সাফফানাহ বিনতে হাতিম

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন


মুসলিম নারীরা যে শুধু মা কিংবা স্ত্রী হিসেবে পুরুষদের জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারেন তা নয় বরং একজন বোন হিসেবেও নিজের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে একজন ভাইয়ের জীবনের গতিপথ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারেন। সাফফানাহ বিনতে হাতিম ছিলেন এমনই একজন বোন, যিনি বয়স এবং পদমর্যাদায় ছোট হওয়া স্বত্তেও সময়োপযোগী ও বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে তাঁর ভাই আদি ইবনে হাতেমকে ইসলামের পথে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আদি ইবনে হাতিম ছিলেন আরবের তাঈ গোত্রের প্রধান। তার পিতা হাতিম আত-তাঈ আরবদের মাঝে তার কাব্যপ্রতিভা, বীরত্ব এবং দানশীলতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তাঈ গোত্রের লোকেরা আদিকে পিতার স্থলাভিষিক্ত করে। মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ) যখন মানুষকে ইসলামের আহবান দিতে শুরু করলেন, আদি ইবনে হাতিম সেটাকে তার নিজের রাজত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে করলেন। তাই তিনি রাসূল (সাঃ) এবং ইসলামের বিরোধিতা করতে লাগলেন। যখন মুসলিমদের বিভিন্ন অভিযান তার এলাকার সীমানার কাছাকাছি এসে পড়লো, তিনি খৃ্ষ্টান রাজার অধীনস্থ সিরিয়ার অঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।

এদিকে রাসূল( সা:) এর অশ্বারোহী সেনাদল তাঈ গোত্রের অন্য সবার সাথে হাতিম আত-তাঈ এর বোন সাফফানা বিন হাতিমকেও বন্দী করে নিলেন। বন্দী থাকা অবস্থায় একদিন রাসূল (সা:) তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন রাসূল (সা:) কে সম্বোধন করে বললেন, “ইয়া রাসূল (সা:) আমার উপর রহম করুন, আল্লাহও আপনার উপর রহম করবেন। আমি আমার গোত্র প্রধানের কন্যা হয়েও আজ বন্দিনী। আমার পিতা বন্দীদের মুক্তি দিতেন, দুর্বলদের রক্ষা করতেন, অতিথিদের সসম্মানে আপ্যায়ন করাতেন, দূর্ভাগাদের দুর্দশা দূর করতেন, মানুষদের খাওয়াতেন, সবাইকে সালাম দিতেন, সবসময় মানুষের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করতেন। আমি সেই হাতিম আত-তাঈর কন্যা। আজ আমার পিতা বেঁচে নেই। অনুগ্রহ করে আমার দূর্ভাগ্য নিয়ে আরব গোত্র সমূহকে উপহাস করার সুযোগ করে দেবেন না।

তাঁর এই বাকপটুতায় সন্তুষ্ট হয়ে রাসূল (সা:) সাহাবীদের বললেন, “একে মুক্ত করে দাও, এর পিতা উত্তম আখলাক ভালোবাসতেন।” তিনি আরো বললেন, “কিন্তু যতক্ষন তোমাকে নিরাপদে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন বিশ্বাসী লোক না পাচ্ছ, ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করো না। তেমন কাউকে পেলে আমাকে জানিও।”

এরপর তাঈ গোত্রের একটি কাফেলা যখন সেখানে পৌঁছল, তখন সাফফানা তাদের সাথে যেতে চাইলেন। রাসূল (সা:) তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন, সাথে দিলেন তার কাছে থাকা সেরা পোশাক, একটি বাহন এবং তার সফরের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ। রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের এই দয়ার্দ্র ব্যবহার এবং ইসলামের সৌন্দর্য সাফফানাকে মুগ্ধ করল।

বাড়ি ফিরে আসার পর তার বড় ভাই আদি ইবনে হাতিম তাঁর সাথে দেখা করতে আসলেন এবং তাকে বললেন, ‘আচ্ছা, ওই ‘মানুষটাকে’ (রাসূল (সা:) নিয়ে কি করা যায় বলতো?’ সাফফানা ভাইকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার এই সুবর্ণ সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি প্রজ্ঞার সাথে নমনীয় সুরে বললেন ‘আমার মতে, আপনার সেই মানুষটির কাছে একবার গিয়ে দেখা উচিত। আপনার যদি মনে হয় তিনি আসলেই একজন নবী, তাহলে তাকে অনুসরণ করা উচিত। কারণ যারা তার অনুসরণে অগ্রগামী হতে পারবে, তাদের কল্যাণের সম্ভাবনা বেশী। আর যদি তেমনটি না মনে হয়, তাহলেও আপনার ক্ষতি নেই। আমি জানি আপনি একজন জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আপনার আছে। তবে আমার কথা যদি জানতে চান, আমি ইসলামকে আমার দ্বীন হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছি।’

তখন আদি ইবনে হাতিম বললেন, “এটা তো খুবই ভাল পরামর্শ! আমি মদীনায় রাসূল (সাঃ) এর সাথে দেখা করতে যাব।” এরপর তিনি মদীনায় গিয়ে মহানবী (সা: ) এর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে ইসলাম গ্রহণ করেন্। এভাবে নিজের ভাইকে নতুন একটি দ্বীন তথা ইসলাম সম্পর্কে সুধারণা প্রদান করে একজন অমুসলিমের ইসলাম কবুল করার সওয়াবের অংশীদার হয়ে যান সাফফানা বিন হাতিম।

ভাই-বোনের কথোপকথনে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যদিও সাফফানা বুঝতে পেরেছিলেন তার কবুলকৃত ধর্ম ইসলামই সঠিক তবু তিনি তার ভাইকে ইসলাম গ্রহণ করতে জোর করেননি। বরং তিনি তার ভাইয়ের বিচক্ষণতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাকে নিজে গিয়ে ইসলামের সত্যতা যাচাই করে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ।
বর্তমান যুগেও দ্বীনের দাওয়াত ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করা উচিত। অন্যকে কটাক্ষ করে তাকে সরাসরি ভুল বললে সেই ব্যক্তির ইগোতে আঘাত লাগে এবং অনেক ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই্ দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে বাচনভঙ্গীর নমনীয়তা ও যুক্তি প্রয়োগের বিচক্ষণতা উভয় গুণ থাকা প্রয়োজন।সাফফানা বিন হাতিম একজন নারী হয়েও এই অনুকরণীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন । তাই এত বছর পরেও ভাই আদি ইবনে হাতিমের সাথে সাথে তাঁর নামও ইসলামের ইতিহাসে উজ্জল হয়ে আছে।

অনুবাদ: আম্মাতে রাব্বানী

তথ্যসূত্র:
https://www.islamweb.net/…/saffaanah-bint-haatim-at… 


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন