প্রশ্ন: ‘শিকড়ের সন্ধানে’ বইটার ৩১ পৃঃ তে কুরআনের Linguistic Miracle এর একটা উদাহরণ আছে, আরেকটা উদাহরণ খুঁজে বের করবেন, মিরাক্যলটার বিস্তারিত উল্লেখ করার পর আমাদের জানাবেন –
• এটা জানার পর আপনার অনুভূতি
• এই জ্ঞান কিভাবে দাওয়াতী কাজে সাহায্য করতে পারে
উত্তর: Linguistic miracle এর উদাহরণ:
কুরআনের যে ভাষাগত মাধুর্যতা আমাকে অন্যরকম ভাবে অভিভূত করেছে তা হল সূরা আল আহযাবের ৪ নম্বর আয়াতের একাংশ। আল্লাহ সুবহানাহু তা’লা বলেছেন,
مَّا جَعَلَ ٱللَّهُ لِرَجُلٍ مِّن قَلْبَيْنِ فِى جَوْفِهِۦۚ
“আল্লাহ কোন পুরুষকে অভ্যন্তরে দু’টি হৃদয় সৃষ্টি করেননি[৩৩ঃ৪]
লক্ষ্য করার ব্যাপার যে আল্লাহ এখানে বলেননি যে তিনি কোন মানুষকেই দুইটি হৃদয় দিয়ে তৈরি করেননি। তিনি এমন একটি শব্দ لِرَجُلٍ ব্যবহার করেছেন যেটা স্পেসিফিক্যালি পুরুষের জন্যে ব্যবহৃত হয়। এখন বাকি আয়াত দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে এই আয়াতটি মূলত নারীদেরকে নিয়ে নাজিল করা এবং স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার একটা ইস্যুকে নিয়েই আলাপ করছে। তাহলে প্রশ্ন আসে যে এখানে স্পেসিফিক্যালি পুরুষবাচক শব্দ ব্যবহার করার হিকমাহ কী?
এখানে আল্লাহ যে হৃদয়ের কথা বলছেন সেটাকে স্পিরিচুয়াল অর্থে ধরে নেয়া সহজ। কারণ কুরআনে বেশিরভাগ সময়ে যখন হৃদয়ের কথা ফিজিক্যাল অর্থে বলা হয়েছে তখন বলা হয়েছে ’আল কুলুবিল্লাতি ফিল সুদুর ’মানে সে হৃদয় যা বুকে থাকে।
কিন্তু এই নির্দিষ্ট আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা’লা’ ছুদুর ‘ ব্যবহার করেননি, তিনি ব্যবহার করেছেন جَوْفِهِ ‘জাওফ’ অর্থাৎ ফাঁকা কোন জায়গা, সামগ্রিক অর্থে পু্রো শরীর। মানে হচ্ছে আল্লাহ এখন আর তার বক্তব্য তুলে ধরার জন্য হৃদয়কে একটা নির্দিষ্ট অংশে আবদ্ধ রাখছেন না।
প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ কোন পুরুষকে দুইটি হৃদয় দিয়ে তৈরি করেননি এই কথা বলার দরকার কী ছিল? অর্থাৎ কেন এখানে আলাদাভাবে পুরুষের কথা বলা হল এবং মহিলাদেরকে উহ্য রাখা হলো? মহিলারা কি কখনও দুইটি হৃদয়ের অধিকারী হতে পারে?
একটু চিন্তা করলেই আমরা দেখব যে মহিলাদের জীবনে এমন এক পর্যায় আসে যখন আমরা আসলেই একাধিক হৃদয় ফিজিক্যালি আমাদের শরীরে ধারণ করি। আর সেটা হচ্ছে আমাদের গর্ভকালীন সময়ে। আমরা আমাদের অনাগত সন্তানের হার্টবিট শুনতে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করাই। আমাদের অনাগত শিশুর জীবিত থাকার প্রমাণ হচ্ছে তার সেই হার্টবিট। সুবহান আল্লাহ!
একজন পুরুষ কখনোই দুইটি হৃদয়কে ধারণ করেন না কিন্তু একজন নারী তা করেন। আর যেহেতু সে এক্সট্রা হৃদয় নারীর বুকে নয় বরং পেটে থাকে তাই আল্লাহ কোরআনে’ আল কুলুবিল্লাতি ফিল সুদুর ’না বলে জাওফিহি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কুরআনের এই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পার্থক্য সৃষ্টিকারী শব্দচয়নই এর অনিন্দ্য সুন্দর ভাষাগত মাধুর্যতা।
আমার অনুভূতিঃ
আমি নিজে যখন মা হতে চলেছি, তখন এই ভাষাগত মিরাক্যলটি আমাকে একদম আবেগে আপ্লুত করে ফেলে। অনুভূতিগুলো আসলে কলমবন্দি করা কঠিন। আমার খুব বেশী মনে পড়ছিল হানীফ’ ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘটনা। যা আল্লাহ রব্বল আলামীন কুরআনে উল্লেখ করেছেন,
“আর যখন ইব্রাহীম বলল, “হে আমার রব! কিভাবে আপনি মৃতকে জীবিত করেন দেখন তিনি (আল্লাহ) বললেন, “তবে কি আপনি ঈমান আনেন নি?” তিনি (ইব্রাহীম) বললেন, “অবশ্যই হ্যাঁ, কিন্তু আমার মন যাতে প্রশান্ত হয়।”(২ঃ২৬০)
সুবহান আল্লাহ, আমিও আমার রবের উপর ঈমান এনেছি। কিন্তু কুরআনের এই ভাষাগত মাধুর্য আমার অন্তরে এমন অপরিসীম প্রশান্তি এনে দিয়েছে যা আমার ঈমানকে এমনভাবে বাড়িয়ে তুলেছে তা প্রকাশ্যের উর্ধ্বে। এতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি যে আল্লাহ আমাদের এই দুনিয়াতে পথনির্দেশনা স্বরূপ যে কুরআনকে পাঠিয়েছেন তা সাধারণ কোন কিতাব নয় বরং তা আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন এর অসীম প্রজ্ঞা সম্পন্ন বিষয় দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত ও সমৃদ্ধ। শুধুমাত্র গভীর গবেষণা বা চিন্তার দ্বারাই সেগুলো উপলব্ধি ও উদঘাটন করা সম্ভব। এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় এ নয়নযুগল অশ্রুসজল হয় যখন মনে হয় এত সুন্দর এই কুরআন! এত মাধুর্য লুকায়িত এতে! তাহলে আমার রব না জানি কত সুন্দর! না জানি কত মাধুর্য তাঁর।
বিপরীতক্রমে এটাও অন্তরে করাঘাত হানে যে আমার রবের এই মনোহর, মোহনীয় বাণীকে কি আমি আমার জীবনে সঠিক প্রতিফলন করতে পেরেছি? অত্যন্ত শঙ্কা ও অপরাধবোধ নিয়ে অবনত মস্তকে সেই কঠিন দিনে আমার রবের সামনে জবাবদিহিতার ভয় পাই। এত সূক্ষ্মভাবে ভাষাগত দিক সৌন্দর্যমন্ডিত করা কোনো মানুষের পক্ষে যে কখনোই সম্ভব নয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
Linguistic miracle এর এই উদাহরণ যেভাবে দাওয়াতি কাজে সাহায্য করতে পারে–
মুসলমানদের ক্ষেত্রেঃ
• এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ‘আল হাকীম’ এর অসীম প্রজ্ঞা ফুটে উঠেছে। আমার মতো যাদের অন্তরে গুনাহের কারণে দাগ পড়ে গেছে, তাদের অন্তর প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিতে পারে এই আয়াতের ভাষাগত মাধুর্যতা।
• যেসব মুসলিমের অন্তরে শয়তানের ওয়াসওয়াসায়,’ ইসলাম একমাত্র দ্বীন’ কি না এ নিয়ে সংশয় দানা বাঁধতে চায়, তাদের জন্য এ আয়াতের ভাষা মাধুর্য ও আয়াতে লুকায়িত প্রজ্ঞা হতে পারে তাদের সংশয়ের বিপরীতে অকাট্য দলিল।
• কুরআনের মূল্য, মর্যাদা ও এর সার্বজনীনতা নিয়ে চিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত করে দিতে পারে এই আয়াতের প্রজ্ঞা। ক্ষয়িষ্ণু ঈমান যাদের তাদের জন্য এ আয়াতের ভাষাগত মাধুর্য হতে পারে নতুন করে ঈমানের স্বাদ আস্বাদনে একটি সোপান।
নাস্তিক ও মুশরিকদের ক্ষেত্রেঃ
যারা কুরআন আল্লাহর বাণী নাকি মানব রচিত এটা নিয়ে অযথা তর্ক করে তাদের জন্য এই আয়াতের সৌন্দর্য হতে পারে যথার্থ জবাবের অন্যতম একটি। আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন চাইলে এ আয়াতের মাধুর্য হতে পারে, তাদের চিন্তার জগতে নতুন খোরাক কিংবা হতে পারে তাদের হিদায়াতের কারণ।