আজ ডিসেম্বরের ৭ তারিখ।
ছয় বছর আগে শীতের এমনি এক কুয়াশা ঢাকা সকালে নিলা ওর প্রথম সন্তানের এবোরশন করে এসেছিলো। নিলা যদিও এবোরশন করাতে চায়নি কিন্তু রাশেদ জোর করেছিলো বলে আর কিছু বলার ছিলো না ওর। রাশেদ ভার্সিটিতে নিলার দুই বছরের সিনিয়র ছিল। ওদের মধ্যে ঠিক প্রেম না থাকলেও ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই রাশেদ যে ওকে পছন্দ করতো তা নিলা বেশ বুঝতে পারতো। নিলার মাস্টার্স পরীক্ষার পর যখন ওর পরিবার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করলো ,তখন ম্যাসেঞ্জারে এই বিষয়টা শেয়ার করার পর তড়িঘড়ি করেই রাশেদ নিলার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো। রাশেদ মাত্র এক বছর আগেই চাকুরিতে ঢুকেছে। এন্ট্রি লেভেলে আছে বলে বেতন তেমন আহামরী কিছু নয়। তবু নিলার আগ্র্রহেই ওর বাবা-মা রাশেদের সাথে বিয়ে দিতে রাজী হলেন।
বিয়ের পর বাসা ভাড়া নিয়ে নতুন সংসার শুরু করলো নিলা-রাশেদ। ছাত্রজীবনে হলে থেকেছে, বাড়ি থেকেও খরচ দিত। তাই সংসারের খরচ সম্বন্ধে তেমন ধারণা ছিল না ওদের। ঢাকা শহরে একার আয় দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে জীবনের বাস্তবতা টের পেল ওরা। এরই মধ্যে বিয়ের দুই মাস পরে হঠাৎ করেই কনসিভ করলো নিলা।
এমন টানাপোড়ন এর মাঝে তৃতীয় একটা সত্তার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য মানসিক ও আর্থিকভাবে প্রস্তুত ছিল না রাশেদ। তাই সে নিলাকে অনুরোধ করে এবোরশন করাতে। মনে মনে কষ্ট পেলেও রাশেদের অসহায় চেহারার দিকে তাকিয়ে নিলাও এবোরশন করতে রাজি হয়ে যায়। খরচ কমাতে ওরা একটা অখ্যাত ক্লিনিক থেকে কাজটা সেরে সাময়িকভাবে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়।
কিন্তু সেদিন ওরা বুঝতে পারেনি নিজেদের অজান্তেই কত বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিল ।
এই ছয় বছরে রাশেদের চাকুরিতে পদোন্নতি হয়েছে। নিলাও একটা স্কুলে জব করছে। দুজনের আয়ে সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে ঠিকই কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও আর কনসিভ করেনি নিলা। গাইনীর নামকরা ডাক্তার দেখাচ্ছে ওরা। ডাক্তার বলেছেন, এবোরশনের কারণে জরায়ুতে ইনফেকশন হয়েছিল নিলার। ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খাওয়ার পর এখন আর কোনো জটিলতা না থাকলেও কেন যে নিলা কনসিভ করছে না সে বিষয়ে ডাক্তারও কনফিউজড। শেষ বার যখন ডা. নুসরাত কে দেখিয়েছিল তখন উনি বলেছিলেন ,“ আমরাতো ট্রিটমেন্ট করছি কিন্তু আশানুরূপ কোনো ফল পাচ্ছিনা। আপনি আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, তার কাছে সাহায্য চান।”
নিলা এখন আল্লাহ্র উপর ভরসা করেই আছে। আগে নিয়মিত সালাত আদায় করতো না , এখন নিয়মিত সালাত আদায় করে। হিজাব মেইনটেইন করে চলার চেষ্টা করে। রাশেদেরও অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে শুধু জুম’আর সালাতে ওকে মাসজিদে দেখা যেতো, এখন নিয়মিত সালাত আদায় করে। ওরা এখন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার “আর-রজ্জাক” নামের অর্থ জানে। ওরা জানে যে রিজিকের মালিক ওরা না। যে মহান রব ওদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলেন, সেই অনুগ্রহের কদর ওরা বোঝেনি। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল না করে ওরা সব দায়িত্ব নিজেদের ওপর চাপিয়ে নিয়েছিলো। এখন যেন সেই ভুলেরই মাশুল দিয়ে যাচ্ছে ওরা।
রাশেদ যদিও এখন সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করে, নিলার কাছে ক্ষমা চায়, কিন্তু এখন আর ক্ষমা চেয়ে কি লাভ! মা ডাক শোনার যে তীব্র আকুতিটা ওর বুকের মাঝে ঝড় তোলে তা কি আর ক্ষমা চাইলে কমবে? এই সব কথা ভাবতে ভাবতে নিলার বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। একটু স্বস্তির আশায় কুরআন তিলাওয়াত চালিয়ে দিয়ে জানালার পাশে বসে একমনে বাইরেরর দিকে তাকিয়ে আছে নিলা। সূরা নুহের তিলাওয়াত হচ্ছে, অর্থ সহ। হঠাৎ কয়েকটা আয়াতের অর্থ শুনে নিলা থমকে যায়। অর্থটা কিছুটা এরকম,
“তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, আর তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগবাগিচা দেবেন, আর দেবেন নদীনালা।”
( সূরা নুহ: ১০-১২)
নিলার মনে হচ্ছে কথাগুলো যেনো ওকে উদ্দেশ্য করেই বলা। ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো, কানে শুধু এই কথা গুলোই বাজছে “তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও”, “আর তিনি তোমাদের সন্তান সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন”
সেদিন নিলা রাশেদকেও আয়াতটা পড়ে শোনালো। তারপর দুজন মিলে তাদের রবের কাছে ক্ষমা চাইতে শুরু করল। সকাল-সন্ধ্যা, তাহাজ্জুদে বেশি বেশি ইস্তেগফার করতে লাগলো। সিয়াম রেখে ইফতারির আগ মূহুর্তে কান্নাকাটি করলো, নিজেদের ভুল স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলো আর সাথে এই দুআ “রব্বি হাবলি মিনাস স্বলিহীন”।
কয়েক মাস পর, নিলার কেমন বমি বমি পাচ্ছে, মাথাটা ঘুরছে। কয়েকদিন ধরেই এমন হচ্ছে। নিলার মনে আশার সঞ্চার হলো, তাহলে কি সে কনসিভ করেছে? এগুলো তো প্রেগনেন্সির সাধারণ লক্ষণ। নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটা স্ট্রিপ দিয়ে টেস্ট করলো। টেস্টের রেজাল্ট আসলো পজিটিভ। কান্না জড়িত,অস্ফুট কন্ঠে নিলার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো মহান রবের প্রশংসা। নিলা সিজদায় লুটিয়ে পড়ল।
বেশ কয়েক বছর পর…..
নিলার সেই পরম কাঙ্ক্ষিত সন্তান আজ ২১ বছরের যুবক। আল্লাহর প্রতি ভালবাসা থেকে ছেলের নাম রেখেছিলো ‘আব্দুল্লাহ’, আল্লাহর দাস। কিন্তু আব্দুল্লাহ যেন শুধু নামেই আল্লাহর দাস । তার কাজে, কর্মে, কথায় কোথাও মহান রবের দাসত্বের ছিটেফোঁটাও নেই। ছোটবেলায় অবশ্য ছেলেটা এমন ছিলো না। সালাত আদায়ের জন্য পাচঁ ওয়াক্ত রাশেদের সাথে মাসজিদে যেতো। রামাদ্বান মাসে প্রায় পনেরো-বিশ টা সিয়াম রাখতো।
কিন্তু এখন কি যে হলো ছেলের!
গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে যেন অন্ধ হয়ে গেছে আব্দুল্লাহ। সারাদিন শুধু বন্ধু-বান্ধব আর গীটার। নিলা বহুবার নিষেধ করেছে গান না করতে, গীটার না বাজাতে, বলেছে এগুলো হারাম। কিন্তু আব্দুল্লাহর তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর রুমের দেওয়াল জুড়ে টাঙানো পছন্দের শিল্পীদের ছবি আর মিউজিক অ্যলবামের পোস্টার।
একদিন সকালে কানে হেডফোন গুঁজে আর হাতে গীটার নিয়ে বাইরে যায় আব্দুল্লাহ। বেখেয়ালে রাস্তা পার হওয়ার সময় ধাক্কা লাগে বড় এক বাসের সাথে। গীটারটা ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে যায়,আব্দুল্লাহও পড়ে যায় রাস্তার ওপর। আশে পাশে থাকা পথচারীরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কেউ একজন আব্দুল্লাহর ফোনে ‘মা’ লেখা সেভ করা দেখে ফোন করে নিলাকে। বলে তার ছেলের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, হাসপাতালের ঠিকানাও জানিয়ে দেয়। নিলার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়, সারা শরীর কাঁপতে থাকে অজানা আশন্কায়।
হাসপাতালে গিয়ে নিলা দেখে মাথায় আঘাত লাগার কারণে আব্দুল্লাহ অর্ধচেতন হয়ে পড়ে আছে। হাতের আঙুলের যে নখগুলো সে বড় রেখেছিলো গীটার বাজানোর জন্য, সেই আঙুলগুলো ভেঙে গেছে। নিলা আব্দুল্লাহর শিয়রে বসে কপালে হাত রাখে।
কয়েক ঘন্টা পর আব্দুল্লাহর জ্ঞান ফেরে। মায়ের দিকে তাকিয়েই কাদঁতে শুরু করে আর বলে “জানো মা, আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি একটা অন্ধকার,তালাবন্ধ ঘরে আটকা পড়ে আছি। ঘরের ভিতরে রাখা গিটার, পোস্টারগুলো যেন আমাকে গ্রাস করতে আসছে!! কিন্তু ঘরের বাইরে বের হওয়ার চাবিটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। আমার কি তবে বাইরের আলোতে বের হওয়ার কোনোই উপায় নেই মা?”
ছেলের প্রশ্ন শুনে নিলার মনে পড়ে যায় আব্দুল্লাহকে পাওয়ার সেই সময়টার কথা। ছেলের হাত ধরে বলে, “ বাবা, তুমি ক্ষমা চাও সেই সত্তার কাছে যিনি তোমাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। তিনিই তোমাকে মুক্তির পথ দেখাবেন।” মায়ের কথা শুনে অব্দুল্লাহ যেন অন্ধকারের মধ্যে আলোর দিশা খুঁজে পায়।
সুস্থ হওয়ার পর সে গিটার, গান ছেড়ে দেয় । এতদিন ভুল পথে চলে যে গুনাহ করেছে তার জন্য ক্ষমা চাইতে শুরু করে আল্লাহর কাছে। আগে যেখানে গুনগুন করে গানের কলি গাইতো এখন সেখানে সকাল-সন্ধ্যা অবসর পেলেই ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়ে, রাত জেগে গান প্র্যাকটিস না করে ভোরে তাহাজ্জুদে উঠে নামায পড়ে ক্ষমা চায় আল্লাহর কাছে।
ধীরে ধীরে আব্দুল্লাহ শুধু নামে না , আমল দিয়েও সত্যিকারের আব্দুল্লাহ হযে ওঠে। মায়ের বলা সেই Magic key যেন খুলে দিয়েছে ওর জীবনের অপ্রাপ্তির বন্ধ দুয়ার। প্রকৃত প্রাপ্তিতো দ্বীনকে খুঁজে পাওয়া আর সেই দ্বীনকে আঁকড়ে ধরে জান্নাতের দরজা দিয়ে ঢুকতে পারার যোগ্যতা অর্জন করা।
————————————————————————————————————————
জীবনে চলার পথে মানুষ ভুল করবে, শয়তানের প্ররোচনায় গুনাহতে লিপ্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। সেজন্য হয়তো সাময়িকভাবে মানুষের জীবনে নিয়ামতের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মহান আল্লাহর ক্ষমার বিশালতা আমাদের গুনাহর চাইতেও বহুগুণ বেশি। তাইতো তিনি দরজা খোলার চাবির ব্যবস্থাও রেখেছেন। তা হলো-ইস্তিগফার।
একবার হাসান বসরীর কাছে এসে এক ব্যক্তি জানালো “ আমার ফসলে খরা লেগেছে। আমাকে আমল দিন”। হাসান বসরী তাকে বললেন , “ইস্তিগফার করো।”।
কিছুক্ষণ পর আরেক ব্যক্তি এসে অভিযোগ পেশ করল “আমি গরীব। আমাকে রিজক এর আমল দিন” । হাসান বসরী. তাকেও বলেলন , “ ইস্তিগফার করো “
এরপর অপর এক ব্যক্তি এসে সন্তান হও্য়ার আমল চাইলেও তিনি বললেন, “ইস্তিগফার করো।”
উপস্থিত ছাত্ররা জিজ্ঞেস করল, “সবাইকে এক পরামর্শই দিলেন যে?”
বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. বললেন, “আমি নিজের পক্ষ থেকে কিছুই বলিনি। এটা বরং আল্লাহ তায়ালা তার কুরআনে শিখিয়েছেন । তারপর তিনি সুরা নুহ এর (১০-১২)নং আয়াত তেলাওয়াত করলেন। (তাফসীরে কুরতুবী ১৮/৩০৩)
রাসূল (সা:) বলেছেন ,“যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করবেন।” ( আবু দাউদ:১৫২০; ইবন মাজাহ :৩৮১৯; তাবারানি:৬২৯১)
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদেরকে তার দিকে ফিরে আসার এবং তার কাছে বেশি বেশি ইস্তেগফার করার তৌফিক দিন।