কুরআন ও সুন্নাহর মাঝে অপূর্ব মেলবন্ধন হিসেবে সূরা হাশর (পর্ব-১ ও পর্ব-২)

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

পর্ব – ১

বনু নাদীরের নির্বাসনের ঘটনা জানার পর সূরা হাশর তাফসীরসহ পড়লে এবার দেখি নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া যায় কী না!! যদিও প্রশ্নগুলো একটু ক্রিটিক্যাল,তবে এর মাধ্যমে কুরআন নিয়ে আমাদের চিন্তা করার অভ্যাস তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ।। কুরআনের এক অংশের সাথে আরেক অংশ মিলিয়ে পড়ার অভ্যাসও হবে ।

১) সূরা হাশর কি আপনি আগে পড়েছিলেন অর্থসহ? এবার বনু নাদিরের ঘটনা বিস্তারিত জানার পর সূরাটা ভালোভাবে বুঝতে কি আরো সুবিধা হয়েছে? কুরআন বুঝতে সীরাহ জানার গুরুত্বের আরো একটা উদাহরণ দিন, মানে সীরাহ না জানলে আপনি কিছুই বুঝতেন না, কুরআনের এমন কোনো অংশের উদাহরণ দিন।

২) সূরা হাশরের ২য় আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে, বনু নাদীর ভেবেছিলো ওদের দুর্গ ওদেরকে রক্ষা করবে। কুরআনে এমন কি আরো উদাহরণ আছে যেখানে কোনো জাতি ভেবেছিলো তাদের শক্তি তাদেরকে রক্ষা করবে অথচ সেটাই তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছিলো? বিস্তারিত লিখুন (হিন্টসঃ সামূদ জাতি)

৩) ২য় আয়াতে আল্লাহ উনার একটা অস্ত্রের কথা বলেছেন। সেটা কী? অনুরূপ আরেকটা অস্ত্র মুসা আলাইহিস সালামকে ফিরাউন যখন দত্তক নিলো তখনকার কন্টেক্সটে ’শিকড়ের সন্ধানে’ বইতে আছে। রেফারেন্স সহ উল্লেখ করুন।

৪) আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন এমন আরও ২টা অস্ত্রের কথা উল্লেখ করুন রেফারেন্স ও ব্যাখ্যা সহ (হিন্টসঃ সূরা আহযাবে খন্দকের যুদ্ধ প্রসংগে একটা বলা হয়েছে)

৫) সূরা হাশরের ৬ নং আয়াতে আল্লাহ একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্বলিত নিয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন, কী সেটা? নিজেদের জীবনে এটার কোনো উদাহরণ পাই আমরা?

৬) সূরা হাশরের ৭ নং আয়াতে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটা উদ্দেশ্য জানতে পারি, কী সেটা?

৭) সূরা হাশরের ৯ নং আয়াতে একটা মানবীয় দুর্বলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেটা আনসারদের নেই বলা হয়েছে। কী সেটা? আমাদের দেশে কি কখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গত কয়েক বছরে?

৮) সূরা হাশরের ১০ নং আয়াতে একটা দুআর কথা বলা হয়েছে। এমন কোনো পরিস্থিতির উদাহরণ দেন যখন আমাদের এই দুআ পড়ার দরকার হতে পারে।

৯) সূরা হাশরের ১৪ নং আয়াতে কাফিরদের একটা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আমরা মুসলিমরা কি এখন সেই বৈশিষ্ট্য ধারণ করা শুরু করে দিয়েছি? কিভাবে?

১০) সূরা হাশরের ১৬ নং আয়াতে শয়তানের একটা বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে। সেটা কী?

১১) সূরা হাশরের ২১ নং আয়াত পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া লিখুন

১২) সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতে আল্লাহর অনেকগুলো গুণবাচক নাম আছে। আমরা হয়তো জানি যে আল্লাহর নাম ধরে দুআ করা দুআ কবুলের একটা উপায়। এখান থেকে যে কোনো পাঁচটি নাম ধরে আপনি দুআ করবেন এমন পরিস্থিতির উদাহরণ দিন

১৩) এই সূরাটা এভাবে পড়তে গিয়ে কি আপনার কাছে কুরআন জীবন্ত হয়েছে? অন্য আলোয় কি কুরআন পড়া হয়েছে? এইভাবে সূরাটা পড়ার পর আপনার অনুভূতি ব্যাখ্যা করুন।

এখানে অনেকগুলো প্রশ্নের কোনো একক/ সঠিক উত্তর নেই। প্রশ্নগুলো করার সময় আমার মাথায় যেটা ছিলো সেটা, সাথে আমার কোর্সের ছাত্রীরা যে দারুণ সব উত্তর দিয়েছিলো সেগুলো একসাথে করে কিছু উত্তর আগামী পর্বগুলোতে দিবো ইনশাল্লাহ।

পর্ব ২

গত পর্বে আমরা আপনাদের কিছু প্রশ্ন দিয়েছিলাম, আগেও বলেছিলাম এগুলোর কোনো ভুল বা সঠিক উত্তর নেই, কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করাটাই মূল উদ্দেশ্য, তাই যেসব উত্তর মাথায় নিয়ে আমি প্রশ্ন গুলো করেছিলাম সেটা আপনাদের সাথে একটু ধারাবাহিকভাবে শেয়ার করবো। উল্লেখ্য যেহেতু এই প্রশ্নগুলো ’আমার জীবন্ত কুরআন’ কোর্সের এসাইনমেন্ট ছিলো তাই শিক্ষার্থীদের দেয়া উত্তর থেকেও অনেক আইডিয়া নিয়েছি।

১) সূরা হাশর কি আপনি আগে পড়েছিলেন অর্থসহ? এবার বনু নাদিরের ঘটনা বিস্তারিত জানার পর সূরাটা ভালোভাবে বুঝতে কি আরো সুবিধা হয়েছে? কুরআন বুঝতে সীরাহ জানার গুরুত্বের আরো একটা উদাহরণ দিন, মানে সীরাহ না জানলে আপনি কিছুই বুঝতেন না, কুরআনের এমন কোনো অংশের উদাহরণ দিন।

উত্তরঃ সীরাহ থেকে ইহুদী গোত্রগুলোর কাহিনী ধারাবাহিকভাবে জানার পর সূরা হাশর একদম নতুনভাবে উপলব্ধি করার কথা যদিও বা এটা আগেই অর্থসহ পড়া হয়ে থাকে।

কুরআনকে নতুন রূপে আবিষ্কার করার জন্য সীরাহ আদ্যপান্ত জানার কোনো বিকল্প নেই। কিছু কিছু সূরা বোঝার জন্য তো নবীজীর জীবনের সংশ্লিষ্ট কাহিনী জানা একদম অপরিহার্য বলা যায়। এমন কিছু উদাহরণ হচ্ছে-

সূরা আনফাল (বদরের যুদ্ধে)

সূরা আহযাব (খন্দকের যুদ্ধ)

সূরা তাওবা (তাবূকের যুদ্ধ, মক্কা বিজয়ের পরের অংশ ইত্যাদি)

সূরা নূরের অংশ যেগুলোতে আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার উপর দেয়া অপবাদ প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে সেগুলো।

সীরাহ না জেনে যদি শুধু তাফসীর পড়ি তাহলে কি হবে না? এ ব্যাপারে আমার এক ছাত্রী একটা সুন্দর কথা লিখেছিলেন- এ যেন ক্লাসে দেরী করে ঢোকার মত, গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ মিস করে ফেলাতে পরের অংশ আর ঠিকমত বোঝা যায় না।

আর সেজন্যই একদম শুরুতে আমি বলেছিলাম যে ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করা উচিৎ নবীজীর জীবনী পড়ার মাধ্যমে।

২) সূরা হাশরের ২য় আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে বনু নাদীর ভেবেছিলো ওদের দুর্গ ওদেরকে রক্ষা করবে। কুরআনে এমন কি আরো উদাহরণ আছে যেখানে কোনো জাতি ভেবেছিলো তাদের শক্তি তাদেরকে রক্ষা করবে অথচ সেটাই তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছিলো? বিস্তারিত লিখুন (হিন্টসঃ সামূদ জাতি)

উত্তরঃ বনু নাদীরের কাহিনী পড়ে আমরা কি বুঝতে পেরেছি যে কিভাবে ওদের দুর্ভেদ্য দুর্গ উলটা ওদের মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার কারণ হয়েছিলো? ওদের দুর্গগুলো ওদের প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ও অহংকারী করে তুলেছিলো। অথচ সেই দুর্গের মধ্যেই বন্দী হয়ে ওদের অসহায়ভাবে অপেক্ষা করতে হচ্ছিলো আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর সাহায্যের জন্য। যখন কিছুই আসলো না, তখন ওরা বুঝলো যে কোনো রণকৌশল বা কিছুই জানা না থাকার কারণে অসহায় আত্মসমপর্ণ ছাড়া ওদের আর কোনো উপায় নেই। এই দুর্গগুলো তখন ওদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে গেল- যে শত্রুদের বিনাশের জন্য ওরা এত চেষ্টা করেছে, সেই শত্রুরাই এখন এগুলো ভোগ করবে। হতাশার চোটে নিজেদের হাতে গড়া এত সাধের দুর্গের অংশ বিশেষ ওরা নিজেরাই ভাংতে লাগলো। আবার একারণেই ওদের জিনিসপত্র সব ছিলো ভারী ও স্থায়ী যেগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এই দুর্গের উপর ওদের ভরসা যদি একটু কম থাকতো তাহলে ওরা হয়তো রণকৌশল শিখতো আর এহেন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করে হলেও বাঁচার চেষ্টা করতে পারতো। দুর্গের উপর অতি ভরসাই ওদের কাল হল।

একইভাবে বলা যায় সামূদ জাতির কথা, যারা পাহাড় কেটে সুদৃশ্য দুর্গ বানিয়েছিলো এবং ভেবেছিলো আদ জাতির মত ঝড় বা নূহ আলাইহিস সালামের জাতির মত বন্যা ওদের কিছু করতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহ ওদের কিভাবে শাস্তি দিলেন? মহানাদ (১১:৬৭) ও ভূমিকম্পের (৬:৭৮) মাধ্যমে। আমরা হয়তো বা জানি যে কঠিন মাধ্যমে শব্দ সবচেয়ে দ্রুত চলে। ছোট বেলায় বিজ্ঞান বইয়ে প্রশ্ন থাকতো মনে আছে যে রেললাইনের গায়ে কান পাতলে ট্রেন আসার শব্দ শোনা যায় যেটা উপর থেকে শোনা যায় না কেন? ঠিক এখানেও পাহাড় কেটে বানানো দুর্গের ভেতর অবস্থান করছিলো বলেই সামূদ জাতির লোকেরা ওদের ঘরের ভিতরেই উপুড় হয়ে পড়েছিলো! মনে হচ্ছিলো যেন এখানে কেউ কখনো বসবাস করে নি! (১১:৬৮, ২৭:৫২)

হায়! আমরা নিজেদের কত স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাবি, একবারো ভাবি না যে আল্লাহর ক্ষমতার সাথে আমাদের কোনো কিছুরই কোনো তুলনা চলে না!

৩) সূরা হাশরের ২য় আয়াতে আল্লাহ উনার একটা অস্ত্রের কথা বলেছেন। সেটা কী? অনুরূপ আরেকটা অস্ত্র মুসা আলাইহিস সালামকে ফিরাউন যখন দত্তক নিলো তখনকার কন্টেক্সটে শিকড়ের সন্ধানে বইতে আছে। রেফারেন্স সহ উল্লেখ করুন।

উত্তরঃ সূরা হাশরের ২য় আয়াতে আল্লাহ তার যে অস্ত্রের কথা বলছেন সেটা হচ্ছে ‘আল্লাহ ওদের অন্তরে ত্রাস সৃষ্টি করে দিলেন’ – এই বিষয়টা চিন্তা করলে আমার কেমন যেন বুক কেঁপে ওঠে।

আমি যেন আবারো আল্লাহর ক্ষমতার ব্যপ্তি অনুভব করতে পারি। আমরা যখন অস্ত্রের কথা চিন্তা করি তখন আমাদের মাথায় আসে বন্দুক, ড্রেন এগুলোর কথা আর ভাবি যে আহা আমাদের মুসলিমদের তো এগুলো কিছুই নেই। আমরা হয়তো ভাবি না যে আল্লাহর যে কোনো সৃষ্টিই আল্লাহ তার সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।

আমার কাছে আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে অভিনব লাগে ‘অনুভূতি’। এই যে আমরা আমাদের সন্তানদের এত কষ্ট করে বড় করি, কেন? একটা সুস্থ বাচ্চা যখন হাসে, আমাদের আদর লাগে। একইভাবে যখন আমাদের মা-বাবারা চলৎশক্তিহীণ হয়ে যায়, তখন তাদের হাসি দেখে কি আমাদের আদর লাগে? সবসময় কিন্তু না। আল্লাহ এই যে স্নেহকে নিম্নগামী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন সেটা কিন্তু একটা কারণ।

‘অনুভূতি’ আল্লাহর সৈন্য এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক চিন্তার অবকাশ আছে বলে আমার কাছে মনে হয়। যে ফিরাউন বনী ইসরাইলের সব ছেলে শিশুদের হত্যা করছিলো নিজের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য, সে কি নদীতে বাক্স বন্দী একজন শিশুর ভেসে আসা দেখে বোঝে নাই এটা বনী ইসরাইলের কারো সন্তান? এটা বোঝা তো ব্যাসিক কমন সেন্স ছিলো তার জন্য। তাহলে কী মনে করে সে তাকে হত্যা না করে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করলো? উত্তরটা আল্লাহ দিচ্ছেন সূরা ত্বহার ৩৮-৩৯ নম্বর আয়াতে। সেখানে আল্লাহ জানাচ্ছেন যে উনি মুসার জন্য ফিরাউনের অন্তরে ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন। ভাবা যায়?

ফিরাউনের অন্তরে ভালোবাসা?

হ্যাঁ, এটাই আল্লাহর মিরাক্যল, যিনি কী না অন্তর পরিবর্তনের মালিক! আর এটা আসলে মানুষের পক্ষে করা কখনো সম্ভব হয় না। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এমন হয় না যে আমরা কিছু মানুষের জন্য অনেক কিছু করি কিন্তু তাও তাদের মন পাই না? আল্লাহ কুরআনে ঈমানদারদের মধ্যে যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয় সেটার প্রসংগে বলছেন যে একমাত্র আল্লাহই পারেন এই কাজটা করতে, দুনিয়ার সব কিছু দিয়ে হলেও মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব না-

আর তাদের হৃদয়ের মধ্যে তিনি প্রীতি স্থাপন করেছেন। তুমি যদি পৃথিবীতে যা আছে তার সবটাই খরচ করতে তবু তুমি তাদের হৃদয়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করতে পারতে না, কিন্তু আল্লাহ্ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। নিঃসন্দেহ তিনি মহাশক্তিশালী, পরমজ্ঞানী।’(৮:৬৩)


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন