’সূরা নূর’ এর আলোকে অপবাদ, ব্যভিচার—প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তের বিধান নিয়ে আলোচনা (পর্ব ৩)

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

কেস স্টাডি ২

ভার্সিটিতে তুখোড় সুন্দরী হিসেবে পরিচিত রিয়ার ধরা বাঁধা জীবন কখনোই ভালো লাগতো না। অনেক ছেলের সাথে মেলা মেশা থাকলেও অয়নের সাথে বিয়েটা হয় পারিবারিকভাবেই। বিয়ের পর ওর উচ্ছৃঙ্খল জীবনে বিরক্ত হলেও অয়ন কিছু বলতো না, ভেবেছিলো বাচ্চা হলে ঠিক হয়ে যাবে। হয়েছিলোও তাই কিছুটা। বিয়ের বছর তিনেক পর ফুটফুটে একটা সন্তান আসার পর কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলো রিয়া, সারাক্ষণ একটা তটস্থ ভাব। অয়নের ভালোই লাগতো এটা যেহেতু মাতৃত্বের আগের রিয়ার বেহিসেবী জীবন যাপন ওর একেবারেই পছন্দ ছিলো না। ভালোই কাটছিলো দিনগুলো……

প্রচণ্ড পেট ব্যাথা নিয়ে যেদিন হঠাৎ ডাক্তারের কাছে ভর্তি হল, ডাক্তার কারণ অনুসন্ধানের জন্য সব ধরণের পরীক্ষা নিরিক্ষা করলেন, সেদিনের জীবনের এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার সম্মুখীন হল অয়ন। সে Azoospermia রোগে আক্রান্ত, যার অর্থ সে কোনোদিনও বাবা হতে পারবে না। তাহলে রাহী? তার আদরের সন্তান?

বুকে প্রচণ্ড হাহাকার নিয়ে বাসায় ফিরলো অয়ন। ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না, হঠাৎ করে রিয়াকে কিছু বলতেও পারছে না।

বেশ কিছুদিন রিয়াকে লক্ষ করে বুঝতে পারলো যে রিয়া আসলেই কোনো বিষয় নিয়ে খুব টেন্সড। যা কখনও করে নি, তাই একদিন করলো অয়ন। রিয়ার ফোন চেক করে দেখলো যে ফাহিম নামের কারো সাথে রিয়ার অনেক উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছে, ছেলেটা কিছু একটার ব্যাপারে রিয়াকে ব্ল্যাকমেইল করছে, অনেক টাকা চাচ্ছে। ছেলেটার প্রোফাইল পিকচারের দিকে তাকিয়ে হিমশীতল একটা অনুভূতি হল অয়নের। খুব মিল যেন কার সাথে!

এখন কী করবে অয়ন? এমন স্ত্রীর সাথে বাকিটা জীবন কি কাটানো সম্ভব?

ক) উপরোক্ত ঘটনার ক্ষেত্রে সূরা নূর এর কোন আয়াতগুলো প্রযোজ্য এবং কেন প্রযোজ্য ব্যাখ্যা করুন।

খ) লি’আন সম্পকে বিস্তারিত লিখুন। (সংজ্ঞা, নিয়মসমূহ, ফলাফল)

গ) এ ধরনের শাস্তির বিধান রাখার পিছনের হিকমাহ কি?

উত্তর :

ক) উপরোক্ত ঘটনার ক্ষেত্রে, যেহেতু অয়ন তার রোগ সম্পর্কে জানার পর নিশ্চিত যে, রিয়ার সন্তান তার শুক্রজাত নয় তাই সে রিয়ার প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করতে পারে। তবে রিয়াকে ব্যভিচারের শাস্তির সম্মুখীন করতে হলে অয়নকে এর স্বপক্ষে ৪ জন সাক্ষী উপস্থিত করতে হবে, যা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সম্ভব নয়। এধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে

ইসলামী শরীয়তের বিধান হলো, অয়ন ও রিয়ার মধ্যে লি’আন করানো হবে।

লি’আন কি—এ সম্পকে সূরা নূর এর ৬-৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

“এবং যারা তাদের স্ত্রীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং তারা নিজেরা ছাড়া তাদের কোন সাক্ষী নেই, এরূপ ব্যক্তির সাক্ষ্য এভাবে হবে যে,সে আল্লাহর কসম খেয়ে চারবার সাক্ষ্য দেবে যে,সে অবশ্যই সত্যবাদী

এবং পঞ্চমবার বলবে যে, সে যদি মিথ্যাবাদী হয় তবে তার উপর আল্লাহর লানত

এবং স্ত্রীর শাস্তি রহিত হয়ে যাবে যদি সে আল্লাহর কসম খেয়ে চারবার সাক্ষ্য দেয় যে,তার স্বামী অবশ্যই মিথ্যাবাদী ;

এবং পঞ্চমবার বলে যে, যদি তার স্বামী সত্যবাদী হয় তবে তার উপর আল্লাহর গযব নেমে আসবে

খ) লি’আনের বিস্তারিতঃ

সংজ্ঞা

ইসলামী আদালতে কোন স্বামী যখন স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যাভিচারের অপবাদ দেয় অথবা স্ত্রীর ঔরসজাত সন্তানকে নিজের বলে অস্বীকার করে এবং এর পক্ষে শরীয়াতের বিধাননুযায়ী চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে অপারগ হয়,তখন স্বামী-স্ত্রী দুইজনের মধ্যে লি’আন করানো হয়।

প্রথমে স্বামীকে কুরআনে উল্লেখিত ভাষায় চারবার সাক্ষ্য দিতে হয় যে সে এ ব্যাপারে সত্যবাদী, পঞ্চমবারে বলতে হয় সে মিথ্যাবাদী হলে তার উপর আল্লাহর লানত তথা অভিশাপ বর্ষিত হবে। স্ত্রীকেও একইভাবে চারবার সাক্ষ্য দিতে হয় যে তার স্বামী মিথ্যাবাদী, পঞ্চমবারে তাকে বলতে হয়-তার স্বামী সত্যবাদী হলে তার উপর গযব নেমে আসবে। স্বামী-স্ত্রী দুইজনই যদি এভাবে সাক্ষ্য প্রদানে সম্মত হয় এবং তা সম্পন্ন করে, তবে লি’আন পূর্ণতা লাভ করে।

নিয়মসমূহ

) লি’আন অবশ্যই আদালতে হতে হবে। ঘরে বসে লি’আন হবে না।

) শুধু স্বামী নয়, স্ত্রীরও লি’আন দাবী করার অধিকার আছে। স্বামী তার উপর যিনার অপবাদ আরোপ করলে এবং তার সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করলে সে আদালতে গিয়ে লি’আন দাবী করতে পারবে।

) শুধুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করলে লি’আন অনিবার্য হয়ে পড়ে না।স্বামী যখন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্ত্রীকে যিনার অপবাদে অভিযুক্ত করে অথবা সুস্পষ্ট ভাষায় সন্তানকে নিজের বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে, তখনই লি’আন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

) যদি পিতা সন্তানকে নিজের ঔরসজাত বলে মেনে না নেয়,তবে লি’আন অনিবার্য হয়ে পড়ে।  কিন্তু একবার সন্তানকে গ্রহন করে নেয়ার পর পিতার পক্ষে আর তার বংশধারা অস্বীকার করার উপায় থাকে না। যদি করে তবে সে কাযাফের শাস্তির অধিকারী হবে।

) যদি তালাক দেবার পর স্বামী তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর প্রতি যিনার অপবাদ আরোপ করে, তবে লি’আন হবে না।কারণ, লি’আন শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর জন্য।  তালাকপ্রাপ্তা মহিলা তো তার স্ত্রী নয়। তবে এই অপবাদ আরোপ যদি রুজু করার (স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেবার) মধ্যবর্তী সময়ে হয়,তবে ভিন্ন কথা।

) স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকা অবস্থায় স্বামী তার উপর যিনার অপবাদ আরোপ করে, কিন্তু সুস্পষ্টভাবে গর্ভের সন্তানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার না করে, তবে যিনার অভিযোগ স্বত্তেও গর্ভের সন্তান স্বামীর ঔরসজাত বলে গণ্য হবে। আর স্ত্রী যিনাকারিনী হলেই যে বর্তমান গর্ভস্থ বা গর্ভজাত সন্তান যে যিনার কারণেই জন্ম নিয়েছে তা অপরিহার্য নয়।

লি’আনের ফলাফল

লি’আনের আইনগত ফলাফল যেগুলোর ব্যাপারে ফকীহগণ একমত পোষণ করেছেন, সেগুলো হলো-

  • লি’আন সম্পন্ন হলে স্বামী ও স্ত্রী দুইজনই দুনিয়াবী শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবে।
  • এর ফলে স্বামী -স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং তারা পরস্পরের জন্য হারাম হয়ে যাবে।
  • স্বামী সন্তানকে অস্বীকার করলে সন্তান হবে একমাত্র মায়ের, সে তার বাবার সাথে সম্পর্কিত হবে না এবং তার উত্তরাধিকারীও হবে না।
  • সেই নারীকে ব্যাভিচারিনী বা তার সন্তানকে জারজ সন্তান বলার অধিকারও কারো থাকবে না।এমনকী তার ব্যাভিচারিনী হওয়ার ব্যাপারে কারো যদি সন্দেহ নাও থাকে,তাও তাকে ও তার সন্তানকে একথা বলার অধিকার কারো থাকবে না।
  • নারীর মোহরানা বাতিল হয়ে যাবে না।
  • ইদ্দত পালনকালে স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে খোরপোশ ও বাসস্থানের সুবিধা লাভের হকদার হবে না।
  • লি’আনের পর যে ব্যাক্তি তার স্ত্রী বা সন্তানের বিরুদ্ধে আগের অপবাদের পুনরাবৃত্তি করবে, সে ‘হদের’ যোগ্য হবে।

গ) এ ধরনের শাস্তির বিধান রাখার পিছনের হিকমাহ

ইসলামের ন্যায়সংগত বিচারব্যবস্থারই পরিচায়ক। স্বামী ও স্ত্রীর বিচ্ছেদ এবং পরবর্তীকালে পরস্পরের প্রতি হারাম হয়ে যাওয়ার পেছনের প্রজ্ঞা যদি আমরা চিন্তা করি, যে দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে একবার লি’আনের মত স্পর্শকাতর বিধান সম্পন্ন হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনে কি কোন সুস্থ দাম্পত্য জীবন আশা করা সম্ভব? উত্তর হচ্ছে ‘না’।

তাছাড়া স্ত্রী, সন্তানের দায় দায়িত্ব থেকে স্বামীকে মুক্ত করে ইসলাম যেমন স্বামীর সাথে ন্যায় বিচার করেছে, তেমনি স্ত্রীর মোহরানা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাকেও তার প্রাপ্য অধিকার দিয়ে ন্যায় বিচার সমুন্নত রেখেছে।

আবার এরূপ অপবাদ যে স্ত্রী ও সন্তানের উপর আরোপ হয়েছে,সমাজের অন্যান্যদের দ্বারা তাদের অপমান ও লাঞ্ছনা রোধ করার জন্য ইসলাম সুন্দর সমাধান দিয়েছে-সন্তান মাতৃপরিচয়ে পরিচিত হবে এবং তাকে জারজ সন্তান বা তার মা কে ব্যাভিচারিনী বলার ক্ষেত্রে ইসলাম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অর্থাৎ সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের ক্ষেত্রে সেই সন্তান অন্যদের মতই সুবিধা লাভের হকদার। উদাহরণস্বরূপ-হাদীসে উল্লেখিত হিলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রীর সন্তান পরবর্তীতে মিসরের গভর্নর পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবে তাকে তার মাতৃপরিচয়ে ডাকা হতো।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন