সীরাহ পড়ার মেথোডলজি

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

আমার নিয়মিত পাঠকরা হয়তো খেয়াল করে থাকবেন যে ইতিহাস আমার খুব পছন্দের একটা বিষয়। আমার একটা দৃঢ় বিশ্বাস যে ইতিহাস নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা ইসলাম নিয়ে আমাদের অনেক সংশয়ের উৎস। কিভাবে?

আমাদের যদি মানব সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে মোটামুটি ধারণা থাকতো তাহলে বুঝতাম যে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বা একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা এমন কিছু কালচার বা প্রথার সাথে অভ্যস্ত হয়েছি যেগুলোর প্রচলন অতীতের অধিকাংশ সময়ে ছিলো না বললেই চলে। যেমন-

• ‘দেশ’ বা ভৌগলিক সীমানা থাকা যেখানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে ভিসা লাগে। এটা আমাদের জন্য ‘স্বাভাবিক’ বাস্তবতা হলেও আগে পৃথিবী পরিচালিত হতো কিছু সাম্রাজ্যের অধীনে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে বড় দুটো সাম্রাজ্য ছিলো পারসিয়ান এবং বাইজেন্টাইন। ১ম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পড়েই অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, মুসলিম ভূমিগুলো পশ্চিমা উপনিবেশের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তাদেরকে দূর করতে গিয়েই মূলত ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বর্তমান মুসলিম দেশগুলোর জন্ম হয়। আবারো বলছি 1914: The Shaping of the Modern Muslim World pt.1 লেকচারটি এ সংক্রান্ত একটা অসাধারণ রিসোর্স।

• ‘ধর্ম’ একটা ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত হওয়া, অথচ আগে সাম্রাজ্যগুলোতে নাগরিকত্বের ভিত্তি ছিলো ধর্ম।

• কম বয়সে বিয়ে হওয়া, স্বামী স্ত্রীর মাঝে বয়সের ব্যবধান বেশী থাকা, বহুবিবাহ, যুদ্ধের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের প্রসার, দাস প্রথা এগুলোকে ভয়ংকর অন্যায় হিসেবে দেখা।

• নারী- পুরুষের মাঝে সব ব্যাপারে সমতার ব্যাপারটা একটা হট টপিকে পরিণত হওয়া। কারো আগ্রহ থাকলে মেয়েদের কর্মস্থলে যোগদানের ইতিহাস (Labor force participation of women) পড়ে দেখতে পারেন। এটা মাত্র ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী একটা ঘটনা। তার আগ পর্যন্ত ছেলে ও মেয়েদের Role নিয়ে এত confusion ছিল না।

এখন আসুন সীরাহ বা ইসলাম নিয়ে আমাদের মনে সাধারণত যেসব প্রশ্ন তৈরি হয় সেগুলোর একটা লিস্ট বানাই
• রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে এত কম বয়সে বিয়ে করেছিলেন ?
• রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন এতগুলো বিয়ে করেছিলেন?
• রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনার জীবনের অধিকাংশ কেটেছে যুদ্ধ করে, কেন উনি এমন যুদ্ধবাজ টাইপের ছিলেন?
• রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন বনু কুরাইযার সবগুলো পুরুষকে হত্যা করলেন? কেন ইহুদীদের তথাকথিত Freedom of Religion থাকবে না?
• ইসলাম এসে কেন দাসপ্রথাকে বিলুপ্ত করলো না যেভাবে সুদ, মদ্যপানকে হারাম করেছিলো ?
• মেয়েদের কেন সম্পত্তির অর্ধেক দেয়া হয় বা মেয়েদের নিয়মগুলো ছেলেদের থেকে আলাদা কেন? যেমনঃ একজন মুসলিম ছেলে ইহুদী বা ক্রিস্টান সৎচরিত্র মেয়েদের বিয়ে করতে পারে, কিন্তু মুসলিম মেয়ে কেন ইহুদী বা ক্রিস্টান ছেলেকে বিয়ে করতে পারে না?
• সাহাবীরা কেন Offensive জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রসার করেছিলেন?
• একটা ইসলামিক রাষ্ট্রে অমুসলিমদের কেন জিযিয়া কর দিয়ে থাকতে হবে ইত্যাদি।

উপরের এই লিস্ট থেকে আমরা কি ইঙ্গিত পাচ্ছি যে কিভাবে আমাদের সংশয়ের অনেক উৎস ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা?

তবে এখানে একটা ‘ডিম আগে না মুরগী আগে টাইপ’ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমরা ইতিহাস সম্পর্কে জানি না তাই ইসলাম নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। আবার ইসলাম নিয়ে সংশয় বেড়ে যাবে এই ভয়ে ইতিহাস পড়ানো হয় না। এ যেন একটা দুষ্টচক্র যেটার মাঝে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি।

কিন্তু কেন?

কেন আমাদের ইসলামী কোর্স বা শিক্ষার সিলেবাসে ইতিহাস খুব কম গুরুত্ব দেয়া হয় বা দিলেও ইতিহাস পাঠের ব্যাপ্তি খুলাফায়ে রাশেদীনের সময়কালের বেশী আগায় না? তার পরের ইতিহাস পড়তে/ পড়াতে আমরা খুব বেশী আগ্রহী না। কেন?

এখানে আমাদের একটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার বুঝতে হবে। আমাদের বর্তমান দাওয়াতী কাজের স্টাইলের একটা বিশাল সীমাবদ্ধতা হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার সময় আমরা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারগুলো একদমই বিবেচনায় আনি না। যদি আনতাম তাহলে খেয়াল করতাম যে মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে যারা বিজয়ী, যারা সফল, যারা আপনাকে মূল্যায়ন করবে বা দাম দিবে তাদের প্রতি তার একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়, নিজের অজান্তেই তাকে অনুসরণ করতে থাকে। তাই এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার যে যারা পৃথিবী শাসন করবে, বিজয়ীর আসনে থাকবে, তাদের পোশাক, কালচার এগুলো বিজিত/ শোষিতরা অনুসরণ করবে। ফর্সা হলেই যে আমাদের কাছে সুন্দর মনে হয় তার একটা কারণ কিন্তু সাদা চামড়াদের আমরা প্রভু হিসেবে দেখে এসেছি দীর্ঘদিন। আবার মুসলিমরা যখন পৃথিবী শাসন করেছে তখন মুসলিম আর নন মুসলিম মেয়েদের পোশাকের খুব বেশী পার্থক্য ছিলো না। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টাঙ্গানো ঐতিহাসিক ছবিগুলো খুঁটায় খুঁটায় লক্ষ্য করে আমি দেখেছি যে ১ম বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়টাতেও এখানকার রয়্যাল ফ্যামিলির মেয়েদের দেখে মুসলিম মেয়ে হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেত, শুধু পার্থক্য ছিলো যে ওরা হেড স্কার্ফ পরতো না বা হ্যাট পরতো। আজও দেখবেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটা মুসলিম আর নন মুসলিম মেয়ের পোশাক প্রায় একই- পার্থক্য শুধু হেড স্কার্ফে (টাইটফিট আউটফিটের সাথে হিজাব পরার কালচারকে বুঝিয়েছি)। এইভাবে আমরা মুসলিমরা প্রায় সব বিষয়েই অমুসলিমদের অনুসরণ করে যাচ্ছি কিন্তু নিজেদের এই অবস্থাটা ভিতর থেকে মেনে নিতে পারছি না। সেটার প্রতিফলন কিভাবে হচ্ছে? আমরা খুব বাগাড়ম্বর করছি ইসলামের ব্যাপারে। ইসলামকে উপস্থাপন করছি একটা ‘থিওরী ‘হিসেবে যা আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে।

কিন্তু আসলে কি তাই?

ইসলাম নিয়ে অতি মাত্রায় বাগাড়ম্বর করা আসলে এক ধরনের পরাজিত মানসিকতা (Apologetic Tendency)। আমার একজন শিক্ষক একবার একটা খুব সুন্দর কথা বলেছিলেন- We often call for a Golden period that never existed’

একটা উদাহরণ দেই। ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে কথা বলার সময় আমরা এমনভাবে কথা বলি যে সুদ নিশ্চিহ্ন হলে বা দিনার, দিরহামের পুনঃপ্রচলন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এই Rhetoric শুনতে শুনতে অভ্যস্ত আমি যখন পড়েছিলাম যে উমার (রা:) এর শাসনামলে দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো, আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। আমার ধারণা আমাদের সময়ে এই টাইপ দুর্ভিক্ষ হলে আমরা দাবী করতাম যে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা নাই বলেই এমন হচ্ছে!

কিন্তু কেন করি আমরা এমন?

সাইকোলজিক্যাল বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতাম যে, নিজেদের ব্যাপারে খুবই উচ্চ ধারণা পোষণকারী জাতিরা যখন শাসনক্ষমতায় থাকে না, তখন সাধারণত এমনটা হয় । ঠিক যেমনটা ঘটেছিলো ইহুদীদের ক্ষেত্রে। ইহুদীরা রাসূল (সা:)কে সহ্য করতে পারতো না তার একটা কারণ হচ্ছে কুরআন তাদের অতীত অপকর্ম সব প্রকাশ করে দিয়েছে যেমন তারা নবীদেরকে হত্যা করেছিল, মুসা (আ:) এর ক্বওম কী করেছিলো ইত্যাদি। তৎকালীন ইহুদীরা ‘আমরা এই আমরা সেই’ এমনভাবে বলে বেড়াতো যেন তাদের অতীতে কোনো কালিমা নেই।

ঠিক একইভাবে আমরাও ইসলামের ব্যাপারে একটা Perfectionist Image গড়ে তুলেছি- বর্তমান পৃথিবীতে যা কিছু অনাচার, অবিচার হচ্ছে সব কিছুর কারণ রাষ্ট্রক্ষমতায় ইসলামের অনুপস্থিতি। এই লেন্স দিয়ে আমরা যখন শাসনক্ষমতা মুসলিমদের হাতে ছিলো সেই সময়ের ইতিহাস পড়তে যাই, দারুণভাবে হতাশ হই। ইসলামের ব্যাপারে যেভাবে পড়ি, যা ধারণা করি অনেকসময়ই তার প্রায় বিপরীত চিত্র দেখতে পাই।

বাস্তবতা হচ্ছে দুনিয়ার বুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলেও দুনিয়াটা জান্নাত হয়ে যাবে না। কিছু জালিম থাকবেই যারা ইসলামের কল্যাণকর বিধানগুলোরও অপব্যবহার করবে। এজন্য আমি বলি যে, মোহরানার বিধানও সমাজে এমন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে যা যৌতুক প্রথার মাধ্যমে হয়। একটা ইসলামী সমাজেও মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হতে পারে। এই ধরণের সম্ভাবনার কথা অস্বীকার করে আমরা ইসলামকে এমনভাবে তুলে ধরি যার ফলে মনে হয় এটা বাস্তবতা থেকে বহুদূরে।

বাস্তবতা তাহলে কী? আল্লাহ আমাদের জন্য যে আইন দিয়েছেন সেটার মাঝেই কি সর্বোচ্চ কল্যাণ নিহিত না?

উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, অবশ্যই।

ইসলাম আমাদেরকে Optimal solution দেয়। ক্যাল্কুলাসের ভাষায় যখন 1st derivative zero আর 2nd derivative negative হবে। মানে মানুষ তার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে সম্ভাব্য যা কিছু বের করবে, তার চাইতে বেশী কল্যাণ নিয়ে আসবে আল্লাহর দেয়া বিধান। তার মানে মেয়েদের ধর্ষিত বা লাঞ্ছিত হওয়ার পরিমাণ সবচেয়ে কম হবে যখন ইসলামী সমাজ থাকবে। কিন্তু শূন্য হয়ে যাবে না।
আর অবশ্যই এই Optimal solution Unique হবে, অর্থ্যাৎ মানুষের তৈরি কোনো বিধান দিয়ে একই পরিমাণ কল্যাণ আনা সম্ভব হবে না। তবে আবারো বলছি, Maximum কল্যাণ সহ জীবনেও পরীক্ষা থাকবে না তা না। এই দুনিয়া By Definition, Unjust একটা জায়গা এবং Justice প্রতিষ্ঠাই পরকালের অস্তিস্ত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমার কাছে।

আচ্ছা তাহলে কিভাবে আমরা এই দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারি ?যেখানে ইতিহাস জানি না বলে ইসলাম নিয়ে সংশয় তৈরি হয় আবার ইতিহাস ব্যাপকভাবে পড়ানো হয় না ইসলামের ‘Perfectionist Image’ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই?

আমি বর্তমানে উস্তাদ ইসমাইল কামদারের History of Islam কোর্স করছি, সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছেঃ

১। ‘ইসলামী ইতিহাস’ আর ‘মুসলিমদের ইতিহাস’ এই দুটোর মাঝে পার্থক্য করতে হবে। ইসলামের ইতিহাস হচ্ছে শুধু সীরাহ। রাসূল ( সা:) ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন, তার করা কাজ আমাদের জন্য ‘Authority’ ( তবে সব কাজ ‘Authority’ না, কোনগুলো, সেটা আলোচনার দাবী রাখে।)

উনার পরে খুলাফায়ে রাশেদীনের ইতিহাস অবশ্যই আমাদের জন্য অনুসরণীয় কিন্তু তাদের সব কাজ যে ইসলামের বিধান দ্বারা সমর্থিত তা বলা যাবে না। মুসলিমরা মানুষ, তারাও ভুল করে। তাই উমাইয়্যাদ বা আব্বাসীদ খিলাফতের সময়ের কোনো মুসলিম শাসকের কাজ কর্ম দেখে ইসলাম নিয়ে হতাশায় ভোগার কোনো কারণ নেই বরং তাদের ভুল, সাফল্য এগুলো থেকে শেখার আছে, অনুপ্রাণিত হবার দরকার আছে। আর এক্ষেত্রে Proper Expectation Management খুবই জরুরী।

২। আমরা এটা ভাববো না যে, আমরাই ইতিহাসের জঘন্যতম সময়ে বাস করছি বা আমাদের সময়ের নেতারাই সবচেয়ে খারাপ ইত্যাদি। বরং মুসলিমদের ইতিহাস পড়লে দেখবো যে অতীব জঘন্য কিছু মুসলিম শাসক সাহাবারা বেঁচে থাকতেও ছিলো। কিন্তু ঐ যে অতীতকে অতি মাত্রায় Glorify করতে চাই, সেটা করতে গিয়ে এমন কিছু তথ্য আমরা বেমালুম চেপে যাই। এটা আমার কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা। এভাবে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাই যারা খোলা মন নিয়ে ইতিহাস পড়তে যায়। অথচ রাসূল (সা:) ছাড়া অন্য যে কোনো মানুষকে নিয়ে জানতে হলে সবার আগে মাথায় রাখতে হবে যে তারা ‘মানুষ’ ছিলেন!

৩। রাসূল (সা:) জীবনের কোনো অংশ নিয়ে যদি আমরা দ্বিধায় ভুগি তাহলে অবশ্যই আমাদের জানতে হবে সমসাময়িক সময়ের কালচার কী ছিলো এবং এটা নিয়ে ইসলামের অবস্থান কী।
সর্বশেষ মূলনীতির আলোকে এবার আমরা পূর্বে উল্লেখিত ইসলাম নিয়ে কমন সংশয়গুলোর উপরে একটু দৃষ্টিপাত করবো।

প্রথমত: রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিয়ের সময় আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বয়স ও নবীজির এতগুলো বিয়ে। কিভাবে আল্লাহর একজন নবী এমন নারী লোভী হতে পারেন! (আস্তাগফিরুল্লাহ)

আমাদের রেস্পন্স কী হয় সাধারণত?

যে পরাজিত মানসিকতা (Apologetic Tendency) র কথা উপরে বলেছিলাম, সেটার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমরা ইসলামকে পরিবর্তন করে হলেও বর্তমান সময়ের সাথে উপযোগী করে উপস্থাপন করতে চাই। যেমন প্রমাণ করতে চাই যে, বিয়ের সময় আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বয়স ছিল ১৮। খেয়াল করে দেখবেন ১৬,১৯ বা ২১ নয় এক্কেবারে ১৮, যেটা কী না প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে গণ্য করা হয় অনেক দেশেই। এই ১৮ বছরের ভিত্তি কী? কোনো উৎস বা রেফারেন্স নাই, এটা স্রেফ মানব রচিত একটা সংখ্যা। আবার দেখবেন এটা হাইলাইট করা হয় যে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের একটা লম্বা সময় এক স্ত্রী নিয়ে জীবন যাপন করেছেন।

আমার কাছে এই সংক্রান্ত সবচেয়ে শক্তিশালী আর্গুমেন্ট হচ্ছে তৎকালীন আরবরা বা কেউ এই ব্যাপারগুলো নিয়ে প্রশ্ন না তোলা। আমরা কি অনুভব করি যে মক্কাবাসী কী রকমের আদাজল খেয়ে লেগেছিল রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে? ওয়ারাকা বিন নওফেলের মন্তব্যের কথা? সে বলেছিল I wish I was alive and young when your people will plot against you and expel you (ভাবার্থ)। শুনে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী পরিমাণ অবাক হয়েছিলেন? উনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার ছিল যে উনার বিরুদ্ধে উনার ক্বওম এমন করবে। কিন্তু এমনটা তো হয়েছিলো তাই না? সেই শত্রুরা যেদিকে অঙ্গুলিহেলন করেনি, সেটা অবশ্যই তাদের সময়ের কালচার অনুযায়ী খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল, তাই না?

তাই রবীন্দ্রনাথের নায়িকার বয়স তুলে কালচারের ব্যাপারটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমার কাছে convincing লাগে।

কারণ শুধু রাসূল ( সা: ) এর সময়েই না, খেয়াল করলে দেখবো যে, আমাদের মায়েদেরও অধিকাংশেরই ২০ পার হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে, ‘কুড়িতেই বুড়ি’ এই প্রবাদটা সেই সময়ের সামাজিক প্রথার দিকে দিকনির্দেশ করে। ২৫ এর পর মেয়েদের বিয়ে হওয়া মূলত আমাদের Generation Fact. আর সবচেয়ে বড় কথা, আয়িশা (রা:) এত কম বয়স থেকে রাসূল (সা:) এর ঘরে স্ত্রী হিসেবে ছিলেন বলেই আমরা উনাকে One of the Most Prolific Hadith Narrator হিসেবে পেয়েছি। এমন সব টপিকে উনার থেকে হাদীস পাওয়া যায় যেগুলো অন্য কারো থেকে পাওয়া কঠিন বৈ কি!

একবার একটা লেকচারে শুনেছিলাম যে, যদি আয়িশা (রা:) না থাকতেন তাহলে ইসলামী ফিকহের এক- চতুর্থাংশ আমরা হারিয়ে ফেলতাম। এত কম বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে উনার দাম্পত্য জীবন যদি ট্রমাটিক হত (আস্তাগফিরুল্লাহ) তাহলে উনি কি এরকম বিদুষী হয়ে গড়ে উঠতেন? IOU তে পড়ার সময় একটা মজার জিনিস আমি সবসময় খেয়াল করতাম। যখনই কোনো হাদীসের অংশবিশেষ পড়ে আমার মনে কোন প্রশ্ন জাগতো, তখনই দেখতাম আয়িশা (রা:) হুবহু সেই প্রশ্নটাই করেছেন হাদীসের বাকি অংশে। মাশাআল্লাহ উনি এত Inquisitive ছিলেন! বাচ্চাদের মধ্যে যেটা থাকে, একদম ঠিক সেরকম। রাসূল (সা:) এর অন্যান্য স্ত্রী যারা বয়স্ক, পরিণত ছিলেন তাদের মাঝে আমরা নবীজীকে এত Back to Back প্রশ্ন করার প্রবণতা দেখি না কিন্তু।

রাসূল (সা:) এর এতগুলো বিয়ে নিয়েও আমাদের নারীদের মনে অনেক প্রশ্ন বিদ্যমান। আবারো বলছি, বহুবিবাহের ব্যাপারটাও সামাজিকভাবে খুবই স্বাভাবিক ছিলো আমাদের নানা দাদাদের প্রজন্মেও। তাই আমাদের সময়ে প্রচলিত না বলেই কোনো কিছুকে অস্বাভাবিক বলে লেবেলিং করা আমার কাছে অনুচিত মনে হয়। তাছাড়া আমরা যদি ভালোভাবে সীরাহ পড়ি, একটা ঘটনা পাবো না, যেখানে রাসূল (সা:)এর বিয়েটা তার স্ত্রী, তৎকালীন সমাজ বা গোত্রের জন্য কল্যাণ বৈ অকল্যাণ বয়ে এনেছে। জুয়াইরিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাহিনী কি জানি আমরা? উম্মে হাবিবা? সাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা? The list can go on and on.

আর একটা বিষয়, যেটা পুরোই আমার উর্বর মস্তিষ্কজাত, সেটা হচ্ছে রাসূল (সা:)এর এতগুলো স্ত্রী ছিলেন বলেই আমরা দাম্পত্যের অনেক স্পর্শকাতর ব্যাপারে নির্দেশনা পাই। যেমন ফরয গোসল কিভাবে করতে হবে। ফিকহুত তাহারার কোর্স করলে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়।

আবার রাসূল (সা:) রাতে কিভাবে সালাত আদায় করতেন, স্ত্রীদের সাথে উনার ব্যবহার, ঘরের কাজে উনার সাহায্য করা এসব কিছু আমরা একাধিক উৎস থেকে বিস্তারিত জানতে পারি, এতে আমাদেরই কল্যাণ।

দ্বিতীয়ত: একটা প্রশ্ন আসে যে রাসূল (সা:) কি যুদ্ধবাজ ছিলেন (আস্তাগফিরুল্লাহ)? বাস্তবতা হচ্ছে, মদীনার প্রথম ছয় বছরে ৩টা যুদ্ধ হলেও সেগুলোতে Casualty র পরিমাণ ছিলো খুবই কম, বড়জোড় সাড়ে তিনশো মানুষ মারা গিয়েছিলো সব মিলিয়ে। আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, এটা এমন একটা সময় যখন খুবই তুচ্ছ কারণে বছরের পর বছর ধরে গোত্রদের মাঝে যুদ্ধ লেগে থাকতো। আমরা হয়তো বা হিলফুল ফুযুলের কথা জানি বা জানি মদীনাবাসী রাসূল (সা:)সাদরে গ্রহণ করার একটা কারণ ছিলো ওরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত ছিলো। তখন Military Expansion এর ব্যাপারটা এতটাই স্বাভাবিক ছিলো যে, আপনি যদি নিজে থেকে আক্রমণ না করেন তাহলে আপনাকে আক্রমণের স্বীকার হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে।

এই আলোকে যদি আমরা তাবুকের যুদ্ধ বা রাসূল (সা:)এর মৃত্যুর পর সাহাবীদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ঘটনাগুলো পড়ি তাহলে আর ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগবে না। আমরা দেখবো যে, কিভাবে তাদের নিয়্যত ছিলো আদতে ইসলামের প্রচার, কী অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছিলেন সাহাবীরা, কেন বিজিতরা সাগ্রহে ইসলাম গ্রহণ করেছিল ইত্যাদি। মানে আবারো সেই Optimal Solution! তখনকার পরিস্থিতিতে ইসলাম যুদ্ধকালীন, যুদ্ধ পরবর্তী যেসব বিধান দিয়েছে সেগুলাই সবচেয়ে কল্যাণকর!

তৃতীয়ত: দাসপ্রথা নিয়ে আমাদের মনে অসংখ্য প্রশ্ন। কিন্তু সেটা আর কথা বলতে চাই না যেহেতু আমাদের পেইজ থেকে এটা নিয়ে রিসোর্স সম্প্রতিই প্রকাশিত হয়েছে। শুধু এটা বলবো যে, দাসপ্রথা তখনকার কায়িক পরিশ্রমের যুগে একটা ‘সময়ের প্রয়োজন’ ছিলো। আমরা যেন ভুলে না যাই যে তখন ওয়াশিং মেশিন, ট্রাক্টর এইসব কিছুই ছিলো না। তাই ইসলাম এটাকে বিলুপ্ত না করে কী করেছে? ইসলাম এসে প্রচলিত দাস প্রথাকে সংস্কার করে অভাবনীয় রকমের মানবীয় করেছে আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে দাস মুক্ত করাকে ইসলামী ফিকহের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে (যেমনঃ কেউ রোযাদার অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে দাম্পত্য সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার কাফফারা ইত্যাদি)।

এক কথায়, সীরাহ বা ইতিহাস পড়ার যে মেথোডলজি আমি এখানে তুলে ধরতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে – আমরা আমাদের সময়ের কালচার তখনকার সমাজব্যবস্থার উপরে চাপিয়ে দিয়ে ন্যায়-অন্যায়/ স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক বিচার করতে বসবো না বরং তখনকার সময়ে যেটা প্রথা ছিলো সেটার আলোকে বোঝার চেষ্টা করবো।

এইটুকু পড়ে কি আপনাদের কী মনে হচ্ছে সত্যি করে বলুন তো………

মনে হচ্ছে না যে– সব কিছু যদি ১৪০০ বছর আগের কালচারের আলোকেই বিচার করতে হবে তাহলে আমাদের নবী কিভাবে সব যুগের জন্য আদর্শ হলেন কিংবা Modernist দের যে আহ্বান থাকে ইসলামের সংস্কার করতে হবে সেটার মাঝে ভুল কোথায়?

আপনাদের যদি সত্যিই এটা মনে হয়ে থাকে তাহলে আমি আপনাদের দোষ দিবো না। এটা fact যে, উনার সব কাজ ঢালাওভাবে আমাদের জন্য Authority না। কোন ব্যাপারে উনাকে বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করতে হবে সেটা ব্যাখ্যার দাবীদার, আমাদের আলিমরা এগুলো নিয়ে বিস্তারিত কাজ করেছেন আলহামদুলিল্লাহ।

এটা বোঝার জন্য সবার আগে আমাদের যেটা জানা দরকার সেটা হলো, ‘সুন্নাহ’ শব্দটার মানে আপেক্ষিক। মানে ফিকহের ভাষায় সুন্নাহর সংজ্ঞা একরকম, হাদীসের পরিভাষায় এক রকম, আবার শামাইল এর পরিভাষায় আরেক রকম। আমি যখন IOU তে পড়া শুরু করি তখন ইসলামিক স্টাডিজের ভেতর যে এত শাখা আছে, এটা যে কত সমৃদ্ধ একটা বিষয় সেটা জেনে আমি রীতিমত মুগ্ধ হয়েছিলাম।

যাই হোক, সুন্নাহ টার্মটার ব্যাপকতা বুঝাতে একটা কথা বলা হতো- সফরের সময় সুন্নাহ নামায ছেড়ে দেয়া সুন্নাহ। Confusing লাগছে?

ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করি। ফিকহের ভাষায় ’সুন্নাহ’ মানে হচ্ছে যা করলে সাওয়াব, না করলে গুনাহ নাই। ধরেন যোহর, মাগরিব বা এশার পরের দুই রাকাত নামায। আবার অযুর সময়ে মিসওয়াক করা। এগুলা ফরযের থেকে আলাদা। অযুর ফরয কাজগুলার মাঝে কোথাও নাই যে আগে মিসওয়াক করতে হবে, নাইলে অযু হবে না। তো এই কাজগুলো করলে অতিরিক্ত সওয়াব পাওয়া যাবে।

আবার সামগ্রিকভাবে হাদীসের ভাষায় ’সুন্নাহ’ হচ্ছে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা, কাজ, মৌন সম্মতি সব কিছু। উনার সব কাজই সুন্নাহ, কিন্তু কিছু আমাদের জন্য ফরয, কিছু আমাদের জন্য আবার নিষিদ্ধ (যেমন ছেলেদের একই সাথে চারটার অধিক স্ত্রী রাখা)।
এখন কি উপরের বাক্যটা স্পষ্ট হচ্ছে?

সুন্নাহ নামায বলতে ফিকহের ভাষায় সুন্নাহ বোঝানো হয়েছে।
সফরের সময় রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরয বাদে অন্য নামায পড়তেন না, আবার কসর করে মানে সংক্ষিপ্ত করে নামায পড়তেন। উনার এই কাজটা হচ্ছে সুন্নাহ, মানে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফরে এমনটা করতেন।

এখন আমাদের টপিকে ফিরে আসি। বিয়ের বয়স নিয়েই শুরু করি। এটা কি আমরা বলতে পারি যে কম বয়সী মেয়ে/ কুমারী বিয়ে করা সুন্নাহ?

উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ বা না।

নির্ভর করছে সুন্নাহ বলতে আমরা কী বুঝাচ্ছি। যদি বুঝাই যে এমনটা করলে সাওয়াব, তাহলে উত্তর হচ্ছে—’না’।

কেন?

কারণ ইসলাম বিয়ের বয়সের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলে দেয় না। একজন ছেলে বা মেয়ে বালেগ/পূর্ণ বয়স্ক হলেই তার কাজের জন্য শরীয়াতের দৃষ্টিতে সে দায়িত্বশীল হয়ে যাবে, মানে টেকনিক্যালি সে বিয়ের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু আসলে মানসিক, শারীরিকভাবে সে কতটা উপযুক্ত হয়েছে সেটা নির্ভর করবে সময়, স্থান, পরিবেশ, আবহাওয়া অনেক কিছুর উপর।

একটা কথা আজকাল প্রায়ই বলা হয় যে আমাদের শিশুরা শৈশব হারিয়ে ফেলছে। আমি এটার সাথে পুরোপুরি একমত। যেভাবে চোখের সামনে এরা বিশাল স্ক্রীনে আপত্তিকর দৃশ্য সারাদিন দেখে বড় হচ্ছে তাতে তারা শারীরিক ব্যাপারগুলো অনেক আগে বুঝবে এটাই স্বাভাবিক। আমার আম্মাকে দেখতাম বাসার কাজের মেয়েদের সাথে গল্প করলে সেটা মনিটর করতে চাইতেন। এখন বুঝি যে গ্রামের মেয়েরা সব কিছু অনেক আগে থেকে জানে, ওরা শহুরে জীবনের মত প্রাইভেসীর মাঝে বড় হয় না, তাই তাদের সাথে মিশে যেন ইচড়ে পাকা না হয়ে যাই সেটা নিশ্চিত করতে চাইতেন।

তাই মেয়েদের বেশী বয়সে বিয়ে হওয়া হারাম/ সুন্নাহর বিরোধী এমনটা কখনোই বলা যাবে না।
তবে হ্যাঁ, এই যে আমাদের মেয়েদের এখন ২৫-৩০ বছর বয়সে বিয়ে হয় সামগ্রিকভাবে এটা আমাদের জন্য কল্যাণকর কী না সেই আলোচনায় আমরা যেতেই পারি। আমাদের দেশের একজন শীর্ষ স্থানীয় ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞকে দেখেছিলাম ২৮ বছরের আগেই মাতৃত্বের ক্যারিয়ার যেন শুরু করা হয় সেই আহ্বান জানাতে। উনার কারণ ছিলো পুরাই সাইন্টিফিক, উনি বলছিলেন যে বয়স যত বাড়ে, ডিম্বানুর পরিমাণ তত কমতে থাকে, ফলে মা হওয়ার সম্ভাবনাও কমতে থাকে। এখন এগুলো সবই Probabilistic কথা, এটা আশা করি আমরা বুঝি। বিজ্ঞান আমাদের যা জানায় সবই স্রেফ সম্ভাবনা।

পারস্পরিক সম্মান বজায় রেখে এধরণের healthy discussion আমরা করতেই পারি, কিন্তু সেখানে যদি বলা হয় যে মেয়েরা নারীবাদী হয়ে যাচ্ছে, পাশ্চাত্যের প্রভাবে দেরীতে বিয়ে করছে, ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে বাচ্চা নিতে চায় না, ইসলামের নিয়ম হচ্ছে মেয়েদের চাকরি, পড়ালেখা দরকার নাই, দরকার অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়া যাতে ঘর ভরা বাচ্চা থাকে ইত্যাদি তখন সেগুলো আমার কাছে খুব আক্রমাত্মক, স্থূল চিন্তার মনে হয়।
একইভাবে চার বিয়ে সুন্নাহ এই কথাটা শুনলে আমার মনে হয় ‘সুন্নাহ’ টার্মটার গভীরতা, ব্যাপ্তি নিয়ে মশকরা করা হচ্ছে। আমার কথা খুব সিম্পল- বহু বিবাহের পক্ষে বা বিপক্ষে দলীল দেখানোর সময় আমি যেন আমার অন্তরের অবস্থাটা একটু চেক করে নেই। আমি কি নিজে যেটা পছন্দ করি সেটার পক্ষে দলীল খুঁজতে চাচ্ছি? নাকি আমি আসলে ইসলাম যেটা বলে সেটা মেনে নিতে রাজি আছি?

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে স্বামী স্ত্রীর মাঝে বয়সের অনেক পার্থক্য থাকলে বা কারো একাধিক স্ত্রী থাকলে সামাজিকভাবে তাকে হেনস্থা করা উচিৎ না। হারামভাবে বহুগামীতার চাইতে অবশ্যই একাধিক স্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া, তাকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া শ্রেয়। এই বাধ্যবাধকতা থাকলে এমনিতেই কমে যাবে বহুগামীতার প্রবণতা।

কেউ একাধিক বিয়ে করবে নাকি সেটা তার ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করছে। এটা কারও জন্য ফরজ হতে পারে যে পতিতার কাছে যাচ্ছে, কারও জন্য মুস্তাহাব হতে পারে যে এর মাধ্যমে কোনো বিধবা নারী ও এতিম বাচ্চার দায়িত্ব নিচ্ছে এবং বাহ্যিক সমতা বজায়ে সক্ষম। আবার কারও জন্য এটা হারাম হতে পারে যে বাহ্যিক সমতা বজায় রাখতে না পেরে আগের বউয়ের দায়িত্ব ত্যাগ করছে।
আবার কোনো স্ত্রী সেটা মেনে নিতে পারবে নাকি তালাক্ব নেয়াটা প্রেফার করবে সেটাও তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে একজন মেয়ে স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকা পছন্দ করবে না এটাই স্বাভাবিক, এটা কম ঈমানের দাবী না। আমাদের উম্মুল মুমিনীনরাও এমন ছিলেন। সেজন্যই একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে আগের স্ত্রীদের অনুমতি নেয়াটা শর্ত হিসেবে রাখা হয় নাই।

আবার আজকাল যেমন ধোঁয়া উঠছে ‘আমি আমার স্বামীকে আরেকটা বিয়ে করাতে চাই’ এটা আদৌ উচ্চ ঈমানের বহিঃপ্রকাশ কী না সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ, কারণ আমি যখন বলি আমি করাতে চাই মানে আমি ঠিক করবো আমার স্বামী কাকে বিয়ে করবে, মানেই হচ্ছে আমি এমন কাউকে আনবো যার উপর আমি ছড়ি ঘোরাতে পারবো। আমাদের দেখা উচিৎ যে কোন কাজে আমি আল্লাহর দিকে বেশী এগিয়ে যাচ্ছি।

তবে সামগ্রিকভাবে বহুবিবাহ যদি ট্যাবু না হয় তাহলে সেটা নারী জাতির জন্যই কল্যাণকর বলে আমার নিজস্ব ধারণা। কেন সেটার বিস্তারিততে যাবো না। তবে এটাও বাস্তবতা যে একাধিক স্ত্রীর মাঝে বাহ্যিক সমতাটুকু বজায় না রাখতে পারা অনেক জুলুমের কারণ হতে পারে। তাই আবার বলছি এটা ব্যক্তি বিশেষের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিৎ, কিন্তু কেউ করলে তাকে ব্যাকলাশের স্বীকার যেন না হতে হয় সেটা নিশ্চিত করা উচিৎ।

এতক্ষণ যা বললাম সেগুলোর সারাংশ কী আসলে? ইসলাম সব যুগের জন্য উপযোগী কারণ কিছু ব্যাপারে ইসলাম শুধু কিছু মূলনীতি বলে দিয়ে বাকিটা সময়, পরিস্থিতি এগুলোর উপর ছেড়ে দেয়।

এজন্যই ইজতিহাদ বা ইসলাম নিয়ে চিন্তা-গবেষনার দরজা আসলেই কখনোই বন্ধ হবে না।

যে কোনো টপিকে আমাদের দেখতে হবে যে কারো ইসলাম পালন সেটার উপর নির্ভর করে নাকি। ধরেন, সমাজে দাস প্রথা না থাকলে ইসলাম পালনে কি কোনো অসুবিধা হয়?

অবশ্যই না।
তাই অবশ্যই আমরা দাস প্রথা আবার শুরু করার চেষ্টা করবো না।

ছেলে মেয়েদের অনেক দেরীতে বিয়ে হওয়ার কারণে কি তাদের ইসলাম পালনে সমস্যা হচ্ছে? তারা কি হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে? মা-বাবা হিসেবে অবশ্যই আমাদের সেগুলো জানতে হবে, দরকার হলে তাদের সাহায্য করতে হবে। তবে সব কিছু মা-বাবা করে দিলে ছেলে মেয়েরা যেন দায়িত্বহীন না হয়ে যায় সেটাও দেখতে হবে। আমি একাধিক কেস জানি যেখানে মা-বাবা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আগে বিয়ে দিয়েছেন ছেলে মেয়েদের, তারা স্ত্রী বা সন্তানের দায়িত্ব নেয়ার মানে না বুঝে পরনির্ভরশীলই রয়ে গেছে।

সীরাহ বা ইতিহাস বোঝার মেথোডলজি তাহলে কী দাঁড়ালো?

১) কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন/ দ্বিধা জাগলে আমরা আমরা প্রথমেই দেখবো সেই সময়ের কালচার কী ছিলো
২) তারপর বোঝার চেষ্টা করবো ইসলাম সেটা নিয়ে কী বলে

খেয়াল করলে দেখবো যে সীরাহ বা ইতিহাসের যেসব টপিকে আমাদের প্রশ্ন জাগে সাধারণত, (যেমনঃ স্বামী স্ত্রীর মাঝে বয়সের পার্থক্য, ছেলে-মেয়ের বিয়ের বয়স, কয়টা বিয়ে করবে) সেগুলো নিয়ে ইসলাম নির্দিষ্টভাবে কিছু বলে দেয় না। দাস প্রথা বা যুদ্ধকালীন নিয়মগুলোর উপর আমাদের ইসলাম পালন নির্ভর করে এমন না।

এই যে কিছু বিষয়ে নির্দিষ্টতা ও কিছু বিষয়ে স্বাধীনতা এই সমন্বয়টাই ইসলামের সৌন্দর্য, ১৪০০ বছর পর আজও একইরকম উপযোগী থাকার পেছনে রহস্য। এগুলো নিয়ে আমি যত চিন্তা করি, ততই মন থেকে বলে উঠি- নিশ্চয়ই আল্লাহকে রাব, ইসলামকে দ্বীন এবং রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসেবে পেয়ে আমি সন্তুষ্ট, খুব বেশী রকমের সন্তুষ্ট ইয়া রাব!


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন