আমার নানী, আমার অনুপ্রেরণা

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

আমার জীবনের একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন আমার নানি। তাঁর মতো শিক্ষানুরাগী, পরোপকারী ,অনাড়ম্বর এবং ধার্মিক নারী আজকের যুগে বিরল।
আমার নানা নিজ গ্রাম থেকে বেশ দূরের গ্রামে গিয়ে নানিকে বিয়ে করেছিলেন উনার শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে। যদিও তাঁর একাডেমিক পড়াশোনা ছিল মাত্র ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত কিন্তু তখনকার দিনে এই পর্যায়ের শিক্ষা এবং নিজ গ্রাম থেকে দূরে গিয়ে বিয়ে করার ঘটনা সচরাচর ঘটত না। তাই উনাদের বিয়েতে নানা কোথায় গিয়ে বিয়ে করল দেখার জন্য দুর্গম রাস্তা সত্ত্বেও প্রচুর মানুষ গিয়েছিল।
নানা তখনও ছাত্র ছিলেন। তাই নানি বাবার বাড়িতে থাকতেন। কয়েক ভাইয়ের মাঝে সবার ছোট ছিলেন, খুব আদরের ছিলেন তাই। ভাইয়ের ছেলেদের পড়াতেন নিয়মিত। পরবর্তীতে উনার ভাতিজারা আম্মুদের কাছে এসে বলত, “ফুপুর যে অংকের ব্রেইন, তোরা তো অংকে ভালো হবি-ই।”
ছুটিতে নানা শ্বশুরবাড়ি গেলে নানির জন্য নানারকম বই, ধর্মীয় মাসিক ম্যাগাজিন ইত্যাদি নিয়ে যেতেন। পড়ার প্রতি তাঁর এই আগ্রহ শেষ বয়স পর্যন্ত অটুট ছিল। একাডেমিক পড়াশোনা আর না করলেও তিনি সারাজীবনই পড়ে গেছেন। নিজ ছেলেমেয়েদের স্কুলের বই থেকে গল্প পড়ে ফেলতেন। এমনকি নাতি-নাতনীদের বইয়ের প্রতিও তাঁর আগ্রহের কমতি ছিল না। আমার ছোট খালার বাসায় গিয়ে ছোট খালাত ভাইটার সাথে মিলে ওর সংগ্রহের গল্পের বইগুলো পড়তেন। আমাদের বাসায় একবার বেড়াতে এসে আমার আইওইউর বইগুলোও নেড়চেড়ে দেখেছেন, সেগুলো বাংলায় হলে হয়ত পড়তে বসে যেতেন।

নানির বাবার বাড়িতে ধার্মিকতা কম ছিল। আমার নানার সাথে বিয়ে হওয়ার পর নানি আস্তে আস্তে ধর্মের ব্যপারে আরও জানতে শুরু করেন। আমার নানা প্রথমে মাদ্রাসা লাইনে পড়ে পরে জেনারেল লাইনে আসেন কিন্তু ধর্মীয় লাইফস্টাইল বজায় রেখেছিলেন চিরদিন। নিজে জানা, আমল করা এবং আশপাশের মানুষের জন্য কিছু করা – এসবই করে গেছেন আজীবনএবং নিজ স্ত্রীকেও এসবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আমার নানিও নানার থেকে ধর্ম নিয়ে জেনে একে মেনে চলেছেন।
নানা আমার নানিকে সাথে নিয়ে ইবাদাত করতেন। নানা অবসর গ্রহণের পর উনারা দুইজন একসাথে রাত তিনটায় উঠে যেতেন ঘুম থেকে। তাহাজ্জুদ পড়তেন, আরও নফল ইবাদাত করতেন। ফজরের সময় নানা চলে যেতেন মসজিদে। আর ফজরের পর ইশরাকের সালাত আদায়ের অভ্যাস আমার নানির সংসার জীবন থেকেই ছিল। উনাদের এই অভ্যাস একদম বৃদ্ধ বয়স পর্যন্তও ছিল।
যতদিন হুঁশ-জ্ঞান ঠিক ছিল আমার নানি কখনো ফরয সালাত থেকে গাফেল থাকেন নি। সুন্নাত, নফলও পড়ে গেছেন সবসময়। আম্মুর কাছে শুনেছি নানি কখনো রামাদানের রাতে ঘুমাতেন না। সারা রাত জেগে ইবাদাত করতেন আর ফাঁকে ফাঁকে রান্না করতেন। ভোর বেলা ছোট বড় সবাইকে ডেকে খাইয়ে দিতেন। এবং দিনের বেলা ঘরে কোন খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা রাখতেন না। তাই ছেলেমেয়েরা সবাই বাধ্য ছিল সিয়াম পালনের জন্য। আমার কাছে এক মাস সারা রাত জেগে ইবাদাত করা বেশ কঠিন কাজ বলে মনে হয়েছে, কারণ দিনের ঘু্ম রাতের ঘুমের পরিপূরক হয় না।
যেহেতু ইবাদাতের মাঝে থাকতেন সবসময় তাই আমার নানি শারীরিক পবিত্রতার প্রতি খুবই যত্নশীল ছিলেন। বৃদ্ধ বয়েসে যখন নিজের পক্ষে একা এতটা পাক-পবিত্র থাকা কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল তখনও অন্যদের সাহায্য নিয়ে একইরকম পবিত্রতা বজায় রেখে চলতে চেষ্টা করতেন। সেই সাথে, যে কঠোরভাবে উনি পর্দা মেনে চলতেন আরও কম বয়স থেকেই সেটা বৃদ্ধ বয়সে শিথিল হলেও তার প্রতি উনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। উনার মতো হায়া-জ্ঞান পাওয়া মানুষ বিরল।
নানা অবসর গ্রহণের পর ঢাকার অদূরে গিয়ে বাড়ি করেন। নানি সেখানেই দ্বীনি মজলিসে যেতেন নিয়মিত। উনার ডায়াবেটিস হওয়ার পর ফজরের সালাত আদায় করে হাঁটতে বের হতেন। হেঁটে তালিমের ঘরে গিয়ে পৌঁছাতেন। সেখানে ধর্মীয় বই পড়া হতো, আলোচনা হতো। এভাবেই নানি একটা ধর্মীয় সার্কেল মেইন্টেইন করতেন। দ্বীনী বোনদের বাসায় দাওয়াত দিতেন বিভিন্ন উপলক্ষে। আমার আম্মু হাজ্জ থেকে নানির জন্য যে জায়নামায এনেছিলেন উনি সেটা এলাকায় হিন্দু থেকে মুসলিম হওয়া এক দম্পতিকে উপহার দিয়েছিলেন।
নানি সবসময়ই সাদাকা করতেন। নানার চাকরিসূত্রে মতিঝিলের মতো ব্যস্ত জায়গায় থেকেও কখনো মার্কেটে যাওয়া, ফেরিওয়ালা ডেকে কিছু কেনা এসব করেননি। এ কারণে হয়ত টাকাপয়সা হাতে পেয়েও বিলাসিতা তো দূরের কথা, কিভাবে নিজের জন্য খরচ করবেন সেটাও বুঝতেন না। ছেলেমেয়েরা যে টাকা উনাকে দিত সেগুলো উনার দ্বীনী সার্কেলে, অন্যান্য গরীব-দুঃখী, বিধবাদের দান করে দিতেন। এমনকি যা কিছু গহনা ছিল তা বিক্রি করে সেই টাকা দান করে দিয়েছিলেন।
নানা মারা যাওয়ার পরও নানি ষোল বছর বেঁচে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময় তিনি নি:সঙ্গতা অনুভব করলেও সাংসারিক জটিলতায় নিজেকে জড়িত করেননি। মামিরা সংসারে আসার পর পরই নানিকে রান্নাঘরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেন। তিনিও ‘আমার সংসার’ বলে তা আঁকড়ে ধরে রাখার অযথা চেষ্টা করেন নি। সংসারের ব্যপারে খবরদারি না করে সংসারের বাইরেও নিজস্ব জগত তৈরি করে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। টিপিক্যাল শাশুড়ির ভূমিকায় উনাকে আমরা দেখি নি। নানির মৃত্যুর পর উনার চেনা একজন বৃদ্ধা বলছিলেন, এলাকার বয়স্ক মহিলারা একসাথে হলে সকলেই ছেলের বউ নিয়ে অভিযোগ করে, কিন্তু নানি কখনো এই নিয়ে কিছু বলতেন না।

আমার নানি মাশাল্লাহ দীর্ঘায়ু পেয়েছিলেন। উনি যখন মৃত্যু শয্যায় পৌঁছেন তখন চারপাশে মেয়ে, বউ, ছেলেরা ছিল। তারা উনাকে বলতে শুনেছিল একসময়, “তোমরা সরে যাও, ফেরেশতারা আসছে। তাদের আসত দাও।” আমরা জানি মৃত্যুর আগে গায়েবের পর্দা উঠে যায় এবং নিঃসন্দেহে সেটা কঠিন এক সময়। সেই সময় ফেরেশতাদের আগমনে তাদের স্বাগত জানাতে পারা অমূল্য অভিজ্ঞতা। আল্লাহর সাথে সুন্দর সাক্ষাতের আশা অন্তরে থাকলেই হয়ত এভাবে চাওয়া যেতে পারে। আর সেটা আল্লাহর স্মরণে, তাঁকে ভালোবেসে, তাঁর কথা মেনে চলে জীবন যাপন করলেই হয়ত মৃত্যুর সেই কঠিন সময়ে মুখ থেকে নিঃসৃত হতে পারে। আমার নানি গত রামাদানের এক শুক্রবার ইন্তেকাল করেছেন। উনার জন্য আমরা এমনই ভালো কিছু আশা করেছিলাম, আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ সেটা পূরণ করেছেন।

আমার দ্বীনের পথে চলার শুরুর দিকে একবার আমার দাদা-দাদি-নানা-নানি সকলের কথা মনে করে মন খুব নরম হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল উনারা আমাদের মতো দুনিয়ার এত খারাপ দিক দেখেন নি। উনাদের সময়ে আমাদের মতো চোখের সামনে, হাতের মুঠোয় আল্লাহর নাফরমানীর এত বন্দোবস্ত ছিল না। যতটুকু যা ছিল উনারা তাতেও গা ভাসিয়ে দেন নি। এত পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করেও উনারা যদি আল্লাহর ক্ষমা না পান তাহলে আমাদের কী আশা আছে!

আমরা যারা তাদের উত্তরসূরী আমাদের ভেবে দেখা দরকার আমরা কি এমন জীবন যাপন করছি যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে উদাহরন হতে পারে? তাদের জীবনের শেষটা যেমন ছিল তেমন পরিণতি পাওয়ার মতো জীবন কি আমাদের? আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি কখনো আমাদের মৃত্যুর পরও আমাদের জন্য ক্ষমা চাইবে? কোথায় চলেছি আমরা?

আল্লাহ আমার নানিকে ক্ষমা করুক, কবুল করুক এবং এই লেখাটা উনার জন্য সাদাকায়ে যারিয়া করে নিক।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন