’শিকড়ের সন্ধানে’ বই লেখার নেপথ্যের কাহিনী

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

লিখেছেন – হামিদা মুবাশ্বেরা

‘ইলমা নাফিয়া’-বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় উপকারী জ্ঞান। বহু হাদীসে এটার জন্য দুআ করার কথা আছে। শুধু জ্ঞান না কিন্তু, উপকারী জ্ঞান। জ্ঞান যে অপকারীও হতে পারে, এই বুঝটা ‘বিশ্ব আঁতেল’ এই আমার জন্য ছিলো এক ধরণের বৈপ্লবিক উপলব্ধি। কারণ ছোটবেলা থেকে যত ধরণের হাবিজাবি বই পড়া সম্ভব, সব আমি পড়েছি। ভারতীয় খুব কম লেখক আছে যার বই আমি ক্লাস এইটের মাঝে পড়ে ফেলি নাই। তসলিমা নাসরিনের সব নিষিদ্ধ বই গেলা শেষ ক্লাস টেনের মাঝে। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ থেকে মুখস্থ আঁওড়াতে পারতাম একসময়। শুধু কখনো খুলে বসা হয় নাই কুরআনটা। এমন না যে আমি চেষ্টা করি নাই, করেছি, খুলে পড়তে গিয়ে আগা মাথা কিছু বুঝি নাই, তাই হাল ছেড়ে দিয়েছি। এটা হচ্ছে তিক্ত সত্য।

ভারতীয় গল্পের বইগুলো দিয়ে আমি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে খুব একটা প্রভাবিত হই নাই। সহজাত একটা কী যেন বুঝ ছিলো, সেটা দিয়ে মনে হত পৌত্তলিকতা কোনো ভালো জিনিস না। আমি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে Corrupted হয়েছিলাম তসলিমা নাসরিনের বই পড়ে। আমি যে জন্মগতভাবে মুসলিম, এইটাতে যে আমার কোনো হাত নাই এবং ইসলামও যে একটা ভুল ধর্ম হতে পারে এই চিন্তা আমার মাথায় প্রথম উঁকি দিয়েছিলো উনার বই পড়ে। তাই আব্বু মারা যাওয়ার পর আমি যখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে ঘাটাঘাটি করবো, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করবো, তখন আমার প্রথম চিন্তা ছিলো ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের বিশ্বাস, রীতি নীতির মাঝে পার্থক্য জানতে হবে। Candidate Religion বলতে মাথায় ছিলো Christianity  আর Judaism। পৌত্তলিক ধর্মগুলো আগেই বাদ। তখন প্রচুর রিভার্ট মুসলিমদের কাহিনী পড়েছি, ওখান থেকে বর্তমান ক্রিস্টান ধর্মের মূলনীতি যেমন ট্রিনিটি, আদি পাপ, ঈশ্বরপুত্র ইত্যাদির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, Christianity যে সত্য ধর্ম হতে পারে না এব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা যাকে স্রেফ নবী ভাবি, তিনি কিভাবে আল্লাহর ছেলে হয়ে গেলেন এইটা একটা পাজলের মত ছিলো আমার কাছে। কিন্তু  Judaism এর ব্যাপারে তেমন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। শুরু হল এক যাত্রা-শিকড়ের অনুসন্ধানের।

 আল্লাহর সব নবীরা যদি একই বাণী প্রচার করে থাকেন তাহলে কিভাবে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলিম- এই তিনটি জাতির উদ্ভব হল- এটা বোঝা ছিলো আমার মিশন। হাঁতড়ে হাঁতড়ে চলে, অনেক ঘাটাঘাটি করে মোটামুটি একটা সামগ্রিক ছবি দাঁড়া করাতে সক্ষম হলাম আলহামদুলিল্লাহ। সেটা একদিন এক সিনিয়র দ্বীনি বোনকে বুঝালাম। ঊনি শুনে একদম অবাক হয়ে গেলেন। বললেন এভাবে এক সূত্রে গেঁথে উনাকে কেউ কোনোদিনও বুঝায় নি! উনার উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়ায় এবার আমার বেকুব হওয়ার পালা। উনি আমার থেকে দ্বীনের জ্ঞান ও আমলে এত এগিয়ে, উনিই এই ঘটনাক্রমটা জানেন না?

সেই ঘটনার পর নদীতে বহু জল গড়িয়েছে, কিন্তু উনার সেই প্রতিক্রিয়াটা আমি ভুলি নি। সেটাই মূলত আমাকে ২০১৩ তে ফেসবুকে সিরিজটা লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। ‘আমি কেন মুসলিম’- এই আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার ক্লান্তিকর অথচ আনন্দদায়ক যাত্রার ফসল ছিলো ‘শিকড়ের সন্ধানে’ সিরিজটা। যা পরবতীতে ২০২০  বইমেলাতে বই হিসেবে প্রকাশ হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

তবে কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি আপনার বইটা কেন কিনবো, এক কথায় বলুন, তবে আমি তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, কেন মুসলিম এইসব হাবিজাবি ভারিক্কি কথা বলবো না। আমি এক কথায় বলবো ইনশাল্লাহ এটা পড়ার পর আপনি কুরআনের অনুবাদ পড়ে অনেকটাই বুঝতে পারবেন এবং আল্লাহ কুরআনে বনী ইসরাঈলদের কাহিনী যেসব উল্লেখ করেছেন সেগুলা থেকে শিক্ষা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারবেন ইনশাল্লাহ।

That’s it. আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে কুরআনে আল্লাহ ‘আমার’ সাথে কথা বলছেন-এই অনুভূতির স্বাদ পাওয়ার আগের জীবন আর পরের জীবন এক না, এক হতে পারে না। আর সেজন্যই আমি খুব করে চাই যে বইটা বহু মানুষ পড়ুক।

‘শিকড়ের সন্ধানে’ বইটা আমার ‘ইলমা নাফিয়া’ অর্জনের গল্প। সেই ২০১৬ সালে যখন প্রথমবারের মত মা হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিলো, তখন থেকে আমি ঠিক করে রেখেছিলাম মেয়ে হলে তার নাম রাখবো ইলমা নাফিয়া ইনশাল্লাহ। এই শব্দদ্বয়ের সাথে আমার যে কী তীব্র আবেগ জড়িয়ে আছে! কিন্তু আল্লাহ সেই বছর তাক্বদীরে রাখেন নি। আলহামদুলিল্লাহ মা হওয়ার সৌভাগ্য হয় ২০১৮তে এসে। মাঝের এই সময়টাতে আমার প্রাপ্তি ছিলো ফেসবুকে সিরিজটা শেষ করা। ‘মানুষ ইলমা নাফিয়া’ না পাওয়ার দুঃখ ভুলে ছিলাম এটা করতে গিয়ে।

ফেসবুকে লেখা সিরিজটা বই হিসেবে সম্পাদনার কঠিন বুদ্ধিবৃত্তিক কাজটা আমি করেছি ‘মানুষ ইলমা নাফিয়া’ কে পেটে নিয়ে। নাজুক শরীরে এই কাজ করতে মারাত্মক কষ্ট হয়েছে, কিন্তু প্রেরণা ছিলো একটাই- ইলমু সোনাকে দুনিয়াতে আনতে গিয়ে যদি মরে যাই, আল্লাহর সামনে কী নিয়ে দাঁড়াবো? হঠাৎ মনে হল আমি ‘শিকড়ের সন্ধানে’ প্রকাশযোগ্য করে রেখে যাই, মরে গেলে আল্লাহকে বলবো আল্লাহ, মানুষকে কুরআনের কাছাকাছি করবে এমন একটা লেখা লিখে এসেছি, তুমি সেটার উসীলায় আমাকে মাফ করে দাও ইয়া রাব।

’শিকড়ের সন্ধানে’ নিয়ে এটাই আমার দুআ। আমি প্রায়ই চোখ বন্ধ করে কল্পনা করি যে আমার মৃত্যুর পর আমার কবর হঠাৎ আলোকিত হয়েছে, আমি অবাক হয়ে ভাবছি এই আলোর উৎস কী, ফেরেশতারা বলছে এটা তোমার ‘শিকড়ের সন্ধানে’ বইটার সাদক্বায়ে জারিয়া। বহু মানুষ এই বই পড়ে তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বেঁচে গেছে কিয়ামতের দিন যাদের ব্যাপারে অভিযোগ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলবেন-

”হে আমার পালনকর্তা, আমার সম্প্রদায় এই কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে।” (সূরা ফুরক্বান,২৫:৩০)

আল্লাহ আমাদের অতি ক্ষুদ্র চেষ্টা ক্ববুল করুন, আমীন।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন