’সূরা নূর’ এর আলোকে অপবাদ, ব্যভিচার—প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তের বিধান নিয়ে আলোচনা (পর্ব ২)

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

আজকের পর্ব থেকে আমরা জানবো আয়েশা (রা:) এর উপর অপবাদের ঘটনা, যা ‘ইফকে’র ঘটনা নামে পরিচিত তার বিভিন্ন দিক সম্পকে।

  • এই ঘটনার প্রেক্ষাপট কি ছিল? একজন উম্মুল মুমিনীনের চরিত্র নিয়ে অপবাদ দেয়ার দু:সাহস কারা, কেন দেখিয়েছিল?
  • এই ঘটনার পরবতী ঘটনাপ্রবাহ থেকে আমরা কিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের সত্যতার প্রমাণ পাই?
  • যখন কোনো মুসলিমের নামে অপবাদ দেয়া হয় তখন অন্যান্য মুমিন নারী-পুরুষের কি করণীয়?

‘ইফকে’র ঘটনার প্রেক্ষাপট

হিজরী পঞ্চম (বেশিরভাগ হাদীস বিদগণের মত অনুযায়ী) সনে সংঘটিত হয় বনু মুস্তালিকের যুদ্ধ বা মুরাইসির যুদ্ধ। এটা সংঘটিত হয় বদর যুদ্ধের পর কিন্তু খন্দকের যুদ্ধের আগে। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে এই যুদ্ধে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফর সঙ্গিনী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন তাঁর প্রিয়তম স্ত্রী আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা।

এখানে উল্লেখ্য যে, এই যুদ্ধাভিযানে প্রথমবারের মত মুনাফিকরাও অংশ নিয়েছিল। যদিও এর পূর্বে ওহুদের যুদ্ধে তারা যুদ্ধ না করে ফিরে এসেছিল যা মুসলিমদের মাঝেও সাময়িক চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল, খন্দকের যুদ্ধেও তারা শঠতা অবলম্বন করেছিল, ইহুদি গোত্র বনু কায়নুকা চুক্তি ভঙ্গের পরেও তাদের ব্যাপারে সুপারিশ করেছিল এবং বনু নাযীরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল। অর্থাৎ প্রতারণা ও অন্তর্নিহিত কুফরের কারণে বরাবরই  মুনাফিকরা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ না করে শত্রুদের জন্য সন্তোষজনক পথই অবলম্বন করতো। কিন্তু এবারের অভিযানে তারা অংশ নিয়েছিল, কারণ এতে জয়লাভ এবং ফলশ্রুতিতে গনীমত লাভ অনেকটা অনুমিত ছিল। আল্লাহও মুনাফিকদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলেছেন যে, আশু লাভের সম্ভাবনা থাকলে এবং যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত হলে তারা যুদ্ধে অংশ নিত। তবে আল্লাহ এটাও বলেছেন, তারা মুসলিমদের সাথে বের হলেও বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই বাড়াতো না আর ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছোটাছুটি করতো। এই আয়াতগুলো তাবুক যুদ্ধের প্রসঙ্গে হলেও এর প্রমাণ বনু মুস্তালিকের অভিযানের সময়ই পাওয়া যায় মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবন উবাই কর্তৃক মুহাজিরদেরকে মদীনা হতে বহিষ্কারের ইচ্ছা পোষণ এবং পরে আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর উপর অপবাদ আরোপের ঘটনা থেকে।

মূল ঘটনায় ফিরে আসি। হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা এই সফরে পরিপূর্ণ পর্দা ব্যবস্থা রক্ষা করেন।  এই সফরের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি নিজেই বলেন, তাঁর জন্য প্রস্তুতকৃত হাওদায় উঠে বসলে হাওদা বহনকারীরা হাওদাটি উটের পিঠে বসিয়ে রশি দ্বারা শক্ত করে বেঁধে দিতো। একইভাবে তাঁকে হাওদাসমেত নামানো হতো। তিনি এতই হালকা-পাতলা ছিলেন যে হাওদায় তার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি হাওদা বহনকারীরা টের পেত না এবং পর্দা রক্ষার জন্য তিনি হাওদা বহনকারীদের সাথে কোন কথাও বলতেন না।

বনু মুস্তালিক যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মদিনার কাছাকাছি পৌঁছে এক স্থানে মুসলিমরা শিবির স্থাপন করেন এবং শেষ রাতে পুনরায় যাত্রার ঘোষণা আসে। এই সময় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রাকৃতিক কাজে শিবির থেকে বাইরে যান এবং ফেরার পথ, দামি মুক্ত বসানো তাঁর হারটি হারিয়ে যায়। সেইখানেই তিনি হারটি খুঁজতে থাকেন। কিন্তু যতক্ষণে তিনি হারটি পেয়ে ফিরে আসেন, ততক্ষণে পুরো কাফেলা ওই স্থানটি ত্যাগ করে অগ্রসর হয়ে গেছে। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার হাওদা বহনকারীরা বুঝতেই পারেনি যে তিনি হাওদায় নেই।

উপায়ন্তর না দেখে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তবে তাঁর বিশ্বাস ছিল অনতিবিলম্বে কাফেলা তার অনুপস্থিতির কথা জানতে পারবে এবং খুঁজতে আসবে। তাই তিনি উত্তমরূপে গায়ের চাদর জড়িয়ে নেন এবং আপন হাওদার স্থানে বসে পড়েন। ক্লান্ত থাকায় ইত্যবসরে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।

সাফওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু এই পুরো কাফেলার পেছনে পেছনে আসছিলেন। এই জায়গায় এসে তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে দেখতে পান, চিনতে পারেন। কারণ পর্দার হুকুম ফরজ হওয়ার আগে তিনি আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে দেখেছিলেন। উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে এমন অবস্থায় দেখে বিস্মিত সাফওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহুর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে বিপদ কালীন দোয়া “ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন “। এতে আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘুম ভেঙে যায়। তিনি দ্রুততার সাথে চাদর দিয়ে নিজের চেহারা ঢেকে নেন।

সাফওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু শুধু একটি প্রশ্ন করেন ” আপনি এখানে কিভাবে রয়ে গেলেন?” আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কোনো উত্তর দেননি, তাদের মাঝে আর কোনো কথাও হয়নি। সাফওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু উম্মুল মুমিনীনকে নিজের উটে উঠিয়ে দিয়ে, সামনে সামনে উটের রশি ধরে দ্রুতপদে যাত্রা করেন। অবশেষে দ্বিপ্রহরের কঠিন গরমের সময় তাঁরা মুসলিম বাহিনীতে পৌঁছে যান।

এভাবে আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহাকে একাকী ফিরতে দেখে মুনাফিকদের প্রধান আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর চরিত্র নিয়ে অপপ্রচার শুরু করেন।

যে কারণে তারা একজন উম্মুল মুমিনীনের চরিত্র নিয়ে অপবাদ দেয়ার দু:সাহস দেখিয়েছিল-

এখানে মূল কারণ হচ্ছে, সূরা মুনাফিক্বুন নাযিল করে আল্লাহ মুনাফিকদের চরিত্রের শঠতার যে দিকটি উন্মোচন করেছিলেন, তার প্রতিশোধ নেয়া। মুরাইসী থেকে ফেরার পথে আনসার-মুহাজিরদের কয়েকজনের মাঝে কোনো এক প্রসঙ্গে কিছুটা বাক-বিতণ্ডা হয়। সেটা কিছুটা বাড়াবাড়ির দিকে যাওয়ার মুহূর্তে রাসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মেটানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু মদীনার অধিবাসী আব্দুল্লাহ ইবন উবাই তো মুসলিমদের ভাঙনই চাইত। সে বলা শুরু করলো, মুহাজিররা মদীনায় আশ্রয় গ্রহণ করে এখন তাদের সমকক্ষ হতে চাইছে, যেমনটা কুকুরকে লালন-পালন করা হয় যেন সে আশ্রয়দাতাকে ফেঁড়ে খেতে পারে। এরপর কসম করে বললো, মদীনায় ফিরে গেলে তারা সম্মানিতরা নিকৃষ্টদের বহিষ্কার করবে।

যায়দ বিন আরক্বাম রাদিয়াল্লাহু আনহু নামক একজন অল্পবয়স্ক ব্যক্তি এই ঘটনা রাসূল সল্লল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবগত করলে, আব্দুল্লাহ ইবন উবাই কসম করে তা অস্বীকার করে। আল্লাহ তখন সূরা মুনাফিক্বুন নাযিল করে ঘটনার সত্যতা বর্ণনা করেন এবং মুনাফিক্বদের মিথ্যা সাক্ষ্যের বিষয়টি প্রকাশ করে দেন।

এভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিমদের প্রতি স্বভাবগত বিদ্বেষ আর সত্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ফলে মুনাফিকদের যে মর্যাদাহানি হয়েছিল, তার হীন প্রতিশোধ গ্রহণের মানসিকতা থেকেই তারা এই অপবাদের ঘটনা প্রচার করেছিল।

আমরা জানি কাউকে ছোট করতে চাইলে বা তার প্রচারিত/প্রকাশিত সত্যের ন্যায়সঙ্গতভাবে বিরোধিতার কোনো রাস্তা না থাকলে বিরোধীদের খুব সাধারণ একটি কৌশল হলো তার/ তার কোনো পরিবারের সদস্যের/ প্রিয় মানুষের চরিত্রের উপর কালিমা লেপনের চেষ্টা করা। এতে তাকে মানসিকভাবে যেমন বিপর্যস্ত করা যায়, তেমনি সমাজের চোখেও তাকে ছোট করা যায়।

মুনাফিকরাও ঠিক একই কাজই করেছিল।

বর্তমান সমাজেও আমরা এই মানসিকতার প্রতিফলন দেখতে পাই। ইসলামিক জনপ্রিয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যেমন এটি করা হয়, তেমনি অবিশ্বাসীরা নিজেদের দ্বন্দ্বেও এটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের আগে বিরোধী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে এহেন স্ক্যান্ডাল মিডিয়ায় খুব ফলাও করে প্রচার করা হয়।

এই ঘটনার পরবতী ঘটনাপ্রবাহ থেকে যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়

প্রায় একমাস পর্যন্ত এই ঘটনা মানুষের মুখে মুখে কথা প্রচার হতে থাকে। রাসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রিয় স্ত্রীকে নিয়ে এই অপপ্রচারের কষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে মুসলিমদের সাথে পরামর্শ করেন এবং প্রত্যেকেই আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার চারিত্রিক নিষ্কলুষতার ব্যাপারে ভাল সাক্ষ্য দেন।

এরপর রাসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়িতে (আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তখন সেখানে ছিলেন) গিয়ে সালাম জানান এবং পাশে বসে কালিমা শাহাদাত পাঠ করে বলেন,

আয়িশাহ, তোমার ব্যাপারে আমার কাছে অনেক কথাই পৌঁছেছে, যদি তুমি এর থেকে পবিত্র হও তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহ করে থাক তাহলে আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তওবা কর। কেননা বান্দা গুনাহ স্বীকার করে তওবা করলে আল্লাহ তা‘আলা তওবা কবূল করেন’।

যেহেতু মানুষের চোখে বিশ্বাসযোগ্য কিছু তাঁর তুলে ধরার ছিল না, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাই সেটাই বললেন, যেটা ইউসুফ আলাইহিস সালামের পিতা বলেছিলেন,

“কাজেই পূর্ণ ধৈর্য্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ এ ব্যাপারে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল।”

তিনি জানতেন যে, আল্লাহ জানেন তিনি পবিত্র এবং আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেবেন। তখনই রাসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ওহী নাযিল হয় এবং সূরা নূরের সেই দশটি আয়াতে (১১-২০) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার পবিত্রতার ঘোষণা দেন এবং এহেন ঘৃণ্য অপবাদ আরোপের ভয়াবহতা তুলে ধরেন।

এই ঘটনা থেকে আমরা অনুধাবন করি যে, কুরআন একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সত্য, কারো বানানো কথা নয় । কখন ওহী আসবে বা তাতে কি থাকবে সেটা রসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামও আগে থেকে জানতেন না। সুদীর্ঘ এক মাস ধরে কষ্টকর যে অবস্থা ও অপবাদ থেকে মুক্তির যে প্রতীক্ষা, সেটা অবসানের কোনো উপায় তাঁর হাতে ছিল না, যতক্ষণ না আল্লাহ সেটা তাঁকে জানিয়ে দিচ্ছেন। আল্লাহর কাছ থেকে ওহী পাওয়ার পরেই তিনি আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার সততা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। এভাবে এই ঘটনা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

মুসলিমদের মাঝে যারা এই অপপ্রচারে অংশ নিয়েছিলেন পরবতীতে তাদের আশিটি বেত্রাঘাত করা হয় ( অপবাদ আরোপের শাস্তি)। আর মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবন উবাই এতটাই অপমানিত হয় যে, এরপর যখনই সে গন্ডগোল করতে যেত লোকেরা তাকে তিরস্কার করে বসিয়ে দিতো। আর আখিরাতে গুরুতর শাস্তির ওয়াদা তো আল্লাহ তার ব্যাপারে দিয়েই রেখেছেন।

যখন কোনো মুসলিমের নামে অপবাদ দেয়া হয় তখন অন্যান্য মুমিন নারী-পুরুষের যা যা করণীয়

আল্লাহ সূরা নূরে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার এ ঘটনাকে আমাদের জন্য মঙ্গলজনক বলে অভিহিত করেছেন। কারণ আমরা এই ঘটনা থেকে একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের কর্মকান্ডের চমৎকার কিছু মুলনীতি পাই। যেমন-

  • ইমানদার নারী-পুরুষ সম্পর্কে উত্তম ধারণা রাখা

১৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-

তোমরা যখন একথা শুনলে, তখন ঈমানদার পুরুষ ও নারীগণ কেন নিজেদের লোক সম্পর্কে উত্তম ধারণা করোনি এবং বলোনি যে, এটা তো নির্জলা অপবাদ তারা কেন এ ব্যাপারে চার জন সাক্ষী উপস্থিত করেনি; অতঃপর যখন তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, তখন তারাই আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী”

অথ্যাৎ মু’মিনদের “নিজেদের লোকের” ব্যাপারে সুধারণা রাখতে হবে।উম্মাহর ঐক্য ও সম্মান রক্ষায় আমাদের সেরকমই তৎপর হতে হবে যেমনটা নিজের বা পরিবারের সম্মান রক্ষায় সচেতন থাকি।

এই ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা দেখি, যয়নাব বিনতে জাহশ রাদিয়াল্লাহু আনহা, তাঁর ও আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহার মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা সত্ত্বেও নিজের কান ও চোখকে হেফাজত করেছিলেন এবং বলেছিলেন তিনি আয়িশা (রাঃ) এর ব্যাপারে ভালো ব্যতীত কিছু জানেন না। তাঁর তাক্বওয়ার কারণে আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেছিলেন।

  • যেকোনো স্ক্যান্ডালের খবর জানলে সেটা নিয়ে ঘাটাঘাটি না করা।

১৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন,

তোমরা যখন এ কথা শুনলে তখন কেন বললে না যে, এ বিষয়ে কথা বলা আমাদের উচিত নয়। আল্লাহ তো পবিত্র, মহান। এটা তো এক গুরুতর অপবাদ”। 

অথ্যাৎ ঘটনা আদতে কি ঘটেছে, তা সত্যি নাকি মিথ্যা এসব আলোচনায় যাওয়াটাই অনুচিত, যতক্ষণ না সেটা ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এই ঘটনার ক্ষেত্রেই আমরা দেখি, কুরআন এবং হাদিসে কি অপবাদ দেয়া হয়েছিল বা ঠিক কারা কারা এটায় জড়িত ছিলেন তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের শিক্ষার জন্য ঘটনাটি উল্লেখ করা হলেও তার বিস্তারিত বিবরণ এমনভাবে বর্ণনা করা হয়নি যাতে কারও সম্মানহানি হয়।

  • যেকোনো স্ক্যান্ডালের খবর জানলে সেটা প্রচার না করা।

১৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যে কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তখন তো শয়তান নির্লজ্জতা ও মন্দ কাজেরই আদেশ করবে”

 অর্থ্যাৎ কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কোনো ঘটনা প্রচার করা যাবে না, যদিওবা ঘটনাটি সত্য হয়। কারণ মুমিনের নিজের জন্যই যেখানে এটা দেখা/ জানার চেষ্টা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে তা প্রচারের মাধ্যমে গুনাহে জারিয়ার পথ তৈরি করা হয়, যা মূলত শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণের নামান্তর।

বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে দেখা যায়, কারও স্ক্যান্ডালের খবর জানলে সত্যমিথ্যা যাচাই ছাড়াই তা শেয়ার করে ছড়িয়ে দেয়াকে অনেকেই দায়িত্ব ভেবে নেন। এর পেছনে প্রথমত একটা আত্মতৃপ্তি কাজ করে যে অমুকরা কত খারাপ, আমরা তো এসবের মাঝে নেই। দ্বিতীয়ত তাঁরা ভাবেন মানুষকে বোধহয় এভাবে সচেতন করছেন।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা এবং প্রচার বরং সমাজে এগুলোকে নরমালাইজ করে। নিয়মিত অপরাধগুলো নিয়ে জানতে জানতে আমাদের এসবের প্রতি সংবেদনশীলতা কমতে থাকে, লজ্জাবোধ উঠে যায় এবং ধীরে ধীরে অপরাধের মাত্রা বরং বাড়তে থাকে। এছাড়াও অনেক নিরপরাধ মানুষ অপমানজনক জীবন যাপনের মুখোমুখি হন, কেউ ধৈর্য্য রাখতে না পেরে আত্মহত্যা করেন।

আমাদের তাই উচিত সচেতন থাকা, আমরা যেন কারও সম্মানহানির কারণ না হই এবং জেনে বা না জেনে কোনো অন্যায়-অশ্লীলতার প্রচারকারী হয়ে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ না হই।

আল্লাহ আমাদের সৎ থাকার, সত্য কথা বলার ও যাবতীয় অশ্লীলতা-অপবাদ ও এ সংক্রান্ত ক্ষতিকর আলোচনা থেকে দূরে থাকার তাওফীক দিন।

আগামী পর্বে আমরা আরেকটি কেস স্টাডি থেকে ব্যভিচার সম্পর্কিত ইসলামী শরীয়তের বিধান জানবো ইনশাআল্লাহ।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন