করোনায় বৈশাখ

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

.
মায়ের সাহায্যে শাড়ির কুচিগুলো গুছিয়ে নিলো নোশীন।মা তাকে তাড়া দিয়ে বললেন,’সাড়ে দশটা বেজে
গেছে।।!নাস্তা করবি কখন! আয় এবার।’

-‘এইতো মা,মেইক আপটা শেষ করে-ই আসছি।তুমি যাও!

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসতে বসতে বললো সে।মা চলে যেতেই ড্রয়ারটা খুলে লাল-সাদা মিশ্রণের জামদানি শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা মাটির গয়নাগুলো একে একে বের করলো।এরপর চোখ দু’টো সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।..

কয়েকদিন থেকেই তার প্রচন্ড মন খারাপ! হবেই-বা না কেন? প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ নিয়ে কত প্ল্যান-প্রোগ্রাম থাকে,এই দিনটার জন্যই সারাটা বছর অপেক্ষা করে। কিন্তু এবার হলো কী?!লকডাউনের কারনে সারাদিন ঘরে বসে কাটাতে হবে! শাড়িটা পর্যন্ত কিনতে পারেনি,গয়না-গাটি তো দূরের কথা! গতবারেরগুলোই তাই আবারো পরতে হলো!…

বিষণ্ণতা ঘিরে ধরেছে তাকে। মন ভালো করার জন্য ফুল ভলিউমে মোবাইলে গান ছেড়ে দিলো।চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে গত বছরের স্মৃতি রোমন্থন করলো….সেদিন হালকা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শেষে আলোকজ্জ্বল রোদ্দুর উঁকি দিতেই সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়েছিল বান্ধবীদের সাথে।সব বান্ধবীরা মিলে চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিল! সে-কী মানুষের কোলাহল! নানান রকম মুখোশ পরে,ঢাক-ঢোল ,তবলার বাদ্যির সাথে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য আর গানের তালে তালে নতুন বছরকে বরণ করে নিয়েছিল সবাই।’মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’-কি চমৎকার প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সেই শোভাযাত্রা হয়েছিল!
আর এবার মঙ্গল শোভাযাত্রাও হবে না! না জানি কী অমঙ্গল যে সামনে অপেক্ষা করছে!ভাবতেই শিউরে উঠলো সে।’ভাই করোনা,আসবেই যখন আরো একটু পরে এলেই পারতে! সবকিছু মাটি করে দিলে!’বিরক্তির সাথে স্বগোতক্তি করলো নোশীন।

গালের মধ্যে বিউটি ব্লেন্ডিং দিয়ে ব্লেন্ড করতে করতে চারুকলার সেই সুদর্শন ভাইয়ার কথা মনে এলো তার।যিনি অনেকটা সময় নিয়ে গত মেলায় তার গালে আল্পনা এঁকে দিয়েছিলেন! সে কথা ভাবতেই কেমন যেন এক ভালো লাগার শিহরণ বয়ে গেলো!..

‘বখাটে ছেলেদের ভীড়ে ললনাদের রেহাই নাই”….মোবাইলে গানের লাইনটা শুনে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো প্রতিবছর মেলায় কত ছেলেকে বোকা বানানোর দৃশ্যগুলো! যেসব ছেলেরা ফোন নাম্বার পাওয়ার আশায় তাদের পেছন পেছন সারাদিন ঘুরতো,ডিস্টার্ব করতো,বান্ধবীরা মিলে তাদের পয়সা খসাতো! নাগোরদলায় চড়ার ট্রিট নিতো! গতবার তো দু’জনকে বেকুব বানিয়ে ফুচকা-চটপটি আর বিরিয়ানি খেয়ে ভুলভাল নাম্বার দিয়ে এসেছিল! সে কথা মনে হতেই সশব্দে হেসে উঠলো নোশীন।

কপালের ঠিক মাঝখানে লালটিপটা বসিয়েই ডাইনিংয়ে এলো সে।মা তাকে দেখেই বললেন,’কী সুন্দর লাগছে আমার পরীটাকে !একদম নায়িকাদের মত!’..
-ধুর..কী যে বলো’! হাসলো নোশীন।
মা খাবার বাড়তে লাগলেন।মাটির থালায় পান্তা-ইলিশ,পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে সাজিয়ে দিলেন।
সুবিধামত জায়গায় থালাটা নিয়ে বসে সেলফি তুলতে শুরু করলো নোশীন।পরপর বিভিন্ন কায়দায় কয়েকটা
ছবি তুলে থালার দিকে নজর পড়লো তার।মাছের বড় পিস দেখে মা’কে বললো,এত বড় ইলিশ কোথায় পেলে?!

-তোর বাবা এনেছে রে।উৎসব ভাতা পেয়েই আর দেরী করেনি। ভাগ্য ভালো,বড়-বড় দেখে দুটো কিনে
এনেছিলো সময়মতো। নয়ত এবার তাও খাওয়া হতো না!…”
‘হুম’.. লিপস্টিক মুছে ভাত মাখাতে থাকলো নোশীন।কিন্তু দু’লোকমা খেয়েই উঠে পরলো।
পানিভাত খেতে তার কখনোই ভালো লাগে না,জাস্ট ট্রেডিশন ফলো করার জন্য খাওয়া!
তাই মায়ের বকুনি উপেক্ষা করেই নিজের রুমে এগিয়ে গেলো সে।

রুমে এসে ফেইসবুক ওপেন করতেই দেখলো,বান্ধবী মিতু তার ছেলে বন্ধুর সাথে গত পহেলা বৈশাখের কয়েকটা ছবি শেয়ার করেছে।এই মিতুটার উপর সে-বার কত রাগ-ই না হয়েছিল ওদের!
এত করে বলেছিলো,ছেলে-বন্ধুর সাথে ঘুরার পর তাদের সাথে যেন জয়েন করে!কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিতু আসেনি!এ-নিয়ে কতদিন যে তারা মিতুর সাথে কথা বলেনি! অথচ আজ আর কেউ চাইলেও বের হতে পারবে না!
চোখদুটো ভিজে উঠলো নোশীনের। কাজলে মাখামাখি হলো নয়ন!

নিজের কয়েকটা ছবি বাছাই করে মাথায় ফুলের মুকুট এডিট করে নিলো নোশীন।এফবিতে শেয়ার করার সময় আয়েশার কথা মনে হলো! এই আয়েশার যে কী হয়েছে! একদম হুজুরনী হয়ে গিয়েছে আজকাল! সুযোগ পেলেই সবাইকে উপদেশ দিয়ে বেড়াচ্ছে! আরে বাবা সবকিছুতে ইসলাম কেন টেনে আনতে হবে!

কী বিরক্তিকর! প্রাইভেসি অপশনে যেয়ে আয়েশা যেন ছবি দেখতে না পায় তা এডিট করতে করতেই আবার ভাবলো,ধুর! দেখলেই বা কি! কয়েকদিন আগে নিজেই তো কত কিছু করে বেড়িয়েছে! কতবার হিজাব ধরেছে আর ছেড়েছে..ওর কাছে আবার লুকোনোর কি আছে!..ছবিগুলো পাবলিক করেই শেয়ার করলো নোশীন…!

নোটিফিকেশন আসা শুরু হয়েছে। লাইক-লাভ রিয়্যেক্টে ছবিগুলো ভরে যাচ্ছে! আবিদ ভাইয়া কমেন্টকরেছেন,’ওয়াও,জোশ লাগছে নুশু!’ অন্যান্য বান্ধবীরা কমেন্ট করলো; তারাও এখন শাড়ি পরবে, ঘরেই সেলিব্রেইট করবে…মন কিছুটা ভালো হতে থাকলো নোশীনের। ভাবলো এবারের বৈশাখের অপ্রাপ্তিগুলো সব সামনের বৈশাখে সুদে-আসলে উসুল করে নেবে।

.

টাইমলাইনে নোশীনের ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আয়েশা! দেশের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতেও কিছু মানুষের জীবনে কোন পরিবর্তন আসে না ভেবে অবাক হলো! পরমূহূর্তেই নিজের অতীত ভেবে লজ্জিত হলো আয়েশা।কিছুদিন আগেও তো তার চিন্তাভাবনাও ওদের মতোই ছিল। নিজের মন থেকে না চাইলেও বন্ধুদের সাথে তাল মেলানোর জন্য ও নিজেও তো পহেলা বৈশাখ উদযাপন করেছে এতদিন। যদিও প্রতিবছর বৈশাখের আগমন ছিল ওর কাছে এক আতংকের নাম।

বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী আয়েশার বাবা তো আর ওর বন্ধুদের বাবার মতো বৈশাখে উৎসব ভাতা পান না । তাই পহেলা বৈশাখ উদযাপন ওদের পরিবারে বিলাসিতারই নামান্তর। তবে বন্ধুদের তো আর এত কিছু বোঝানো যায় না। বৈশাখী উদযাপন নাকি আজকাল ঈদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ ঈদ হলো মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব আর পহেলা বৈশাখ নাকি বাঙ্গালীদের সার্বজনীন উৎসব। তাই বন্ধু মহলে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের জন্য হলেও এই উৎসব উদযাপন করা এখন সময়ের দাবী।

এপ্রিল মাস আসলেই তাই শুরু হয়ে যায় আয়েশার পরিচিত, আত্মীয় মহলে শাড়ি খোঁজার প্যারা। একবছর পরা শাড়ি তো আবার পরের বার পরলে প্রেস্টিজ থাকে না। তাই এর-তার কাছ থেকে ধার নিয়েই কাজ চালাতে হয় ওকে।। শুধু শাড়ি পরলেই তো আবার চলে না, তার সাথে ম্যাচিং চুড়ি, গয়না কেনা, সারাদিন ঘোরাঘুরির খরচ এসব নিজের টিউশনির টাকা দিয়েই ম্যানেজ করতে হয় আয়েশাকে। এককথায় বৈশাখ মানে ওর কাছে উদযাপনের নামে অনেক কিছু ম্যানেজ করে প্রেস্টিজ রক্ষা করা।

এই বছর আর এসব কোন ঝামেলা করতে হচ্ছে না দেখে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে আয়েশা। তাছাড়া হোম কোয়ারান্টাইনের এই সময়টায় ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে অনেক নতুন কিছু জেনেছে সে। সে এখন জানে যে হাজার বছরের ঐতিহ্যের নামে যেভাবে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয় তা মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাস, আচরণের সাথে কতটা সাংঘর্ষিক!! নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য সূর্যোদয়ের সময়কে নির্ধারণ করা হয় অথচ এসময় সালাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে, মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঘ, হরিণ, পেঁচা প্রভৃতির মুখোশ পরে মিছিল করে এটাই আশা করা হয় যে নতুন বছরে এগুলোর বদৌলতেই মঙ্গল আসবে অথচ এধরনের চিন্তা করা মুসলিমদের জন্য শিরক করার শামিল। মুসলিমরা তো বিশ্বাস করে কল্যাণ-অকল্যাণ সবই মহান আল্লাহর হাতে। তাছাড়া বৈশাখের অনুষ্ঠানগুলোতে ননমাহরাম ছেলে-মেয়েদের ফ্রি-মিক্সিং আর গান-বাজনার যে আয়োজন হয় তাও যে কত গুনাহর দরজা খুলে দেয়—এসব জেনে এখন আতংকে শিউরে ওঠে আয়েশা। এত বছর না জেনে শুধু সামাজিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে এই একদিনেই কত যে পাপ করেছে তা ভেবে এখন অনুশোচনায় দগ্ধ হয় ।

সেই সাথে মহান স্রষ্টার ক্ষমতা আর পরাক্রমশীলতা অনুভব করে শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায় আয়েশা। প্রতি বছর আলেম ওলামারা তো ঠিকই সতর্ক করে যান মুসলিমদের এই ইমান বিধ্বংসী দিনে অংশ না নিতে । কিন্তু কতজন মুসলিম তাদের কথায় কর্ণপাত করে? বরং দিন দিন এসব অনুষ্ঠানে মুসলিমদের অংশগ্রহণ বেড়েই চলছিল। তাইতো মহান রব আজ নিজেই তার বান্দাদের গৃহবন্দী করার ব্যবস্থা করেছেন। সামান্য এক ছেঁায়াচে অণুজীব দিয়ে এমন ত্রাস সৃষ্টি করেছেন যে মানুষ আজ নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই একসাথে জমায়েত হবে না। মনে যতই আফসোস থাকুক আজ একসাথে পাপের রাজ্যে অবগাহন করতে বের হবে না। ফ্রি-মিক্সিং,
ফটোসেশন, একসাথে গানের তালে নাচা-নাচির মতো অজস্র পাপের কাহিনী আজ রচিত হবে না শুধুমাত্র বিশ্বজাহানের প্রতিপালক ইচ্ছা করেছেন বলেই! আসলেই তিঁনি ছাড় দেন , কিন্তু ছেড়ে দেন না। এমন রবের দাস হতে পেরে আজ নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হলো আয়েশার।

সেই সাথে রবের ক্ষমাশীলতার কথা ভেবে আশান্বিত হলো ও। বান্দার পাপের পরিমাণ যতই বিশাল হোক না কেন, স্রষ্টার ক্ষমার বিশালতা তাঁর চেয়েও বেশি। তাই ওযু করে জায়নামাজে বসে পড়লো আয়েশা। প্রথমেই নিজের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো সে। আজ সে জানে , হেদায়েত তো সেই পায় যার প্রতি স্রষ্টা তাঁর কৃপাদৃষ্টি দেন। তাই আজ তার এই বোধদয় স্রষ্টার অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। এরপর বন্ধু দের হেদায়াতের জন্যও দুআ করলো। তারপর অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করলো,

নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কোরবানি,আমার জীবন মরণ সবকিছুই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ জন্য (সূরা আনআম: আয়াত: ১৬২)

মোনাজাত শেষে এক অদ্ভূত আত্মবিশ্বাসে ছেয়ে গেল আয়েশার মন। নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করলো যে জীবন সে সমর্পর্ণ করেছে তার মালিকের নিকট সে জীবন সে আর সমাজের দাসত্ব করবে না। মানুষের অনুকরণ করে পালনকর্তার অবাধ্য হবে না। আয়েশা আর দিকভ্রান্ত হবে না ইনশাআল্লাহ। সে যে পেয়েছে শ্বাশ্বত দাসত্বের সন্ধান!


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন