দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে কুরআন থেকে পাওয়া গাইডলাইন (পর্ব ২)

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

প্রশ্ন : নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মুসা ‘আলাইহিস সালাম যখন প্রথমবারের মত ফিরাউনের কাছে যান, তখন ফিরাউনের সাথে তাঁর কথোপকথন এর অংশটা পবিত্র কুরআনে সূরা ত্বহা এর ৪৭-৫২ এবং সূরা আশ-শু’আরা এর ১৮-২১ নং আয়াতে আল্লাহ মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে এবং বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। আর এই কথোপকথন থেকে আমরা দাওয়াতী কাজের কিছু চমৎকার পদ্ধতি শিখতে পারি। সেগুলো কি কি?

উত্তর: নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মুসা ‘আলাইহিস সালাম যখন প্রথমবারের মত ফিরাউনের কাছে যান, তখন ফিরাউনের সাথে তাঁর কথোপকথন এবং তা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা নিম্নরূপ-

সূরা ত্বহা ৪৭ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা

সুতরাং আপনারা তার কাছে যান এবং বলুন, আমরা তোমার রব এর রাসুল, কাজেই আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিও না, আমরা তো তোমার কাছে এনেছি তোমার রবএর কাছ থেকে নিদর্শন। আর যারা সৎপথ অনুসরণ করে তাদের প্রতি শান্তি।

  • প্রথমেই আমরা কাউকে কেন দাওয়াত দিচ্ছি এটা তাকে জানতে এবং জানাতে হবে। যেমন মুসা ‘আলাইহিস সালাম জানিয়েছেন যে, আল্লাহ, যিনি প্রত্যেকের রব, তিনি তাঁদেরকে তাঁর রসূল বা বার্তাবাহক হিসেবে পাঠিয়েছেন। অথ্যাৎ তারা মানুষকে দাওয়াত দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। মুসলিম হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে অন্যকে হিদায়াতের পথে আহ্বান করা। আমরাও সেই দায়িত্ববোধ থেকেই দাওয়াতি কাজ করছি-এই বিষয়টা প্রথমেই ক্লিয়ার করে নিতে হবে।
  • এরপর মুসা (আ:) জানাচ্ছেন তারা (রাসূলরা) আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে এসেছেন। অথ্যাৎ তারা নিজেরা মনগড়া কোনো কথা বলছেন না, যা বলছেন, করছেন তা আল্লাহর কতৃক প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতেই করছেন। আমরাও যখন কাউকে কোনো বিষয়ে দাওয়াত দিতে যাবো, তখন আমরা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সেই বিষয়ের সাধ্যমত রেফারেন্স জোগাড় করে রাখবো এবং আল্লাহর নিদর্শন বোধগম্যভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করবো, ইন শা আল্লাহ।
  • এরপরের অংশটা খুব চমৎকার। “শান্তি যারা সৎপথের অনুসারী” – এই কথাটা আমরা এখন অধিকাংশ সময়ই খেয়াল রাখতে পারি না। আমরা দাওয়াত দেয়া শুরুই করি খুব আক্রমণাত্মক বা যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিতে। কিন্তু আমরা মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময়েও দেখি, তিনি রোমান সম্রাট এবং আরো অনেককে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে যেসব পত্র দিয়েছিলেন, তার শুরুতে লিখেছিলেন, “ইসলাম গ্রহণ করে নাও, শান্তিতে থাকবে” বা, “শান্তি তাদের প্রতি যারা সৎপথ অনুসরণ করে”। হ্যাঁ, এটা অভিবাদনের সালাম না, কিন্তু নম্রতার সাথে শান্তির প্রতি এ আহ্বান নিঃসন্দেহে কিছু ইতিবাচক প্রভাব আনতে পারে।

সূরা ত্বহা ৪৮ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা

নিশ্চয় আমাদের প্রতি ওহী পাঠানো হয়েছে যে , শাস্তি তো তার জন্য যে মিথ্যা আরোপ করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

এরপর মুসা ‘আলাইহিস সালাম জানিয়েছেন সত্য গ্রহণ না করলে কি হবে। এটাও রসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন, যখন তিনি সাফা পর্বতের উপরে উঠে কুরাইশদের বিভিন্ন গোত্রকে প্রথমবারের মত ইসলামের দিকে ডেকেছিলেন। এখানে এটাও লক্ষ্যনীয়, যে শাস্তি বা বিচারের কথা বলা হচ্ছে সেটা একান্তই আল্লাহর আদেশে এবং এখতিয়ারে। এটা আমার মনগড়া কোনো ভয় দেখানো নয়।

অর্থাৎ ইসলামের একটা পূর্ণ ধারণা দেয়া প্রয়োজন, যাতে মানুষ বুঝতে পারে। আমরা বর্তমানে অনেক সময়ই খন্ডিত ভাবে কিছু বিধানের যৌক্তিকতা বা ইত্যাদি বলে মানুষকে দাওয়াত দিতে যাই, কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখি কেউ যখন কোনো একটা বিধানের পেছনের কারণ তার জ্ঞানে বা প্রজ্ঞায় বুঝতে পারছে না, তখন তারা আবার বিভ্রান্তির দিকে চলে যায়। তাই আমাদের দাওয়াত শুরু করা উচিত আল্লাহর পরিচয় দিয়ে এবং তিনি যেসব নিদর্শনগুলো আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন তা হিকমাহ এর সাথে উপস্থাপন করে এবং চূড়ান্ত পরিণতি আখিরাতের কথা স্মরনের মাধ্যমে। কারণ চূড়ান্ত দিনের পুরষ্কার বা শাস্তির ধারণা না থাকলে ইসলামের বুঝ কখনোই পূর্ণ হতে পারে না।

সূরা ত্বহা ৪৯৫০ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা

ফিরআউন বলল, হে মূসা! তাহলে কে তোমাদের রব?

মূসা বললেন, আমাদের রব তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার সৃষ্টি আকৃতি দান করেছেন, তারপর পথনির্দেশ করেছেন।

এখানে ফিরাউন “রব” এর পরিচয় জানতে চায়। মুসা ‘আলাইহিস সালামের উত্তর থেকে আমরা আল্লাহর পরিচয় জানানোর উপায় সম্পর্কে জানতে পারি।

যেহেতু ফিরাউন নিজেকেই রব মনে করতো, অন্য কাউকে কর্তৃত্বের অধিকারী হিসেবে মানতে প্রস্তুত ছিল না তাই মুসা ‘আলাইহিস সালাম তাকে আল্লাহর সেই পরিচয়গুলোই তুলে ধরেন যার বিরুদ্ধে বলার কিছু ফিরাউনের ছিল না। অর্থাৎ কাকে, কিভাবে বা কি নিদর্শনের মাধ্যমে বুঝালে কাজ হতে পারে, এই হিকমাহ আমাদের থাকতে হবে।

আমরা যখন সৃষ্টিজগৎ নিয়ে জানবো আমরা দেখবো প্রত্যেক জীবকে তার জন্য যেরকম আকার-আকৃতি হলে নিখুঁত হতো, আল্লাহ ঠিক সেভাবেই তাকে সৃষ্টি করেছেন। তার প্রকৃতিগত আবশ্যকতা অনুসারে বাসস্থান, পানাহার ও জীবনাচরণ শিক্ষা দিয়েছেন। এই ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা যে কাউকেই চমৎকৃত করবে।

তবে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, ফিরাউন এসব নিদর্শনের কথা শুনেও আল্লাহর আনুগত্য স্বীকারে  আগ্রহী হলো না বরং ঔদ্ধত্য দেখালো। এই ব্যাপারেই মুসা ‘আলাইহিস সালাম ‘বিশ্বাস করা/বুঝ থাকার’ কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থ্যাৎ, আল্লাহর নিদর্শন অকাট্যভাবে সবার সামনেই আসবে কিন্তু,হিদায়াতের অনুসারী তারাই হবে, যারা অন্তরের দিক দিয়ে অহংকারমুক্ত থাকবে এবং সত্য গ্রহণে আন্তরিক হবে। অন্যের মানসিকতা বুঝে তাই, তার অন্তরের অবস্থার দিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

সূরা ত্বহা ৫১৫২ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা

ফিরআউন বলল, তাহলে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কী ?

মূসা বললেন, এর জ্ঞান আমার রব এর নিকট কিতাবে রয়েছে, আমার রব ভুল করেন না এবং বিস্মৃতও হন না

এরপর ফিরাউন ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে মুসা (আ:)কে লক্ষ্যচ্যুত করতে চায়, একই সঙ্গে লোকদেরও তাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে চায়। সে জানতে চায়, অতীতে যারা মারা গেছে তাদের তাহলে কি অবস্থা! অর্থাৎ তার ধারণা ছিল, লোকেরা যদি এটা শোনে যে তাদের পূর্বপুরুষেরা আগুনের অধিবাসী, তাহলে তারা নিশ্চয়ই আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত রাসুলকে পছন্দ করবে না।

মুসা ‘আলাইহিস সালাম তখন খুব হিকমাহ এর সাথে জানালেন যে, অতীতের সবার জ্ঞান আল্লাহর কাছেই সুস্পষ্ট ভাবে আছে, তিনি ভুলে যান না, ভুল করেন না। কাজেই কারো উপর জুলুমও তিনি করবেন না। আর এটি যেহেতু আমাদের জ্ঞানের বাইরে, তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য করাও আমাদের কাজ না। আমাদের কাজ আমাদের কাছে যা পৌঁছেছে, সেই সত্যের উপর আমল করা।

সূরা আশশুআরা এর ১৮২১ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা

ফেরাউন বলল, আমরা কি তোমাকে শিশু অবস্থায় আমাদের মধ্যে লালনপালন করিনি? এবং তুমি আমাদের মধ্যে জীবনের বহু বছর কাটিয়েছ। তুমি সেইতোমরা অপরাধ যা করবার করেছ। তুমি হলে কৃতঘ্ন।

মূসা বলল, আমি সে অপরাধ তখন করেছি, যখন আমি ভ্রান্ত ছিলাম। অতঃপর আমি ভীত হয়ে তোমাদের কাছ থেকে পলায়ন করলাম। এরপর আমার পালনকর্তা আমাকে প্রজ্ঞা দান করেছেন এবং আমাকে পয়গম্বর করেছেন।

এখানে ফিরাউন মুসা ‘আলাইহিস সালামকে স্মরণ করিয়ে দেয় তার বাড়িতে বড় হওয়ার কথা এবং পরবর্তীতে এক লোককে ভুলবশত হত্যা করার কথা। তখন মুসা ‘আলাইহিস সালাম সেটা মোটেও অস্বীকার করেননি বরং জানিয়েছেন তখন তিনি ভ্রান্ত ছিলেন এবং পরবর্তীতে আল্লাহ তাঁকে হিকমাহ দিয়েছেন।

এই অংশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জীবনেও অনেকেই আমাদের অতীতের ভুলগুলো তুলে ধরে আমাদের লক্ষ্যচ্যুত করতে চায়। আমরাও তখন স্বীকার করবো যে, হ্যাঁ, আমিও ভুল করেছি। কিন্তু আল্লাহ এখন আমাকে হিদায়াত দিয়েছেন। কাজেই এখন ভুলের উপর অটল থাকার কোনো সুযোগ নেই।

অনেক মুরব্বির কাছে আমরা শুনি, “তাহলে আমাদের আব্বা-আম্মা কি ভুল ইসলাম পালন করেছিল?” বা “তুমিও তো আগেও গীবত করতে, এই এই অন্যায় করতে”। এটাই আমাদের বুঝতে হবে এবং তুলে ধরতে হবে যে, আগে কি হয়েছে, সেটা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু সত্য জানার পরেও না মানাটাই হলো অন্যায়। আর আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে তার অবস্থার প্রেক্ষিতে বিচার করবেন। এ ব্যাপারে কেউই জুলুমের স্বীকার হবে না।

আর আমরা কৃতজ্ঞ হবো সবার আগে আল্লাহর প্রতি। এটা আল্লাহর অধিকার। কোনো ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞ হতে গিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত সত্য অস্বীকার করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। এটাও হিকমাহ এর সাথে বুঝাতে পারার যোগ্যতা একজন দায়ী হিসেবে আমরা রাখার চেষ্টা করবো।”


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন