আমরা জানি পবিত্র কুরআন মজীদ কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম জাতির জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। সেই হিসেবে কুরআনের ১১৪টি সূরার সবগুলোই আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটি সূরা রয়েছে যার সূচনাতেই মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, এই সূরার বিষয়বস্তু জানা মুসলিমদের জন্য ফরজ। আর সেই সূরাটি হলো ’সূরা নূর’।
কি আছে সূরা নূরে, যার কারণে এই সূরাটিকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এত গুরুত্ব দিয়েছেন?
এই সূরায় ইসলামী শাসনব্যবস্থার বেশকিছু স্পর্শকাতর বিধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যার সম্পকে অজ্ঞতার ফলাফল যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা আমাদের বর্তমান সমাজের নানা ঘটনাপ্রবাহে খুব স্পষ্টভাবে টের পাই।
”কুরআনকে জীবন্ত করুন” কোর্সের ২য় ব্যাচের বেশ কয়েকটি ক্লাসে ’সূরা নূর’ এর বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় । এরপর বতমান সময়ের আলোকে কয়েকটি ’কেস স্টাডি’ দিয়ে শিক্ষাথীদের এসাইনমেন্ট করতে দেয়া হয়, যেন কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে ইসলামের কোন বিধান প্রযোজ্য হবে তা সবাই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে
কেস স্টাডি ১
সাজ গোজ করে, টিপটপ থাকতে খুবই পছন্দ করতো শিলা। শাড়ি পরতেও খুব ভালোবাসত। একটা শিল্পমনা পরিবারে বেড়ে ওঠা, বিয়েও হয়েছে এমন পরিবারেই। সুন্দরী হিসেবে প্রশংসা শুনেছে প্রচুর তবে ওর উচ্ছ্বল স্বভাব, ম্যাচিং শাড়ি সাজগোজ এগুলোকে উচ্ছৃংখলতা হিসেবে আখ্যায়িত করেনি কেউ কখনো।
সমস্যাটা শুরু হল যখন বিবিএ পাস করার পর সাথে সাথেই কর্পোরেট জবে ঢুকলো। শিলার রেজাল্ট ভালো থাকলেও বড় ভাইয়ের বন্ধু যখন উনার সদ্য প্রতিষ্ঠিত অ্যাডভার্টাইজিং ফার্মে যোগ দিতে বললেন তখন কাজের স্বাধীনতা পাবে, নিজের সৃজনশীলতা দেখাতে পারবে- এসব ভেবে বেতন কম হলেও এখানেই জয়েন করে সে। অন্য কোথাও চাকরির চেষ্টা করেনি বললেই চলে। কিন্তু যোগ দেয়ার বছর খানেকের মাঝে এত নোংরা পলিটিক্সের স্বীকার হল যে জীবনটাই ছারখার হয়ে গেলো।
অফিসের অন্য সবার মাঝে শিলার মার্কেটিং আইডিয়াগুলোতে সবসময় নতুনত্ব থাকায় খুব পছন্দ করতেন শাফকাত ভাই, ওর বস। বড় ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে ছোটবেলা থেকেই চিনে উনাকে, একটা সহজ সম্পর্কও ছিলো। যেদিন ভাইয়া ওকে মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের হেড করে দিলেন, তখন থেকেই মূলত সমস্যার শুরু। অফিসে যারা বয়সে ওর সিনিয়র ছিল, ওর আগে থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে আছে তারা যেন উঠে পরলো ওর পিছনে।
স্বামী তমাল যেহেতু মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছিলো, বাচ্চা হয় নি এখনও তাই শিলার অঢেল সময় ছিলো, টাকা পয়সার জন্য না, নিজের মেধা কাজে লাগাতেই চাকরিটা করতো। কিন্তু সেইদিকেই অশ্লীল ইঙ্গিত করে মানুষজন তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে নানা কথা বলতো- আজকালকার মেয়েদের কী মজা, স্বামীর থেকে টাকা, অন্য ভাইদের থেকে সুখ আবার সমাজের থেকে সমান অধিকার। কেউ কেউ তো বসের রুম থেকে বের হলে ওকে সরাসরিই বলা শুরু করলো যে আপা নেক্সট প্রমোশনের রাস্তা কি ক্লিয়ার হচ্ছে?
শাফকাত ভাইয়ের সাথে জড়িয়ে এসব অশ্লীল কথা ছড়ালো তার স্ত্রী ও শিলার স্বামীর কানেও। দুইজনেরই ঘর ভাঙ্গার উপক্রম। শেষ মেষ বাধ্য হয়ে শিলাকে চাকরি ছেঁড়ে দিতে বললেন শাফকাত ভাই। ওর কাছে ক্ষমাও চাইলেন। কিন্তু তাতে কি শিলার হারানো সম্মান ফিরে আসবে?
আচ্ছা কোনো মেয়ে যদি পর্দা না করে চলে তবে তার নামে কি ইচ্ছামত এভাবে বলে বেড়ানো যায়?
ক) সূরা নূর এর কোন আয়াতগুলো উপরোক্ত ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং কেন প্রযোজ্য ব্যাখ্যা করুন।
খ) কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার কারণে অপবাদ প্রদানকারী ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী কি শাস্তি পেতে পারে? এ ধরনের শাস্তির বিধান রাখার পিছনের হিকমাহ কি?
উত্তর:
ক) সূরা নূরের অপবাদ সংক্রান্ত আয়াতগুলো উপরোক্ত ঘটনাটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সূরা নুরের ২৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে,
“যারা সতী-সাধ্বী, নিরীহ ঈমানদার নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা ইহকালে ও পরকালে ধিকৃত এবং তাদের জন্যে রয়েছে গুরুতর শাস্তি”।
কেন প্রযোজ্য : ইসলামে একজন ব্যক্তির সম্মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সাতটি সর্বনাশা কাজ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন তার অন্যতম হলো- সতী উদাসীনা মুমিনা নারীর চরিত্রে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া (বুখারী ২৭৬৬)।
এই সতী-সাধ্বী নারী কারা? পর্দা না করলেই কি এই নারীর কাতার থেকে কেউ বের হয়ে যায়? আর তার উপর যাচ্ছেতাই অপবাদ আরোপ করা যায়?
সতী-সাধ্বী নারী তাঁরাই, যারা সমাজে chaste হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার কোনো পূর্ব অভিযোগ/নজির থাকবে না। এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম নারী chaste হিসেবে পরিচিত হলেও এই নিরাপত্তা পাবে, রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই।
সমাজে সুপরিচিত prostitute বা এই জাতীয় মানুষদের ব্যাপারে সতর্ক করতে চাইলে, তখনই কেবল সুস্পষ্ট প্রমাণ ব্যতীতও সাধারণ আলোচনাটা কে শাস্তির আওতামুক্ত ধরা হবে। কিন্তু এই prostitute ট্যাগ এর ক্ষেত্রেও সচেতন থাকতে হবে যে, এটা কি কারো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ফলে দেওয়া হচ্ছে কিনা বা যারা এইধরণের ট্যাগ দিচ্ছে তারা নিজেরা কি চরিত্রবান/সৎ ব্যক্তি কিনা।
শিলার ঘটনায় আমরা দেখি, তার চলাফেরাকে উচ্ছৃংখলতা হিসেবে আখ্যায়িত করেনি কেউ কখনো। কিন্তু যখনই তার মেধা, আইডিয়ার নতুনত্ব ইত্যাদির কারণে এমন একটা প্রমোশন হলো যেটায় তার সিনিয়ররা নিজেদের বঞ্চিত ভাবতে শুরু করেছে, তখনই তার বিরুদ্ধে কানা-ঘুষা শুরু হলো। অথচ তাদের এই অভিযোগের স্বপক্ষে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই, সাক্ষী তো দূরের কথা। এখানে Professional jealousy এবং Male Ego এর কারণে শিলার কলিগরা তার চরিত্র নিয়ে অপবাদ দেয়া শুরু করে। এভাাবে একজন নারী তিনি পর্দা করুক বা না করুক, সুস্পষ্ট প্রমাণ ব্যতীত তাঁর চরিত্র নিয়ে সম্মানহানিকর কোনো কিছু প্রচার করা ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ।
পর্দা না করার কারণে তিনি আল্লাহর কাছে গুনাহগার হবেন কিন্তু তাই বলে এটা তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের জাস্টিফিকেশন দেয় না। ইসলাম কখনই এ ধরনের কাজ সমর্থন করে না। কুরআনে বলা হয়েছে-
“প্রত্যেকেই নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী এবং কেউ অন্য কারো ভার গ্রহণ করবে না”। (সূরা আল-আন’আমঃ১৬৪)
তাই শিলার কলিগরা তার বিরুদ্ধে যা করেছে তা মিথ্যা অপবাদ দেয়ার শামিল এবং ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
খ) কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার কারণে অপবাদ প্রদানকারী ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী কি শাস্তি পেতে পারে, তা উল্লেখ করা হয়েছে সূরা নুরের ৪ নং আয়াত এ-
“যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর এর স্বপক্ষে চার জন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনও তাদের সাক্ষ্য কবুল করবে না। এরাই ফাসিক।”
এধরনের শাস্তির বিধান রাখার পিছনের হিকমাহ-
ইসলামী শরীয়তের প্রতিটি শাস্তির বিধানের পিছনেই হিকমাহ রয়েছে। মিথ্যা অপবাদ আরোপের শরয়ী শাস্তির একটি অন্যতম হিকমাহ হলো এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ-সংঘাতের ফলে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব থেকে কাউকে সমাজে ছোট করার যে প্রবণতা তা প্রতিহত হয়। Without clear proof, you can never state anything against anyone.
অথচ বর্তমান সময়ে শরীয়াহ আইন সম্পকিত জ্ঞান এবং তার প্রয়োগের অভাবে ঠিকই কথার দ্বারা, মুখে, মুখে অপবাদ ছড়িয়ে নিরপরাধ মানুষের জীবনকে কঠিন করা হচ্ছে এবং অশ্লীলতাকে সমাজে নর্মালাইজ করা হচ্ছে। সত্যিকার পাপাচারীদের মনে হবে ‘এ আর এমন কি! সব জায়গাতেই তো এসব হচ্ছে, এখনকার সময়ে এটাই স্বাভাবিক’। এ কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,
“যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহাকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না”। (24:19)
বিদায় হজ্জের ভাষণে রসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
এক মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও মান-সম্মান অন্য মুসলিমের জন্য শারী’আতের হক ব্যতীত হারাম (পবিত্র)। [বুখারীঃ ৬৩২৮-ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
এই আয়াতটি মহান আল্লাহর পরিপূর্ণ ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার কথাই তুলে ধরে। দুনিয়াতেও এই মূলনীতিটি মাথায় রাখা মুমিনদের দায়িত্ব।
উপরোক্ত কেস স্টাডি পড়ে অনেকেই হয়তো প্রশ্ন তুলবেন শিলা পর্দা করে না, ফ্রি মিক্সিং এর পরিবেশে চাকুরী করে বলে তাকে এই অপবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
কিন্তু নারীরা যদি পরিপূর্ণ পর্দা করে এবং ফ্রি মিক্সিং না করে, জরুরী প্রয়োজনে বাইরে বের হয় তাহলেও ঘটনাচক্রে তারা মিথ্যা অপবাদের শিকার হতে পারে। পবিত্র কুরআনেই আমরা এধরনের ঘটনার বিবরণ পাই। আর তা হলো আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার উপর অপবাদের ঘটনা, যা ‘ইফকে’র ঘটনা নামে পরিচিত।
- কি ছিল সেই ঘটনার প্রেক্ষাপট? একজন উম্মুল মুমিনীনের চরিত্র নিয়ে অপবাদ দেয়ার দু:সাহস কারা, কেন দেখিয়েছিল?
- এই ঘটনার পরবতী ঘটনাপ্রবাহ থেকে আমরা কিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের সত্যতার প্রমাণ পাই ?
- যখন কোন নারীর নামে অপবাদ দেয়া হয় তখন অন্যান্য মুমিন নারী-পুরুষের কি করণীয় ? তারা কি এই অপপ্রচারে অংশ নিবে ? নাকি চুপ থাকবে ? নাকি সত্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করবে?
এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা পরবতী পর্ব থেকে জানতে পারবো ইনশাআল্লাহ।