সে আমার দ্বীনি বোন…

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

তাঁর সাথে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। তবু তিনি আমার বোন, দ্বীনি বোন। পরিপূর্ণভাবে দ্বীন মেনে চলার চেষ্টা শুরুর পর কাছের অনেক মানুষরাই ধীরে ধীরে দূরে সরে গিয়েছে, কটু কথা শুনিয়ে মন ভেঙ্গে দিয়েছে। আবার আপুর মতো কিছু দ্বীনি বোন হুট করেই আপন করে নিয়েছেন গুনাহগার আমাকে। দ্বীনের পথে আমার ছোট পদক্ষেপটা পছন্দ করে আল্লাহই হয়তো তাঁর পছন্দের মানুষদের অন্তরে আমার জন্যে জায়গা করে দিয়েছেন। এটাই তো আল্লাহর ওয়াদা, যা তিনি কখনো ভঙ্গ করেন না।

আপুর সাথে পরিচয় হয়েছিল বই নিয়ে। কিন্তু পরিচয় শুধু বইয়ের আলাপেই থেমে থাকলো না। আসলে এই মানুষগুলো তো নূরের মতো, যারা নিজেদের সাথে সাথে আশেপাশের মানুষকেও আলোকিত করে যান। দু-একদিন কথা হতেই, আমার কিছু ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিলেন। রবের অপছন্দের কাজগুলো কত অবলীলায় করে যাচ্ছিলাম। আশেপাশে এত মানুষ, কেউ তা কখনো এভাবে বলেনি । অথচ একদম নিজের বোনের মতো করে যত্ন করে, সময় নিয়ে, বুঝিয়ে বললেন, কী কী গাফিলতি আছে আমার, কেন সেগুলো ঠিক করা প্রয়োজন। খুব অল্প সময়ে ভালো লেগে গেল আপুকে। খুঁটিনাটি কাজের বাহানায় যাওয়া-আসা শুরু করলাম আপুর বাসাতেও। সেই থেকে কখনও বই দিয়ে, কখনও গুরুত্বপূর্ণ নসীহা দিয়ে এখনো আগলে রেখেছেন আমাকে।

আপুর কাছে শুনেছিলাম তাঁর ছাত্রজীবনের গল্পগুলো। মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ সর্বশেষে মেডিকেলের চৌকাঠ – সবই পার করে এসেছেন তিনি। কখনো কখনো দ্বীন পালনে হতে হয়েছে বাধার সম্মুখীন। তবু বৈরী পরিবেশেও থেমে থাকেনি তাঁর দ্বীনপালন। দেশের এক নামকরা কলেজেই পর্দা মানতে গিয়ে বারংবার হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। ক্লাসের গোটা বিশেক পর্দা করা মেয়ের প্রায় সকলেই সেদিন দুনিয়ার সামনে দ্বীনকে আপোস করে নিয়েছিল। কেবল আপুসহ আরও দু-একজন ছিলেন তাদের সিদ্ধান্তে অবিচল। প্রিন্সিপালের অপমান, টিচারদের চোখ রাঙানো সহ্য করে দ্বীন পালন করে যাওয়াটা কষ্টসাধ্য হলেও এই কষ্ট এনে দিয়েছিল এক অসাধারণ বিপ্লব।
আপুদের দেখাদেখি তাদের পরের ব্যাচের মেয়েরা পেয়েছিল পর্দা মেনে চলার নতুন উদ্দীপনা। তাদের কাউকে পর্দা বিসর্জন দিয়ে দুনিয়াবি সার্টিফিকেট অর্জন করতে হয়নি। বরং তাদের দ্বীনপালন দেখে কলেজ প্রশাসনকে হতে হয়েছিল নমনীয়। এভাবেই ফরজ বিধানটুকু যত্ন করে আগলে রেখেই শেষ করেছেন কলেজের অধ্যায়। এরপর এম.বি.বিএস পাশ করার পাশপাশি শেষ করেছেন ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটির পড়াশুনা, থিসিস। বর্তমানে একটি অনলাইন মাদ্রাসার উস্তাযা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আপুর আরেকটি গুণ হলো তাঁর লেখালেখি। এ দেশের শিক্ষিত ঘরানার মানুষগুলো এতদিন যেন ইচ্ছে করেই জেনারেল লাইনের পড়াশুনাকে ইসলাম থেকে আলাদা করে রেখেছিল। ইসলামিক জ্ঞান সীমাবদ্ধ হয়েছিল হাইস্কুলের ইসলাম শিক্ষা বই পর্যন্ত। অথচ সালাফদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল ইসলামের ছোঁয়া। বর্তমানে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সাথে ইসলামিক জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে অনেকেই কলম হাতে ধরেছেন। আপুও তাঁদের মধ্যে একজন।

মেয়েরা তাদের যে শারীরিক সমস্যাগুলোর কথা সঙ্কোচের কারণে বলতে পারেন না, অন্দরমহলের চার দেয়ালের মাঝেই ধাক্কা খেয়ে বেড়ায় যে কষ্টগুলো – সেগুলোর অবসান ঘটাতে প্রয়োজন সহজ ভাষায় দ্বীনি মাসয়ালা। ফিকহশাস্ত্রের হাজার হাজার মাসায়ালা থেকে নিজের সমস্যা সংক্রান্ত মাসয়ালাটি খুঁজে বের করা সব নারীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই ডাক্তারের টিপিক্যাল খটোমটো ভাষায় নয় বরং সাবলীল ভাষায় শিশুর টিকা থেকে শুরু করে মায়ের ডেলিভারি, অ্যাবরশন, ইস্তিহাজা – প্রভৃতি বিষয়ে ইসলাম কী বিধান দিয়েছে, কোন মাযহাবের আলেমগণ কী মত দিয়েছেন আপু যখন এসব নিয়ে লেখালেখি শুরু করলেন তখন অল্প সময়েই তা পৌঁছে গেলো হাজার হাজার মানুষের কাছে।

মেয়েদের সমস্যাগুলো যে মেয়েরাই ভালোভাবে বুঝতে পারে , দ্বীনের জ্ঞান আছে এমন ডাক্তারই যে মেডিকেল ফিক্বহের বিষয়গুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারে- আপুর লেখার জনপ্রিয়তা এটাই প্রমাণ করেছে। আপুর লেখা পড়ে অনেক নারীই এখন বুঝতে পেরেছে যে, দ্বীন পালন করতে গিয়ে যেন আমরা কোনো হেলথ ইস্যুকে অবহেলা না ফেলি আবার হেলথ ইস্যুর কথা বললেও যেন আমাদের জানা থাকে ইসলামের আদেশ-নিষেধগুলো।

ব্যক্তিজীবনে আপু বিবাহিতা, এক কন্যা সন্তানের মা। তার ছোট্ট সাজানো সংসার দেখে, সংসারের সর্বত্র দ্বীনি পরিবেশ দেখে অনুপ্রাণিত হওয়ার অনেক উপাদান খুঁজে পাই। ঘরে ঢুকতেই আপুর লেখা বিশাল এক কবিতা ফ্রেমে বাঁধাই করা। র‍্যাক উপচে পড়া বই, এখানে ওখানে বই ।কোথাও আবার দিনের সময়গুলো কীভাবে কোন পড়ায় বা প্রোডাক্টিভ কোন কাজে ব্যবহার করা যায় তার রুটিন ঝোলানো। আর ঘরময় ছোট্ট এক পরীর আদুরে ছুটাছুটি আর আধোবোলের কথা তো আছেই। সেই ছোট্ট পরিকে আদতেই জান্নাতের সর্দারনির আদর্শে বড় করার জন্যে দিনরাত চলছে ইসলামি প্যারেন্টিং নিয়ে পড়াশুনা, লেখালেখি, সে অনুযায়ী বাচ্চাকে শিক্ষাদান সবকিছু।

আপুর বাবার পরিবারও একই বিল্ডিং এ থাকেন। সিঁড়িতে একবার দেখা হয়েছিল শুভ্র দাড়ি, পাঞ্জাবি পরিহিত নূরানি চেহারার এক ভদ্রলোকের সাথে। আপুর বাসায় যাচ্ছি শুনে, বারবার করে বলে দিলেন, “ওকে বাসায় না পেলে এই বাসায় চলে এসো।” বুঝলাম আপুর পরিচিত কেউ।
পরে জেনেছিলাম, ভদ্রলোক ছিলেন আপুর বাবা। উনার অমায়িক আচরণ দেখে পুরো পরিবারকেই মনে ধরে গেল। মা-মেয়ে এক জায়গায় থাকলে কখনো মাছের তরকারিটা কখনো লাউয়ের ঝোলটা তো পাঠানো হয়-ই, কিন্তু এখানে আরও একটা বিষয়ের লেনদেন হয় হরদম। তা হলো দ্বীনি পরিবেশের হাওয়া।
আপুর কাছে জেনেছি-আপুদের শৈশব, কৈশোর কেটেছে নবি-রাসূলের গল্প শুনে। যে বয়সে আমি মগ্ন হয়ে হ্যারি পটারের জাদুর দুনিয়া আর হ্যান্সেল গ্রেটেলের কেকের বাড়ির স্বপ্ন দেখে বেড়াতাম সেই সময়টা আপুদের কেটেছে আমাদের বাস্তব হিরোদের গল্প শুনে, তাদের সাহাবায়ে কেরামদের ত্যাগের মহিমা জেনে। কল্পনায় তারা ঘুরে বেড়িয়েছেন মরুবিয়াবনে, বাইতুল্লাহ কিংবা মিশর-ফিলিস্তিনে। এ জন্যেই হয়তো বাসার ছোট্ট সদস্যটা থেকে খাদেমা খালা – সবাই দ্বীনি বিষয়ে কমবেশি জানেন, জানতে চান, যারা জানেন না তাদের জানাতে চান। পুরো পরিবেশটাতেই যেন একটা শান্তি শান্তি ভাব !! মাঝে মাঝে লোভ হয় এমন দ্বীনি সহবতে যদি আমারও থাকার সৌভাগ্য হতো!!

আপুর লেখালেখি, সন্তান, সংসার-সব সামলিয়ে দ্বীনের খেদমতে কাজ করে যাওয়া দেখে প্রতিমুহূর্তে অনুপ্রাণিত হয়ে চলেছি। অবাক হয়ে দেখছি, কীভাবে দুনিয়ার দায়িত্বগুলো পালন করেও এগিয়ে চলতে হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে। যদিও পথটা সহজ নয় ,বন্ধুর। তবে আল্লাহর উপর ভরসা করলে তিনিই সবকিছু সহজ করে দেন।

ফিতনাময় এ যুগে আপুর মতো কন্যার আগমন হোক ঘরে ঘরে। যারা দুনিয়ার চাকচিক্যের সামনে দ্বীনকে কাঁচের মতো স্বচ্ছভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারেন। আল্লাহ যেন তাকে, তার পরিবারের সকলকে কবুল করে নেন। তাদের এই হাসিমাখা পরিবারটা কে জান্নাতুল ফেরদৌসের উদ্যানেও এভাবেই থাকার সুযোগ করে দেন। আমিন।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন