১৬ মার্চ ২০২০
আজ ফিফথ পিরিওডে শুনলাম ৩১ তারিখ পর্যন্ত ছুটি। খবরটা আমদের কাছে যেন ঈদের চাঁদ দেখার মতো আনন্দ বয়ে আনল। কারণ ১৯ তারিখ থেকে পরীক্ষা ছিলো। আমাদের গ্রুপের কেউই আমরা কিছুই পড়িনি। রুবি, সুমি, আমি আর মিনি মিলে ঠিক করলাম প্রথম সপ্তাহটা চিল করবো। তারপরের সপ্তাহ থেকে ধুমিয়ে গ্রুপ স্টাডি করবো। পরীক্ষায় ভালো করা যাবে।
এই প্লানিং এর মধ্যে অবশ্য সুমি কিছুটা বাগড়া দিয়েছিলো। বললো, ‘আখিকে বলবি না?’ আখিকে বলার ব্যাপারে আমরা কেউই আগ্রহী না। কেনই বা বলবো!! আস্ত একটা খ্যাত হয়ে গিয়েছে ও। লাস্ট সুলতান’স এ গিয়েছিলাম সবাই মিলে খেতে। খাওয়ার ফাঁকে দু-চারটা সেল্ফি না নিলে চলে! নাহ্! তিনি সেল্ফি তো নিলেনই না উল্টো বিশাল লম্বা চওড়া লেকচার দিয়ে আমাদের সবার মুডের বারোটা বাজিয়ে দিলো। আমাদের সাথে সেল্ফি তুললে আমরা তো অবিশ্যই পিক গুলো আপলোড করবোই। তখন নাকি কত লোক দেখবে। আর আমাদের তাপসী রাবেয়ার পর্দা নষ্ট হবে। কোনো মানে হয়! দুই দিনের সন্ন্যাসী। ভাতেরে কয় অন্ন। যত্তোসব!
সেদিন ভাইয়া ইতালি থেকে ফেরার সময় আমার সব বান্ধুবীদের জন্য কি সুন্দর কাপল শোপিস নিয়ে আসলো। আখির জন্যও এনেছিলো। ভাইয়া তো আর জানে না যে আমাদের ছোট্টবেলার বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে ওর বাড়াবাড়ির জন্য। কি আর করা। এনেছে যখন ক্লাসে নিয়ে দিলাম সবাইকে। সবাই খুব খুশি। কিন্তু আমাদের তাপসী রাবেয়া! শুরু করে দিলো নিজের ওয়াজ। ঘরে পুতুল শোপিস রাখলে নাকি রহমতের ফেরেস্তা আসে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
সত্যি বলতে মাঝে মাঝে আমি নিজেও আখিকে খুব মিস করি। আগে আমরা সবাই এক সাথে কত্তো মজা করতাম। আমরা পাঁচ জনের গ্রুপ। সেই ছোট্টবেলা থেকে। সবাই একই রকম ড্রেস কিনতাম। ঘুরতে যাওয়া। শপিং করা। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি, সুমি আর আখি আমরা তিনজনেরই ক্রাশ ছিলো রবিন স্যার। সেই আশ্চর্য মহিলা এখন রবিন স্যারের ক্লাসে নেকাব পরে বসে থাকে। কেমন যে মেজাজ খারাপ লাগে!
যাক, একটা লম্বা ছুটি পাওয়া গিয়েছে। এখন আর পুরনো কথা ভেবে মেজাজ খারাপ করে কাজ নেই। থাকুক তাপসী নিজের তপস্যা নিয়ে। আমরা এখন শুধুই চিল করবো। ইয়াহহু!
২৩ মার্চ ২০২০
এই কয়দিন আমরা অনেক মজা করলাম। ভাইয়ের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ইচ্ছে মত শপিং, ঘুরাঘুরি, খাওয়াদাওয়া সব করেছি। সবাই বলেছে পরে টাকা ফেতর দিবে। সেই টাকা কি আর ভাইয়ার পকেটে যাবে নাকি। হুহ! প্রশ্নেই আসে না।
আজ আমাদের বাসায় সবাই এসেছিলো। ওদের সবার আম্মুর রান্না খুব পছন্দের। এতোদিন তো আমার বাসাটাই সবার আড্ডা খানা ছিলো। আব্বু মারা গিয়েছে আনেক ছোটবেলায়। ভাইয়া ছিলো ইতালি। আমরা দুই মা মেয়ে। বাসায় কোনো ঝামেলা নেই আর সাথে ফ্রি পাওয়া যায় আম্মুর রান্না। ওরা নিজেরাই এটা ওটা আবদার করে। আম্মুও নিজের রান্নার শখ মিটায় ওদের আবদার করা খাবার রান্না করেই। আজও সবাই হইহুল্লোড় করে খেয়ে গেলো। ভাইয়া না থাকলে হয়তো রাতে থেকেও যেতো।
৩০ মার্চ ২০২০
গত এক সপ্তাহ আমরা খুব গ্রুপ স্টাডি করলাম। না। ইয়ে। মানে। গ্রুপ স্টাডি করারই চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমরা বান্ধুবীরা একত্র হলে আবার পড়া হবে। ইহা কি আদৌ সম্ভব!! আমরা যে গ্রুপ স্টাডি করছি সেটা সুমি আখিকে বলে দিয়েছিলো। এজন্য রুবি আর মিনি মিলে সুমিকে সেই ধোলাই দিয়েছে। ভালোই হয়েছে। শিক্ষা হবে। নেক্সট টাইম এমন করার আগে ১০ বার ভাববে। উম্ম। অবশ্য এতো ধোলাই না দিলেও চলতো। আখি তো নিজেই ২য় দিন থেকে আর আসেনি। হয়তো আমরা লাউডস্পিকারে গান প্লে করাতে। ১ম দিন তো এই নিয়ে ছোটখাটো ওয়াজ নসিহতও করার চেষ্টা করেছিলো। রুবির ধমক খেয়ে বোবা হয়ে গেলো। রাতে গ্রুপ কলে সুমি বলছিলো আখি নাকি নীরবে কেঁদেছিল। ও নাকি আখির নয়ন জোড়া ছলছল করতে দেখেছে। এই কথায় সবাই হেসে দিলো। সুমি অবশ্য হাসির জন্য বলেনি। আখির জন্য সুমির দরদ সব সময়ই একটু বেশিই ছিলো। নেকামি যত্তোসব। আজ জানলাম ছুটি এপ্রিলের ১১ তারিখ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। হুহ। আমাদের গ্রুপ স্টাডি লাটে উঠলো।
০৪ এপ্রিল ২০২০
ছুটি আবার বাড়ানো হয়েছে। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। এবার সত্যিই খুব বিরক্ত লাগছে, ভয়ও। গত চার দিনে আমার চারপাশে পৃথিবীটা যেন একেবারে হুট করেই থমকে গিয়েছে। ভাইয়া আর আম্মুর ভীষণ জ্বর। লকডাউনের কারণে সব বন্ধ। আমি একা কিভাবে সব করে যাচ্ছি আমি নিজেও জানি না। পাশের বিল্ডিংএর আমজাদ চাচার মৃত্যর পর আমাদের পুরো কলোনিটা লকডাউন করে দেয়া হয়েছে।
কলোনির সবাই ভাবছে ভাইয়ার কারণেই এখানে করোনা ছড়িয়েছে। গত পরশুদিন প্রতিবেশিরা এসে অনেক তামাশা করে গিয়েছে। কোনো রকমে যদি আমাদের বাসার দরজা খুলতে পারতো তাহলে হয়তো আমাদের স্বপরিবারে মেরেই ফেলতো সবাই। এই অবস্থায় আম্মুর এমন শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে যে দেখে মনে হচ্ছিলো আমারই দম বন্ধ হয়ে যাবে এখুনি।
রুবিকে কল দিয়ে বললাম একটু আসতে আমি একা পারছিনা। ও মুখের উপর কি কি যেন বলে ফোনটা কেটে দিলো। আমার মাথা কাজ কছিলো না। কি করবো বুঝতেই পারছিলাম না। পাগলের মতো মিনি আর সুমিকেও কল দিলাম। কেউ রিসিভ করলো না। আগে যে কোনো সমস্যায় ওদের কল দিতাম। ব্রেকআপ যখন হয়েছিলো তখনও তো ঘন্টার পর ঘন্টা ওদের সাথে কথা বলেই ওভারকাম করেছিলাম। কিন্তু এবার ওদের এমন স্বার্থপরের মতো আচরণ আমাকে অবাক করে দিল।
শেষে পাগলের মতো আম্মুকে আর ভাইয়াকে বাসায় রেখে আমিই বেরিয়ে পড়লাম আম্মুর পার্সটা হাতে নিয়ে। ভাইয়া অনেকবার বললো ভাইয়া বের হবে। কিন্তু ভাইয়ার গায়ে এক রত্তি হাটার শক্তিও নেই, কিভাবে আমি ভাইয়াকে যেতে দেই! আমি জানি না শাষ্টকষ্টের জন্য কি ওষুধ কিনতে হয়। আমি জানি না কোথায় এখন ওষুধের দোকান খোলা পাবো। আমার এখন এটাও মনে পড়ছে না যে তখন আমি কি পরে বেরিয়েছিলাম। আমি শুধু হাঁটছি আর মনে মনে দু’আ করছি, ‘আল্লাহ আমাকে ওষুধ কেনার ব্যাবস্থা করে দাও। আল্লাহ আমার আম্মুকে তুমি বাঁচিয়ে রাখো। আমার ভাইয়াকে তুমি বাঁচিয়ে রাখো।’
আপাতত নেবুলাইজারে আম্মুর শ্বাসকষ্ট কমেছে। নিউজ ফিডে যে সব দেখছি তাতে আম্মু আর ভাইয়াকে হস্পিটালে নেয়ার সাহস হয়নি আমার। হাতে টাকাও তেমন নেই। বাসায় যা ছিলো তা-ই রান্না করছি একটু একটু করে। আজ শুধু ডাল, আলু ভর্তা করলাম। আম্মুর জ্বর কিছুটা কম। খুব আশা করে আছি ওরা দু’জনই ভালো হয়ে যাবে। করোনা হয়নি ওদের। আর যদি হয়ও তবে যেন আমারও হয়। আম্মু আর ভাইয়াকে ছাড়া আমার পৃথিবীটা অর্থহীন।
৬এপ্রিল ২০২০
আজ আখি এসেছিলো আমাদের বাসায়। সেদিন নাকি আমাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যেতে দেখেছিলো। তারপর এই দুই দিনে কিছু ফান্ড কালেক্ট করে আমাদের সবার জন্য কিছু খাবার আর ওষুধ দিয়ে গেলো। ওর কাজ ছিলো। আরো কিছু ফ্যামিলিতে ও সহ আরো কিছু আপুরা মিলে খাবার আর ওষুধ দিচ্ছে। খুব ব্যাস্ত। তাই বেশিক্ষণ বসলো না।
তবে ও চলে যাবার পর আমার মনে হতে লাগলো এতোদিন আমি অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, আজ যেন আখি আমাকে একটু বাঁচার সাধ দিলো। খুব দ্রুত রান্না শেষ করে ভাইয়াকে আর আম্মুকে খাইয়ে ওষুধ দিলাম। সব কেমন যেন ভ্রম মনে হয় ইদানীংআমার কাছে। যেন খুব ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখছি আমি।
প্রতিদিন ঘুমোতে যাবার সময় মনে হয় সকালে উঠলেই দেখবো সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। রুবি, সুমি, মিনি সবাই, হ্যাঁ আখিও আবার আমাদের বাসায় এসে আম্মুর কাছে নানান রকম খাবারের জন্য আবদার করবে। আম্মু প্রথমে কিছুক্ষণ পারবোনা বলে ভাব নিবে। ওরা আম্মুর পিছু নিয়ে, ‘প্লিজ আন্টি। প্লিজ। আপনি না কত্তো ভালো।’ এসব বলে বলে আম্মুকে তেল দিতে দিতে রাজি করাবে। এতে আমি হালকা অভিমানে ঢং করে নাক ফুলিয়ে বলবো, ‘হ্যাঁ। ওরা যা বলে তা-ই তো করবা। আমি কিছু বললে তো কখনোই করো না।’ এতে সবাই হেসে উঠবে।
তবে আমার এই স্বপ্ন কি আর আদৌ সত্যি হবে? আম্মু, ভাইয়া সুস্থ হলেও কি বান্ধবীদের সাথে আমার সম্পর্কটা আর আগের মতো হবে? ওরা তো কেউ এখন আমার ফোন কলই রিসিভ করে না। করোনা ছোঁয়াচে! বুঝলাম। কিন্তু আমার সাথে ফোনে কথা বললেও কি ওদের করোনা ধরে ফেলবে! হায়!! আমার ছোট্টবেলার বান্ধুবীরা!!!
৮ এপ্রিল ২০২০
সেদিনের পর থেকে আখি একটু পরপরই কল দিয়ে খোঁজ নিচ্ছে। আম্মুর আর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না। ভাইয়ার জ্বর অনেক কমেছে। এখন হাটাচলাও করতে পারছে আলহামদুলিল্লাহ্। এখন মনে একটু সাহস পাচ্ছি। খুব করে বিশ্বাস করছি এটা করোনা না। ওরা দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। সব ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। আল্লাহ চাইলেই হবে।
ওরা সুস্থ হয়ে গেলে ইনশাআল্লাহ আমিও আখির সাথে অন্যদের সাহায্য করতে বের হবো। হ্যাঁ অবশ্যই আখির মতই ফুল প্রটেকশন নিয়ে। এতোদিনে যা বুঝলাম মানুষ আসলে ভয় পাচ্ছে বেশি। কথায় আছে না ‘বনের বাঘে না খাইলেও মনের বাঘে খায়।’ আমি নিজেও এতোটা মনোবল পেতাম না যদিনা আখি ক্ষণেক্ষণে আমাকে কল দিয়ে এতো না বুঝাতো। সাহায্য আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আখিই বলেছে। আমার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাওয়া যদি আল্লাহ আখিকে না দেখাতেন তাহলে তো ও জানতোও না যে আমি কেমন সমস্যায় আছি। ওকে তো আমি কিছুই বলিনি। যাদের বলেছি তারা সবাই দেখেও না দেখার ভান করেছে।
আখির শেয়ার করা কিছু পিকের মানে আমি এখন বুঝতে পারছি। একটা পিক এমন ছিলো যেখানে লেখা ছিলো ‘সেদিন সব বন্ধুরা শত্রুতে পরিণত হবে শুধু দ্বীনদাররা ছাড়া।’ এটা তখন আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিলো। এখন বুঝি। পৃথিবীতে সামান্য করোনা ভাইরাস আমার ছোট্টবেলার বান্ধুবীদের কেমন রূপ দেখালো। যা আমি আগে কল্পনাও করিনি। আখিকে কথায় কথায় এটা বলাতে ও বললো যে ও যদি দ্বীনের পথে না আসতো তাহলে হয়তো ও নিজেও রুবি, মিনি, সুমির মতই করতো। কথাটা আমার ভেতরে তোলপাড় তুলে দিলো।
আখি যে দ্বীনের কথা বলছে সে দ্বীন তো আমারও। রুবিরও, সুমিরও, মিনিরও। আমরা সবাই তো মুসলিম। তাহলে আমরা কেমন মুসলিম!!! আল্লাহ কোনো কিছুই এমনি এমনি করেন না। অহেতুক কাজ থেকে আল্লাহ পবিত্র। আমাদের এই পরীক্ষা নেয়ার পিছনেও অবশ্য তাঁর হিক্বমাহ আছে। আমাদের কাজ ধৈর্য্যের সাথে নিজের দায়িত্বে ফোকাস করা। আখিও সেটাই করছে। আমিও ধৈর্য ধরে সাওয়াবের আশায় নিজের দায়িত্বে ফোকাস করবো ইনশাআল্লাহ।