‘Desensitization of Evil’ কি? কিভাবে এটা করা হয়?

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

প্রশ্ন:

ক)’Desensitization of Evil’ কি?এর কোনো উদাহরণ কি আপনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দেখতে পান?

খ) কিভাবে এটা করা হয়? এখানে মিডিয়া/ ফেসবুকের ভূমিকা উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করুন।

গ) এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি?

উত্তর:

ক) ‘Desensitization of Evil’ কনসেপ্ট দ্বারা ক্ষতিকর বিষয়ের প্রতি/ পাপ কাজের প্রতি সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বোঝায়। এর ফলে মানুষ পাপবোধ হারিয়ে ফেলে এবং এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠে। 

এই কনসেপ্টের সাথে যায় এমন অসংখ্য উদাহরণ আমি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দেখতে পাই। যেমন- গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ছেলে- মেয়েদের অবাধ নাচা-নাচি। 

মুসলিম বিয়েতে হলুদের অনুষ্ঠানের কোন স্থান নেই। অথচ আগের জামানার ‘গায়ে হলুদ’ কিংবা এই প্রজন্মের ‘হালদি নাইট’ বিয়ের একটা অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই অনুষ্ঠান পালন করার ব্যাপারে আমরা যে কী পরিমাণে Desensitized, তা বলাই বাহুল্য!

আমার উদাহরণের বিষয় মূলত উক্ত অনুষ্ঠানের নতুন ট্রেন্ড—স্টেজে ছেলে মেয়েদের নাচের পারফরম্যান্স। এই কালচারের প্রতি মানুষজন ইতোমধ্যেই Desensitized হয়ে পড়ছে। গুটি কয়েকজন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই এর সাথে গা ভাসাতে অস্বস্তি বোধ করছে না। হায়! একটু Fun-এর অজুহাতে মানুষ পাপকেই আর পাপ মনে করছে না! 

অথচ এক যুগ আগেও কি কেউ ভাবতে পেরেছিল,সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে মেয়েরা প্রকাশ্যে অশ্লীল গানের সাথে স্টেজে নাচবে? মুরুব্বিদের সামনে একে অন্যের হাত ধরবে, কোমর দোলাবে? যে মেয়েটিকে হয়তো বাসা থেকে ছেলেদের সাথে কথা বলতে দেয় না, সেও কাজিনদের সাথে নাচবে বলে রিহার্সাল করতে চলে যায়! সবাই যাকে সহজ সরল ছেলে ভাবতো, সেও উড়াধুরা নেচে সবাইকে হতবাক করে দেয়! 

বস্তুত, এই অবক্ষয়ের পিছনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে হালের ওয়েডিং ফটোগ্রাফি। নেটে অজস্র ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে এই নাচা-নাচি নিয়ে। মিলিয়নের উপর ভিউ, শত শত শেয়ারে সয়লাব এই পোস্টগুলো। এই ধরণের কন্টেন্ট বারবার দেখতে দেখতে শুধু আমরা না, আমাদের আগের জেনারেশনও আর অনুভব করে না যে, ফ্রি মিক্সিং হারাম, মিউজিক হারাম, এরকম নাচ হারাম….অতঃপর এক পর্যায়ে এই হারামই আমাদের কাছে নর্মাল হয়ে গেছে। নিজে না নাচলেও আমরা অন্যকে উৎসাহ দিতে ভুলি না; একটি লাইক রিয়েক্ট দিয়ে হলেও ভার্চুয়ালি তাদের সমর্থন জানিয়ে আসি।

আফসোস! 

খ)

‘Desensitization of Evil’ একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। এটা করা হয় ব্যক্তিকে বারবার evil (খারাপ/পাপ) এর সাথে expose (প্রকাশ) করার মাধ্যমে। ব্যক্তি প্রথমদিকে যে পরিমাণ সংবেদনশীলতা (পাপ-বোধ) অনুভব করে, ধীরে ধীরে সেটা আর অনুভব করতে পারে না। 

উক্ত পাপের প্রতি তার সংবেদনশীলতা কমে যায় বা একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। তার কাছে পাপ কাজটি নিছক এক অভ্যাসে পরিণত হয়। ফলে সে এই ইস্যুতে আর অনুতপ্ত বোধ করে না। 

এখানে মিডিয়া/ফেসবুক খুব নিপুণতার সাথে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। 

সোশ্যাল মিডিয়া/ফেসবুকের কাছে যেহুতু আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ডাটা রয়েছে, তারা সেটিকে পর্যালোচনা করে আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারে। যেমনঃ তারা বিভিন্ন Strategy অবলম্বন করে আমাদের ফিতরাত (সহজাত প্রবৃত্তি) বদলানোর চেষ্টা করে। ইসলামে নিষিদ্ধ অনেক পাপ কাজ তারা আজ এইসব প্লাটফর্মে স্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করছে।

তাদের Target Audience কিন্তু শুধু বড়রা না, শিশু-কিশোররাও এর শিকার।ইমেইজ, ভিডিও, ইত্যাদি মাধ্যম ব্যবহার করে, তারা তাদের এজেন্ডার প্রচার-প্রসার চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু সংখ্যক মানুষ যখন তাদের প্রচারে সাড়া দেয়, বাকিরাও বাছ-বিচার না করে তাতে যোগ দিয়ে বসে। ফলে এটাই হয়ে যায় স্মার্টনেস, হয়ে যায় নিউ নর্মাল।

উদাহারণ হিসেবে আমার Ellen DeGeneres (American Comedian) -এর কথা মনে পড়ছে। এই মহিলা(?) তার অনুষ্ঠানে নিজেকে পরোপকারী হিসেবে উপস্থাপন করে। যারা অন্যদের সাহায্য করে, সে তাদের ভাল অংকের টাকা গিফট দেয়। সে মানুষকে হাসায় আর অনুষ্ঠানের শেষে “Be Kind” বলে বিদায় নেয়।

আমার কাছে মানুষটাকে স্মার্ট মনে হত। কিন্তু খটকা লাগল যখন সে কিছু ছেলে মেয়েদের অনুষ্ঠানে এনে প্রায় Hero হিসেবে উপস্থাপন করা শুরু করলো। এরা কী সাহসী কাজ করেছে? 

They came out of the closet… 

অর্থাৎ তারা গে, লেসবিয়ান, ইত্যাদি। এল্যান নিজেও এমন কিছু। আর এটা ডিক্লেয়ার করাটা Heroic!

আমি অনুষ্ঠানটি না দেখার চেষ্টা করি এখন।বুঝতে পারি যে এর একটা প্রভাব আছে। এল্যানের সুন্দর কথা আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ত্বের মোহে পড়ে এসব পাপের সাথে Sympathise করে ফেলতে পারে যে কেউ। সুন্দর মোড়কে বারবার এসব ইস্যু দেখতে দেখতে মানুষের মনে আর ঘৃণার উদ্রেক হয় না, এক পর্যায়ে তার সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। আর তখনই জিতে যায় এল্যান আর তার টিম। 

আমরা একটু খেয়াল করলে দেখবো যে, মিডিয়া/ ফেসবুক আমাদেরকে সেভাবে তথ্য জানায় যেভাবে জানালে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে সুবিধা হয়। তাদের বিপরীতে গিয়ে কিছু প্রকাশ করতে গেলে পড়তে হয় কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের গ্যাঁড়াকলে। 

সত্যি বলতে, আমরা ফেসবুক ব্যবহার করি নাকি ফেসবুক আমাদের ব্যবহার করে— তা যথেষ্ট চিন্তার দাবি রাখে। 

গ)

একজন সচেতন মুসলিম হওয়ার বিকল্প নাই এখানে। সেটা আমরা যেভাবে করতে পারিঃ 

 জ্ঞান অর্জন করাঃ

Desensitization of Evil কনসেপ্টটা বিভিন্ন রূপে আমাদের জীবনে হানা দিতে থাকবে। মিডিয়া/ফেসবুক এখানে কেবল একটা মাধ্যম। এর বিরুদ্ধে টিকে থাকতে হলে শক্ত একটা হাতিয়ারের প্রয়োজন। জ্ঞান অর্জন করা হলো সেই হাতিয়ার। যেহুতু এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, তাই নিজের জ্ঞান যত আপডেটেড হবে, হাতিয়ার ততই মজবুত থাকবে।

উক্ত কনসেপ্টের পরিপ্রেক্ষিতে আমি জ্ঞানের দুইটি ফিল্ডের উপর জোর দিচ্ছি। 

• Evil এর জ্ঞানঃ ইসলামের দৃষ্টিতে Evil (পাপ) এর সংজ্ঞা, পাপ কর্মসমূহ ও হালাল-হারামের বিধিনিষেধ সম্পর্কে আমাদের খুব স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। কেননা Desensitization of evil এর ভিক্টিম হওয়া থেকে বাঁচতে চাইলে আগে Evil-কে সনাক্ত করতে হবে। এটাই প্রথম ধাপ। 

•  টেকনিক্যাল জ্ঞানঃ মিডিয়া/ফেসবুকের এজেন্ডা ও কার্যক্রম সম্পর্কে বাস্তবমুখী জ্ঞান থাকা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। আমরা এখানে অপ্রয়োজনীয় তথ্য দেয়া থেকে বিরত থাকব, ট্রেন্ডে অংশ নেয়ার প্রবণতা এড়িয়ে চলব। সর্বোপরি, ফেসবুক যাতে আমাদের কোনক্রমেই নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, সেইদিকে সতর্ক থাকা চাই। 

নিজেদের এজেন্ডা প্রচার করাঃ 

মিডিয়া/ ফেসবুক খুব দক্ষতার সাথে তাদের এজেন্ডা (যেমনঃ Same-sex marriage) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে। আমাদেরকেও পাল্লা দিয়ে তাদের এজেন্ডার কুৎসিত রুপ ও অসাড়তা তুলে ধরতে হবে। আমাদেরকে অল্টার্নেটিভ ডকুমেন্টস সহজলভ্য করে দিতে হবে, নিজেদের পরিসরে এর প্রচার ও প্রসারে তৎপর হতে হবে। 

 তথ্য প্রসেস করতে শেখাঃ 

উদাসীন হয়ে আমরা যখন নিউজফিড স্ক্রল করতে থাকি, তখন আমাদের ব্রেন কেবল তথ্য নেয় কিন্তু প্রসেস করে না। অথচ আমাদের উচিত সতকর্তার সাথে তথ্য প্রসেস করা। এটা এখন সময়ের দাবী। 

 এক্টিভ থাকা/ না থাকার সিদ্ধান্ত নেয়াঃ 

সত্যি বলতে, মিডিয়া/ ফেসবুক সকলের জন্য সমান কল্যাণকর হয় না। লাভ ক্ষতি হিসাব করে ফেসবুক থেকে সাময়িক বিরত থাকা যেতে পারে। আবার প্রয়োজন অনুসারে মিডিয়া/ ফেসবুক ব্যবহারে করা যেতে পারে। এটা ব্যক্তির সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। 

 ছাড় না দেয়াঃ 

পাপ কাজ করা, দেখা, শোনা ও বলা থেকে আমাদের যথাসম্ভব বিরত থাকা প্রয়োজন। একটু পাপ করলে কী হয় ভেবে ছাড় দেয়া বোকামি। তাই পাপে ছাড় দেয়া যাবে না। 

 দু করাঃ

আমরা জানি দু’আ আমাদের অস্ত্র। আমরা পাপের প্রতি সংবেদনশীলতা হারানো থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইব আর নিত্যদিন ইস্তিগফার জারি রাখবো ইন শা আল্লাহ। সেই সাথে আমরা  এরকম দু’আ করতে পারি, 

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ

“হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের ওপর অবিচল রাখুন।” 

 তারবিয়ত করা দাওয়াত দেয়াঃ 

আমরা মিডিয়া /ফেসবুকের যে সমস্যা টের পেয়েছি, সেটা অন্যদের জানানো আমাদের কর্তব্য। বাচ্চা/ ছোট ভাই-বোনদের তারবিয়ত করা খুব জরুরি। তারা যাতে সোশ্যাল মিডিয়ার এই ফাঁদে না পড়ে, সে লক্ষ্যে আমাদের বিশেষ গাইডলাইন প্রদান করতে হবে। 

 দ্বীনি হালাকায় নিয়মিত উপস্থিত থাকাঃ

প্রত্যেক মুসলিমের সময়ে সময়ে রিমাইন্ডার প্রয়োজন হয়। তা’লিম ঈমানকে জাগিয়ে তুলে আর উত্তম নাসীহা অন্তরকে বিগলিত করে। তাই কেউ যদি পাপের প্রতি Desensitized হওয়াও শুরু করে, সে মজলিশে বসে নিজেকে ঝালাই করে নিতে পারবে। 

পরিশেষে, Desensitization of Evil এর ভয়াবহতা ও পরিণতি থেকে আমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে আশ্রয় চাই। রাব্বুল ‘আলামিন আমাদের হেফাযতে রাখুন।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন