ইসলামের আলোকে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতায় করণীয়

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

প্রশ্ন:


ক) আমরা যখন কুরআনের কাহিনীগুলো পড়ি তখন আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহর প্রিয় বান্দা নবী-রাসূলরাও তাদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন ,কিন্তু তাঁরা সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থেকেছেন। এসব রেফারেন্স টেনে প্রায়ই বলা হয়,প্রকৃত মুমিন কখনো ডিপ্রেশন এ ভুগতে পারে না।


কিন্তু এটা কি সত্যি ?


কুরআন থেকে এমন কিছু আয়াত/ উদাহরণ/ ঘটনার উদাহরণ দিন যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, আল্লাহর প্রিয় বান্দারা ও আপসেট হয়েছিলেন ।


খ) আমাদের জীবনে যখন দুঃসময় আসে,তখন আমরা কি দুআ করতে করতে পারি ?

উত্তর:

ক) প্রথমেই আমাদের ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা বিষয়ে একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার।মেডিক্যাল সাইন্সের ভাষায় ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতাএকটি মানসিক সমস্যা, যা বহুমাত্রিক কারণে হতে পারে। বংশানুগতিক,জৈবিক ,শারীরিক বিভিন্ন রোগ ( থাইরয়েড,ডায়াবেটিস), অন্য মানসিক রোগ, ব্যাক্তিত্ব জনিত সমস্যা, শৈশব ও সাম্প্রতিক প্রতিকূল পরিবেশের কারণে মস্তিস্কের নিউরো ট্রান্সমিটার এ পরিবর্তন হয়ে ’বিষণ্ণতা ‘ তৈরি হয়।

ডিপ্রেশনের বেশ কয়েকটি লক্ষণ ও শ্রেণীবিভাগ আছে ।আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশনের মতে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন থেকে উত্তোরণের জন্য ওষুধ আর কাউন্সিলিং এর পাশাপাশি সুস্থ ধর্মচর্চার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা বিষয়ে ইসলাম কি বলে?


ইসলাম আমাদের দেখায় যে, জীবনের চলার পথে মুমিন ব্যাক্তিও বিভিন্ন সময় বিষণ্ণ হতে পারে। কুরআন থেকে আমরা এমন কিছু ঘটনা বা আয়াত পাই যেখানে দেখতে পাই আল্লাহ’র প্রিয় বান্দারাও বিভিন্ন সময় মানসিক চাপে পড়ে বিষণ্ণ হয়েছেন। আর কুরআনের ভাষাগত অলৌকিকতার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের বুঝিয়েছেন যে এই বিষণ্ণতার ও কয়েক ধরনের প্রকারভেদ আছে। যেমন –

১. রাসুল (সা:) নব্যুওয়াত প্রাপ্তির পর কুরাইশদের কাছে আল্লাহর বাণী প্রচার শুরু করেন। কিন্তু তারা অধিকাংশই ঈমান আনলো না বরং আল্লাহর বাণীকে অস্বীকার করে তাঁকে বিভিন্নভাবে কটূক্তি করতে লাগলো । তখন উনি এতোটাই কষ্ট পেলেন যে উনার মধ্যে এক ধরণের বিষণ্ণতা ভর করে । মূলত এই ডিপ্রেশন কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ নাযিল করেন –

‎“ قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُونَ فَإِنَّهُمْ لَا يُكَذِّبُونَكَ وَلَٰكِنَّ الظَّالِمِينَ بِآيَاتِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ
আমার জানা আছে যে, তাদের উক্তি আপনাকে দুঃখিত করে। অতএব, তারা আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে না, বরং জালেমরা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে।” [ সুরা আনআম,৩৩]


এ আয়াতে ‘লা ইয়াহ্ যুনকা’শব্দটি দিয়ে আল-হাযানের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে । “আল-হাযান” শব্দটি অতীতের কোনও দুর্ঘটনার ফলে চলমান দুঃখবোধ কে বুঝায় ।
এই ঘটনার উল্লেখ করে আল্লাহ সূরা কাহাফ এও বলেন যে ,তাদের হিদায়াত না হওয়ায় রাসূল (সাঃ) এত বেশি কষ্টে ছিলেন যে তিনি দুঃখে আত্মবিনাশী হয়ে যেতে পারতেন।

فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّـفۡسَكَ عَلٰٓى اٰثَارِهِمۡ اِنۡ لَّمۡ يُؤۡمِنُوۡا بِهٰذَا الۡحَـدِيۡثِ اَسَفًا‏
তারা বাণীতে ঈমান না আনলে সম্ভবত তাদের পিছনে ঘুরে আপনি দুঃখে আত্মবিনাশী হয়ে পড়বেন।” [সূরা কাহাফ :]


এখানে “আল আসাফ” দ্বারা দুঃখ বোঝানো হয়েছে।

আরেকবার রাসুল সাঃ এর কাছে টানা বেশ কিছু মাস ওহী আসা বন্ধ থাকে, এ সময় মুশরিকরা তাকে নানা রকম কটূক্তি করে এবং বলে যে আল্লাহ তাঁকে ত্যাগ করেছেন। তিনিও ওহী না আসায় ভিতরে ভিতরে খু ই অস্থির হয়ে গেলেন । তখন আল্লাহ নাযিল করলেন,

(হে নবী!) তোমার রব তোমাকে কখনো পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্টও হননি। নি:সন্দেহে তোমার জন্য পরবর্তী যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো।” [সুরা আদদুহা, ৩-৪]

রাসুল সাঃ এর নবুয়াতের দশম বছরে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে উনার প্রিয় চাচা আবু তালেবের ও প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.) এর মৃত্যু, কুরাইশ মুশরিক কর্তৃক মুসলমানদের নির্যাতন বৃদ্ধি এবং তায়েফে অপমানিত হয়ে উনি এতো কষ্ট পেলেন যে এই বছর কে عام الحزن‎, Year of Sadness বা দুঃখের বছর বলা হয়।

২.নবী ইয়াকুব আলাইহিস সালাম পুত্র ইউসুফকে হারানোর শোকে বিমর্ষ ছিলেন এবং উনার এই দুঃখবোধ এতো গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল এবং উনি এত ই কান্নাকাটি করেন যে অন্ধ হয়ে যান –
وَ تَوَلّٰی عَنۡہُمۡ وَ قَالَ یٰۤاَسَفٰی عَلٰی یُوۡسُفَ وَ ابۡیَضَّتۡ عَیۡنٰہُ مِنَ الۡحُزۡنِ فَہُوَ کَظِیۡمٌ ﴿۸۴﴾
আর তাদের থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং বলল, ‘ইউসুফের জন্য আফসোস’! আর দুঃখে তার চক্ষুদ্বয় সাদা হয়ে গেল, কিন্তু সে তো সংবরণকারী। [ সূরা ইউসুফ :৮৪]

এখানে “আল হুযুন” শব্দ টি দ্বারা গভীর দুঃখ বোধ বা “extreme sadness” বোঝানো হয়েছে।

৩.ইউনুস আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তার সম্প্রদায়কে ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় নদীতে ঝাঁপ দিলে তিনি মাছের পেটে বন্দি হন।মাছের পেটে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয় কিনা বা শেষ বিচারের দিন এই অবস্থায় উত্থিত হবার দুশ্চিন্তায় এবং পাপবোধ থেকে এক ধরনের বিষন্নতা তাঁকে ঘিরে ধরে।তখন তিনি নিজের ভুল স্বীকার করে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে দুআ করতে থাকেন আর তাঁর দুআর জবাব হিসেবে আল্লাহ বলেন –

“ فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَٰلِكَ نُنجِي الْمُؤْمِنِينَ

অতঃপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনি ভাবে বিশ্বাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি।” [সুরা আলআম্বিয়া, ৮৮]


এখানে “আল-গাম” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ হলো চলমান কোন সঙ্কটে চিন্তিত হয়ে বিষন্ন হওয়া।

সুতরাং আলোচ্য ঘটনাগুলো থেকে সুস্পষ্ট যে স্বয়ং আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের চলার পথ ও মসৃণ ছিল না, তারাও বিভিন্ন সময়ে বিষন্ন হয়েছেন, কিন্তু তাঁরা আল্লাহর রহমতের প্রতি নিরাশ হননি। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া একজন মুমিনকে কুফুরীর দিকে নিয়ে যায়,তাই ডিপ্রেশন থেকে হতাশ হয়ে আল্লাহর রহমতের প্রতি নিরাশ হওয়া (আল-ইয়াস) এর ব্যাপারে ইসলাম অনুমোদন দেয় না ।


তবে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আমরা এটাও দেখি যে বিষন্নতা একজন মুমিনের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়,ডিপ্রেশনের ব্যাপারে ইসলাম অনুমোদন দেয় এবং স্বীকার করে,তাই এটাকে ঈমানের মাপকাঠিতে মেপে,মুমিন ব্যাক্তি কোনও ভাবেই বিষন্ন হতে পারে না বলে ধারণা করাও ঠিক নয়।ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা বর্তমান সময়ের একটি অন্যতম মারাত্মক সমস্যা। প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজে বিষণ্ণতা থেকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘটনার হার বেড়ে চলেছে। আমরা অনেকে হয়তো নিজেরাই এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি আবার অনেকের পরিচিত, প্রিয়জন আছেন যারা এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন, যাদেরকে সহায়তা করা আমাদের মানবিক ও ঈমানী দায়িত্ব।


কিন্তু অজ্ঞতাবশত অনেক সময় আমরা সাহায্যের পরিবর্তে তাদের ক্ষতি করে ফেলি।


কিভাবে??


বিষণ্ণতায় ভোগা ব্যাক্তিদের স্বান্তনা দিতে গিয়ে আমাদের একটা সহজাত এপ্রোচ থাকে যে তাকে আরও বেশি মুমিন হতে বলা, কারণ মুমিন কখনও হতাশ হয়না। এভাবে তাদের ঈমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বরং নিজের অজান্তেই তাদের বিষণ্ণতার পারদে আমরা আরো কিছু ডিগ্রি যোগ করে দেই। তাই বিষণ্ণতার চোরাবালি থেকে নিজেকে বা প্রিয়জনকে উদ্ধার করার জন্য আমাদের এই সংক্রান্ত ইসলামিক এপ্রোচের সাথে পরিচিত থাকাটা খুবই জরুরি।


খ) আমাদের জীবনে যখন দুঃসময় আসে তখন আমরা যে যে দোয়া করতে পারি-

নবী-রাসলরা যখন বিষণ্ণ হয়ে পড়তেন তখন তারা সেই স্বত্তার শরনাপন্ন হতেন যার কাছে রয়েছে সব সমস্যার সমাধান। আর এটাই ইসলামসম্মত উপায় একজন ব্যাক্তির জন্যে নিজের বিষণ্ণতার সাথে ডিল করার। অবশ্যই আমি কাউন্সিলিং এর শরনাপন্ন হওয়ার মত এপ্রোচের গুরুত্ব অস্বীকার করছি না। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের জন্যে বৈজ্ঞানিক এপ্রোচের সাথে সাথে স্পিরিচুয়াল এপ্রোচ নেয়ার প্রয়োজন আছে।

এই কাজের অংশ হিসেবে আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের মনের সব কষ্ট খুলে বলে আল্লাহর উত্তম নামসমূহে তাঁকে ডেকে তাঁর নিকট নিজেকে সমর্পণ করে তাঁর সাহায্য চাইতে পারি।আল্লাহই আমাদেরকে সমস্যায় ফেলে পরীক্ষা করেন এবং তিনিই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে এই কঠিন মূহুর্তগুলোতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে-

“তোমরা আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করো ধৈর্য্য ও নামাজের মাধ্যমে।’ (সূরা বাকারা: ১৫৩)।


ব্যাক্তিগতভাবে আমি যখন কোন কারণে আপসেট থাকি বা কষ্ট পাই কিংবা হতাশা আমাকে গ্রাস করে নিতে শুরু করে তখন আমি বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে তওবা করতে থাকি। বিভিন্ন ধরনের ইস্তিগফার থাকে আমার সে সময়ের দোয়া লিস্টের শীর্ষে। “আস্তাগফিরুল্লাহ”- হচ্ছে আমার হতাশাকালীন সময়ের সবচেয়ে প্রিয় দোয়া। আল্লাহ বান্দার তওবাকে অনেক বেশি ভালবাসেন।

এছাড়াও দুঃসময়ে আমরা নিম্নোক্ত দুআ করতে পারি -َ

১. আপনি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। অবশ্যই আমি পাপী। (সূরা আম্বিয়া:৮৭)

. চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী, প্রত্যাশা করি আপনার রহমত। আপনি আমার সব অবস্থা সংশোধন করে দিন,চোখের পলক পরিমাণ সময়ের জন্যও আপনি আমাকে আমার উপর ছেড়ে দিবেন না।

. হে আল্লাহ! আমি দুশ্চিন্তা পেরেশানী থেকে, অক্ষমতা অলসতা থেকে, কৃপণতা ভীরুতা থেকে, ঋণভার লোকজনের প্রাধান্য থেকে আপনার নিকট পানাহ চাচ্ছি।
(
সহীহ বুখারী: /১৫৮)

. হে আমার রব! নিশ্চয়ই আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ নাজিল করবেন, আমি তার মুখাপেক্ষী। (সূরা কাসাস: আয়াত ২৪)

. হে আল্লাহ! আপনি যা সহজ করেছেন, তা ছাড়া কোনো কিছুই সহজ নয়। আর যখন আপনি ইচ্ছা করেন তখন কঠিনকেও সহজ করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান:২৪২৭)

. হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আপনি যা ফয়সালা করেছেন, তার সুন্দর সমাপ্তি দিন। (মুসনাদ আহমাদ: /১৮১)

সবশেষে বলতে চাই, ব্যাক্তিগত জীবনে আমাদের সবার লাইফেই কমবেশি দুঃখ কষ্টের মূহুর্ত আসে। কিন্তু আমাদের কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত না যে,

”অবশ্য কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে ।” (সূরা ইনশিরাহ ৯৪: ৫-৬)


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন