মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য একটি অনন্যসাধারণ উপহার হলো পবিত্র রমজান মাস। এই মাসে সঠিকভাবে সিয়াম পালনের মাধ্যমে শারীরিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করে একজন মুসলমান পেতে পারে ‘রাইয়ান’ নামক একটি বিশেষ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করার অপূর্ব সুযোগ। জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ লাভের ঢাল হিসেবেও কিয়ামতের দিনে রোজাদারের পক্ষে সুপারিশ করবে এই রোজা, যদি তা ইমানের সাথে সওয়াবের আশায় পালন করা হয়। মহান আল্লাহ রমজান মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলিত রেখে মুসলমানদের জন্য এই সওয়াব অর্জনের পথকে করেছেন আরও সহজতর। কিন্তু আমরা কি আদতেই এইসব সুবর্ণ সুযোগের পূর্ণাঙ্গ সদ্ব্যবহার করতে পারি? নাকি সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা শেষ পর্যন্ত একটি নিষ্ফল উপবাসে পরিণত হয়? নিচের কয়েকটি ঘটনা থেকে আসুন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।
দৃশ্যপট -১
রিয়াদের পরিবারের সবাই রমজান মাসে রোজা রাখে। রিয়াদও শৈশব থেকেই রোজা রেখে অভ্যস্ত। রোজা উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও ভার্সিটির ক্লাসের সময়সূচী কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সকাল ৮টার পরিবর্তে ক্লাস শুরু সকাল ৯টায় আর ছুটিও হবে ১ ঘন্টা আগে দুপুর ১টায়। সেহরির পর ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করায় ভোরে ঘুমাতে দেরি হয়ে গেল রিয়াদের। ফলে সকালবেলার ১ম ক্লাসটা মিস করল সে, বন্ধুরা যখন দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করল তখন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতেই সে বলল, “রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল।” (মিথ্যা নং ১)
ভার্সিটি ছুটির পর বন্ধুরা সবাই ঠিক করল,পাশের শপিং মলে যাবে ঈদের নতুন কালেকশন দেখতে। শপিং মলে ঢোকার একটু পরেই মায়ের ফোন এলো, “আজ তো তাড়াতাড়ি ছুটি, বাড়ি চলে আয়।“ উত্তরে রিয়াদ অবলীলায় বলল, “ কাল এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার লাস্ট ডেট। বন্ধুরা মিলে গ্রুপওয়ার্ক করতে হবে, ফিরতে দেরী হবে।” (মিথ্যা নং ২)
এই যে ছোট ছোট মিথ্যা; যা হয়তো আপাতদৃষ্টিতে অন্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, প্রতিদিন হরহামেশাই বলা হয়, রোজাদার অবস্থায়ও যদি এই অভ্যাসটা অব্যাহত থাকে তবে কি এই সিয়াম পালনের গ্রহণযোগ্যতা থাকে মহান রবের কাছে?
দৃশ্যপট -২
শারমিন ও প্রিয়া পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। প্রতিবছর রমজানেই তাদের বিল্ডিং এর সব পরিবার একজন আরেকজনের বাসায় ইফতার পাঠায়। ৭ম রোজার দিন শারমিন প্রিয়ার বাসায় গিয়ে বলল,“ ভাবী, এবারের ইফতারের মেন্যুতে ইউটউব দেখে নতুন কোন আইটেম বানাবো ভাবছি। সবাই খেয়ে রীতিমতো চমকে যাবে।” উত্তরে প্রিয়া বলল,“ আমি তো ভেবেছি গতানুগতিক আইটেমগুলোই বানাবো। ছোলা, পিঁয়াজু, বেগুনি ,আলুর চপ আর সাথে কিছু ফ্রটস দিব। তবে সব আইটেম নিজে যত্ন করে বানাবো। সেদিন যে দোতলার ভাবী ইফতার পাঠালেন তাতো মুখেই দেয়া যায়নি। ছোলা সেদ্ধ হয়নি ,পেঁয়াজুর ডাল ঠিকমতো বাটা হয়নি, বেগুনি আর আলুর চপ তো বোধহয় বেসনের পরিবর্তে খাবার সোডা দিয়ে ভেজেছিল।” তখন শারমিন হাত নেড়ে বলল, “ আরে দোতলার ভাবী কি নিজে ইফতার বানায় নাকি , কাজের বুয়াকে দিয়ে সব কাজ করায়। ইফতার দিতে হবে তাই দিয়েছে, কোন আন্তরিকতা নেই।” (পরনিন্দা নং ১)
ইফতারের আগে শ্রেয়া ও প্রিয়া দুই বোন গল্প করছে ঈদের শপিং নিয়ে। গল্পের এক পর্যায়ে প্রিয়া বলল, “গত বছর ভাইয়া আমাদের যে ড্রেস দিয়েছিল তার কোয়ালিটি একদম ভালো ছিল না । একবার ধোয়ার পরই রং উঠে গিয়েছিল। এবার ভাইয়াকে বলবো ভালো ড্রেস দিতে।” তখন শ্রেয়া উত্তর দিল, “ ড্রেস কি ভাইয়া কিনেছে নাকি? ভাইয়ার এত শপিং করার সময় আছে? ভাইয়া তো ভাবীর কাছে টাকা দিয়ে দেয়, আর ভাবী সেই টাকা থেকে নিজের ইচ্ছামতো কেনাকাটা করে। হয়তো আমাদের বাজেট থেকে টাকা সেভ করে সেই টাকায় নিজের কেনাকাটা করে।” (পরনিন্দা নং ২)
এভাবে অন্যের সর্ম্পকে সম্পূর্ণ না জেনে নিজস্ব ধারণা থেকে কারও বদনাম করা আপাতদৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ না হলেও, সিয়াম পালনও যখন এই পরনিন্দা থেকে আমাদের নিবৃত্ত রাখতে পারে না তখন সেই সিয়াম পালনে কি আদৌ আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে?
উপরের এই সিচুয়েশনগুলোর পরিণতি জানা যায় নিচের হাদীস থেকে-
“যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও এর উপর আমল করা বর্জন করে না ও মূর্খতা পরিহার করে না, তার পানাহার থেকে বিরত থেকে উপবাস করা আল্লাহর নিকট প্রয়োজন নেই।”
অর্থ্যাৎ এটা স্পষ্ট যে, শুধু পানাহার থেকে বিরত থেকে শারীরিক কষ্ট করলেই রোজা পূর্ণাঙ্গ হয় না বরং নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারাটাও সার্থকভাবে রোজা পালনের জন্য অবশ্য কর্তব্য। শারীরিক ও আত্মিক উভয় ধরনের সংযম করতে পারলেই কেবল পরকালে আল্লাহর নিকট থেকে উত্তম প্রতিদানের আশা করা যায়।
দৃশ্যপট ৩
অফিস থেকে বের হতে আজ একটু দেরী হয়ে গেল রায়হানের। ইফতারের সময় খুব বেশী বাকী নেই। এদিকে চাষাঢ়া মোড়ে এসে যথারীতি বিশাল জ্যামে পড়তে হলো । রিক্সা, গাড়ি সব স্থবির হয়ে বসে আছে, নড়ার লক্ষণ নেই। বাসায় নিশ্চয়ই মা , বাবা, বোন ইফতার সাজিয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্য। ওদের অপেক্ষারত মুখগুলো কল্পনা করতে করতে হঠাৎ কাঁচ ভাঙ্গার ঝনঝন শব্দে সম্বিৎ ফিরল রায়হানের। পিছন থেকে একটি দ্রুত গতির মোটর সাইকেল এসে ওর গাড়ি ঘেষে ফুটপাতের উপর দিয়ে চলে গেল এবং যাওয়ার সময় গাড়ির বাম পাশের লুকিং গ্লাসটা ভেঙ্গে দিয়ে গেল। পুরো ঘটনায় মেজাজ খারাপ হযে গেল রায়হানের। গাড়ি থেকে নেমে মোটরসাইকেল আরোহীকে থামিয়ে কিছু কড়া কথা শুনাবে ভাবল সে,“ রাস্তা কি আপনার একার নাকি? দেখে-শুনে চালাতে পারেন না? ইত্যাদি ইত্যাদি।” কিন্তু গাড়ির লক খুলতে গিযে আচমকা একটা হাদীস মনে পড়ল ওর। আজই ফেসবুকে ওর এক বন্ধু একটা শেয়ার করেছিল
“তোমাদের মধ্যে যে রোজা রাখে সে যেন অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। যদি তার সাথে কেউ ঝগড়া-বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায়, তবে তাকে বলে দেবে,“ আমি রোজাদার।”
এই কথাগুলো যেন রায়হানের রাগের আগুনে জল ঢেলে দিল। মনে মনে ‘অাউযুবিল্লা’ পড়ে নিজেকে শান্ত করল সে। এমন সময় পাশের মসজিদ থেকে ভেসে এল আযানের শব্দ। গাড়িতে রাখার পানির বোতল বের করে রোযা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল, “ হে আল্লাহ, আপনি আমার রোজা কবুল করে নিয়েন।”
আসুন, এবারের রমজানে আমরাও এমনভাবে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি যেন পানাহার থেকে বিরত থাকার সংযম শেষ পর্যন্ত উপবাসে পরিণত না হয়। রোজা যেন হয় মহান রবের সাথে আমাদের আনন্দময় সাক্ষাত লাভের একটি উপযুক্ত মাধ্যম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে রোজা পালনের তওফিক দান করুন। আমীন।