বনু কাইনুকার নির্বাসনের নেপথ্য ঘটনা এবং বনু কাইনুকার নির্বাসন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

বনু কাইনুকার নির্বাসনের নেপথ্য ঘটনা

আজকের পর্ব থেকে আমরা জানবো বনু কাইনুকার নির্বাসন (১ম ইহুদী গোত্র যাদের সাথে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের encounter হয়েছিল) সেই কাহিনীর বিস্তারিত বিবরণ। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো শুরু হয় মুসলিম মহিলার সম্মানহানীর ঘটনা দিয়ে, অথচ তার আগে থেকেই যে দুই পক্ষের মাঝে একটা টেনশন শুরু হয়েছিল সেটা বোঝা খুবই জরুরী!

এজন্য সবার প্রথমে আমাদের জানতে হবে সীরাহর ঘটনাক্রম। বনু কাইনুকার সাথে এই ঘটনা ঘটেছিল বদরের যুদ্ধের পর, ওহুদের আগে। আমরা সবাই হয়তো জানি যে, বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের অবিশ্বাস্য জয়লাভ তাদের নৈতিকভাবে খুবই উদ্ধুদ্ধ করেছিল। কিন্তু এই ঘটনায় ইহুদীরা একেবারেই খুশি হতে পারে নাই এবং তারা তাদের অসন্তোষ ঢাকার কোনো চেষ্টাও করে নি।


আসুন ব্যাপারটা আমাদের সময়ের প্রেক্ষিতে চিন্তা করি। মনে করি যখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ ছিল তখন ইন্ডিয়া- পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধ হলো, তাতে পাকিস্তান জিতে গেলো। এটাতে বাংলাদেশের মানুষ যদি খুব দুঃখ পায় এবং ফেসবুকে সেটা নিয়ে স্ট্যাটাস দিতে থাকে তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? আচ্ছা সেটাকে যদি বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ধরে নেয়া হয়, কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে বলে যে ইন্ডিয়া অতি ফাউল দেশ বলেই তোমরা ওদেরকে হারাতে পেরেছো,আমাদের সাথে হলে গোহারা হারতে তাহলে পাকিস্তান কি বাংলাদেশকে আর বিশ্বাস করতে পারবে?

দেশের কথা বাদ দেই যদি আওয়ামী লীগের কেউ জামাত নেতাদের হত্যায় দু:খ প্রকাশ করে তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? তার আওয়ামী সদস্য পদ থাকবে? মনে আছে প্রিয়া সাহা যখন ট্রাম্পের কাছে গিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যা লঘু নির্যাতনের কথা বলেছিল তখন সেটা নিয়ে কত কথা উঠেছিল? বনু কাইনুকার সাথে এই ঘটনা আমাদের এইভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার আলোকে চিন্তা করতে হবে, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে ইনশাআল্লাহ্।

এখানে বলে রাখা ভালো যে, বনু কাইনুকা ছিল সবচেয়ে বড় ইহুদী গোত্র, যাদের মাঝে ছিল প্রায় ৭০০জন যোদ্ধা। তারা পরিচিত ছিল স্বর্ণ ব্যবসার জন্য। স্বর্ণ এর বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তারা অর্থনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী এবং ক্ষমতাধর ছিল। এমন না যে ইহুদীরা আগে চুনোপুটি টাইপ ছিল আর এখন অনেক শক্তিধর হয়ে গেছে।

এহেন পরিস্থিতিতে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বাজারে গিয়ে সমস্ত বনু কাইনুকাকে একত্রিত করে মদীনা সনদের ধারাগুলো মনে করিয়ে দেন। প্রতিউত্তরে বনু কাইনুকার এক নেতা নবীজীর মুখের উপর বলে দেয় যে, বদরের যুদ্ধে জয়লাভ করা মুসলিমদের কৃতিত্ব নয়, বরং তা একারণে সম্ভব হয়েছে যে কুরাইশরাই যুদ্ধ করতে জানতো না। ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ করলে মুসলিমরা বুঝতে পারবে, আসল যোদ্ধা কাকে বলে! বনু কাইনুকার এই মৌখিক ঔদ্ধত্যের জন্যও কিন্তু আমাদের নবীজী (সা:) কোনো ব্যবস্থা নেননি।

এর কিছুদিন পর ঘটে আসল ঘটনা। এক মুসলিম নারী বাজারে অলংকার কেনা বা বেচার জন্য এক ইহুদীর সোনার দোকানে যান। সেখানে উপস্থিত আরও কয়েকজনসহ ইহুদী দোকানদারটি মহিলার সাথে flirting করতে থাকে, তাকে পোশাকের কিছু অংশ সরাতে বলে। মুসলিম মহিলাটি তা করতে রাজী না হওয়ায় তারা মহিলাটিকে লাঞ্চিত করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। তার অজান্তে তার পোশাকের একটা অংশ এমনভাবে বেধে রাখে যে সে যখন উঠে দাড়ায় তখন তার শরীরের অনেকটাই অনাবৃত হয়ে যায়। মহিলাটি যখন চিৎকার করতে থাকে ইহুদীরা তখন তাকে নিয়ে উচ্চ শব্দে হাসাহাসি করতে থাকে।
একজন মুসলিম মহিলার এমন অপমান আর হেনস্থা সহ্য করতে না পেরে একজন মুসলিম যুবক এগিয়ে এসে রাগের মাথায় যে ইহুদী উত্যক্ত করেছিল তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে এই ঘটনা ঘটেছিল বনু কাইনুকার লোকালয়ে, তাদের সীমানার মধ্যে। ফলশ্রুতিতে অন্য উপস্থিত ইহুদীরা মুসলিমটির ওপর চড়াও হয়ে তাকে হত্যা করে ফেলে।


আমরা কি বুঝতে পারছি যে এটা মদীনার সনদের লঙ্ঘন? কারণ এই চুক্তির কথাই ছিল যে গোত্রগুলো নিজেদের মাঝে শান্তিপূর্ন ভাবে সহাবস্থান করবে। এখানে মুসলিম ব্যক্তির দ্বারা হত্যার অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তা মদীনার বিচার ব্যবস্থার অধীনে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু ইহুদিরা নিজেদের নীতিবিরুদ্ধ কাজকে চাপা দিতে গিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে অপরাধী ব্যক্তিকে মেরে ফেলে। এভাবে মদীনা সনদ তারা নিজেরাই ভঙ্গ করলো।

এই ঘটনায় রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? উনি কি মুসলিম মহিলাকে দোষারোপ করে বলেছিলেন যে, ”উনার জন্য ইহুদী গোত্রের সাথে এহেন ঝামেলা হলো, ওনার দরকার কী ছিল ইহুদীদের বাজারে যাওয়ার, মেয়েদের জায়গা হচ্ছে ঘর, বাজারে যায় খারাপ মেয়েরা ইত্যাদি??”

নাহ। আর এজন্যই সীরাহ পড়তে গেলে আমি প্রতিবার যেন নতুন করে উপলব্ধি করি যে আপনাকে আমি ভালোবাসি ইয়া রাসূলুল্লাহ!

এরপর আমাদের নবীজী যেটা করেছিলেন সেটা আমার খুব প্রিয় একটা ব্যাপার। উনি প্রথমেই বনু কাইনুকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে, মদীনার রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে জানিয়ে দিলেন যে চুক্তি ভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। এখানে কয়েকটা বিষয় লক্ষণীয়: রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধরে নিতে পারতেন যে চুক্তি ভঙ্গের বিষয়টা এতই স্পষ্ট যে এটা নতুন করে জানানোর কিছু নাই , কিন্তু উনি সেটা করেন নাই।

টেকনিক্যালি উনি যদি surprise attack করতেন তাহলে এটা ভুল কিছু হতো না কারণ কিছুদিন আগেই ওদেরকে সনদের ধারাগুলো মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও উনি কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রাখলেন। এরপর রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেনাদের নিয়ে ওদের দুর্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

বনু কাইনুকা রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে এমন কঠিন প্রতিক্রিয়া আশা করে নি। ওরা যখন এটা শুনলো তখন তারা যুদ্ধ না করে তাড়াতাড়ি নিজেদের দুর্গের মধ্যে আশ্রয় নিলো। তাদের আগের করা বাগাড়ম্বর যে কতটা অন্ত:সারশূণ্য ছিলো তা এই ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আগেও বলেছি যে তখনকার ইহুদীরা প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুবই দক্ষ ছিল, ওদের নিজস্ব একাধিক দূর্গ ছিল যেটা ভেদ করে ভিতরে যাওয়ার মত দক্ষতা তখনকার মুসলিমদের ছিল না। তাই তারা রণ কৌশল হিসেবে দূর্গ অবরোধ করাকে বেছে নেয় যাতে বাহির থেকে সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং ভিতরের দূর্গবাসী আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এই রণকৌশল আমরা সাহাবাদের সময়ের প্রায় সবগুলো যুদ্ধের ক্ষেত্রে দেখতে পাই।

প্রায় ১৫ দিন এভাবে অবরুদ্ধ থাকার পর বনু কাইনুকা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিলেন যে ওদের সকল পুরুষদের একত্রিত করে বন্দী করা হোক, তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে যে ওদেরকে নিয়ে কী করা হবে।

এরপর কী হলো?

আত্মসমর্পণের পর ওরা উবাদাহ ইবনে আল সামিত আর আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর কাছে সাহায্যের জন্য গেলো, দেন দরবার করতে লাগলো। উনারা ছিলেন ইসলাম পূর্ব যুগে বনু কাইনুকার বিশিষ্ট মিত্র। কিন্তু ইসলাম এসে যে সাহাবীদের Loyality আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে সেটা হয়তো তাদের মাথায় ছিলো না। সাহাবী উবাদাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে উনার alliance হচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে, ওদের হয়ে উনি নবীজীর কাছে কোনো সুপারিশ করবেন না।
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই কী করেছিল?

সে সোজা ক্যাম্পে চলে গেলো যেখানে যুদ্ধ বন্দীরা ছিল এবং যে সাহাবী তাদের দায়িত্বে ছিলেন তাকে কড়া করে বললেন বন্দীদের ছেড়ে দিতে। সেই সাহাবী যদি ছেড়ে না দেন তাহলে উনি নিজেই তা করবেন। দায়িত্বরত সাহাবী বললেন যে, আবদুল্লাহ যদি এই কাজ করেন তাহলে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে হত্যা করতে বাধ্য হবেন।

জানের ভয়ে সে এইবার গেলো নবীজীর কাছে। তাকে ইয়া মুহাম্মদ (যদিও কুরআনে এভাবে ডাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে) বলে ডেকে বললো যে,” আমার মিত্রদের প্রতি সদয় হও। ”
প্রতি উত্তরে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ করে থাকলেন। সে কথাটার পুনরাবৃত্তি করলো, রাসূল আবারো চুপ করে থাকলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

অবিশ্বাস্যভাবে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবার নবীজীর বর্মের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে উনার হাত ধরে একই কথা ৩য় বারের মত বললেন। রাসূল বললেন, ”আমাকে ছেড়ে দাও।” উনার চেহারায় ক্রোধের ছাপ ছিল স্পষ্ট। কিন্তু তাতে নিবৃত্ত না হয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উনাকে আরো শক্ত করে ধরে বললেন যে, “ না আমি তোমাকে ছাড়বো না।”

রাসূল তাকে আবারও বললেন ছেড়ে দিতে। এবার সে বললো যে, “ আল্লাহর কসম আমি তোমাকে ছাড়বো না যতক্ষণ না এদের সাথে সদয় ব্যবহার করা হচ্ছে। এরা আমার দু:সময়ে ছায়ার মত আমার পাশে থেকেছে আর তুমি একদিনে এদের ধ্বংস করে ফেলবে? আমি ভয় পাচ্ছি যে যদি তাদের সাথে খারাপ কিছু করা হয় তাহলে আমার সাথে খারাপ কিছু ঘটবে!”
এভাবে যখন সে দীর্ঘসময়েও রাসূল এর হাত ছাড়লো না, তখন রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ”আচ্ছা, আমি কথা দিচ্ছি তাদের হত্যা করা হবে না।”

এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো যে বনু কাইনুকাকে তিন দিন সময় দেয়া হবে, এর মাঝে তাদের মদীনা ছেড়ে চলে যেতে হবে। ওরা আরো বেশি সময় চাইলো, সেটা দেয়া হলো না। ওরা আরও একবার সাহাবী উবাদাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে চেষ্টা করলো, কিন্তু তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন যে, “আমার কাছে এসো না, আমি হলে তোমাদের তিন দিন সময়ও দিতাম না।”

আল্লাহর রাসূল উবাদাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে দায়িত্ব দিলেন এটা নিশ্চিত করতে যে তিনদিনের মধ্যে যেন চলে যায় বনু কাইনুকার সবাই। বনু কাইনুকা যাওয়ার সময় তাদের সোনা গয়না বা অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি নিতে পারলেও অনেক কিছুই নিতে সক্ষম হয় নি, সেগুলো সব মুসলিমদের অধিকারে আসে।

বনু কাইনুকার নির্বাসন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা

প্রথমত: আমাদের মনে হতে পারে যে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওদের সাথে খুব কঠোর আচরণ করেছিলেন। ওদের কি লঘু পাপে গুরুদণ্ড দেয়া হয়েছিল? আমার মতে , না। ইহুদীদের এই শক্তিশালী, দুর্ভেদ্য দূর্গ নিয়ে খুবই আত্মবিশ্বাস ছিল, ওরা ভাবতেই পারে নি রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওদের এহেন ক্ষমতা, শৌর্য বীর্য দেখে ভয় পাবেন না। তাই এটা ইহুদী গোত্র গুলোর জন্য একটা সংকেত ছিল যে মদীনার সনদ কোনো হালকা ব্যাপার না, এটার ধারা লঙ্ঘন করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।

দ্বিতীয়ত: বিশ্বাসীদের আবার অপরদিকে মনে হতে পারে যে, রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন মুনাফিকদের সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর অনুরোধ রক্ষা করলেন। সেটা বুঝতে হলে আবারও ঘটনাক্রম আমাদের মাথায় রাখতে হবে, এই ঘটনা ঘটেছে উহুদের আগে, মানে এখনও আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মুনাফিক হিসেবে তার রূপ প্রকাশ করে নাই। এই মুহুর্তে সে মদীনায় খুবই সম্মানিত, সিনিয়র একজন নাগরিক- যার ব্যাপারে অনেক আনসার ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। তাই তার কথা শোনার মাধ্যমে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে উপযুক্ত সম্মান দিলেন যদিও নবীজীর সাথে তার ব্যক্তিগত আচরণ খুবই আপত্তিকর ছিল।

তৃতীয়ত: এই প্রেক্ষিতে সূরা মায়িদার ৫২-৫৬ আয়াত নাযিল হয়েছিল।

অনেকেই হয়তো এই কাহিনী আগে জানতেন না, অনুরোধ করবো এখন আয়াতগুলো আবার খুলে পড়তে। এখন কি বোঝা যাচ্ছে যে কোন ধরনের বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে? আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ভাবছিল যে দুর্ভাগ্য থেকে ওকে রক্ষা করবে ইহুদীদের সাথে মিত্রতা। এটা আল্লাহ একদম সরাসরি উল্লেখ করেছেন। তার মানে এরকম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদের কাছ থেকে মিত্রতা খুজবো না, ভাববো না যে ওরা আমাদের রক্ষা করবে বা কথা শুনবে বা আমাদের স্বার্থের দিকে খেয়াল করবে।

ইতিহাস থেকে এটা একাধিকবার প্রমাণিত যে মুসলিমরা যখনই তাদেরকে রাজনৈতিক উপদেষ্টা বা মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে তখনই তাদের দ্বারা প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে। এ ব্যাপারে আগ্রহী হলে শেখ ইয়াসির কাদ্বীর 1914: The Shaping of the Modern Muslim World শিরোনামে লেকচারটা শুনে দেখতে পারেন। অসাধারণ কিছু তথ্য এতে সন্নিবেশিত হয়েছে।
আবারও বলছি, সাধারণত আরবীতে বন্ধু বোঝাতে ”সাদিক্বুন” শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এই আয়াতে আল্লাহ যে শব্দ ব্যবহার করেছেন তা হলো “আওলিয়া” যার মূলরূপ “ওয়ালী”। ওয়ালী বলতে আমরা বুঝি অভিভাবক, এমন কেউ যিনি সর্বাবস্থায় আমার ভালো চাইবে, নির্দেশনা দিবে, দায়িত্ব নিবে। ইহুদি-খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধু বানানোর ব্যাপারে আল্লাহ নিষেধ করেননি কিন্তু ওয়ালী হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। তাই তাদের সাথে পারিবারিক বা অন্যান্য বিষয়ে বন্ধুত্ব করা গেলেও তা একটা সীমার মাঝে রাখতে হবে, তাদের সাথে গোপনীয় ও স্পর্শকাতর বিষয় শেয়ার করা যাবে না। এই আয়াতটার কনটেক্সট চিন্তা না করে যদি একে বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করা হয় তাহলে সেটা কুরআনের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে সেটা কি আমরা টের পাচ্ছি?

বনু কাইনুকার ঘটনা বিশ্লেষণে যে বিষয়টা বিশেষ মনোযোগ এর দাবি রাখে তা হলে এটা বোঝা যে, তৎকালীন ইহুদীরা ক্ষমতা ও দক্ষতার দিক থেকে কোনো অংশেই আমাদের সময়ের থেকে কম ছিল না। কিন্তু তাতে তৎকালীন মুসলিমরা ভয় পেয়ে যান নি, তারা ভরসা করেছিলেন আল্লাহর সাহায্যের উপর। সেইসাথে যতটুকু সাধ্য ছিল, সেটার সবটুকু দিয়ে তারা দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করে গিয়েছিলেন।

আমরা সাহাবীদের জীবনের এই অংশ একেবারে মিস করে যাই। তারা কিন্তু দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারটাকে ছোট করে দেখেন নাই। আমরা যদি রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ের যুদ্ধগুলোর রণকৌশল খেয়াল করি,দেখবো যে তারা তাদের ওই সময়ের দক্ষতা অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করেছেন। বদরের যুদ্ধের কথা মনে আছে? এক সাহাবী রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জানতে চাইলেন মুসলিমদের বর্তমান অবস্থান কি ওহী দ্বারা নির্দেশিত কী না। যখন উত্তর না শুনলেন, তখন প্রস্তাব করলেন যেন কূপের অধিকার মুসলিমদের থাকে এইভাবে তারা অবস্থান নেয়। নিঃসন্দেহে এটা ছিলো একটা দারুণ কৌশল। আমরা যখনই বদরের যুদ্ধ নিয়ে কথা বলি, কেন যেন শুধু ফেরেশতা নেমে এসেছিল এটার দিকেই ফোকাস করি। উহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল সেটার অবশ্যই আধ্যাত্মিক কারণ ছিল যে কিছু সাহাবী গনিমতের মাল নেয়ার জন্য নেমে এসেছিলেন কিন্তু কৌশলগত একটা কারণ ছিল, যে অবস্থান থেকে উনারা সরে এসেছিলেন সেটা খুবই ক্রিটিক্যাল একটা পজিশন ছিল, তাই নবীজী বারবার মানা করে দিয়েছিলেন ওখান থেকে না সরে যেতে।

দুনিয়াবি বা প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন আর আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন এই ব্যাপারটাকে আমরা কেন যেন mutually exclusive বানিয়ে ফেলেছি। আমাদের আলোচনাগুলো কেমন যেন প্রান্তিক হয়ে যায়। একদিক থেকে বলা হয় আমরা মুসলিমরা আল্লাহর কাছ থেকে সরে গেছি তাই এমন দুরবস্থা আমাদের, যেদিন সব মুসলিমরা ফজরের জামাতে শরিক হবে সেদিনই বুঝতে হবে আমরা বিজয়ের জন্য তৈরি। রেফারেন্স টানা হয় সাহাবীদের সময়ে,উনাদের যে কোনো দক্ষতা ছিল না সেটা খুব হাইলাইট করা হয়। তা থেকে আমাদের ধারণা হয় উনারা যেন অকর্মণ্য টাইপ কিছু ছিলেন!

কিন্তু আমার কাছে উনারা এক অসাধারণ প্রজন্ম যারা আমাদের মত mediocracy তে বিশ্বাস করতেন না, excellency ছিল তাদের টার্গেট। আমাদের মত কোনোরকমে দুনিয়ার জীবন পার করে দেয়ার প্রবণতা তাদের থাকলে তারা কি এত তাড়াতাড়ি অর্ধ পৃথিবী শাসন করতে পারতেন? আবার আরেক দল আছে যারা বলতে থাকে ইহুদীরা পৃথিবী শাসন করছে কারণ তারা জ্ঞান বিজ্ঞানে এত এগিয়ে গেছে, নোবেল প্রাইজ পাচ্ছে ইত্যাদি। অথচ আল্লাহ সূরা হাশরে আমাদেরকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে তারা খুবই ভীরু, কাপুরুষ টাইপ জাতি যেটা বনু এই ঘটনায় একদম স্পষ্ট।

আজকের সময়েও আপনি দেখবেন যে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের মোকাবিলায় ওরা আসে অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে। আগে যেমন দুর্গের আড়ালে লুকাত, এখন লুকায় বুলেট প্রুফ জ্যাকেট বা এমন কিছুর আড়ালে। আর প্যালেস্টাইনের শিশুদের আপনি দেখবেন নির্ভীক, ট্যাংকের সামনে দাড়িয়ে ওদের দিকে পাথর ছুঁড়তে। মৃত্যুকে যখন কেউ ভয় পায় না, শুধু তখনই এমন হতে পারে। তাহলে আমরা ওদের সাথে পেরে উঠি না কেন?

কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তর। আমরা ওদের চেয়েও বড় কাপুরুষ হয়ে গেছি এখন। তাহলে সমাধান কী? ঐ যেটা বললাম, ব্যালেন্স। আমাদের প্রচুর ডাটা সাইন্টিস্ট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী দরকার যারা আল্লাহ ভীরু। আমরা আমাদের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী সর্বোচ্চটা ঢেলে দেবো, আল্লাহ সেটাতে বারাকাহ দেবেন। দ্বীন আর দুনিয়ার মাঝে দাগ টানার দরকার নেই, প্রয়োজন দুনিয়াকে ব্যবহার করা জান্নাতুল ফিরদাউস অর্জনের জন্য।

যাইদ বিন সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর যে দুই সপ্তাহের মধ্যে হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন ইহুদীদের সাথে যোগাযোগের সুবিধাথে সেটা আমরা কয়জন জানি বা আলোচনা করি? সেটা কি ইবাদত ছিল না? ইসলামের একটা দারুণ সৌন্দর্য তো এটাই যে সব কিছুকেই ইবাদতে পরিণত করা যায়, তাই না?
তবে এই ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ Take away হচ্ছে এটা বোঝা যে রাসূল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু কাইনুকার সাথে যা করেছিলেন সেটা তারা ইহুদী বলে নয় বরং ওদের কৃতকর্মের জন্য করা হয়েছিল। (Not because who they were, rather what they did!)

মুসলিমরা ইহুদী বিদ্বেষী এটা একটা অপবাদ এবং আমাদের বর্তমান সিরিজে এটা আমরা সীরাহ ও ঐতিহাসিক Facts থেকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ।

বনু কাইনুকার ঘটনা বিশ্লেষণ এখানেই শেষ, একটু বিরতি নিয়ে শুরু করবো বনু নাদিরের ঘটনা ইনশাল্লাহ। তবে তার আগে বনু কাইনুকার ঘটনার কিছু মূল পয়েন্ট আমাদের মুখস্থ করতে হবে।
১) এটা কখন হয়েছিলো
২) বনু কাইনুকার অপরাধ কী ছিলো
৩) বনু কাইনুকার শাস্তি কী হয়েছিলো
৪) এ প্রসঙ্গে কুরআনের কোন আয়াত নাযিল হয়েছিলো মনে আছে তো?


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন