ইমাম বুখারী (রহঃ), ইমাম শাফি (রহঃ) এবং ইমাম আহমেদ (রহঃ) এরা প্রত্যেকেই ছিলেন হাদিসশাস্ত্রের বিশিষ্ট আলেম। তাঁদের রচিত গ্রন্থসমূহ আজও সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে নির্ভরযোগ্য কিতাব যা পড়ে রাসূল (সা:)এর কথা এবং আমল সম্পর্কে জানা যায়। কাকতালীয়ভাবে এই তিনজন ইমামই শৈশবে তাঁদের পিতাকে হারিয়েছিলেন এবং তাঁদের বিধবা মায়ের একক প্রচেষ্টায় প্রতিপালিত হয়েছিলেন। ইমামদের জীবনী তাই অসম্পূর্ণ রয়ে যায় যদি না তাঁদের জীবনে তাঁদের মায়ের অবদানকে মূল্যায়ন করা হয়।
ইমাম বুখারী (রহঃ) – ইমাম বুখারী (রহঃ)র বাবা যখন মারা যান তখন তিনি ছিলেন নিতান্ত শিশু। মাত্র বারো বছর বয়সে ইমাম বুখারী (রহঃ) দৃষ্টিশক্তি হারান। সেই সময়ে বহু চিকিৎসকের অক্লান্ত প্রচেষ্টা স্বত্তেও তাঁর দৃষ্টি ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু ইমাম বুখারী ( রহঃ) এর মা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও ধৈর্য্যশীলা মহিলা। তিনি তাঁর ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে অনবরত দুআ করতে থাকেন। দীর্ঘ ৪ বছর পর আল্লাহ্ তাঁর দুআ কবুল করেন। এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, ইব্রাহীম(আঃ) তাঁকে বলছেন, “আল্লাহ্ তা’আলা তোমার দু’আর সৌন্দর্য এবং দৃঢ়তার কারণে তোমার সন্তানের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছেন।”
পরদিন সকালে ইমাম বুখারী (রহঃ) ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর সম্পূর্ণরূপে তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। এই ঘটনা থেকে আমরা যে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারি তা হলো আল্লাহর দরবারে সন্তানের জন্য মা-বাবার দুআ কতটা মূল্যবান!! আমরা আমাদের প্রিয়জনকে সবচেয়ে দামী যে উপহারটা দিতে পারি তা হলো তাঁর মঙ্গলের জন্য আন্তরিকভাবে দুআ করা । এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আমরা অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে দুআর ফলাফল না পেলে অধৈর্য্য হয়ে পড়ি। কিন্তু ইমাম বুখারীর মা আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে বিরতিহীনভাবে দুআ করে গেছেন, যা তাঁর অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক।
এছাড়া ইমাম বুখারীর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্যটি হলো, তিনি যে চার বছর অন্ধ ছিলেন সেই সময়ে ৫০০,০০০ হাদীস মুখস্থ করেছিলেন এবং এই হাদীসগুলো তাঁকে পড়ে শোনাতেন তাঁর মা। যতক্ষণ পর্যন্ত না হাদীস মুখস্থ হতো তিনি বার বার পড়ে যেতেন। একজন মা কতটা অধ্যাবসায়ী এবং উচ্চাকাঙ্খী হলে তাঁর সন্তানের অন্ধত্বকে অভিশাপ হিসেবে না নিয়ে বরং তাকে আশীর্বাদে পরিণত করতে পারেন—এই ঘটনাই তাঁর প্রমাণ।
ইমমি শাফি (রহঃ) – উসুল আল ফিকহের জনক হিসেবে পরিচিত ইমাম শাফি (রহঃ) এর পিতাও তাঁর অল্প বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না । কিন্তু এই আর্থিক দুরবস্থা তাঁর জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি। কারণ তাঁর মা ছিলেন একজন দূরদর্শী মহিলা। তিনি চাইতেন তাঁর সন্তান যেন অন্যন্য সাধারণ হিসেবে বেড়ে ওঠে এবং দ্বীন ইসলামের সর্বোত্তম শিক্ষা অর্জন করে। তাই দ্বীনি শিক্ষায় বুৎপত্তি লাভের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর ছেলেকে প্রসিদ্ধ আলেমের কাছে প্রেরণ করেছিলেন।
উনার জীবন থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, একজন মা যদি সন্তানের ব্যাপারে উচ্চাভিলাষী হন এবং তাঁর লক্ষ্যে অটুট থাকেন তবে দারিদ্র্যতা বা অন্য কোনো অজুহাত সেই লক্ষ্য পূরণে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না।
ইমাম আহমেদ (রহ:)– ইমাম আহমেদ (রহ:)ও পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মায়ের সান্নিধ্যে প্রতিপালিত হন। বর্ণিত আছে যে, ইমাম আহমেদ (রহ:) তরুণ বয়স থেকেই তাঁর উত্তম আচরণের জন্য মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। আর এই উত্তম আচরণের শিক্ষা তিনি তাঁর মায়ের কাছে পেয়েছিলেন। তাঁর মা শৈশব থেকেই জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি শিষ্টাচার শেখার উপর গুরুত্ব দিতেন। এভাবে একজন মা তাঁর সন্তানের প্রথম শিক্ষক হিসেবে যদি তাকে সুশিক্ষা দিতে পারেন তবে তাঁর প্রভাব সারা জীবন রয়ে যায়।
পরিশেষে বলা যায়, আজও যখন কোনো মুসলমান উপরোক্ত ইমামদের রচিত বই পড়ে উপকৃত হয় এবং বলে আল্লাহ্ তাঁদের উপর রহমত বর্ষিত করুন তখন নিশ্চয়ই সেই দু’আ তাঁদের মায়ের আমলনামায়ও যুক্ত হয়। এভাবেই একজন মা তাঁর সন্তানকে তাঁর জন্য সাদকায়ে জারিয়া হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। একজন মুসলিম মায়ের জন্য এর চেয়ে বড় সার্থকতা আর কি হতে পারে যদি তাঁর সন্তান এমন একজন কালোত্তীর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয় যার জন্য সমগ্র মুসলিম উম্মাহ তাঁকে স্মরণ করবে এবং দুআ করবে!!
অনুবাদ-তানজিলা শারমিন
তথ্যসূত্র:
https://www.amaliah.com/…/single-mothers-made-men-role…