“আমারো প্রাণ যাহা চায় তুমি তাই, তাই গো”…. একটা সময় ছিলো যখন এই রবীন্দ্র সংগীতটা আমার অনেক প্রিয় ছিলো। শুধু রবীন্দ্র সংগীত না, আধুনিক গান, ব্যান্ড মিউজিক, হিন্দী গান, ইংরেজী মিউজিক সবই আমার কালেকশানে ছিলো। এখন আর শুনিনা আলহামদুলিল্লাহ্। এই গানপ্রিয় মানুষ থেকে কিভাবে গান শুনতে ভালো লাগেনা এমন মানুষে পরিণত হলাম সেই গল্পটাই বলতে চাই।
আমি জাহান। আমার জন্ম বেড়ে উঠা মুসলিম পরিবারে। ছোটবেলায় সপ্তাহে ছয়দিন স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি দুপুরবেলা হুজুরের কাছে আরবী পড়তাম। আর সাপ্তাহিক বন্ধের দিন গান ও নাচ শিখতাম। হুজুরের কাছে আরবী পড়া সাথে নাচ-গান শেখা, অনুষ্ঠান করা সবই সমান তালে করেছি। একটা সময় হুজুর বললো, “জাহান, তুমি যে গান-নাচ শেখো, মারা গেলে আল্লাহ্ তোমাকে আগুনের হারমোনিয়াম দিবে গান গাওয়ার জন্য আর আগুনের স্টেজ দিবে নাচ করার জন্য। তখন কি করবা??” এই কথা শুনে প্রাইমারী স্কুলের এই আমি অনেক ভয় পেয়ে গান, নাচ ছেড়ে দিলাম।
সাথে মনে হলো আমি নিজে গাইতে পারবো না তাতে কি শুনতে তো দোষ নাই?? গান শোনা যদি খারাপ হতো তাহলে নিশ্চয় হুজুর আমাকে তা বলতেন!!!! এই বিশ্বাস নিয়েই আমি বড় হতে থাকলাম। এই বড় হওয়ার চক্রে নামাজ পড়া, সাথে শুক্রবার আর রামাদানে কুরআন পড়ার মধ্যেই আমার মুসলিম পরিচয় সীমাবদ্ধ ছিলো।
গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমার এমপিথ্রি প্লেয়ার, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ সবকিছুতে গানের বিরাট কালেকশান। পড়াশুনা শেষ করে জবে ঢুকে হিজাব পড়া শুরু করলেও গান শোনা ছাড়তে পারিনি। একসময় উচ্চ শিক্ষার জন্য জামাইয়ের সাথে অন্য দেশে আসলাম। বিদেশের ছোট শহরে দেশের জন্য মন কাঁদলে গান শুনি, অবসর সময় এমনকি নতুন সংসারে রান্না করার সময়ও গান আমার সংগী। হঠাৎ করে এক ল্যাবমেইট খুব ঝামেলা শুরু করলো সাথে শুরু হলো আমার প্রচন্ড স্ট্রেস। একই সময় আবিষ্কার করলাম গান কেন যেন আমাকে মানসিক শান্তি দিতে পারছিলো না। নামাজ পড়ে অনেক কাঁদলাম আল্লাহ্র কাছে। সেই কেঁদে দোয়া করা থেকেই যেন আল্লাহ্র রহমতে কুরআনের সাথে সম্পর্ক শুরু হলো।
এর কিছুদিনের মধ্যে জানতে পারলাম আমাদের ছোট শহরের একমাত্র মুসল্লায় এক বোন ফ্রি তে তাজউইদ পড়া শিখাবেন। প্রথম ক্লাসে গিয়ে বুঝতে পারলাম আসল তাজউইদ কি, সাথে বুঝলাম হুজুর ভয় দেখিয়ে আমাকে নাচ-গান ছাড়ালেও তাজউইদ ছাড়া ভুল উচ্চারণের আরবী পড়তে শিখিয়েছেন। তখন তাজউইদ ক্লাস করতে করতে মনে হলো শুদ্ধ উচ্চারণে আমার সূরাগুলো আবার শেখা উচিত। সূরা শিখতে গিয়ে দেখলাম ২/৩ ভাষার গান আমার মুখস্থ থাকলেও আগের শেখা অনেক সূরাই এখন মনে নেই। শুধুমাত্র ছোট ৪/৫টা সূরাই আমার সম্বল – যা দিয়ে নামাজ পড়ি!!!!
নতুন করে শুরু করতে গিয়ে কোনভাবেই যেন শিখতে পারছিলাম না। তখন মনে হলো বোধ হয় ল্যাবের স্ট্রেসের জন্য এমন হচ্ছে। এর মধ্যে একদিন এক ভাইয়ের থেকে শুনে ইউটিউবে ইসলামিক লেকচার শুনতে শুরু করলাম। তখন নোমান আলী খানের এক লেকচারে শুনলাম “কুরআন ও গান কখনও একইসাথে এক অন্তরে থাকতে পারেনা”। কথাটা আমাকে চরমভাবে আঘাত করলো। সাথে আরো জানতে পারলাম গান নিজে গাওয়া যেমন ইসলামে নিষেধ আছে; ঠিক তেমনি গান শোনার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা আছে । আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘মানুষের মাঝে কেউ কেউ এমন আছে, যে আল্লাহর রাস্তা (ইসলাম) হতে বিচ্যুত করার জন্য অসার কথা খরিদ করে’ (সূরা লুক্বমান: আয়াত ৬)।
ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) আল্লাহর কসম করে বলেছেন, উক্ত আয়াতে ‘অসার কথা’ বলতে গানকে বুঝানো হয়েছে। [তাফসীর ইবনে কাসীর]
এরপর কয়েকদিন চেষ্টা করলাম গান না শুনে থাকতে। কিন্তু কেন যেন পারছিলাম না। এভাবে হবে না বুঝতে পেরে নিজেকে শক্ত করলাম, নিজেকে বুঝালাম এই বিদেশের এক ছোট মুসল্লায় আল্লাহ্ তাজউইদ শিখার সুযোগ দিয়েছে তা নষ্ট করা যাবে না। তাজউইদ শিখে নতুনভাবে সূরা মুখস্থ করতে হলে শক্তভাবে এই জিনিস বাদ দিতে হবে। এই চিন্তা করে রান্নার সময় মোবাইল থেকে সব গান ডিলিট করে দিলাম। সাথে কুরআনের এপ নামিয়ে যেই সূরা নতুন করে মুখস্থ করার চেষ্টা করছিলাম সেই সূরার তিলাওয়াত প্লে করে দিয়ে রান্না করতে করতে শুনতে শুরু করলাম।
এরপর প্রতিদিন আমার নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু হলো। গান শুনতে ইচ্ছা করলেই কুরআন তিলাওয়াত শুনি আর নয়তো নাশীদ শুনি। একসময় মনে হলো নাশীদেও তো মিউজিক আছে। যতই আল্লাহ্র কথা বলুক; হারাম উপায়ে আল্লাহকে ডাকলেই তো তা হালাল হয়ে যাবেনা। একসময় আল্লাহ্র ইচ্ছায় তাও বাদ দিয়ে দিলাম। আর আবিষ্কার করলাম গান শোনা ছাড়ার সাথে সাথে তাজউইদ সহ সূরা শেখা অনেক সহজ হয়ে গেলো আলহামদুলিল্লাহ্। ৪/৫ সূরা থেকে ধীরে ধীরে সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছিলো। আবিষ্কার করলাম যত মন থেকে গানকে দূর করে দিচ্ছিলাম ততোই যেন কুরআনের সাথে সখ্যতা বেড়েই চলছিলো। সাথে কেমন যেন এক অন্যরকম শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম।
গান অন্তরে এমন এক মোহ তৈরি করে যা দূর করতে হলে আল্লাহ্র সাহায্যের সাথে দৃঢ় সংকল্প প্রয়োজন। আল্লাহ্র কাছাকাছি আসার জন্য, একজন একান্ত অনুগত দাস হওয়ার চেষ্টায় অন্যতম কাজ হলো কুরআনের সাথে সম্পর্ক। আর এই কুরআনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে মিউজিক এক বড় অন্তরায়।