New year, is it happy always ??

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

১.
রফিক স্যারের এসাইনমেন্টটা মনোযোগ দিয়ে করছিলো শিবলী। কালই জমা দেওয়ার লাস্ট ডেইট। তাই গভীরভাবে কাজে মগ্ন ছিল। এই সময় মোবাইলটা তাকে ডিস্টার্ব করতেই যেন তারস্বরে বেজে উঠলো। কিছুটা বিরক্ত হয়েই কল রিসিভ করলো সে। ওপাশ থেকে বন্ধু রাকীবের উচ্ছ্বাস-
“হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার দোস্ত!”
-সালাম নাই কালাম নাই ,কয় হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার! এখানে হ্যাপির কী আছে? তুমি মৃত্যুর জন্য আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলে, তাই তোমায় মোবারকবাদ? অদ্ভুত তোরা!
-ধুর ব্যাটা! এত সিরিয়াস হয়ে যাস ক্যান!..আচ্ছা শোন, তোর কাছে কি দুই হাজার টাকা হবে?
-কেন ? এত টাকা দিয়ে কি করবি?
-আরে ব্যাটা মাসের শেষ। পকেট খালি। তোর মত তো আর পয়সাওয়ালা বাপ নাই। কিছু টাকা ধার দে। বুঝিস না ,নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের ব্যাপার-স্যাপার আছে! প্রথম দিনটা এঞ্জয় করলেই না সারা বছর এঞ্জয় হবে মাম্মা!।
-এই, তুই না সবসময় বলিস, তুই এথিস্ট, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ?! তো সূর্য পূজারীদের মত এসব কী বিশ্বাস করিস?!
-আররে! এত কথা বলস কেন? টাকা দিবি কি-না বল?
-দিবো না। স্যরি। আল্লাহ বলেছেন, একে অপরকে খারাপ কাজে যেন সহযোগিতা না করি।
-দিবি না বলসস ঠিক আছে, বয়ান দিতে কইসি? বয়ান ভরা মাঠে গিয়া দে। ফোন রাখ হালা…!
টুট..টুট শুব্দ করে লাইনটা কেটে গেলো।
“ভন্ড স্যাকু!” রাকীবের উদ্দেশ্যে গজগজ করে আবার নিজের কাজে মন দিলো শিবলী। কিন্তু মুড নষ্ট হয়ে গেছে তার। কাজ বন্ধ করে বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। একটু পরেই মাগরীবের আজান দিবে। পরিষ্কার ফকফকা একটা দিন কেমন ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে ! বড় বিষন্ন এক সন্ধ্যা যেন নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে! শিবলীর স্মরণ হলো পবিত্র সে আয়াত-
“আল্লাহ রাত ও দিনকে পরিবর্তিত করেন। এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে ঐ সমস্ত লোকের জন্য ,যাদের বিবেককে তারা কাজে লাগাতে চায়।” (২৪:৪৪)

আহ! জীবন থেকে আরো একটা বছর শেষ হয়ে গেলো ! কত দ্রুত সময়গুলো হারিয়ে যায়! কত মানুষ এই মুহুর্তে মাটির নিচে শুয়ে আছে,যারা আগামী বছরগুলোর জন্য কত প্ল্যান করেছিল..ভাবতে ভাবতে আফসোস হলো শিবলীর। সে জানে না তার মৃত্যু ঠিক কতটা নিকটে! আল্লাহ তাকে এখনো যে সুযোগ দিচ্ছেন তা-ই বা কতটুকু কাজে লাগাতে পারছে! মনে মনে নিজের অজ্ঞতা,ভুল স্বীকার করে নিয়ে সেই চরম ক্ষমাশীল সত্তার কাছে মাফ চাইতে থাকলো সে।দু’আ করলো,”হে আল্লাহ,আমাকে সরল পথে চলার তাওফীক দান করো,আমাকে তোমার মুকাররিবীন বান্দাদের দলভুক্ত করে নাও।”…..মুয়াজ্জিনের কন্ঠে সুমধুর সালাতের আহবান ভেসে আসলো…আল্লাহু আকবর…আল্লাহু আকবর…! ওযু করে মসজিদের পথে রওয়ানা হলো শিবলী।
২.
শিবলী যখন মসজিদের দিকে হাঁটছে ঠিক সেই মুহুর্তে তারই বন্ধু রাকীব,সাদী,রনিরা দলবল নিয়ে বছরের শেষদিন উদযাপনের জন্য আয়োজিত কনসার্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। আজ তাদের ভার্সটিতে অনেক বড় বড় সিঙ্গাররা আসবে। এমন আনন্দের মুহুর্ত প্রথম সারিতে থেকে উপভোগ না করলেই নয়। সবাই তাই আগেভাগে যাচ্ছে জায়গা দখল করতে। রাকীব আজ সবার চেয়ে বেশি এক্সাইটেড। তার টাকা জোগাড় হয়ে গেছে। কনসার্ট শেষে রাতের পার্টিতে বন্ধুদের সাথে সেও এটেন্ড করবে।মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ছেলে রাকীব আগে কখনো হুইস্কি-বিয়ার চেখে দেখেনি। বাবার কড়া শাসনের মধ্যে এতদিন থেকেছিলো। আজ ভার্সটির প্রথম বর্ষেই মুক্ত জীবনে এমন একটা সুযোগ পেয়েছে ভেবে সে যারপরনাই খুশি।
৩.
হলের ফ্রেন্ডরা সুরাইয়াকেও টেনে বের করলো কনসার্টে যাওয়ার জন্য। সুরাইয়া কিছুটা কনজার্ভেটিভ মাইন্ডের মেয়ে। যেতেই চাচ্ছিলো না। বান্ধবীরা জোর করে তাদের সাথে তাকেও নিয়ে গেলো।
প্রথম দিকে বেশ ভালোই লাগছিলো সুরাইয়ার। তার পছন্দের সব গায়কেরা এসেছে। যাদের এতদিন শুধু টিভি পর্দায় দেখেছিলো,তাদের সামনে দেখে ভালো লাগছিল ওর। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলো।বান্ধবীদের বললো ফিরে যেতে। কিন্তু কেউ তার কথায় পাত্তা দিলো না। তারা যেন এখন আর এ জগতে নেই। ড্রাম আর বিটের তালে তালে,রাতের অন্ধকারের সাথে লাল-নিল-সবুজ লাইটের কারিশমা, তাদের যেন মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে! বন্ধুদের এমন রুপ আগে কখনো দেখেনি সুরাইয়া। তারা ছেলেদের মত চিৎকার করছে, শীষ বাজাচ্ছে, নাচছে, গাইছে। হঠাৎ সুরাইয়া দেখলো মেয়েদের দলের মধ্যে তাদেরই ক্লাসের কিছু ছেলে ঢুকে পরেছে। তার বান্ধবীরাও এটা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে! অন্য সময় যা কল্পনাও করা যেতো না;এই সময়,এই পরিবেশটা যেন সে সবকিছু করার স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছে!যে কোন মুহূর্তে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে..বাঁধা দেওয়ারও কেউ নেই!ভয় হতে থাকলো সুরাইয়ার।বাবার মুখটা মনে পড়লো।গ্রামের বাড়ির ছোট্ট নিরিবিলি ঘরটাকে সে ভীষণ মিস করা শুরু করলো।এত কোলাহলের ভীড়েও সুরাইয়া যেন হারিয়ে গিয়েছিল নিশ্চুপ শান্ত সেই সুরমা নদীর তীর ঘেঁষা তার ছোট্ট কুটিরটায়।..
হঠাৎ সে টের পেলো কে জানি তার হাত ধরে টানছে।তাকিয়ে দেখে তাদেরই ব্যাচমেট রাকিব তাকে ড্যান্স পার্টনার হিসেবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ঝটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো সে।এরপর উল্টা দিকে ঘুরে ছুটা শুরু করলো। ভীড় ঠেলে ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে চারপাশের উন্মাতাল মানুষ দেখে তার মনে হলো, এই জায়গায় যেন ইবলিশ শয়তান তার সমস্ত চ্যালাপ্যালাদের নিয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। এখানে যেন আল্লাহর ভয়াবহ লানত আর ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষিত হচ্ছে! তার মনে হলো, এই মুহুর্তে হয়তো আল্লাহর গজব নাযিল হয়ে যাবে।সে চায় না কুফফারদের রীতিনীতি অনুসরণ করায় ভয়ংকর সেই হাশরের মাঠে তাদের সাথে দাঁড়াতে..এক হাত উপরের সূর্যকে সহ্য করার ক্ষমতা তার নাই..সে তো তাদের সাথে থাকতে চায় যারা সেদিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবে। প্রাণপণে সে এ জায়গা ছেড়ে পালাতে থাকলো। ছুটতে ছুটতে হলের কাছে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সুরাইয়া।

৪.
কন্সার্ট শেষে সাদী তার বান্ধবী তারিনকে নিয়ে শহরের অভিজাত একটা নাইট ক্লাবে এসেছে। থার্টি ফার্স্ট উপলক্ষে এখানে ভালো অফার চলছে। বান্ধবী নিয়ে আসলে 50℅ ডিস্কাউন্টে এন্ট্রি ফি। মেয়েদের জন্যে তো এসব ক্লাবে এমনিই এন্ট্রি ফ্রি। কিন্তু সাদীর জন্য এমন সুযোগ লুফে নেওয়ার মত। তারিন প্রায়ই এসব ক্লাব পার্টিতে আসে। কিন্তু সাদী আজই প্রথম এসেছে। বছরের প্রথম প্রহর তারিনের সাথে কাটানোর এটাই ওর জন্য সুবর্ণ সুযোগ। সেজন্যই আসা।

বিশাল বলরুম জুড়ে ডিজে পার্টির সাথে সাথে ড্যান্স চলছে। ইচ্ছেমত হাত-পা ছুড়ে নারী-পুরুষ একসাথে নাচানাচি করছে। কেমন মাতাল এই পরিবেশটায় একদম কমফোর্ট ফীল করছিলোনা সাদী। চারপাশের মানুষজনকে তার উন্মাদ মনে হলো! তারিনের কথায় সে তাদের দু’জনের জন্য কোল্ড ড্রিংক্স আনতে গেলো ।ফিরে এসে তারিনকে না পেয়ে হালকা আলোয় খুঁজতে খুঁজতে দেখতে পেলো সুদর্শন মাঝবয়সী এক লোকের সাথে তারিন নাচছে! সাদী সেখানে যেয়ে তাকে বারবার ফিরিয়ে আনতে চাইলো কিন্তু তারিন কৌশলে তাকে এড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই সাদী ঐ লোকসহ তারিনকে আর খুঁজে পেলো না! পুরো ড্যান্সরুম জুড়ে কোথাও তাদের দেখতে পেলো না! লজ্জায়, প্রচন্ড অপমানে কোকের ক্যানগুলো ছুড়ে ফেলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো সে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মোবাইল খুলতেই শিবলীর এসএমএস পেলো সাদী। শিবলী তার হ্যাপি নিউ ইয়ারের রিপ্লাইয়ে পাঠিয়েছে,
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে সে তাকে নির্লজ্জতা ও অপকর্মের আদেশ দিবে।” (২৪ঃ২১)
ঠিক এই মুহূর্তে এরকম বার্তা সাদীর ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো। একটু আগেও যেখানে বিস্বাদে মন ছেয়ে ছিলো,এখন সেই মন ভরে উঠলো কৃতজ্ঞতায়। সে আশেপাশে মসজিদ খুঁজতে লাগলো। আজ রাতটা সে কাটাতে চায় মহান প্রভুর সান্নিধ্যে..!

৫.
কন্সার্ট শেষ করে রাকিব আর তার বন্ধুরা ছাদে জড়ো হয়েছে। খাবার পানীয়র আঞ্জাম একে একে ছাদে এনে রাখলো। পটকা, আতশ বাজিয়ে ফুটিয়ে রাত বারোটায় নতুন বছরকে সবাই স্বাগত জানালো। হৈ-হুল্লুড় আর আমোদ ফূর্তিতে মেতে উঠলো তারা।

গানের শব্দে ঘুমোতেই পারছেনা শিবলী। উপরের তলার ব্যাচেলররা সেই কখন থেকে লাউড স্পিকারে গান বাজিয়ে রেখেছে,আর বন্ধ করার নাম নেই। মাথাটা ঝিমঝিম করছে শিবলীর। না পারতে আবার উঠলো সে।উপরতলার দরজায় আওয়াজ করলো।

টালমাটাল লাল চোখের এক ছেলে দরজা খুলেই বললো, কাকে চাই?

-ভাই গানের শব্দে তো আমাদের খুব সমস্যা হচ্ছে…তখনও একবার বলে গেলাম,শুনলেন না!
শিবলীর দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে ওর কথাই ব্যাঙ্গ করে বলতে লাগলো মাতাল ছেলেটা। শিবলী ছেলেটার হাত বাড়ি মেরে সরিয়ে দেয়। এতেই ক্ষেপে যায় সে। শিবলীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকলো। চিৎকার করে শিবলী বলল,“ আপনারা কি মুসলমান না? নিজেরা নোংরামি করছেন আবার আশেপাশের সবাইকে কষ্ট দিচ্ছেন! আপনাদের সম্পর্কেই তো আল্লাহ বলেছেন,
“যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সূরা আহযাব : ৫৮)।
উত্তেজিত হয়ে বলতে বলতেই ফিরে গেলো শিবলী।

৬.
মাঝরাতে ফ্রেশ হওয়ার জন্য রুমে এসেছিল তারেক। ছাদের পার্টিটা বেশ জমে উঠেছে। গায়ে জ্যাকেটটা জড়িয়েই আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে একটা দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপলো তার। সবার সাথে একটা প্র‍্যাঙ্ক করলে কেমন হয়?! ভাবতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ফেইসবুকে লাইভ ভিডিও ওপেন করে সে ঘোষণা করলো, হ্যলো ফ্র‍্যান্ডস! যারাই জেগে আছো, সাথেই থাকো…তোমাদের জন্য নিয়ে এসেছি থার্টি ফার্স্ট নাইটের উপহার..!
ছাদে উঠেই বন্ধুদের উদ্দেশ্যে সে চিৎকার করে উঠলো, “এই তোরা পালা…পালা…পুলিশ আইছে..পুলিশ..!”
বন্ধুরা সব মাতাল হয়ে পড়েছিল।পুলিশের কথা শুনে ভয় পেয়ে টলমল পায়ে তারা উঠার চেষ্টা করলো..রাকীব আগে থেকেই বেশ এক্সাইটেড ছিল। তার উপর ভেতরে কেমন যেন একটা অজানা ভয়ও কাজ করছিল,বারবার মনে হচ্ছিলো,এই বুঝি বাবা এসে একটা ধমক দিবেন! পুলিশ শব্দটা কানে যেতেই তার ভয় আরো বেড়ে গেলো। হন্তদন্ত হয়ে ভারী পা দু’টো টেনে নিয়ে দ্রুত ছাদের কিনারায় চলে আসলো সে।ছাদ টপকে অন্য ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করতেই পা পিছলে গেলো তার। দুই বিল্ডিং এর মাঝখানে ছয় তলার ছাদ থেকে সোজা নিচে পড়ে গেলো রাকীব।বন্ধুরা তার বিকট চিৎকারের আওয়াজ শুনলো।মুহূর্তেই এত বড় ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখে তারেক,রনিরা হতভম্ভ হয়ে ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে রইলো।…নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে রাকীবকে দেখার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো!……

৭.
পরদিন আবছা আলোয় রাকীবের ছুটে যাওয়া মূর্তির ভিডিওটা দেখতে দেখতে শিবলীর মনে হলো,আহা! এই তো রাকীব! যে চেয়েছিল সারা বছর এঞ্জয় করবে অথচ বছর শুরুর সূর্যটাই তার আর দেখা হলো না….!


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন