প্রশ্নঃ ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সাথে উনার বাবার কথোপকথন আছে সূরা মারইয়ামঃ ৪২-৪৮ আয়াতে। এই আয়াতগুলো থেকে আমরা দাওয়াতী কাজের কী strategy শিখতে পারি? বিস্তারিত লিখুন।
উত্তর: ‘দাওয়াত’ (دعوة) এর শাব্দিক অর্থ ডাকা, আমন্ত্রণ জানানো, আহবান করা। নবীগণের সর্বপ্রথম কর্তব্য হচ্ছে মানবজাতিকে আল্লাহর দিকে আহবান করা।
কুরআনুল কারীমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিশেষ পদবী হচ্ছে- আল্লাহর দিকে আহবানকারী হওয়া।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদাংক অনুসরণ করে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া উম্মতের উপরও ফরয করা হয়েছে। কুরআনুল কারীমে এ সম্বন্ধে বলা হয়েছে
“তোমাদের মধ্যে একটি দল এমন থাকা উচিত, যারা মানুষকে কল্যাণের প্রতি দাওয়াত দেবে (অর্থাৎ) সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজের নিষেধ করবে।” [আলে-ইমরানঃ১০৪]
এখন এই দাওয়াতের কাজটি কিভাবে করতে হবে তার গাইডলাইনও কিন্তু আমরা কুরআন ও সুন্নাহতে পাই চমৎকারভাবে।
সূরা নাহলের ১২৫ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা রাসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-
“আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়। নিশ্চয় আপনার রব, তাঁর পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়, সে সম্বন্ধে সবিশেষ এবং কে সৎপথে আছে, তা-ও সবিশেষ অবহিত”।
আর এই আয়াতের চমৎকার প্রায়োগিক উদাহরণ রয়েছে সূরা মারিয়ামের ৪২-৪৮ নং আয়াতে। ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালামের সাথে তাঁর বাবার কথোপকথন আছে এই আয়াতগুলোতে।
৪২ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা:
“যখন তিনি তাঁর পিতাকে বললেনঃ হে আমার পিতা, যে শোনে না, দেখে না এবং তোমার কোন উপকারে আসে না, তার এবাদত কেন কর?”
সম্বোধন– ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালাম নিজে আল্লাহর একজন নবি হওয়া সত্ত্বেও নিজ মুশরিক পিতাকে সম্বোধন করছেন খুব আন্তরিকতার সাথে, ‘হে আমার পিতা’ বলে। আমরা দেখি কথা বলার ক্ষেত্রে, কাউকে কোনো কাজে মোটিভেটেড করার ক্ষেত্রে সম্বোধন ও বাচনভঙ্গি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদেরকে কেউ যখন খুব আন্তরিকতার সাথে, আমাদের সাথে তার বিশেষ সম্পর্কসূচক সম্বোধন ব্যবহার করে কিছু বলে, তার অনুরোধ ফেলে দেয়া কিন্তু কঠিন হয়ে যায়।
ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালাম কিন্তু কোনো তিরস্কার করেননি তাঁর পিতাকে, কোনো কঠোর ভাষাও ব্যবহার করেন নি, বরং তাঁর পিতৃত্বের স্বাভাবিক মর্যাদার দিকে খেয়াল রেখে খুব বিনম্রভাবে সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দিচ্ছেন। আমরা দেখব পরবর্তী প্রতি আয়াতেও তিনি বারবারই ‘হে আমার পিতা’ বলে সম্বোধন করছেন এবং তাদের জীবনাদর্শের অসারতা তুলে ধরছেন।
কাজেই নিকটাত্মীয়দের দাওয়াতের ক্ষেত্রে আমরা এটা খুব সহজে প্রয়োগ করতে পারি।
আন্তরিক আবেগের সাথে “আম্মু…খালামণি”… ইত্যাদি সম্বোধন বা বান্ধবীর ক্ষেত্রেও আন্তরিকতার সাথে হিতাকাংখী হয়ে তাদের কাছে সত্য তুলে ধরাটা আমাদের দায়িত্ব।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে সত্য যে, আমরা দ্বীনে আসার পর আচার-ব্যবহারে ভালো হওয়ার পরিবর্তে আরো কষ্টদায়ক হয়ে যাই। সবার সমালোচনা করি কঠোর ভাষায়। আব্বা-আম্মা কেন মানে না, কেন আমাদের শিখায় নাই…ইত্যাদি। অথচ কাউকে হিদায়াতের দিকে ডেকে সাওয়াবের অংশীদার হওয়ার যে সুযোগ আলহামদুলিল্লাহ পেয়েছি এটাও তো আমরা ভাবতে পারতাম। কেননা, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (খায়বার যুদ্ধের সময়) আলী (রাঃ) কে সম্বোধন করে বললেন, “আল্লাহর শপথ! তোমার দ্বারা একটি মানুষকেও যদি আল্লাহ সৎপথ দেখান, তবে তা (আরবের মহামূল্যবান) লাল উট অপেক্ষা উত্তম হবে।” (বুখারী ৩০০৯, ৩৭০১, ৪২১০, মুসলিম ৬৩৭৬)
আন্তরিক সম্বোধনের পর ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালাম আক্রমনাত্মক না হয়ে খুব সরল ভাষায় মূর্তিপূজার অসারতা তুলে ধরেছেন, এই বলে যে, যার নিজের দেখার, শোনার বা উপকার করার কোনো ক্ষমতা নেই, তার ইবাদাত করার কি আছে?
আমরা অনেক সময় খুব যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে কাউকে বলে ফেলি, “তুমি খুবই ভুল করছো…ইত্যাদি”। ফলে সে ও রক্ষ্মণাত্মক মনোভাব থেকে পালটা কিছু বলে ফেলে বা কুযুক্তি দেয় বা কথা শুনতেই চায় না। কিন্তু ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালামের বলার ভঙ্গি এমন যেটা কাউকে চিন্তা করতে অনুপ্রেরণা দেবে।
৪৩ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা
“হে আমার পিতা, আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে; যা তোমার কাছে আসেনি, সুতরাং আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সরল পথ দেখাব।”
তথ্যের উৎস সম্পকে অবহিত করা-এখানেও ‘হে আমার পিতা’ সম্বোধন করে তিনি জানাচ্ছেন তাঁর কাছে আগত অহীর কথা। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ, কিসের ভিত্তিতে তিনি দাওয়াহ দিচ্ছেন, বা তাদের প্রচলিত জীবনাচার পরিহার করতে বলছেন, এটাতো জানাতে হবে। তিনি বলছেন, তাঁর কাছে এমন জ্ঞানে এসেছে, যেটা তাঁর পিতা বা অন্যদের নেই এবং এজন্যই তিনি তাঁর অনুসরণের আহবান জানাচ্ছেন।
আমরা অনেক সময়ই দেখি মুরুব্বিরা বলেন আমরা কি জানিনা নাকি বা আমাদের আম্মা-আব্বারা কি ভুল জানতেন…ইত্যাদি। কাজেই, আমাদেরও কুরআন-সুন্নাহ থেকে রেফারেন্স সাথে রাখতে হবে, এবং বিনয়ী হয়ে বুঝাতে হবে কেন আমরা কি বলছি।
‘আমি তোমাকে সরল পথ দেখাব’ এই কথাটাও একটা আন্তরিকতা আর নির্ভরতা দেয় যে, “তুমি একা নও, আমিও, ইন শা আল্লাহ্, তোমার সাথে আছি, আমরা হাত ধরে সত্যের পথে একসাথে হাঁটবো, ইন শা আল্লাহ”। কারণ, দ্বীনের জ্ঞানের ধারণা/বুঝ পাওয়ার পর মানুষের মনে হতে পারে, “এই পথ তো কঠিন…এত দিনের ফেলে আসা জীবনের সাথে অনেক বৈপরীত্য… কিভাবে চলবো!”
৪৪ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা
“হে আমার পিতা, শয়তানের এবাদত করো না। নিশ্চয় শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য।”
প্রকৃত শত্রুকে চিহ্ণিত করতে সাহায্য করা- আমাদের প্রকৃত শত্রুকে চিনতে হবে, অন্যকেও চেনাতে হবে। শয়তানই নিজে আল্লাহর অবাধ্য এবং মানুষকেও সে-ই আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে প্ররোচিত করে। সে নিজেই বলেছে,
“এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।” [সূরা আল-আ’রাফ, আয়াতঃ১৭]
সূরা কাহফে আল্লাহও শয়তানের ব্যাপারে বলছেন,
“সে তার পালনকর্তার আদেশ অমান্য করল। অতএব তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। এটা জালেমদের জন্যে খুবই নিকৃষ্ট বদল।” (আয়াত-৫০)
প্রতি জুমু’আ বারে সূরা কাহফ পড়া রেকমেন্ডেড আর নিয়মিত এই রিমাইন্ডারটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের শত্রু শয়তানই আমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুতির প্ররোচনা দেয়। কেননা কাউকে যখন ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়, সে অধিকাংশ সময়ই ভাবে যে, তাকে বুঝি তার ছোট্ট বাবলের মধ্যকার আমারমদায়ক জীবন থেকে বঞ্চিত করতে বা কোনো ঝামেলায় ফেলে দিতেই এই আহবান করা হচ্ছে। এটা আমরা কুরআনেই দেখি মুসা ও হারুন ‘আলাইহিমুস সালাম সম্পর্কে তখনকার পরামর্শকারীরা যা ভাবছিলো,
“তারা বললঃ এই দুইজন নিশ্চিতই যাদুকর, তারা তাদের যাদু দ্বারা তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বহিস্কার করতে চায় এবং তোমাদের উৎকৃষ্ট জীবন ব্যবস্থা রহিত করতে চায়।” [সূরা ত্ব-হাঃ৬৩]
কাজেই এটা আমাদের বুঝতে এবং বুঝাতে হবে যে, আমরা নই বরং শয়তানই আমাদের ও যাদের আমরা দাওয়াত দিচ্ছি তাদের শত্রু এবং সে জাহান্নামের দিকেই কেবল আহবান করে। ছোট ছোট প্রতিটি কাজে তার পদাংক অনুসরণের মাধ্যমে একসময় মানুষ আল্লাহর বড় ধরণের অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়, আল্লাহর সাথে শিরক করে বসে, মূর্তিপূজাও এমনই একটি কাজ। পরম দয়াময় আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজ হাতে বানানো প্রতিমা আর নিজেদের মনগড়া কিছু নামের উপাসনা কিয়ামতের দিন ঐ উপাস্যসহ জাহান্নামে পতিত হওয়ার কারণই হবে, যদি না আল্লাহ অনুগ্রহ করে মৃত্যুর পূর্বেই হেদায়াত দেন।
কিন্তু এটা বুঝাতে গিয়ে তাদের উপাস্যদের ব্যাপারে মন্দ মন্তব্য করা যাবে না, কেননা তখন তারা সত্য ইলাহ আল্লাহকে নিয়ে মন্দ মন্তব্য করে বসবে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো এই আদব এখন অনেকেই মনে রাখতে পারে না। তারা অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য, ধর্মীয় ব্যক্তিদের নিয়ে মন্দ মন্তব্য, কৌতুক, কার্টুন তৈরি করে থাকে, ফলে, একদিকে যেমন আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় কাজ তারা করছে (রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“মু’মিন ব্যক্তি অশ্লীলভাষী হতে পারে না” – [তিরমিযী, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৪৮৪৭]), “কিয়ামাত দিবসে মু’মিনের দাঁড়িপাল্লায় সচ্চরিত্র ও সদাচারের চেয়ে বেশি ওজনের আর কোন জিনিস হবে না। কেননা, আল্লাহ্ তা‘আলা অশ্লীল ও কটুভাষীকে ঘৃণা করেন” – [জামে‘ আত-তিরমিজি, সহীহাহ্ (৮৭৬)]
অন্যদিকে সমাজেও ঘৃণা, আর বিশৃংখলা তৈরি করছে কেননা, ঐ ধর্মাবলম্বী তো এরপর আর ইসলামের আহবান অত সহজে শুনতে বা মানতে চাইবে না বরং আরো সীমালংঘনের দিকে আগাতে পারে।
৪৫ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা
“হে আমার পিতা, আমি আশঙ্কা করি, দয়াময়ের একটি আযাব তোমাকে স্পর্শ করবে, অতঃপর তুমি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাবে।”
শিরকের পরিণতি সম্পকে জানানো- কেন আমরা আরেকজনকে হিদায়াতের পথে ডাকি/ডাকব? অন্যথায় সে আল্লাহর আযাব ও ক্রোধে নিপতিত হবে, আর জাহান্নামে স্থায়ী হবে। এটা সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়াটাও কর্তব্য। আমরা অনেক সময়ই ইসলামে ধর্মীয় সম্প্রীতি ইত্যাদি বলে ইসলামের দিকে ডাকি কিন্তু, আমরা নবী-রাসুলগণের দাওয়াতি পন্থায় দেখব তাঁরা মূল সত্যকে আগে উপস্থাপন করেছেন।
তবে এটাও লক্ষ্যনীয় যে হুমকি নয় বরং ভালোবাসার দাবি থেকে ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালাম আযাবের ‘আশংকা’র কথা বলেছেন। অর্থাৎ, তিনি যে পিতার ভালো-মন্দের ব্যাপারে চিন্তিত এটা তাকে বুঝিয়েছেন।
এই আয়াত ও আগের আয়াতে লক্ষনীয় বিষয় হলো, আল্লাহকে ‘আর-রহমান’ বা দয়াময় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে বহু জায়গায়, এমনকি আযাব সংক্রান্ত আয়াতগুলোতেও নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘আর-রহমান’ হিসেবে। এটা আমাদেরকে আল্লাহর অসীম ক্ষমা ও দয়ার কথা মাথায় রেখে আল্লাহর কাছে ফিরে আসতে যেমন অনুপ্রেরণা দেয়, তেমনি এটাও রিমাইন্ডার যে, অপরাধীরা পার পাবে না এত দয়ার পরেও। কাজেই, শিরকের অপরাধ কতটা ভয়াবহ! এই ব্যাপারটিও আমাদের দাওয়াতের মাঝে উল্লেখ করা প্রয়োজন। সূরা হিজরের ৪৯-৫০ আয়াতে আল্লাহই বলেছেন,
“আপনি আমার বান্দাদেরকে জানিয়ে দিন যে, আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল দয়ালু। এবং ইহাও যে, আমার শাস্তিই যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।”
শয়তানের সঙ্গী হওয়ার ব্যাপারে সতর্কবার্তাটাও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শয়তান যে বিতাড়িত, অভিশপ্ত আর জাহান্নামে চিরস্থায়ী এটা আল্লাহ বহু অমুসলিমের মনেও গেঁথে দিয়েছেন।
৪৬-৪৭ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা
“পিতা বললঃ যে ইব্রাহীম, তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, আমি অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণনাশ করব। তুমি চিরতরে আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও।”
“ইব্রাহীম বললেনঃ তোমার উপর শান্তি হোক, আমি আমার পালনকর্তার কাছে তোমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি মেহেরবান।”
ধৈর্য্য ও ইতিবাচকতা – ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালামের এত চমৎকার বিনম্র আহবানের পরেও পিতা তাঁকে সম্বোধনেই বুঝিয়ে দিলেন তিনি এই সত্য গ্রহণে রাজি নন। তিনি “ইবরাহিম” বলেই সম্বোধন করেছেন, ‘হে পুত্র’ নয়। অর্থাৎ, আন্তরিকতার লেশমাত্র নেই, বরং আছে প্রাণনাশের হুমকি।
পিতার চরম অন্যায় আচরণের পরও ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালাম হতাশ হননি, মন্দ আচরণ করেননি, অভিশাপ দেননি, বরং আল্লাহর রাহমাহর কথা স্মরণ করিয়ে জানিয়েছেন তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তখনো মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা নিষিদ্ধ হয়নি।
আমরাও এখান থেকে ধৈর্য্য ও ইতিবাচকতার শিক্ষা পাই। প্রথমবার কেউ আমাদের দাওয়াত গ্রহণ না করলেও হতাশ হওয়া যাবে না, বরং লেগে থাকতে হবে এবং তাদেরকে দূরেও সরিয়ে দেয়া যাবে না। তাদের অভিশাপও দেয়া যাবে না, কারণ আমরা জানি না আল্লাহ ভবিষ্যতে তাদের হিদায়াত দিবেন কিনা।
৪৮ নং আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা
আমিপরিত্যাগ করছি তোমাদেরকে এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের এবাদত কর তাদেরকে; আমি আমার পালনকর্তার এবাদত করব। আশা করি, আমার পালনকর্তার এবাদত করে আমি বঞ্চিত হব না।
সীমালংঘনের আশংকা থাকলে সেই স্থান পরিত্যাগ করা: তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, এখানে তাঁর আসলেই কিছু করার নেই, তখন তিনি ঐ মন্দ স্থান এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করলেন। এটা একজন মুসলিমের কর্তব্য। আশ-পাশের মানুষ যদি সত্যিই আল্লাহর অবাধ্যতায় সীমালংঘন করে, তবে আমাদের অবশ্যই তাদের থেকে দূরে সরে যেতে হবে। অন্যথায় তাদের পাপের মাঝে আমরাও শরীক হয়ে যেতে পারি। যেমনটা রসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন কোনো পাপ কাজ সংঘটনের সময় বাধা দিতে না পারলে ঐ স্থান থেকে সরে যেতে হবে, কেননা তখন ওখানে আল্লাহর ক্রোধ আপতিত হয়।
“যেখানে কোনো মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে সেখানে কখনই দাঁড়াবে না; কারণ সেখানে উপস্থিত লোকেরা যদি তার হত্যা প্রতিরোধ না করে তাহলে সকলের উপরে লানত ও অভিশাপ বর্ষিত হয়। যেখানে কোনো মানুষকে অত্যাচার করে মারধর করা হচ্ছে সেখানে দাঁড়াবে না। কারণ উপস্থিত সকলের উপরেই লানত-অভিশাপ বর্ষিত হয়।”
(আহমদ, তাবারানী, বাইহাকী। বাইহাকীর সনদটি হাসান বলে ইরাকী এহইয়াউ উলূমিদ্দীনের তাখরীজে উল্লেখ করেছেন।)
এখানে একটা গুরূত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হলো, পূজা দেখতে না যাওয়া। বহু মুসলিম পরিবারের মানুষ না জানার কারণে পূজামণ্ডপে ঘুরতে যান এই ভেবে যে, আমরা তো আর পূজা করছি না। অথচ, শিরকের মত চরমতম জুলুম আমরা কখনোই দেখতে যেতে পারি না। এই ব্যাপারটি আমাদের মুসলিমদের মাঝে দাওয়াতে তুলে ধরা প্রয়োজন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর ক্রোধের হাত থেকে হিফাযত করুন এবং ভুলগুলো ক্ষমা করুন।
শেষ বাক্যে আবারো সত্যের আহবান এলো যে, আমরা আশা রাখি, আল্লাহর ইবাদত করে আমরা কখনোই বঞ্চিত হবো না। কেননা, একজন মু’মিনের জন্য দুনিয়ার ভালো-মন্দ সবই প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকর। কেননা, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
“মু’মিনের অবস্থা বিস্ময়কর। সকল কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মু’মিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। তারা সুখ-শান্তি লাভ করলে শুকর-গুজার করে আর অস্বচ্ছলতা বা দু:খ-মুসীবাতে আক্রান্ত হলে সবর করে, প্রত্যেকটাই তার জন্য কল্যাণকর”। [মুসলিমঃ৭৩৯০]।
কেউ যদি আল্লাহর ইবাদত করতে গিয়ে, আল্লাহর পথে ডাকতে গিয়ে দু’নিয়াতে কোনো কষ্টের মুখোমুখিও হয়, আল্লাহ এর ক্ষতিপূরণ করে দিবেন, ইন শা আল্লাহ। কাজেই, আল্লাহর দিকে কাউকে ডাকার পরে সে সাড়া না দিলে, বা, আমাদের ক্ষতি করতে চাইলে আমাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই, আমরা যেন নিজেরা সত্যের অবলম্বন ছেড়ে না দেই, আশা না হারাই। কেননা, আল্লাহর রহমত থেকে মু’মিন কখনো নিরাশ হয় না। [সূরা ইউসুফঃ৮৭, সূরা আয-যুমারঃ৫৩]
মক্কাবাসীরা যখন ঈমান না এনে উলটো নানা কষ্টদায়ক কথাবার্তা বলতো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা রসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও তখন বলেছেন,
“সুতরাং এরা যা বলে সে বিষয়ে ধৈর্য্য ধারণ করুন এবং আপনার পালনকর্তার প্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করুন সূর্যোদয়ের পূর্বে, সূর্যাস্তের পূর্বে এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করুন রাত্রির কিছু অংশ ও দিবাভাগে, সম্ভবতঃ তাতে আপনি সন্তুষ্ট হবেন”।[সূরা ত্ব-হাঃ১৩০]
এভাবেই আমরা ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালামের দাওয়াতের একটা সার্বিক চিত্র দেখে শিক্ষা নিতে পারি এবং আমাদের জীবনেও এটা বাস্তবায়ন করে আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে মানুষদের ডাকতে পারি।
ওয়া মা- তাওফীক্বী ইল্লা বিল্লাহ (আমার কৃতকার্যতা তো শুধু আল্লাহরই সাহায্যে)। [সূরা হূদঃ৮৮]