্টিক্যাল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আয়াতগুলো একসাথে করা যেন ঘটনাগুলোর সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়।
যারা এতদিন আমাদের সাথে থেকে এই সিরিজ পড়েছেন, তাদের জন্য আমরা গিফট হিসেবে একটা রিসোর্স দিচ্ছি যেটাতে মুসা আলাইহিস সালামের জন্ম থেকে শুরু করে ঈসা আলাইহিস সালামকে তুলে নেয়া পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ ছোট ছোট ভাগ করে আয়াতগুলো একসাথে করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
https://drive.google.com/file/d/1nWs9NXp7d6xdr6hsDIm1PI5vglpSPtYz/view?usp=sharing তাহলে আর দেরি কেন? আসুন কুরআনে বর্ণিত ঘটনা গুলো এক অন্য আলোয় অধ্যায়ন করা শুরু করি যেখানে এই চরিত্রগুলো পাশের বাসার মেয়েটির মতোই আমাদের খুব আপন, খুব কাছের কেউ….