প্রশ্ন:
ক) কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় ‘Right Hand Possess’ Term টা ব্যবহার করা হয়েছে, এটার মানে কী?
খ) মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া গৃহকর্মীরা কি দাসী?
গ) ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে নারীদের ধর্ষণ করা কি এই কনসেপ্ট দিয়ে জায়েজ করা যায়? বিস্তারিত লিখুন।
ঘ) ইসলাম অনুযায়ী একজন দাসীর কী কী অধিকার আছে?
ঙ) ইসলামিক বিধান অনুযায়ী কখন একজন দাসীকে মুক্ত করে দিতে হয়?
চ) একজন নারী হিসেবে এই নিয়মকে আপনার কেমন লাগে?
উত্তর:
ক) কুরআনের ৭টি সূরায় সর্বমোট ১৫ বার ‘মালাকাত আইমানুহু’ বা Right hand possess টার্মটি ব্যবহৃত হয়েছে। এটার অর্থ করা যায় ‘অধিকারভুক্ত দাস-দাসী’ হিসেবে, অর্থাৎ, যাদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে অধিকার করা হয়েছে।
ন্যায়সঙ্গতভাবে কাদের অধিকারে নেওয়া যাবে, এই বিষয়টি ইসলামি শরিয়তে সুষ্পষ্ট। কাউকে দাস/দাসী হিসেবে গ্রহণের একটি মাত্র বৈধ পথই বর্তমানে রয়েছে। সেটি হলো আল্লাহর রাস্তায় তাওহিদকে উড্ডীন করার জন্য, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, কাফেরদের সঙ্গে জিহাদে যুদ্ধবন্দিদের দাস বানানো। এরকম বৈধ মালিকের কাছ থেকে কেউ কিনে নিলে, তার জন্যও ঐ দাস/দাসী বৈধ হবে।
• আল্লাহ কুরআনে দাসীর সঙ্গে শারীরিক মেলামেশা বৈধ করেছেন। এ ব্যাপারে সুরা নিসা’র আয়াত ২৪, সুরা মুমিনুনের আয়াত ৬, সুরা আহযাবের আয়াত ৫০, সুরা মা‘আরিজের আয়াত ৩০ দ্রষ্টব্য।
কিন্তু একজন নারীকে কখন দাসী হিসেবে নেয়া যাবে এবং শারীরিক মেলামেশা করা যাবে তার জন্যও আল্লাহ সীমা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। সেগুলো হলোঃ
১। শুধুমাত্র মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে যুদ্ধ হতে হবে। জাতিগত/ভৌগলিক/ভাষাগত কারণে মুসলিমদের মাঝে কোনো যুদ্ধ হলে তার বন্দিদের দাস-দাসী বানানো যাবে না। মুসলিম বন্দিকে দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হলে এটা হবে ব্যভিচার এবং শর’য়ী শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
২। যুদ্ধ শেষে কাফির বন্দি মেয়েদেরকে প্রথমে আইনানুযায়ী ইসলামী সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে। সরকার তাদের বিনা শর্তে অথবা মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে দিতে পারে, শত্রুর হাতে বন্দি মুসলিমদের সাথে বিনিময় করতে পারে, অথবা সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দিতে পারে। কাজেই যুদ্ধাবস্থায় বা বণ্টনের পূর্বে দাসী হিসেবে মেলামেশা ব্যভিচারের শাস্তিযোগ্য।
৩। গর্ভবতী নয় নিশ্চিত হতে এক মাসিক বা গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
৪। যার ভাগে দেয়া হবে শুধুমাত্র সে-ই ভোগ করতে পারবে। স্ত্রীর দাসীকেও ব্যবহার করা যাবে না।
৫। দাসী সন্তানের মা হলে তাকে অন্য কারো কাছে দেয়া যাবে না। বরং মালিকের মৃত্যুর পর সে স্বাধীন হয়ে যাবে।
৬। দাসীর বোন, ফুপু, খালা এমন কাউকে একসাথে দাসী হিসেবে রাখা যাবে না।
৭। বিবাহিত ক্রীতদাসীর সাথে মেলামেশা করা যাবে না।
অর্থাৎ, আল্লাহ কখনোই শর্তহীনভাবে ভোগের অনুমতি দেন নি। খুব স্বল্পসংখ্যক উপায়েই কেবল দাসী গ্রহণ করা যায় এবং তাদের বহু অধিকার নিশ্চিত করতে হয়।৬
বর্তমানে ইসলামবিরোধী এবং কিছু মুসলিমের মাঝেও কারা দাসী এই ব্যাপারে বিভ্রান্তি রয়েছে।
উত্তর:
খ) গৃহকর্মী বা কাজের লোক এবং দাসী কখনোই এক না। গৃহকর্মীরা হলো শ্রমিকের মতো। ওরা নির্দিষ্ট বেতনের বিনিময়ে আমাদের সাথে কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হয়। এটা সমাজের আর পাঁচ-দশটা চাকুরীর মতোই। তারা স্বাধীন মানুষ, কারো অধিকারভুক্ত নয়। যে কোন সময় এ গৃহকর্মীরা নিয়মমাফিক কাজ ছেড়ে দেয়ার অধিকার তারা রাখে অন্য সব চাকুরীজীবির মতোই। কিন্তু দাস-দাসীর এ অধিকার থাকে না, যতক্ষণ না তার মালিক তাকে মুক্তি দিচ্ছে স্বেচ্ছায় বা চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে।
অধিকাংশ সময়ই এই গৃহকর্মীরা মুসলিম, আর, অমুসলিম হলেও তারা কোনো জিহাদে বন্দি হিসেবে প্রাপ্ত না। কাজেই পয়েন্ট-১ অনুযায়ী তারা কখনোই দাসী হতে পারে না। তাদেরকে দাসী হিসেবে মনে করে ওই অনুযায়ী আচরণ করা হলে তা ইসলামি শরিয়তে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিবাহিত কোনো ব্যক্তি কোনো গৃহকর্মীর সাথে দাসী হিসেবে মেলামেশা করলে তা রজমযোগ্য অপরাধ। (আল্লাহ আমাদের মাফ করুন)
মধ্যপ্রাচ্যে বা আমাদের দেশে গৃহকর্মীর সাথে হয়ে আসা এসব জাহেলিয়াতের অবসানে তাই দাসপ্রথা সম্পর্কে ইসলামের বিধানগুলো বিস্তারিত জানা খুবই জরুরি।
উত্তরঃ
গ) না, কোনোভাবেই তা জায়েয করা যায় না এবং এটা স্পষ্টতই হারাম। বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে হলে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট আমাদের জানতে হবে।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ- দুটি দেশই মূলত মুসলিম প্রধান দেশ। এদের দুই পক্ষের মধ্যকার জাতীয়তাবাদ, ভাষা, রাজনীতি, অত্যাচার-নিপীড়ন, হত্যা, ইত্যাদি কারণে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এটি শরীয়তসম্মত জিহাদ বা কাফিরদের সাথে সংঘটিত কোন যুদ্ধ ছিল না।
উপরোক্ত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দাসী বানানোর মূলনীতি অনুসারে আমরা বুঝতে পারছি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মুসলিম নারীদেরকে ধর্ষণ অবশ্যই যিনা-ব্যভিচার বলে গণ্য হবে। এই যুদ্ধে নারীরা (হোক মুসলিম বা কাফির) কোনভাবেই গনিমতের মাল হিসেবে গণ্য হবে না।
আরো উল্লেখ্য যে, যুদ্ধচলাকালীন তারা আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছে যা ছিল ঘৃণ্য পাশবিকতার উপস্থাপন এবং Totally Unacceptable। মুসলিমদের একটি বড় গুণ হলো Controlling Power। মুসলিম সৈন্যদের জিহাদ চলাকালীন সময়ে Control Mechanism এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তারা যুদ্ধের ময়দানে অবস্থিত শারীরিকভাবে দুর্বল শ্রেণীর অর্থাৎ নারী শিশুদের নিরাপত্তা দিতে বাধ্য। এমনকি তারা যুদ্ধের ময়দানে অবস্থিত পশুপাখি, গাছপালা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি পর্যন্ত করতে পারবে না। যুদ্ধে যদি জেতে, তবেই গনিমতের মাল ভাগ হবার পর শুধুমাত্র দাসী পাবে, কোন ভাবেই তার আগে নয়।
এখানে একটা হাদিস উল্লেখ্য,
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) কে সৈন্যবাহিনী সহ প্রেরণ করেন এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) সৈন্যদল সহ জিরার ইবনুল আজওয়ারকে প্রেরণ করেন, আর তারা আসাদ গোত্রের একটি এলাকা দখল করেন। তারা একটি সুন্দরী নারীকে বন্দী করেন এবং জিরার তার প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি তাঁর সঙ্গীদের থেকে তাকে চাইলেন তারা দিয়ে দিলো এবং তিনি তার সাথে সঙ্গম করলেন। উদ্দেশ্য পূর্ণ হবার পর কৃতকর্মের জন্য তিনি অনুতপ্ত হলেন এবং খালিদ (রা) এর নিকট তিনি এ সম্পর্কে বললেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) বললেন, অবশ্যই আমি তোমার জন্য এর অনুমোদন ও বৈধতা প্রদান করছি। জিরার বললেন, না, ওমর (রা) কে চিঠি না পাঠানো পর্যন্ত নয়। ওমর (রা) উত্তরে লিখলেন, তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করতে হবে। কিন্তু চিঠি পৌঁছাবার আগেই জিরার ইন্তেকাল করলেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন আল্লাহ তাকে অপমানিত করতে চাননি। ( সূত্র- বায়হাকী আল-কুবরা হাদিস নং ১৮৬৮৫)
এমনই চমৎকার, অসাধারণ আর ব্যালেন্সড- আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন ইসলাম। এজন্য ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ঘটা মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির ঘটনা কোনোভাবেই ইসলামকে কটাক্ষ করার হাতিয়ার হতে পারে না। যারা এটা করে থাকে নিতান্তই এটা তাদের কলুষিত ফিতরাত এবং সত্য উপলব্ধির স্বল্পতা প্রমাণ করে।
ঘ)
ইসলাম-পূর্ব সময়ের সাথে ইসলাম পরবর্তী সময়ের তুলনা করলে আমরা দেখব যে দাস-দাসীদের সাথে আচার-আচরণের এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে ব্যবস্থা ইসলাম করেছে তা এককথায় ছিল অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী বিষয়। দাসীদের অধিকারের ইসলাম প্রদত্ত কিছু ক্ষেত্র নীচে উল্লেখ করা হলঃ
১। ভরণপোষণ ও নিরাপত্তা পাবার সমানাধিকারঃ
সাহাবীরা এই অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। মারুফ ইবনে সাঈদ বলেন আমি আবু যর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর গায়ে একটি চাদর দেখলাম, অনুরূপ আরেকটি চাদর তার দাসের গায়ে দেখলাম।
(বুখারীঃ ২৫৪৫, মুসলিমঃ ১৬৬২)
২। কাজকর্মে সহানুভূতি পাবার অধিকারঃ
দাসীদের উপর তার সামর্থের অতিরিক্ত কোনো কাজের বোঝা চাপানো যাবে না। (বুখারীঃ ২৫৪৫, মুসলিমঃ ১৬৬২)
৩। সম্মান লাভের অধিকারঃ
ইসলামে একজন দাসীর ধর্মীয় মর্যাদায় একজন স্বাধীন মুসলিম নারীর চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং বেশি।
(বুখারি- ৭২২, ইংরেজি অনুবাদ ভলি ৩, বুক ৪৬)
৫। ন্যায়বিচার লাভের অধিকারঃ
দাসীদের ন্যায়বিচার লাভের অধিকার কে ইসলাম নিশ্চিত করে। এক্ষেত্রে ইসলাম ঘোষণা করে কঠোর সতর্কবাণী, কেউ কোন দাসীকে হত্যা করলে তাকে হত্যা করা হবে। কেউ কোন দাসীর অঙ্গহানি ঘটালে তাকেও অঙ্গহানি ঘটানো হবে।
(দাউদ-৪৫১৫)
৬। জৈবিক চাহিদা পূরণের অধিকারঃ
ইসলাম তাদের জৈবিক চাহিদা পূরণের অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং নিজের দাস-দাসীদের বিবাহ দিয়ে দেওয়াকে মনিবের জন্য দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছে। (আন-নূর,২৪:৩২)
৭। পবিত্র জীবন যাপনের অধিকারঃ
ইসলামে দাসীদের পতিতাবৃত্তিতে নিযুক্ত করা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। (আন-নূর,২৪:৩৩)
৮। বিবাহের ক্ষেত্রে মতামত প্রদানের অধিকারঃ
দাসীর সাথে আলোচনা না করে তাকে কারো সাথে বিবাহ দিতে পারবে না। (বুখারি-৭০৫৬; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৯, বুক ৮৬, নম্বর ১০০;)
৯। দাসী এবং তার শিশুর একত্রিত থাকার অধিকারঃ
কোন ক্রীতদাসীকে ভিন্ন কোথাও বিক্রি করে তার থেকে তার শিশুকে বিচ্ছিন্ন করার কোন অনুমতি ইসলামে নেই এবং এই ধরনের বেচাকেনা নিষিদ্ধ। (সুনান আবু দাউদ, ইংরেজি অনুবাদ: বুক ১৪, নম্বর ২৬৯০)
ইসলাম মনিব ও দাসীর মধ্যে মানবিকতার পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী নীতিমালা নির্ধারণ করেছে এবং এমন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যার ধারে কাছেও মানব রচিত কোনো নিয়ম-কানুন ও বিশ্ব শাসন ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে কখনও পৌঁছাতে পারেনি।
উত্তরঃ
ঙ) ইসলামিক বিধানের অন্যতম মহান বৈশিষ্ট্য হলো ইসলাম দাসীদেরকে প্রকৃত স্বাধীনতার/মুক্তির ব্যাপারে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে অনুপ্রাণিত করে এবং প্রস্তুত করে।
আভ্যন্তরীণ মুক্তিঃ
মানসিক দাসত্ব মূলত দাসীদের অস্তিত্ববোধ ও সম্মানবোধ কে দুর্বল করে ফেলে। তাদেরকে মনের এই শৃংখল থেকে বের না করে, স্বাধীন হবার ইচ্ছা ভিতর থেকে জাগ্রত না করে, মুক্ত করলে কোন লাভ হয় না। উদাহরণস্বরূপঃ এখানে আব্রাহাম লিংকনের আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দাস প্রথা বাতিলের সিদ্ধান্ত কে দেখানো যেতে পারে, যার ফলাফল এখন পর্যন্ত আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গরা ভোগ করছে। বনী ইসরাইলের মানুষদের ভিতরও আমরা এই মনোভাব দেখতে পাই। লোহিত সাগর পার হবার অলৌকিক ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হবার পরেও তারা আল্লাহর দাসত্বে মনোনিবেশ করতে পারেনি, মানসিক দাসত্বের শেকল থেকে বের হতে পারেনি। এজন্যে ইসলাম দাস-দাসীদের মুক্ত করার আগে প্রস্তুত করে নেয়। ইসলামী শরীয়তের বিধান তাদেরকে মান সম্মানের সাথে বাঁচার, উত্তম ব্যবহার পাওয়ার, নিরাপত্তা ও ভরণপোষণের ক্ষেত্রে একজন স্বাধীন নারীর সমান অধিকার দিয়েছে, যাতে করে তারা তাদের মানবিক অস্তিত্ব ও আত্মসম্মানবোধকে অনুভব করে। আর এভাবে একটা সময় সে নিজেকে স্বাধীন মানুষের মত ভাবতে শুরু করে এবং মনের ও হৃদয়ের গভীর থেকে বলিষ্ঠতার সাথে স্বাধীনতার দাবি করে। এটাই হল মূলত মুক্তি/স্বাধীনতার প্রকৃত উপায়। এভাবেই ইসলাম দাসীদেরকে মানসিক দাসত্ব থেকে অভ্যন্তরীণভাবে মুক্তি দিয়েছে এবং মুক্তি পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত করেছে।
বাহ্যিকভাবে মুক্তিঃ
ইসলামিক বিধানে লক্ষ্য করলে আমরা দেখব যে, ইসলাম দাসত্বে ঢোকার/দাসে পরিণত করার পথটা খুবই সংকীর্ণ করেছে, আর দাসত্ব থেকে বের হবার পথটা রেখেছে ব্যাপক-বিস্তীর্ণ।
বিভিন্নভাবে ইসলাম দাসী মুক্তিকে উৎসাহিত করেছে এবং বিরাট সওয়াবের কাজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। (সুরাহ আল-বাকারা,২:১৭৭)
১। সন্তানের মা (ঊম্মুল অলাদ) হওয়ার কারণে মনিবের ঊপর দাসীকে বিক্রি করা হারাম হয়ে যায়। মনিবের জীবন দশায় তাকে আযাদ না করে মারা গেলে তাঁর মৃত্যুর পর সাথে সাথে সে মুক্ত হয়ে যাবে।
২। বিবাহ করার মাধ্যমে মুক্তিদানঃ মনিব দাসীকে বিবাহ করতে গেলে প্রথমে তাকে মুক্ত করবে, তারপর বিবাহ করবে।
৩। নির্যাতনমূলক প্রহারের কারণে মুক্তিদান।
৪। কাফফারা আদায়ের মাধ্যমে মুক্তিদান। যেমন- ভুলবশত হত্যা করে ফেললে, শপথ ভঙ্গ করলে, রমাদান মাসে ইচ্ছাকৃতভাবে সাওম পালন করা অবস্থায় শারীরিক সম্পর্ক করলে ইত্যাদি।
৫। মুনিবের সাথে লিখিত চুক্তির মাধ্যমে (মুকাতাবা) মুক্তি লাভ এবং এক্ষেত্রে ইসলাম দাসীকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করার ব্যবস্থা রেখেছে। (সুরাহ আত-তাওবাঃ ৬০)।
দাসীমুক্তির এই নানাবিধ ব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে ইসলাম তার ছায়াতলে মানুষকে একমাত্র আল্লাহর দাসত্বে দিকে অনুপ্রাণিত করেছে, ধাবিত করেছে। তাই তো আজ আমরা দাসপ্রথার অস্তিত্ব আক্ষরিক অর্থে খুঁজে পাইনা।
উত্তরঃ
চ) আমার জীবনের একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করছি। ২০০৯ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি পিলখানা গণহত্যার সেই দিনটার কথা মনে আছে? আমি কোনদিন ভুলবো বলে মনে হয় না। আমার বাসা ছিল হাজারীবাগ বিডিআর ৫ নং গেটের একদম কাছে। পিলখানার ভেতর দিয়েই আমি ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া আসা করতাম। ঐদিন সকাল দশটায় ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে আমার বাসা থেকে আমি মাত্র দুই মিনিট এর দূরত্বে ছিলাম। আল্লাহর ইচ্ছায় আমি আটকে গেলাম ভেতরে। আমার রিক্সাওয়ালার সম্ভবত গুলি লেগেছিল। সবাই ছুটছিল, সাথে আমিও। আশ্রয়ের কোন জায়গা ছিল না, কাউকে চিনি না। ওদিকে গোলাগুলির ভয়ংকর শব্দ, দেখছিলাম কারো হাত, কারো পা গড়িয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কোন জায়গা পাচ্ছিলাম না। আমার অবস্থান থেকে দরবার হল ছিল দুই মিনিট হাঁটার দূরত্বে, একটানা গুলির আওয়াজ আর চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম ওদিক থেকে। বুঝতে বাকি রইলো না যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। মুহূর্তেই পৃথিবীটা উল্টে গেল যেন! আমি এক বিল্ডিং এর সিঁড়ির কোনায় জড়োসড়ো হয়ে কাঁদছিলাম আর অনিশ্চয়তার ভয়ে কাঁপছিলাম। দেখলাম বিডিআর সদস্যরা তাদের পরিবারকে একে একে নিয়ে চলে যাচ্ছে কোথাও। আমি তাদের অনেকের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি কিন্তু কেউ যেন আমাকে দেখছে না, সবাই নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। সময়ের সাথে নিরাপত্তাহীনতার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে চূড়ান্ত ধাপে উঠে গেলাম যেন। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হবার পথে, রঙ্গিন আলোয় সবসময় ঝকঝক করা রাস্তার লাইটগুলো যেন ঐদিন ঘুমিয়ে ছিল। অন্ধকারের চাদরে ঢাকা ছিল পিলখানা। শেষ পর্যন্ত বাবা অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্য ছিলেন বলে তার একটা সুবিধা পেলাম। আল্লাহ কোনো এক অলৌকিক উপায়ে আমাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সম্মানের সাথে বের করে আনলেন।
নিরাপত্তাহীনতার ওই প্রাচীরে আটক থাকা অবস্থায়, একটা সময় সম্ভ্রম হারানোর ভয় আমাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলেছিল যেন। ঐ আতঙ্ক, ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বর্ণনা করা অসম্ভব। ভেতরে থাকাকালীন এবং বের হবার পর অনেক বোনদের একাধিক ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষিত হবার ঘটনা শুনছিলাম, এর সত্যতা আল্লাহই ভালো জানেন। (বিডিআর বাহিনীর নাম পরিবর্তিত হয়ে এখন বিজিবি হয়েছে।)
আমি নিশ্চিত কাফেরদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধের চিত্র আরো হাজার গুণ ভয়াবহ ছিল। এই অভিজ্ঞতার কারণে এখন আমার আল্লাহর দেয়া বিধানগুলো বুঝতে অনেক সহজ হয়, আল-হাকিমের প্রজ্ঞা নির্দ্বিধায় মেনে নিতে পারি । যেমনঃ দোয়ার প্রভাব, ভাগ্য বা তাকদীর, বহুবিবাহ ও দাসপ্রথা ইত্যাদি।
একজন মেয়ে হিসেবে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি এবং মানি যে ইসলাম দাসীদের জন্য যে বিধান দিয়েছে এর চেয়ে মর্যাদা পূর্ণ জীবনব্যবস্থা অন্য কেউ দিতে পারবে না। আমি বিষয়টাকে দুটি দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিচার করব, দাসীর জায়গা থেকে এবং মনিবের পরিবারের সদস্যা হিসেবে।
দাসীর দৃষ্টিকোণ থেকে:
একজন নারী যুদ্ধে তাঁর অভিভাবককে হারানোর পর অচেনা সব মানুষের ভিড়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, এই ভেবে যে তার সাথে যেকোন সময় সর্বোচ্চ খারাপ কিছু ঘটতে পারে। আমরা প্রাক ইসলামী যুগের ইতিহাস থেকে দেখি দাসীদেরকে তারা কেমন চতুষ্পদ জানোয়া্রের চেয়েও নীচু কিছু ভেবে খেয়াল খুশি মতো ভোগ লালসা মেটানোর বস্তুতে পরিণত করেছিল। কারণ কর্মের জন্য জবাবদিহিতার কোন ব্যবস্থা ছিল না। আমরা একটু চিন্তা করে দেখিতো, যুদ্ধের পর কী হয় ঐ অসহায় নারীদের যাদের কোন অভিভাবক থাকেনা, কি, অস্থির লাগছে না ভাবতে?
বিলাসিতায় বড় হওয়া আত্মকেন্দ্রিক কোনো নারীর পক্ষে সত্যিকার অর্থে যুদ্ধের ময়দানে একটি মেয়ের অবস্থা অনুভব করাটা কঠিন। ঐ সময় হোক সে কোন অভিজাত বংশের নারী অথবা সুবিধাবঞ্চিত কোন নারী, তার ভাবনায় থাকে চরম লাঞ্চিত হবার ভয়, সোজা কথায় বলতে গেলে গণধর্ষিত হবার ভয়, তাকে ছিন্নভিন্ন করে খেয়ে ফেলার ভয়, পতিতাপল্লির অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হবার ভয়। যে-কোনো নারী এমন সময় চাইবে কাউকে অভিভাবক হিসেবে পেতে, যে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে, তার মৌলিক চাহিদা মেটাবে। আর সেই অভিভাবক যদি মুসলিম হয়, সে নারী ধন্য হয়ে যাবে কারণ সে তখন অন্য সবার মতো মান-সম্মান নিয়ে সুন্দর ব্যবহার পেয়ে মানুষের মতন বাঁচতে পারবে।
ইসলাম যুদ্ধবন্দীদেরকে দাসী করা অত্যাবশ্যকীয় করেনি বরং অনুমোদন দিয়েছে। ইসলামের এই ব্যালেন্সড মানবিক দিকটা আমাকে মুগ্ধ করে। এটা মুসলিমদের ইমাম/খলিফার বিবেচনার উপর ছেড়ে দিয়েছে, এর অর্থ যুদ্ধবন্দী হলেই মানুষকে দাসী বানানো হতো না, কি চমৎকার ব্যবস্থা, তাই না !
এখানে আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় যে দাসী হলেই তার মনিবের সাথে শারীরিক সম্পর্ক আবশ্যকীয় কিছু না বরং অনুমোদিত। আর এজন্যেই বৃদ্ধা ও শিশু দাসীরা ঊপেক্ষিত না, তাদের দায়িত্বভারও সমানভাবেই ইসলাম নেয়। দাসী বানানোর পর মনিব তার লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সাথে সাথেই চলচিত্রে দেখা কোন দৃশ্যের মত ঐ নারীর ঊপর ঝাপিয়ে পড়ে না, এটা ইসলাম কোন ভাবেই Allow করে না। মনিব কাউকে উপপত্নী দাসী বানাতে চাইলে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তাকে এক হায়েয পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আর যদি দাসীর গর্ভে সন্তান থাকে তবে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
সুবহানাল্লাহ! কি মানবিক আর মর্যাদাপূর্ণ বিধান! একজন দাসী এই সময়ে যুদ্ধের Trauma থেকে, তার প্রিয়জন হারানোর ব্যথা থেকে বের হবার সুযোগ পায়। এর সাথে মুসলিমদের থেকে মানবিক ও উদার আচরণ পেয়ে সে পুনরায় তার অস্তিত্ব অনুভব করে। মানুষ হিসেবে আত্মসম্মানবোধ, মর্যাদাবোধ ফিরে পায়। একজন সঙ্গীর সাথে সম্মানবোধ নিয়ে সেও তার শারীরিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ পায়। ইসলামের ছায়াতলে থেকে সে একটা সময় মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে এক আল্লাহর দাসত্বে নিজেকে সঁপে দেয়।
মনিবের স্ত্রী/মেয়ে/মায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে:
মনিবের একজন উপপত্নী দাসী গ্রহণ, তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য মেনে নেয়া অনেক সময় সহজ নাও হতে পারে। তবে ‘আল হাকিম’ এর বিধান হিসেবে চিন্তা করলে তখন সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ একজন মুজাহিদকে হক দিয়েছেন দাসী উপভোগ করার; আবার দাসীকেও দিয়েছেন তার নিজস্ব হক। তাছাড়া একজন মুজাহিদ তো এখানে অবৈধ কিছু করছেন না। যুদ্ধের ময়দানে তিনি না কাউকে ধর্ষণ করেছেন, না আড়ালে লুকিয়ে পরকীয়া করেছেন। জান-মাল বাজি রেখে যিনি তাওহীদকে সমুন্নত করতে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, আল্লাহ তাকে একটা বেনিফিট দিয়েছেন। কিন্তু এই বেনিফিটের সাথে এসেছে একটা মেয়ের দায়িত্ব। এই মেয়ের বাচ্চা হলে তার স্বীকৃতি প্রদানও তার দায়িত্ব।
তাই একজন মুজাহিদের যদি দায়িত্ব নিতে আপত্তি না থাকে, তবে পরিবারের নারী সদস্যদেরও উচিত বিষয়টিকে মেনে নেয়া।
তাছাড়া আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে ব্যক্তি স্বার্থ চিন্তা না করে তাদের উচিত সামষ্টিক কল্যাণের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া। দাস-দাসী নেওয়ার ইসলামী সিস্টেম না থাকলে সমাজে যত ধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হতো তার প্রভাব পরিবারগুলোতেও পড়তো। এভাবেই ইসলামিক বিধান সমাজের খারাপ একেবারে মুছে দিতে না পারলেও তা অনেকাংশে কমিয়ে আনে। আর এটাই হলো ইসলামের সৌন্দর্য।
সবশেষে বলতে চাই ,আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রতিটা বিধানে প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেন আমরা সবাই মূলত আল্লাহর দাস। দুনিয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে একে অপরের উপর বিজয় দিয়ে, এক অপরের অধীন করিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করেন। দিন শেষে আমাদের প্রত্যেককে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে, আমাদের নিজেদের ব্যাপারে, আমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। দাস-দাসী দুনিয়াবি দৃষ্টিতে বিলাসিতার মনে হলেও একজন মুত্তাকী ব্যক্তির জন্য ভয়ের কারণও বটে, কেননা আল্লাহর সামনে তাদের ব্যাপারে হিসাব দেওয়াটা সবার জন্য সহজ না-ও হতে পারে।
ইসলামের আরও একটা সুন্দর দিক বুঝতে পেরে আমার হৃদয় থেকে এই বাক্যটিই আসছেঃ
رَضِيْتُ بِاللّٰهِ رَبًّا، وَّبِالْإِسْلاَمِ دِينًا وَّبِمُحَمَّدٍ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَبِيًّا
‘আল্লাহকে রব, ইসলামকে দীন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নবীরূপে গ্রহণ করে আমি সন্তুষ্ট।’
References:
সূত্রঃ
১। সূরা নিসা ৪:৩,২৪,২৫,৩৬, সূরা নাহল ১৬:৭১, সূরা মু’মিনূন ২৩:০৬, সূরা আন-নূর ২৪:৩১,৩৩,৫৮, সূরা রূম ৩০:২৮, সূরা আহযাব ৩৩:৫০(২ বার), ৫২, ৫৫, সূরা মা’আরিজ ৭০:৩০।
২। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ফিকহ, ২/৭৮৫ (from response-to-anti-islam.com)
৩। সূরা নিসার ২৪ নং আয়াতের তাফসীর (তাফহীমুল কুরআন ২য় খন্ড, তাফসীর আবু বকর যাকারিয়া, তাফসীর আহসানুল বায়ান বা অন্যান্য)
৪। বায়হাকি’র সুনান আল কুবরা, হাদিস নং ১৮৬৮৫
৫। আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৪৫৯
৬। ইসলামে দাসপ্রথার বিস্তারিতঃ
https://response-to-anti-islam.com/…/%E0%A6%87%E0…/171
এবং
http://response-to-anti-islam.com/…/%E0%A6%87%E0%A6…/173
৭. Tafseer by Dr. Abu Bakar Muhammad Zakaria.