বনু নাদীরকে নির্বাসনের মূল ঘটনা

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

আমরা হয়তো জানি যে তৎকালীন আরবে অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের জন্য রক্তপণ হিসেবে ১০০টা উটের সমমূল্যের অর্থ দিতে হত। তাই বীর মাঊনার হত্যাকাণ্ডের পর মুসলিম সাহাবী দ্বারা অনিচ্ছাকৃত হত্যার মুক্তিপণ হিসেবে মুসলিমদের দিতে হত ২০০ উটের দামের সমান টাকা যেটা নিঃসন্দেহে একটা বিশাল অঙ্ক। এই পরিমাণ অর্থ একজনের পক্ষে দেয়া প্রায় অসম্ভব বলে গোত্রের সবাই এই টাকা দিতে সাহায্য করতো। মদিনার সনদ অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ সব গোত্রেরই এখানে অংশ নেয়ার কথা। কিন্তু বনু নাদীর কি রাজি হবে?

আমাদের হয়তো মনে আছে যে, বনু নাদীরের সাথে একটা টেনশনের সম্পর্ক চলছিলো, বনু কাইনুকাকে নির্বাসনের ঘটনা থেকেও ওরা কোনো শিক্ষা পায় নাই। এই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম সিদ্ধান্ত নেন যে, এ ব্যাপারে বনু নাদীরের সাথে কথা বলবেন। তিনি আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবীদের নিয়ে বনু নাদীরের গোত্র প্রধানদের সাথে দেখা করতে গেলেন।

তখনকার ইহুদিরা ওদের দূর্গ নির্মাণ শৈলীর জন্য বিখ্যাত ছিলো মনে আছে? বনু নাদীরও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। ওদের আরো একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ওদের শত শত একর জমি ছিলো যেখানে খেজুর বাগান ছিলো, এগুলোর মধ্যখানে ছিলো দুর্গসমূহ। এই ঘটনা ঘটেছিলো ওহূদ যুদ্ধের পর, সেটা ছিলো খেজুর একদম পরিপক্ক হওয়ার সময়, ৫-৮ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করার পর ফল ঘরে নেয়ার মৌসুম। এমন সময়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম ওদের দুর্গে যান।

বনু নাদীরের নেতারা প্রাথমিকভাবে উনাকে দেখে খুব খুশী হয়েছে এমন ভাব প্রকাশ করে। তারা নবীজীকে দুর্গের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে, জানায় যে উনাকে আপ্যায়নের জন্য ওদের কিছু সময় প্রয়োজন, সাথে নিজেদের মাঝেও আলোচনা করা দরকার। ব্যাপারটা যুক্তিসঙ্গত বিধায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম প্রধান সাহাবীদের নিয়ে দুর্গের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন।

ভিতরে গিয়ে শলা পরামর্শ করে বনু নাদীরের গোত্র প্রধানরা কী সিদ্ধান্ত নিলো?

ওরা ভাবলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে হত্যার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। ওরা চাইলো যেহেতু নবীজী দুর্গের বাইরে বসে আছেন ওরা দুর্গের ছাদ থেকে বিশালাকায় পাথর যদি উনার মাথার উপরে ফেলে দেয় তাহলে ওদের সব ঝামেলার অবসান ঘটবে!

এখানে জেনে রাখা ভালো যে সামগ্রিকভাবে সীরাহতে আমরা এটা দেখি না যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম সবসময় গায়েব জানতেন। যদি এমনটা হত তাহলে তো বীর মাঊনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই ঘটতো না, তাই না? কিন্তু মাঝে মাঝে অবশ্যই আল্লাহ জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে উনাকে গায়েব জানিয়ে সাহায্য করেছেন। সেইসব দুর্লভ মুহুর্তের মাঝে বনু নাদীরের এই ঘটনাটা একটা।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম যখন দুর্গের বাইরে অপেক্ষা করছেন আর ওদিকে গোত্র প্রধানরা ছাদের উপর থেকে উনার মাথার উপর পাথর ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম নবীজীকে জানালেন যে এখুনি, এই মুহুর্তে উঠে উনি মদীনায় চলে যান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম কোনো সাহাবীকে পর্যন্ত ব্যাপারটা জানালেন না, একদম সোজা মদীনাতে ফেরত আসলেন। সারাদিন বনু নাদীর ও অন্যান্য সাহাবীরা অপেক্ষা করেও যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে খুঁজে পেলেন না তখন সাহাবীরাও মদীনাতে চলে আসলেন।

সাহাবীরা আসার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম পুরো ঘটনা উনাদের জানালেন এবং একজন সাহাবীর মাধ্যমে বনু নাদীরকে চিঠি পাঠালেন যে উনি ওদের চক্রান্ত জেনে গেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে হত্যা প্রচেষ্টার মাধ্যমে ওরা সরাসরি চুক্তির শর্ত ভংগ করেছে, অতএব ওদেরকে ১০ দিন সময় দেয়া হল মদীনা ছেড়ে যাওয়ার জন্য, যদি ১০ দিনের মাঝে এটা করতে ওরা ব্যর্থ হয় তাহলে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।

বনু নাদীর বুঝতে পারে যে ওরা হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে, মদীনা ছেড়ে যাওয়া ছাড়া ওদের আর কোনো গত্যন্তর নেই। ওরা প্রাথমিকভাবে নির্বাসনে যেতে রাজিও হয়েছিলো।

এখন এই জায়গায় আমরা একটু বিরতি নিব। আসুন ঘটনাপ্রবাহ পুরোটা চিন্তা করি।

বনু নাদীরের অপরাধ কী ছিলো? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে হত্যা প্রচেষ্টা? কাউকে নবী হিসেবে যদি মেনে না হয়, তাকে হত্যার প্রচেষ্টা করতেই পারে একটা গোত্রের প্রধানরা, তাই না?
এভাবে চিন্তা করলে আমরা বুঝবো না ব্যাপারটা। এখানে একজন নবীকে হত্যা প্রচেষ্টার কথা বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে একজন রাষ্ট্র প্রধানের হত্যা প্রচেষ্টার কথা যাকে তারা চুক্তি সাক্ষরের মাধ্যমে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। তাই এটা ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন না বরং একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্ন। ওদের Loyalty যে কুরাইশদের প্রতি সেটা আগের একাধিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে তো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, তাই না? রাষ্ট্র প্রধানকে হত্যা প্রচেষ্টার পর ওদেরকে একটি রাষ্ট্রে বসবাসের অনুমতি দেয়া কি আর নিরাপদ মুসলিমদের জন্য?

যেহেতু হত্যাকাণ্ডটা শেষ পর্যন্ত সংঘঠিত হয় নাই আল্লাহর রহমতে, সেইজন্যই ওদেরকে সসম্মানে চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

অপরাধের একটা ক্রম কি আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি? বনু কাইনুকার অপরাধ ছিলো একজন মুসলিমকে হত্যা করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে মৌখিকভাবে অপমান করা, আর বনু নাদীরের অপরাধ ছিলো সরাসরি কুরাইশদেরকে যুদ্ধে সাহায্য করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে হত্যা প্রচেষ্টা করা।

ফিরে আসছি কাহিনীতে। উপায়ন্তর না দেখে বনু নাদীর যখন নির্বাসনে যাওয়ার আদেশ মেনে নিলো তখন স্বাভাবিকভাবেই মঞ্চে আবির্ভূত হল একজন।

কে ?

আমরা কি আন্দাজ করতে পারছি?

হ্যাঁ, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, যে বনু কাইনুকার নির্বাসনের সময়ও ওদের পক্ষে কাজ করেছিলো। কিছুদিন পরেই বনু নাদীরের নির্বাসনের ঘটনা শুনে সে যারপরনাই রেগে গেলো। বনু নাদীরের গোত্র প্রধানকে চিঠি লিখে সে জানালো যে ওরা যেন কোনোভাবেই নির্বাসনে যেতে রাজি না হয়। যাই ঘটুক না কেন সে ওদের পক্ষে থাকবে এবং ওদের রক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছে। দরকার হলে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও দ্বিধা করবে না। আর একান্তই যদি নির্বাসনে যেতে হয় তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইও ওদের সাথে নির্বাসনে যাবে। ওদের রক্ষা করবে, ওদের হয়ে যুদ্ধ করবে এই মর্মে সে অসংখ্যবার শপথ নিলো। সাথে এও জানালো যে গাতাফান গোত্রের মিত্রদের ডেকে পাঠিয়েছে, ২০০০ সৈন্যের বিশাল দলবল নিয়ে সে একত্রে বনু নাদীরের হয়ে যুদ্ধ করবো।

আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর এত হম্বিতম্বির কারণ কী হতে পারে মনে হয় আপনার কাছে? জাহিলী যুগে যদিও বনু নাদির তার মিত্র পক্ষ ছিলো না কিন্তু মানসিকভাবে মুসলিমদের চেয়ে মুসলিমদের শত্রুকেই সে বেশী আপন ভাবতো। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এভাবে মদীনার আদি অধিবাসীদের মদীনা থেকে একে একে বের করে দিচ্ছেন এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।

আমাদের হয়তো মনে আছে যে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই হতে যাচ্ছিলো মদীনার অঘোষিত নেতা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম তার সব কিছু ভজঘট লাগিয়ে দেয়। মদীনার আদি অধিবাসীদের কাছে উনি তো এখনও একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। উনি যখন এভাবে এত শপথ করে প্রতিরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেন তখন সেটা বনু নাদীরের মনে আশা সঞ্চার করবে এটাই স্বাভাবিক।

তাই তার চিঠি পাবার পর বনু নাদীরের গোত্র প্রধান সিদ্ধান্ত পাল্টালেন। এই পর্যায়ে এসে তার নাম জানাটা মনে হয় আমাদের জন্য খুবই জরুরী। হুয়াই ইবনে আখতাব। সে সিদ্ধান্ত নিলো যে এভাবে নবীজীর কথামত বিনা বাক্যবায়ে মদীনা ছেড়ে যাবে না, প্রয়োজনে যুদ্ধ করবে। যদিও তার এই সিদ্ধান্তে বনু নাদীরের অনেকেই রাজি ছিলো না কিন্তু অনেক তর্ক বিতর্কের পর সে তাদেরকে যুদ্ধ করতে রাজি করাতে সক্ষম হয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের চিঠির বিপরীতে সে উত্তর পাঠালো যে তারা যাবে না, নবীজী যা চান তা করতে পারেন।

এই চিঠি পেয়ে আমাদের নবীর প্রতিক্রিয়া কী ছিলো?

আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর দ্বারা প্ররোচিত হয়ে বনু নাদীর সিদ্ধান্ত নিল যে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কথা মত বিনা বাক্যব্যয়ে মদীনা ছেড়ে যাবে না, বিনিময়ে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুত। নবীজীর চিঠির প্রতুত্ত্যরে এটা জানানোর পর নবীজী খুবই খুশি হয়ে গেলেন, আল্লাহু আকবার বলে সেইদিনই লোকবল নিয়ে বনু নাদীরের গোত্র অবরোধ করলেন। বনু নাদীরও অবাক হয়ে গিয়েছিলো এত দ্রুততার সাথে উনাদের পৌঁছানো দেখে।

অবরুদ্ধ অবস্থায় সময় গড়াতে লাগলো, এদিকে বনু নাদীর তো অপেক্ষা করে আছে!

কিসের?

যার গাল ভরা প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করে ওরা ওদের সিদ্ধান্ত বদলেছিল!

কিন্তু ওরা তো আর জানতো না যে এগুলো সবই ছিলো মুখের বুলি! আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ওদের সাহায্যার্থে একটা আঙ্গুল পর্যন্ত তুললো না! সময়ের সাথে সাথে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে ও আসলে বনু নাদীরের জন্য কিছুই করবে না! এইসময় কিন্তু কোনো যুদ্ধই চলছিলো না, শুধুই অবরোধ, কারণ বনু নাদীর অপেক্ষায় ছিলো বাইরে থেকে সাহায্যের। এদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম ছিলেন একেবারেই নিশ্চিন্ত, উনি খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে ঘটনার ফলাফল মুসলিমদের অনুকূলেই আসবে। তার এই আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে উনি যখন সামান্য কিছু সাহাবীদের অবরোধের কাজে নিয়োজিত রেখে নিজে অধিকাংশ সাহাবীদের নিয়ে বনু কুরাইযার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

কেন?

সীরাহর এই অংশটা আমার খুব খুব প্রিয়!

আচ্ছা বনু কুরাইযা কে মনে আছে তো? ইহুদীদের ৩য় গোত্র যেটা তখনও মদীনাতে বাস করছিলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম যেটা করলেন সেটা হলো বনু কুরাইযার সাথে চুক্তি নবায়ন করলেন।

এই বিষয়টা কিন্তু আমাদের বোঝাটা খুবই জরুরী। বলেছিলাম না যে আমাদের সিরিজের উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা স্পষ্ট করা যে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের সাথে যা করেছিলেন সেটা তারা ইহুদী বলে নয় বরং ওদের কৃতকর্মের জন্য করা হয়েছিল। (Not because who they were, rather what they did!) এই ঘটনা এটার একটা প্রমাণ কিন্তু। ইহুদীদের শাস্তি পাওয়ার কারণ যদি ইহুদী হওয়াই হবে তাহলে আলাদা আলাদা করে গোত্রগুলোর সাথে Deal করতে হবে কেন? এক গোত্রের শাস্তি তো আরেকজনকে দেয়াই যায়, তাই না? ব্যাপারটা এরকম ছিলো না বলেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে বনু কুরাইযা এখনও মুসলিমদের সাথে মদীনায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আগ্রহী, আর বনু কুরাইজাও চুক্তি নবায়নের মাধ্যমে এতে তাদের সম্মতি জানিয়েছিলো।

ধীরে ধীরে যখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর সকল প্রতিশ্রুতি ছিলো বাগাড়ম্বর মাত্র, তখন সেটা বনু নাদীরদের মানসিকভাবে খুবই দুর্বল করে দিলো। এর সাথে যুক্ত হল আরেকটা ঘটনা যেটা ওদের জন্য ছিলো রীতিমত হৃদয় বিদারক!

বলেছিলাম না যে বনু নাদীরের একটা বিশেষ সম্পদ ছিলো বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে খেজুর বাগান? ওদেরকে মানসিকভাবে পঙ্গু করার জন্য সাহাবীরা সেই সব খেজুর গাছ পুড়িয়ে দিতে লাগলেন। দুর্গে অবস্থান করে বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে এই দৃশ্য সহ্য করা ওদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এটাতো শুধু অর্থনৈতিক ব্যাপার ছিলো না, এটা ছিলো বছরের পর বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমে গড়া সম্পদ। এই ঘটনাই মূলত ওদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়ে ওদের চলে যেতে দেন, বলেন সাথে ওদের উটগুলো যতটুকু সম্পদ বহন করতে পারে ততটুকু সাথে নিয়ে যেতে পারবে, অবশ্যই অস্ত্রগুলো ছাড়া।

এই নির্দেশের পর কী দেখা গেল?

যেহেতু নবীজী বলেছিলেন যে উঠের পিঠে যতটুকু নেয়া যায় তা নেয়া যাবে তাই বনু নাদীর উটগুলোকে নিজেদের বহনের কাজে ব্যয় করতে চায় নি। তারা সবাই হেঁটে যাত্রা শুরু করলো, আর উটের পিছনে বেঁধে নিলো যা যা নেয়া সম্ভব। উটগুলো জিনিসপত্রের ভারে একেবারে নুয়ে পড়ছিলো, কেউ কেউ তো উটের পিঠে দুর্গের দরজাও চাপিয়ে দিয়েছিলো! এত বছর ধরে এত আর্কিটেক্ট কৌশল দিয়ে যে দুর্গ ওরা নির্মাণ করেছিলো তা এভাবে মুসলিমদের উপভোগের জন্য রেখে যেতে ওদের কেমন লেগেছিলো তা কি আমরা অনুভব করতে পারছি? ওদের কষ্ট, আফসোস আর প্রচণ্ড হতাশা?

হতাশার চোটে ওরা আরো কি করেছিলো তা কি আমরা জানি? ওরা ওদের দুর্গের আকর্ষনীয় কাঠামো যেগুলোর বছরের পর বছর ধরে পরিশ্রম করে নির্মাণ করেছিলো, সেগুলো নিজে হাতে কুড়াল দিয়ে ধ্বংস করেছিলো। এগুলো মুসলিমরা ব্যবহার করবে এটা ওরা মেনেই নিতে পারছিলো না!

নির্বাসনের পর ওরা কোথায় গেলো?
অধিকাংশই গেলো খায়বারে, মদীনার উপকণ্ঠেই একটা জায়গা যেখানে আরো ইহুদীরা বাস করতো। খায়বারের খেজুর আরবের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলো আর দুর্গগুলোও অনন্য ছিলো, সেখানে গিয়ে তারা আশ্রয় নিলো।

কিন্তু ওরা কি ওদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত বা অনুতপ্ত ছিলো? কী মনে হয়?

অবশ্যই না! নির্বাসিত হবার পরই রাগে ক্ষোভে ওরা আরবের সমস্ত গোত্রকে একত্রিত করার কাজ সম্পন্ন করে, ফলশ্রুতিতে খন্দকের যুদ্ধ সংঘঠিত হয়।

তবে ওদের নির্বাসনের সময় একটা Interesting ঘটনা ঘটে। আগে বলেছিলাম যে তৎকালীন আরবরা ইহুদীরকে শ্রেষ্ঠতর ভাবতো ওদের সমৃদ্ধ সভ্যতার জন্য। তাই কোনো আরব মহিলার যদি একাধিকবার বাচ্চা নষ্ট হতো তাহলে ওদের মাঝে এহেন প্রতিজ্ঞা করার প্রচলন ছিলো যে আল্লাহ তুমি যদি এবার আমাকে সুস্থ ছেলে দাও তাহলে আমি তাকে ইহুদী হিসেবে গড়ে তুলবো। এভাবে এক গ্রুপ শিশু সন্তান ছিলো যাদের ছোটবেলাতেই বনু নাদীরের কাছে দিয়ে দেয়া হয়েছিলো, যারা বড়ই হয়েছে ইহুদী ধর্ম, কালচার এগুলোর মধ্যে। বনু নাদীরের নির্বাসনের সময় যখন দেখা গেল ওইসব সন্তানদেরও চলে যেতে হচ্ছে তখন কিছু আনসারী খুব আপসেট হয়ে গেলো। তারা চাচ্ছিলো যে ওরা যেন ইসলাম গ্রহণ করে, কিছুটা জোর করা হচ্ছিলো। মুসলিম হলেই তো আর ছেঁড়ে যেতে হবে না! কিন্তু যারা বড় হয়েছিলো ইহুদী ধর্ম নীতিতে, এটাই সত্য হিসেবে গ্রহণ করতো তারা ইসলাম গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলো না। এই পরিস্থিতিতে কুরআনের একটা আয়াত নাযিল হয়। কোনটা সেটা কি আমরা আন্দাজ করতে পারছি?

ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলার সময় আমরা এটা নিয়ে কথা বলেছি।

হ্যাঁ, সূরা বাক্বারার ২৫৬ নং আয়াত, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে যে দ্বীন ইসলামে কোনো জবরদস্তি নাই।

মানে এই আয়াতটা নাযিল হয়েছিলো কিছু ইহুদীদের সমর্থনে, যাদেরকে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণের দিকে ডাকা হচ্ছিলো।

ভাবা যায়?

বনু নাদীরের নির্বাসনের মূল ঘটনা বলা এখানেই শেষ। এই ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতেই সূরা হাশর নাযিল হয়েছিলো। তাই এই পর্যায়ে এসে পাঠকদের অনুরোধ করবো সূরা হাশর আরবীতে তিলাওয়াত এবং বাংলা/ ইংরেজী অনুবাদ মন দিয়ে পড়ার জন্য।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন