যে কোনো বিষয়ের জ্ঞানকেই কিভাবে উম্মাহর কল্যাণে কাজে লাগানো যায় (পর্ব-২)

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

প্রশ্ন: “যে কোনো ফিল্ডের জ্ঞানই আমাদের সত্য চিনতে বা উম্মাহর কল্যাণে অবদান রাখতে সাহায্য করতে পারে” আপনি কি এই কথার সাথে একমত? আপনার নিজের জীবন থেকে উদাহরণ দিন।

উত্তর: পবিত্র কুরআনে সূরা ফুসসিলাত এর ৫৩ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন তিনি আমাদের তাঁর নিদর্শনাবলী দেখাবেন বিশ্বজগতের প্রান্তসমূহে এবং আমাদের নিজেদের মধ্যেও, যাতে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে অবশ্যই কুরআন সত্য।

কিছু নিদর্শন আছে সার্বজনীন, যা বিশ্বজগতের সবাই দেখতে পায়। যেমনঃ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, সূর্য আর চন্দ্রের নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তনে, বায়ুপ্রবাহে, আল্লাহ কর্তৃক মৃত ভূমির সঞ্জীবনে মানুষ সুনিপুণ এক স্রষ্টার অসাধারণ ক্ষমতা, শক্তি আর নিয়ন্ত্রণ দেখতে পায়।[১]

 আবার মানুষের সৃষ্টিতে এবং নিজ জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহে আরো কিছু নিদর্শন একজন মানুষ দেখতে পায়, যখন সে অবশ্যম্ভাবীভাবেই বুঝতে পারে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে, এখানে মানুষের কোনো ক্ষমতা বা জারিজুরি নেই। এটা হতে পারে হঠাৎ দেখা কোনো স্বপ্ন, আল্লাহর পাঠানো অবিশ্বাস্য কোনো নিয়ামত যা নিজ যোগ্যতায় লাভ করার কোনো সুযোগ কখনোই তার ছিল না। হতে পারে এমন কোনো ঘটনা যা সে ঘটতে দেখেছে, যেটি অন্য একজনের কাছে খুবই সাধারণ ছিল কিন্তু সে বুঝতে পেরেছে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত কোনো নিদর্শন। এভাবেই আল্লাহ সত্যকে তার কাছে প্রকাশ করেন যাতে তার কাছে আল্লাহর কালামের সত্যতা, তাঁর পাঠানো রসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠে এবং সে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়।

আল্লাহ কুরআনে বহু জায়গায় বলেছেন বিশ্বাসীদের জন্য[২], বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্য[৩], চিন্তাশীলদের জন্য[৪], জ্ঞানীদের জন্য[৫], চক্ষুষ্মানদের জন্য[৬] আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে।

তাহলে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ আমাদের জ্ঞান অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেককেই তাঁর নিদর্শন দেখাবেন সত্য অনুধাবন করে গ্রহণের জন্য। যেই বিষয়েই আমাদের জ্ঞান থাকুক না কেন, সত্য চেনার ক্ষেত্রে সেটাই আমাদেরকে সাহায্য করতে পারে, ইনশাআল্লাহ। আর কোনো একটি বিষয়ে যদি বিশেষ দক্ষতা থাকে, তাহলে সেটা আমাদের জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধি করে আমাদের সত্য গ্রহণে আরো সহায়ক হতে পারে।

আল্লাহ আমাকে জীবনের বহু সময়ে তাঁর নিদর্শন অনুধাবনের সুযোগ দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। একটা কোর্সে যখন অ্যানাটমি পড়ছিলাম, প্রতিটা ক্লাসেই মানুষের দেহের গঠনের কোনো একটা দিক যখন পড়তাম, মনে হত, সুবহানআল্লাহ! আল্লাহ কত চমৎকারভাবেই না আমাদের সৃষ্টি করেছেন।

  • আমাদের চোখের উপরের পাতার পাপড়ি উপর দিকে বাঁকানো আর নিচের পাতার পাপড়ি নিচের দিকে বাঁকানো। এটা না হলে পাপড়িগুলো আমাদের চোখে ঢুকে যেত আর আমরা অস্বস্তিবোধ করতাম। সুবহানআল্লাহ! এটা নিয়ে কি আগে কখনো চিন্তা করেছি?
  • কুরআনে পড়েছিলাম জাহান্নামে আল্লাহ প্রতিবার নতুন করে চামড়া তৈরি করে দিবেন যাতে করে অপরাধীরা দহন যন্ত্রণা বারবার ভোগ করতে থাকে। আর, পরে ক্লাসের পড়া পড়তে গিয়ে জেনেছি আমাদের চামড়াতেই পেইন রিসিপ্টরগুলো থাকে। আল্লাহ তো আমাদের আগেই এ বিষয়ে ধারণা দিয়ে রেখেছেন।
  • ভ্রূণবিদ্যায় যা পড়ি তার পুংখানুপুঙ্খ বর্ণনা তো কুরআনেও পাই। সূরা সাজদায় আল্লাহ এটা বর্ণনা করে বলেছেন মানুষ অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তিরমিযী ও নাসাঈর বর্ণনায় এসেছে রসূল সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে এই সূরা না পড়ে ঘুমাতেন না। এই হাদীস জানাটাও আমাকে সাহায্য করেছে কারণ আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো আমাদের নিত্যদিন যেইসব আয়াত বা দু’আ বা সূরা বারবার পড়তে তাকীদ করা হয়েছে, তার প্রতিটিতেই আমাদের জন্য এমনসব রিমাইন্ডার আছে যেন আমরা আল্লাহর অনুগ্রহ এবং ক্ষমতার প্রতি সবসময় সচেতন থাকি, নিয়মিত বিরতিতে এটা ঝালাই করি আর বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত থাকি। আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ঈমানের যত্ন নেওয়ার প্রতিও এত খেয়াল আল্লাহ রেখেছেন!
  • আমাদের প্রায় ৯ মিটার দৈর্ঘ্যের পরিপাকতন্ত্রকে আল্লাহ এমনভাবে গুছিয়ে দিয়েছেন যে আমাদের ১.৫-২ মিটার দৈর্ঘ্যের শরীরে এটা সুন্দরমত থেকে যায়।
  • আমরা প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাচ্ছি কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই। কিন্তু এটিই যদি আমাদের শরীর আর চালাতে না পারে, অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর বা পুরোপুরি আইসিইউ সাপোর্ট দরকার হয়, তখন তার ব্যবস্থাপনা কত জটিল আর খরুচে, এই কোভিড প্যান্ডেমিকে সবাই কম-বেশি বুঝতে পেরেছি। অথচ, এটাই আল্লাহ আমাদের দিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত, আমাদের কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই।
  • আমরা যখন ডায়ালাইসিস মেশিন নিয়ে পড়ছিলাম, জেনেছিলাম কতকিছু মাথায় রেখে এটা ডিজাইন করতে হয়। রোগীর যাতে কোনো ক্ষতি না হয় এভাবে রক্ত পরিশোধনের ব্যবস্থার চেষ্টা করা হয়, তা-ও একটা পর্যায়ে এটা আর যথেষ্ট হয় না। আর খরচ-ও পড়ে অনেক। আল্লাহ যে আমাদের দু’টো কিডনী দিয়েছেন, যে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ লিটার রক্ত পরিশোধন করছে, বিনা খরচে। আর, কিডনী একটি থাকলেও কাজ চলে যায় অনেকটাই, কিন্তু আল্লাহ দুইটি দিয়েছেন আমাদের সুস্থতার জন্য।
  • তেমনি দুইটি চোখ দিয়েছেন বিস্তৃত এলাকা পরিষ্কারভাবে দেখার জন্য। “বিশ্বাসীদের জন্যে পৃথিবীতে নিদর্শনাবলী রয়েছে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও, তোমরা কি অনুধাবন করবে না?” (সূরা যারিয়াত ২০-২১) 
  • আমরা যখন গাছ লাগাই, বহু সময় দেখেছি অনেক যত্নের পরও ঠিকমত গাছ হয়না, কিন্তু, আগাছাগুলো ঠিকই বেড়ে ওঠে। আল্লাহ আমাদের বুঝিয়ে দেন যে সব কিছু আমাদের হাতে নেই, আল্লাহই ঠিক করেন কোনটা বেড়ে উঠবে আর কোনটা না। আবার স্কুলে কৃষি শিক্ষা পড়তে গিয়ে দেখেছি, একেক গাছ বা একেক প্রাণির যত্নে একেক ধরণের আবাসস্থল প্রয়োজন হয়, কিন্তু প্রকৃতিতে তাকালে দেখি আল্লাহ বনাঞ্চলে একই মাটিতে একই পরিবেশে বিভিন্ন গাছ আর প্রাণীর জন্য রিযিক দিয়ে রেখেছেন। সমুদ্রের তলদেশ নিয়ে পড়াশোনা করলেও একই পরিবেশে আল্লাহ যে বিচিত্র সব প্রাণীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন সেটা আমাকে অভিভূতই করেছে।
  • পদার্থবিজ্ঞানে মহাকর্ষ বা কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে আল্লাহ কি সূক্ষ্মভাবেই না সবকিছুকে ভারসাম্যে রেখে দিয়েছেন যেটা শুধু বুঝতেই আমাদের এত সময় লেগেছে!

এই বিচিত্র সব দিকের বিচিত্র সব জ্ঞানের মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করিয়েছেন এসব অবশ্যই নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি। এসবের স্রষ্টা এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী হলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, যিনি ‘আহসানুল খালিক্বীন’।

তথ্যসূত্রঃ

১। আল কুরআন ৩:১৯০, ৩৬:৩২-৪৩, ৫০:৬-৮ ইত্যাদি।

২। ২:১১৮

৩। ৩:১৯০

৪। ১০:২৪

৫। ২:১৬৪

৬। কাছাকাছি অর্থে ৬:১০৪, ৫৯:২

৭। ৬:১০৯


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন