“ইসলামে আসার আগের ও পরের জীবন: আসলেই কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি?”

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

এই যে একেকটা দিন কাটাচ্ছি, এগুলো কেন করছি- এরকম উদ্দেশ্যবাদী চিন্তা আমার মাথায় প্রথম কিলবিল করা শুরু করে আমার আব্বার আকস্মিক মৃত্যুর পর থেকে। আব্বুর লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনোজগতে এক বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। দুই দিন আগেও আমার প্রতিদিনের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলেন যিনি, তিনি এখন কোথায়? মানুষ মারা যাওয়ার পর কি হয়, তা থেকে Comparative Religion………এভাবেই ইসলামের পথে হাঁটতে শুরু করা, আর একসময় তাকে প্রচণ্ড ভালবেসে ফেলা এবং তার সাথে একীভূত হয়ে যাওয়া-এই হল খুব সংক্ষেপে আমার ইসলামে আসার গল্প।

খুব ফুরফুরে একটা জীবন যাপন করতে করতে হঠাৎ করে খুব কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ইসলামকে এভাবে আবিষ্কার করা মানুষের সংখ্যা ইদানিং খুব কম নয়। আমাদের বোনদেরই তো একটা সার্কেল গড়ে উঠেছে যেখানে আমরা আমাদের সুখ দুঃখগুলো শেয়ার করি। আমাদের এই যে নিজস্ব বিচরণ ক্ষেত্র, সেখানে আমাদের কিছু আচরণে হঠাৎ করেই মাথায় একটা চিন্তা ছলকে ওঠে, আসলেই কি খুব বদলেছি আমরা? এই যে living for the sake of Islam বলে খুব বড় বড় কথা বলি, আসলেই কি তাই?

আমি একবার একটা ক্লাসে একজন বিশিষ্ট স্কলার (যিনি একইসাথে খুবই সুদর্শন) তার একটা ভিডিও দেখিয়েছিলাম। পরেরদিন আমি ক্লাসকে জিজ্ঞেস করলাম তোমরা ভিডিওটা থেকে কি শিখলা? ওরা আমার কাছে প্রথমেই জানতে চাইল মিস, ঊনি (The speaker) কি বিবাহিত? আমি চরম আহত হয়ে বললাম কেন? ওরা সবাই হেসেই কুটিকুটি! আমি বললাম, আমি কি তোমাদের কোন মুভি দেখিয়েছি যে তোমরা নায়কের ফিদা হয়ে গেছ?

শাহরুখ খান যখন আমাদের দেশে এসে উদ্দামতা আর বেহায়াপনার চরম প্রদর্শনী করছিল, তখন এক ভাইকে দেখেছিলাম Facebook এ স্ট্যাটাস দিতে যে They have brought Shahrukh khan, we want Nouman Ali khan!পড়ে I was so shocked!!!!!!আমরা কোন প্রাণে এদের দুজনের মাঝে তুলনা করলাম? তারা কি দুজনেই সেলিব্রেটি?

আমি নিজে একসময় মা-বাবার খুব অবাধ্য সন্তান ছিলাম। আব্বা-আম্মা যা বলত তার উল্টাটা করতে আমার খুব ভাল লাগত। ইসলামে আসার পর পরিবারের অনেক কথাই আমি শুনি না ঈমানের দাবী থেকে। (There is no obedience of the creation by disobeying Allah-this is a hadith)কিন্তু আজও প্রায়ই দেখা যায় মেজাজ রাখতে পারি না। তখন নিজেকে প্রশ্ন করতে হয় যে ইসলামে আসার পর আমার আসলে কি পরিবর্তন হয়েছে? আগে হয়ত দামী একটা ড্রেস কিনে দেয়ার জন্য চিল্লাইতাম, আজ বিয়েতেও বোরকা পড়ার জন্য! তাহলে? আমার ব্যবহারে কি পরিবর্তন আসল যা থেকে মানুষ বুঝবে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যটা জেনেছি? Should not I be more patient, more humble?

বোনদের সার্কেলে দেখি যে বোনদের কার কি হইল না হল এগুলো নিয়ে ধুমায়ে গল্প করতেসে, এতে গীবত হচ্ছে নাকি বা এই গল্পটা আমার আদৌ করার দরকার আছে নাকি……সেগুলো ভাবছি না।

আজকাল আমরা সবাই স্পিকার হইতে চাই, কয়জন টাইপরাইটার হইতে চাই? অর্থ্যাৎ পর্দার অন্তরালের কাজ, যার কথা কেউ জানবে না, সেটা কয়জন করতে চাই? আমরা কয়জন মা হতে চাই?

যেহেতু আমরা এখন ইসলামী সিস্টেম থেকে বঞ্চিত, তাই ইসলাম পালন করতে গেলে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। এখন এমন যদি হয় যে আপনি যে বিষয়টা নিয়ে খুব সমস্যার মাঝে আছেন, দেখলেন সেই ব্যাপারটা আপনার একজন দ্বীনী বোনের খুব সহজে হয়ে গেল, তখন আপনার প্রতিক্রিয়াটা কি হবে? আপনি কি আপনার সেই বোনের জন্য খুশি হবেন নাকি তাকে হিংসা করবেন? এই ব্যাপারটিই বলা যায় আমার আজকের নোটের মূল উপজীব্য বিষয়!
এ সংক্রান্ত ক্লাসিক উদাহরণ হতে পারে বিয়ের ব্যাপারটা। আপনার একজন দ্বীনী বোনের হয়ত খুব সহজে খুব দ্বীনদার একজন ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেল যেখানে তার হয়ত এখন বিয়েটা হওয়া তেমন জরুরিই না। আপাত দৃষ্টিতে আপনার মনে হতে পারে, এমন একজন দ্বীনদার সঙ্গী আপনিই বেশি deserve করেন! আসুন ব্যাপারটা নিয়ে একটু গভীরভাবে ভেবে দেখি-
হিংসার উদ্রেককারী অনুভূতি কিন্তু এই Deserving আসলে কে বেশি এটা থেকেই হয়! আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি যে এটা আল্লাহর Justice কে চ্যালেঞ্জ করা? কি ভয়াবহ এই ব্যাপারটি আমরা কি তা বুঝি?

ইসলামে আসার আগে কারও সুদী ব্যাংকে ফাটাফাটি একটা চাকরি হলে হয়ত আমার হিংসা হত, আজ ইসলামিক প্রতিষ্ঠানে কেউ খুব highlighting কোন পদে কাজ করলে কি আমার হিংসা হয়? আমি কি দাওয়াতী কাজে খুব চেনা মুখ হতে চাই? আগে আমি Extra Curricular Activities করে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চাইতাম এখন কি দাওয়াতী কাজ করি সেই একই উদ্দেশ্যে? আগে হয়ত Finance পড়ে ফাটায় দিতাম, আজ কি Islamic Finance পড়ে ফাটায় দিতে চাই?

This life is a test! Each and every moment of it-be it good times or bad! আমার নিজের খুব সাম্প্রতিক একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি-আমার এক দ্বীনী বোন, বাইরে থেকে দেখে যার জীবন আমার কাছে কানায় কানায় পূর্ণ মনে হত, তার সাথে আমার খুব আন্তরিক একটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। তিনি প্রায়ই বলতেন This life is a test, test, test. আমি অস্বীকার করব না যে আমার শুনে মনে হত ঊনার জীবনে আর কি সমস্যা, আল্লাহ তো সবই উনার জন্য সহজ করে দিয়েছেন! পরে একসময় জানতে পেরেছিলাম উনার জীবনের এক অপ্রাপ্তির কথা-শুনে আমার মাথাটা ঘুরে উঠেছিল। আল্লাহ উনাকে যা দিয়েছেন তার সবকিছু, সাথে আরও অনেক কিছু দিলেও আমি উনার মত এত ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারতাম না। ঊনার জীবনের গল্প শুনে নিজের কাছেই আমি সেদিন আমি এতটা ছোট হয়ে গিয়েছিলাম যে কি আর বলব! আমাদের সবার মাথায় রাখা উচিত যে আমরা প্রত্যেকে পরীক্ষার মাঝ দিয়ে যাচ্ছি, কারণ এই জীবনটাই একটা পরীক্ষার হল। আপনার যে বোনের একটা কিছু দেখে আপনি অজান্তেই হয়ত হিংসা করছেন, সে এমন কিছুর জন্য হাহাকার করছে যা আপনি খুব সহজে পাচ্ছেন। আর প্রত্যেকে তাকে দেয়া নিয়ামতের অনুপাতে হিসাব হবে। তাহলে জীবনে কম নিয়ামত পেয়ে একদিক থেকে কিন্তু আপনার হিসাব সহজ হয়ে যাচ্ছে!

এজন্য সাহাবীদের মাঝে আমার রোল মডেল হল মুসাব বিন উমাইর! সবকিছু ছেড়েছিলেন ইসলামের জন্য, কিন্তু ইসলাম বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই তিনি ওহূদ যুদ্ধে শহীদ হন।

আমি কিন্তু বলছি না ইসলামে আসার পর আমরা অতিমানব হয়ে যাব। মানুষের সকল দুর্বলতা, ক্ষুদ্রতা আর সীমাবদ্ধতাকে বিবেচনা করে বলেই ইসলাম ফিতরাত বা স্বভাবের দ্বীন। ইসলামকে ভালবাসি এইজন্যই। আবার আমি এটাও একদমই বলছি না যে ইসলামে আসার পর আমরা ব্যাঙের শীতনিদ্রা দিব। আমরা প্রত্যেকে আমাদের দক্ষতা ইসলামের সেবায় নিয়োজিত করব। খালিদ বিন ওয়ালিদ ইসলামের আসার আগে যা করতেন, পরেও তাই করেছেন। এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে সাহাবীদের জীবনে। আমার এই নোটের উদ্দেশ্য এটাই যে আমরা যেন শুধু নিজেদের নিয়্যাতটাকে আর একবার চেক করে নেই আর হিংসার থেকে খুব সাবধান থাকি। কারণ যদি নিয়্যতে সমস্যা থাকে তবে তা রিয়ার দিকে ধাবিত করতে পারে, আর হিংসার অভ্যাস থাকলে তা নেক আমলকে পুড়িয়ে দেয়।

কী ভয়ংকর, তাই না?


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন