ছোটবেলায় আমি ভাবতাম জান্নাত মানে হলো নানুবাড়ির মতো একটা জায়গা। যখন থেকে জ্ঞান -বুদ্ধি হয়েছে, তখন থেকে আমি জানি আমার মাথার উপর মস্ত একটা ছায়া হচ্ছে আমার নানু। আমার পরম প্রিয় নানু। তখন নানু এতো প্রিয় ছিল সম্ভবত এজন্য যে নানুবাড়ি গেলেই অবাধ ঘোরাঘুরি, ঘন্টার পর ঘন্টা পুকুরে সাঁতার কাটা আর হুটোপুটি । চারদিকে শাসন বারণহীন একটা পরিবেশ।
বড় হবার সাথে সাথে নানুকে ভালোবাসার সত্যিকার কারণ ধীরে ধীরে প্রতিয়মান হতে থাকলো। নানু ছিলেন আমার বন্ধু। আমাদের মধ্যকার ছাপ্পান্ন বছরের পার্থক্য কখনো নানু অনুভব করতে দেননি। ঠিক সবগুলো হাত যখন একে একে মাথার উপর থেকে সরে গেছে, তখনও নানুর হাতটা আমার মাথার উপর রয়ে গিয়েছিলো। এটার কারণ হয়তো ছিল নানুর নিজের জীবন।
উনি তার নিজের জীবনে বহুবার পাশ থেকে একে একে সবাইকে চলে যেতে দেখেছেন। আমার পাশে দাঁড়িয়ে বারবার তাই বলেছেন সাহস না হারাতে। তুচ্ছতম কথাটাও এই মানুষটার কাছে এসে বলতে ইচ্ছে করতো। গোপন অভিমানের কথা বলতে বলতে ভেউভেউ করে কান্না করা যেতো। কখনো কোনো কথা শুনে উড়িয়ে দিতেন না। নিজের জীবনের গল্পগুলো বলতেন সময়ে অসময়ে। আমার নিজেকে অনেক বড় এবং দায়িত্বশীল মনে হতো, যখন নানু তার সংগ্রামের গল্প শুনাতেন। নিজেকে বুঝদার, ভাবুক মনে হতো। এই যে খুব ছোটবেলা থেকেই আমি জানতাম, জীবন কখনো ফুলের বিছানা হবে না – এটার একমাত্র কারণ ছিল নানু আর নানুর সব গল্পগুলো।
মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে চার সন্তান সহ আরেকটি সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় ভদ্রমহিলা নিজের স্বামীকে হারিয়েছেন। উনিশশো সত্তর সালের প্রলয়ঙ্কারী জলোচ্ছ্বাসের রাতে নানাভাই উপকূলীয় চর এলাকায় অবস্থান করছিলেন ভাগ্যক্রমে। নানাভাই তখন তাগড়া জোয়ান, শিক্ষিত এবং স্মার্ট। সাথে সাইকেল রয়েছে, রয়েছে রেডিও এবং টর্চও। অকস্মাৎ জলোচ্ছ্বাসের খবর নানাভাই রেডিওতে পেয়েছিলেন। নিজের আগ্রজ ভাইসহ আরও অনেককে নিরাপদ স্থানে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিপদের রাতের পর তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। যাদেরকে নিরাপদ স্থানে রেখে গিয়েছিলেন, তারা বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু নানাভাই ফিরেননি, পাওয়া যায়নি কোন সুসংবাদ অথবা দুঃসংবাদ অথবা লাশ।
সবাই বলতেন, নানাভাই হয়তো কখনো ফিরবেন। যদি কখনো নানাভাই ফেরত আসে, এই অপেক্ষা নানু করে গেছেন সারাটি জীবন। রাতের পর রাত স্বপ্নের ঘোরে দরজা খুলেছেন নানাভাইয়ের আশায়।
নানাভাই আর ফিরবেন না -এটা মানতে উনার অনেক সময় লেগেছে। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি নানাবিধ বাস্তবসম্মত কারণে। নিজের বাপের ভিটেয় দাঁত কামড়ে পড়ে ছিলেন । সিনেমার গল্পকেও হার মানায় এমন এক জীবন যাপন করেছেন শেষ অব্দি।
মাত্রাতীত সুন্দরী ভদ্রমহিলার এই একক জার্নি কতটা কঠিন ছিল, সেটা সহজেউ অনুমেয়। অথচ কি ভীষণ চরিত্রবান ছিলেন!! কখনো কেউ কোনো কুদৃষ্টি দেয়নি, সেরকম তো না। কিন্তু সবকিছু কঠিন হাতে ট্যাকেল দিয়েছেন, নিজের চরিত্রে দাগ লাগতে দেননি একফোঁটা। সততা আর সচ্চরিত্রের ব্যাপারে সবসময় শক্ত অবস্থানে ছিলেন। নানুর বাবা-মা বেঁচে থাকতে দ্বিতীয় বিয়ের পরামর্শ দিয়েছেন অনেকবার। অনেকবার বলেছেন সন্তানদের কথা চিন্তা না করে নিজের অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে৷ নানু সসম্মানে এই প্রস্তাব ঠেলে দিয়েছেন প্রতিবার।
দ্বিতীয় বিয়ের কথা কখনো মাথায়ও আনেননি অনেকগুলো কারণে। যদি কখনো নানাভাই ফেরত আসে! যদি নানাভাই বলে ‘আমার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে পারলে না’! যদি নতুন মানুষটা নানাভাইয়ের মতো না হয়! যদি তার বিয়ের কারণে তার সন্তানরা কোনোভাবে বঞ্চিত হয় মায়ের ভালোবাসা থেকে! যদি সন্তানদেরকে তাদের বাবার আদর্শে মানুষ করা ব্যহত হয়! আসলে নানাভাইয়ের জায়গায় অন্য কাউকে নানু কখনো ভাবতেই পারেননি, নানাভাইকে যে কি প্রচন্ড ভালোবাসতেন আর শ্রদ্ধা করতেন, সেটা কল্পনাতীত।
নানাভাই প্রচন্ড সচেতন এবং শিক্ষিত মুসলিম বাঙালি ছিলেন। নিজের বড় মেয়েকে তার সাত বছর বয়সে গ্রামের স্কুল থেকে নিয়ে শহরের মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। মফস্বলি স্কুলগুলোর সহশিক্ষা কার্যক্রম ভদ্রলোকের পছন্দ ছিল না। কিন্তু মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে, এই পণ ছিল ষোলআনা। মেয়েকে ডাক্তার বানানোর বড় শখ ছিল তার। ভদ্রলোক আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে যখন পরপারে চলে গেলেন, তার যোগ্য স্ত্রী হিসেবে শতভাগ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন নানু। দুই মেয়ে এবং তিন ছেলেকে দ্বীনি এবং দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে শুরু করলেন কঠিন সংগ্রাম। কেবলমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে নানু একাই এই সন্তানদের নিয়ে যুদ্ধে নেমে গেছিলেন।
মফস্বলে পরে থাকলে তার সন্তানদেরকে আশানুরূপ মানুষ করতে পারবেন না ভেবে একে একে ভালো স্কুল, ভালো পরিবেশের জন্য শহরে পাঠিয়েছেন ভাইদের কাছে। আল্লাহ নানুকে সাপোর্টিভ দু’জন ভাই দিয়েছিলেন। নিজেকে যতটুকু আত্মপ্রবঞ্চনা দেয়া যায়,ততটুক দিয়েছেন। স্বামীহীন,সন্তানহীন জীবন যাপন করেছেন বছরের পর বছর।
শুধু কি নিজের সন্তানদের জন্য চিন্তা করেতেন? নাহ। নিজের ভাইয়ের,বোনের সন্তানদের জন্যও চিন্তা করেছেন নিজের সন্তানদের মতো করেই। কে বিবাহযোগ্য, তার বিয়ে দেয়া, কার পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা দরকার, তাকে উপযুক্ত পরিবেশ আর সহায়তা দেয়া, কার আয় ইনকামে সমস্যা, তার কথা একে,তাকে বলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা; এ সব কিছু করেছেন এক হাতে।
লোকের কতশত কটুকথার মুখে হকের পথে অবিচল থেকে গেছেন নিরন্তর। বাপের ভিটেয় থাকতেন বলে কত অশ্রাব্য কথা শুনেছেন। না শোনার ভান করে এড়িয়ে গিয়ে হাসিমুখে তার উপকারে লেগে গেছেন। ইয়াতিম কাউকে পেলে নানু অস্থির হয়ে যেতো তার জন্য কিছু করার। সবাই যখন তার এরকম পরোপকারে ঝাপিয়ে পড়া নিয়ে সংযত হতে বলতো, বারবার কুরআনের আয়াত মনে করিয়ে দিতেন নানু। ইয়াতিমকে সাহায্যকারীর মর্যাদা শুনিয়ে দিতেন শক্ত কন্ঠে। হক আর বাতিল নিয়ে নানু খুব স্পষ্ট অবস্থানে ছিল সবসময়। এতোটা নির্ভীক চিত্তে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতেন সবসময়, এটাই তার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল।
নানুকে কখনো ফালতু কথায় সময় নষ্ট করতে দেখিনি। মারাত্মক কর্মঠ ছিলেন নানু। ভোরে ফজরের আগে ঘুম থেকে উঠতেন তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য। সে হোক কনকনে শীত কিংবা গরম। শীতের দিনে হয়তো ঘুম থেকে উঠেই মাটির চুলায় পানি বসিয়ে সেই গরম পানি দিয়ে অজু করে নিতেন। কিন্তু প্রতিদিন এই সময়ে উঠার ব্যতয় ঘটতো না। তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই কাজে নেমে যেতেন।
ছোটবেলায় নানুকে দেখতাম বড় বড় লাই ভর্তি ধান কাঁখে বয়ে নিয়ে রোদে শুকোচ্ছেন,মাড়াচ্ছেন, রাতের পর রাত জেগে ধান সেদ্ধ করছেন। গৃহস্থালীর সমস্ত কাজ এক হাতে আঞ্জাম দিচ্ছেন। এই রসুইঘরে রান্না চড়ালেন তো এই আবার হাঁস-মুরগিগুলোকে খাবার দিয়ে আসলেন। রান্নাটা নেড়েচেড়ে আবার চলে গেলেন ছাগলের দুধ দোহন করতে। দিনভর ব্যস্ত থাকতেন কাজেকর্মে কিন্তু নামাজ সময় মতো পড়ার ব্যাপারে ছিল ‘নো কম্প্রোমাইজ’। নামাজে আমরা কেউ একটু বিলম্ব করলে কড়া করে সুরা মাউন মনে করিয়ে দিতেন।
ইয়া বড় বড় পাতিলে রান্না হতো নানু বাড়িতে। কামলা দিতেন যে যারা, উনারাও খেতেন এ বাড়িতে। বড় গামলায় করে ভাত বেড়ে দিতো নানু। এরা কেমন খাবার পছন্দ করে এই দিকেও নানুর তীক্ষ্ণ নজরদারি ছিল। এরা মাছ-তরকারি দিয়ে খেয়ে আবার একটু নারকেল-গুড় খেতে পছন্দ করতো বলে সময় খেয়াল রাখতেন নারকেল ভেঙে রাখতে। নানুর বাড়ির এই কামলা ,হাইল্যারা নানুর সংসারের একটা অংশ হিসেবে থাকতো। কেউ ডাকতো খালাম্মা, কেউ চাচীম্মা, কেউ মাওইজী।
এদের মেয়ের বিয়ে, ছেলের বিয়ে, বউ পোয়াতি, ছেলের পরীক্ষা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, অসুস্থতা, চিকিৎসা ; যেকোনো বিপদে এরা সবার আগে ছুটে আসতো নানুর কাছে। নানু ধৈর্য ধরে এদের কথা শুনতেন। যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। নানুদের বিশাল বাড়ির নয়টা ঘরের প্রতিটি পরিবারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল নানু। এদের প্রত্যেকের যেকোনো ভালো, মন্দে,বিপদে, আপদে নানু ছিল অগ্রগামী। হয়তো কখনো কানে এলো এদের কেউ বদনাম করেছে কোনো ব্যাপারে, নানু একদম নির্লিপ্ত থেকে বলতো, যার যার আমলনামায় তার তার কর্ম যোগ হয়ে যাচ্ছে,এগুলো শুনে নানু কি করবে। অথচ পরেরবার তাদের ডাকে নানুর ছুটে যেতে এক মুহূর্ত বিলম্ব হতো না।
এতো মানুষের সাথে নিত্যদিন ডিল করতে হতো, অথচ পর্দার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক ছিলেন সবসময়। পর্দা ওপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন, কড়া এবং স্পষ্ট ভাষায়। মাহারাম ছাড়া কোনো পুরুষের সামনে যায়নি নানু। নানুর মাথার কাপড় কখনো পরতে দেখিনি। মাথায় শাড়ির আঁচল লম্বা করে টেনে দিয়ে পরতেন। শাড়ি পরতেন বড় ফুল হাতা ব্লাউজ দিয়ে। গরমে খুব ঘামতেন, তবু কখনো হাফ হাতা বা থ্রি কোয়ার্টার পরার নাম করতেন না। নিত্যদিনের চলাফেরায় এতোটা শালীনতা কিভাবে মেন্টেইন করতেন,সবসময় ভাবতাম অবাক হয়ে। শেষদিকে নিউরোলজির ডাক্তার বারবার বলতেন যে ওড়না এতো প্যাচানোর কিছু নাই,বুড়ো মানুষের পর্দা অনেক শিথিল। তাতে নানুর কোনো ভাবান্তর ছিল না। আশপাশের সবাইকে মাহারাম আর ননমাহারাম মেনে চলার তাগাদা দিতেন খুব সুন্দর ভাষায়। কাউকে বেপর্দা দেখলে সুন্দর করে ওড়নাটা টেনে দিতেন, মিষ্টি করে কথা বলতে বলতে চুলগুলোকে ওড়নার ভেতর ঢুকিয়ে দিতেন।
নানু কখনো বাজারে যাননি, শপিংয়ে যাননি। এরকম নয় যে সুযোগের অভাবে যাননি। নানু ইচ্ছে করেই যেতেন না। প্রথম বয়সে বাবা,তারপর ভাইয়েরা,ভাবীরা, তারপর মেয়েরা,ছেলেরা,নাতনিরা যা কাপড় এনে দিতেন তাই পরতেন। যে বোরখাটা সেলাই করে এনে দিতেন,সেটাই যত্ন করে পরতেন। কাপড়চোপড়ের বেলায় মোটামুটি চুজি ছিলেন। কিন্তু কখনো মুখে প্রকাশ করতেন না সেটা। খুব যত্ন করে কাপড় পরতেন। মাড় দেয়া শাড়ি পরতেন প্রতিদিন। কারণ, মাড় দেয়া না থাকলে শাড়ি গায়ে লেগে থাকে,তাতে পর্দা হয়না মনে হতো নানুর।
মানুষকে সাহায্য করার এক প্রবল তাড়না ছিল নানুর মধ্যে। শুধু নিজে সাহায্য করেই ক্ষান্ত হতেন না। ভাই,বোন,আত্মীয়, স্বজন, পরিচিত যাকেই পেতেন তাকেই দান সদকা করার জন্য বুঝিয়ে বলতেন। নিজের সামর্থ্য ছোট ছিল বলে কখনো দমে যাননি। বড় সামর্থ্যের কাউকে বলে কয়ে অভাবীকে সাহায্য করিয়ে নিয়েছেন।
নিজের সন্তানদের প্রাণাধিক ভালোবাসতেন একজন সাধারণ মায়ের মতোই। কিন্তু তবুও তিনি মা হিসেবে অসাধারণ থেকে গেছেন। এতো ঝড় ঝাপটা গেছে তার উপর দিয়ে, কখনো টোকাটিও লাগতে দেননি সন্তানদের। টিপিক্যাল মা হয়ে সন্তানদের কাছ থেকে তার নিজের স্যাক্রিফাইসের প্রতিদানের আশা করেননি কখনো। জীবনের শেষদিন অব্দি শুধুমাত্র করেই যেতে চেয়েছেন সন্তানদের জন্য। সন্তানদেরকে জিঞ্জিরে বন্দী করে ফেলেননি কখনো। পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন নিজেদের জীবনে, সিদ্ধান্তে, কাজে কর্মে। সুশিক্ষিত আর স্বশিক্ষিত করে তুলেছেন। শেষমেষ পাখির মতো উড়ে যেতে দিয়েছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। নিজের কাছে আটকে রাখতে চায় নি কখনো। সৎ পথে থাকার জন্য, হালালের পথে থাকার জন্য প্রেরণা দিয়েছেন।
নিজে কখনো স্কুলের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেননি, কিন্তু শিক্ষানুরাগ ছিল ষোলআনা। ধর্মীয় শিক্ষা পেয়েছিলেন নিজের মৌলোবি পরিবার থেকে। কুরআন শিক্ষা দিয়েছিল নানুর দাদী (যাকে নানু দাদাজী ডাকতেন)। বাংলা শিক্ষার হাতশিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল বাড়িতেই। বাংলাটাকে চর্চার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নানাভাই। বেগম রোকেয়ার লিখা বই, বেগম পত্রিকা এসবের হাত ধরে নানুর বাংলাটাও ছিল চমৎকার ঝরঝরে। নানাভাই নিজের পড়ার সুবাদে শহরে থাকতেন তাই নানুকে হাতে কলমে চিঠি লিখাটা শেখানোও ভুলে যাননি। শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতেন পুরোটাই। ওরকম নিদারুন গ্রামের মধ্যেও তার নিজস্ব পাঠাগার ছিল। আম্মুর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তেন। নাতি নাতনিরা কেউ পড়ায় অবহেলা করলে নিজের সময়ের কথা বলতেন। নাতিনাতনির পাওয়া সুযোগ সুবিধাগুলোকে নেয়ামত আখ্যা দিতেন। দুই মেয়েকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যায়ন সম্পন্ন করতে তিলে তিলে সাহায্য করেছেন। বড় মেয়ে তিন সন্তানকে গ্রামে মায়ের কাছে রেখে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ হতে মাস্টার্স করে ফেরত আসতে পেরেছে, কারণ রুধীর ধারার মতো গোপনে নানু তার নাতি নাতনিকেও সামলেছেন। বড় মেয়ে সাত সন্তানসহ এবং ছোট মেয়ে পাঁচ সন্তানসহ সর্বদা মায়ের ছায়ার নিচে থেকেছে প্রতিনিয়ত।
নানুর অবসর সময় মানেই ছিল নানুর হাতে একটা বই, নানু সারা দুনিয়া একপাশ করে রেখে বইয়ে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করে রেখেছেন। পরিবারের অনেক সদস্য একত্র হলে আমরা হয়তো আড্ডা কিংবা খোশগল্পে মেতে আছি খাওয়ার পরে ডাইনিং টেবিলে অথবা ড্রয়িং রুমে, আর নানু এক ফাঁকে উঠে গিয়ে বই নিয়ে বসেছেন অথবা নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন। নানু কখনো বেহুদা গল্পের আসরে থাকতেন না। কখনো উচ্চস্বরে হাসতে শুনিনি। পরনিন্দা, পরচর্চার কাছে তো যেতেনই না, কাউকে করতে শুনলেও খুব সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যেতেন, নিষেধ করতেন। সবাইকে কুরআন অর্থসহ বুঝে বুঝে পড়ার জন্য কাকুতিমিনতি করে অনুরোধ করতেন। নামাজটা সময় মতো পড়ার কথা,পর্দা,হালাল-হারাম মেনে চলাটা, বৃদ্ধ শ্বশুর-শ্বাশুড়ী,পিতা-মাতার সেবাযত্নের নসিহত করতেন সবাইকে। সবাইকে মানে সবাইকে।ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি, আত্মীয়পরিজন, অল্প চেনা, বেশি চেনা, পাড়া প্রতিবেশী সব্বাইইইকে! এই কথাগুলো বলতে নানু কখনো দ্বিধা করতেন না।
চার বোনের মধ্যে ছোটবোন হবার সুবাদে প্রথম জীবনে বোনের বাচ্চাদের কোলেপিঠে করে বড় করেছেন আর তার পর নিজের মেয়েছেলেদের সন্তানদের। নানুর বড়মেয়ের সর্বমোট নয় সন্তানের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা নানুর হাতেই। নানুর আঠারো নাতি নাতনির মধ্যে আমি পঞ্চম।
সচেতনে,অবচেতনে মানুষটা কিভাবে এতোটা ভালোবেসেছে, সেটা ভেবে পাইনা। মানুষ হতে চায় নিজের মায়ের মতো,আমি মনে মনে চাইতাম নানুর মতো। নিজেও তিনবোনের মধ্যে ছোট বলেই হয়তো নানুর সাথে খুব মিলতো। কোনো একটা ক্রাইসিস অন্য কাউকে হয়তো বুঝাতে পারছিনা বলে,আম্মুকেও না। কিন্তু নানুকে বললেই নানু বুঝতেন খুব সুন্দর করে। শুধু বুঝতেন বললে ভুল হবে। নানু অনুধাবন করতেন, অনুভব করতেন সম্পূর্ণটা।
এতোটা স্বাধীনচেতা, সৎ,চরিত্রবান,ধার্মিক, পরোপকারী,সময়ানুবর্তী,জ্ঞানপিপাসু, বিদ্যানুরাগী,সন্তানবাৎসল, এরকম আরো না বলা অসংখ্য গুণের সমন্বয় খুব খুব কমই হয়। আলস্য নামের কোনো বস্তু একদমইই ছিল না যার মাঝে। কঠিন থেকে কঠিনতর সব বিপদ এসেছে নানু হয়তো ভেঙে পরতেন স্বল্প সময়ের জন্য কিন্তু হেরে যাননি কখনো। নানুর কাছ থেকে পাওয়া এক অমূল্য শিক্ষা এই ‘হেরে না যাওয়া’টা। যখনই কোনো সমস্যা নিয়ে নানুকে বলেছি, কান্নায় ভেঙে পরেছি, নানু পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে চোখের পানি মুছিয়ে দিতেন আর বলতেন ‘তোর সময় আসবে একদিন’। এই বাক্যটার এতো প্রচন্ড শক্তি ছিল, আমি শুধু এই কথাটুকুর ভরসাতে বারবার উঠে দাঁড়িয়েছি।
নানু বলতেন মুখে কখনো অপমানের জবাব দিতেনা, কাজে জবাব দিতে। যখন সবাই হতাশ হয়েছে আমাকে নিয়ে, নানুই একমাত্র আশাবাদী ব্যক্তি ছিলেন। সবচেয়ে ভঙ্গুর মুহূর্তেও আস্থা রেখেছেন,বিশ্বাস রেখেছেন। কাউকে কখনো হিংসা করা,কোনো কিছু নিয়ে লোভ করা কি জিনিস জানতেন না ভদ্রমহিলা। নিজের মালিকানাধীন জায়গাজমিন ছিল অনেক কিন্তু শখ করে একটা গয়নাও গড়াননি কখনো নিজের জন্য। যা পেয়েছেন তা খেয়েছেন, অল্পে তুষ্ট থেকেছেন জীবনভর। সন্তানদের সংসারে স্বচ্ছলতা ছিল, কিন্তু সন্তানদের কাছেও কখনো কোনো দাবি কিংবা আবদারের বালাই ছিল না। মেয়েদের,ছেলেদের সংসারে যে কদিন থাকতেন কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যেতো না। চুপচাপ নিভৃতে দিন কাটিয়ে দিতেন। পড়াশোনা করতেন, নামাজ পড়তেন। গোসল করে নিজের কাপড়টা ধুয়ে দিতেন সব সময়। মাঝেমধ্যে হয়তো মাড় দেয়ার জন্য শাড়িটা কাউকে দিতেন,তাও কদাচিৎ। কতো করে বলতাম “নানু আমাকে দেন,শাড়িটা ধুয়ে দেই!” নানু বলতেন “একটা সময় এমনিতেই কাপড় ধুয়ে দিতে হবে,তখন দিলেই হবে”। শক্তি সামর্থ্য থাকা অবস্থায় নানু কারো বোঝা হতে চাইতেন না।
যে ভিটেয় তার জন্ম,যে ভিটে থেকে একের পর এক বিদেয় করেছেন নিজের দাদী,বাবা আর মাকে। স্বামীর অপেক্ষায় যে ভিটে আঁকড়ে পরে ছিলেন উনচল্লিশটা বছর, সেই ভিটে থেকে নানুকে চিরবিদায় দিয়ে দিলাম সেদিন রাতে। সারাজীবন ঠিক যেই স্থানে দাঁড়িয়ে নানু আমাদেরকে বিদায় বলতেন,আমি ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে নানুকে বিদায় বললাম। নানুর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, এই মাটির ভেতর আমার নানু আছেন। যার গন্ধমাখা আমার জীবনের ছাব্বিশটা বছর। আমার শৈশব,কৈশোর যার আঁচলের ছত্রছায়ায় ডালপালা মেলেছে। বিশ্বাস করার চেষ্টা করি, ধরাছোঁয়ার দুরত্বে আর নেই আমার মানুষটা। নানুর আর আমার বিচ্ছেদের মাঝে চিরকালের মতো অশ্রুজল বইছে। তাকে ছাড়া আমার জীবনের বাকি দিনগুলো কোনোমতে কাটিয়ে দিয়ে এই জান্নাতী নারীর সাথে জান্নাতের কোনো এক কোনে দেখা হয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায় থাকি।