রানী যুবাইদা বিনতে জা’ফর

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

প্রত্যেক সফল পুরুষের সাফল্যের পেছনেই একজন নারীর অবদান থাকে। পঞ্চম আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল রশিদের জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন একজন নারী, তাঁর স্ত্রী আমাতুল আযিয বিনতে জা’ফর। “যুবাইদা” ছিলো দাদা আল মনসুরের দেয়া ডাকনাম। সমসাময়িক ইতিহাসবিদগণ তাঁর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের কথা বর্ণনা করেছেন। শুধু সৌন্দর্যই নয়, যুবাইদার বাচনভঙ্গিও ছিলো রাশভারি ও মনোমুগ্ধকর। তাঁর সাহসিকতা ও বুদ্ধিদীপ্ততার কারণে তিনি সকলের কাছে প্রশংসনীয় ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন।

তিনি কবিতা লিখতেন, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের নিয়ে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। সৌন্দর্য ও গুণের কারণে তিনি তার স্বামীর ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। খলিফার অন্যান্য স্ত্রীদের চেয়ে তিনি অনেক বেশি প্রভাবশালী ছিলেন। এ কথা কারোরই অজানা ছিলো না যে, খলিফা যে কোনো বড় সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেয়ার আগে তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করতেন। আর প্রতিবারই তিনি সেসব সমস্যার উপযুক্ত এবং বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান দিতেন। ইতিহাসবিদগণ এটাও বলে থাকেন, রাজ্যে যে কোনো আক্রমণের সময় খলিফার অনুপস্থিতিতে যুবাইদা সকল দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিতেন। দেশের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ থেকে আপামর জনগণ সকলেই তার কর্মদক্ষতার প্রতি শ্রদ্ধা, আস্থা ও আনুগত্যতা জ্ঞাপন করতো।

দেশের বাইরের বহু যাত্রাতেও তিনি তার স্বামীর সঙ্গী হয়েছেন। রোমান হামলার সময়, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সৈন্যদের হয়ে যুদ্ধ করার সময় বা হজ্ব পালন – সকলক্ষেত্রেই তিনি খলিফার সঙ্গী হতেন। প্রায় প্রতি বছরই হারুন আল রশিদ হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে বাগদাদ থেকে মক্কায় যেতেন। একবার হজ্বে যাওয়ার সময় যুবাইদা লক্ষ্য করলেন, এক বোতল খাবার পানির দাম এক দিনার হওয়ার কারণে হাজিগণ পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। বিষয়টি তাকে এতটাই স্পর্শ করলো যে তিনি প্রকৌশলীদের মক্কা থেকে বাগদাদ পর্যন্ত একটি খাবার পানির টানেল খনন করার নির্দেশ দিলেন। টানেলটি এখন পর্যন্ত “যুবাইদা নদী” নামে পরিচিত।

এছাড়াও তিনি বাগদাদ থেকে মক্কায় যাওয়ার রাস্তার পাশে বেশ কিছু মসজিদ, কিছু সরাইখানা নির্মাণ করে দিয়েছিলেন, যেখানে হাজিরা বিনামূল্যে থাকতে পারবেন, বিশ্রাম নিতে পারবেন। এভাবে এই নয়শত মাইল দীর্ঘ রাস্তাটিতে প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু নির্মাণ করে দেয়ার মাধ্যমে তিনি সেখানে চলাচলরত হাজিদের ভোগান্তিকে শূন্যের কোঠায় এনে দিয়েছিলেন। আজ অব্দি রাস্তাটি তাই ‘রোড অফ যুবাইদা’ নামে পরিচিত।

নিজের ব্যক্তিগত এত সাফল্য স্বত্তেও স্ত্রী হিসেবে তিনি সবসময় তাঁর স্বামীর মর্যাদাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কথিত আছে, একবার তিনি তার স্বামীর সঙ্গে রসিকতা করছিলেন। কথায় কথায় তাঁরা পারস্যের দুটি বিখ্যাত মিষ্টান্নের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তর্ক জুড়ে দেন। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, ঐদিন সভায় প্রথম যে ব্যক্তি উপস্থিত হবেন তাঁরা তার মতামত গ্রহণ করবেন। প্রথম যে লোকটি এল সে ছিল ঘটনাক্রমে একজন বিচারক। খলিফা তার দাসীদের দু’পদের মিষ্টান্ন আনতে আদেশ করলেন এবং বিচারককে তার মতামত জানাতে বললেন। তখন লোকটি বলল, যে মিষ্টি তিনি কখনো খাননি তার স্বাদ তিনি কীভাবে বিচার করবেন! খলিফা তখন তাঁকে মিষ্টি খেয়ে দেখার অনুমতি দিলে সে ততক্ষণ পর্যন্ত মিষ্টি খেতে থাকল যতক্ষণ না তাঁর পেট ভরে গেল! তার অবস্থা দেখে খলিফা হাসতে হাসতে তার স্ত্রীর সাথে বিবাদ মিটিয়ে ফেললেন এবং ঐ ব্যক্তিকে ১০০০ দিনার উপহার দিলেন। এরপর, যুবাইদা ঐ ব্যক্তিকে আরও ৯৯৯ দিনার উপহার দিলেন। এভাবে ১ দিনার কম দিয়ে তিনি তার স্বামীর উপহারের মর্যাদাকে উচ্চে রাখলেন। এখান থেকে তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।

কথিত আছে, ’এক সহস্র আর এক আরব্য রজনী’ নামক বিখ্যাত বইটি হারুন আল-রশিদ এবং যুবাইদা বিন জাফরের জীবনকাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত। গবেষকরা যদিও বইয়ের বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে যুবাইদাকে চিত্রণের চেষ্টা করেছেন তবে, ’আল সাইয়্যাদা যুবাইদ ‘ নামে সমাদৃত রানীর প্রকৃত চারিত্রিক সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা সহজসাধ্য নয়। তাঁর অপরূপ সৌন্দর্য, মহানুভব হৃদয় আর বিনয়াবনত আচরণ তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।

অনুবাদক: শারিকা হাসান

তথ্যসূত্র : https://www.alshindagah.com/julaug2003/woman53.html


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন