আমাদের জীবনে ‘সীরাহ’

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

একটা রুঢ় বাস্তবতা যেটা আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করি, সেটা হচ্ছে আমাদেরকে ইসলামের ব্যাপারে সংশয়ে ফেলে দেয়া খুব সহজ (এখানে আমরা বলতে যারা ইসলামকে পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছি, তাদের কথা বুঝিয়েছি)। কারণ ইসলামের একদম a,b,c নিয়েও আমাদের জ্ঞান খুব অপ্রতুল। ইসলামের সত্যতার ব্যাপারে দ্বিধায় ফেলতে সাধারণত যেসব কৌশল ব্যবহার করা হয় তার মাঝে খুব কমন এবং কার্যকরী হচ্ছে সুন্নাহর সংরক্ষণ বা কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা। কুরআনের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করা একটু কঠিন কারণ আমরা চোখের সামনে দেখছি, যে জীবনেও কোনোদিন দেখা হয় নাই এমন দুইটা মানুষ পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসে সালাতে একই কুরআন তিলাওয়াত করছে। তবে আমরা একটা ব্যাপার বুঝি না যে, কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমন সুন্নাহর কর্তৃত্ব বা মর্যাদা নিয়ে সংশয়ে পড়লে কুরআনের ব্যাপারে সেটা সংক্রমিত হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কেন?

আমরা যদি সুন্নাহকে কুরআন থেকে আলাদা করে ফেলি, তাহলে কুরআন হয়ে যাবে একটা খেল তামাশার বিষয়বস্তু যাকে ইচ্ছামত ব্যাখ্যা করা যায়। কুরআনের কোনো আয়াত ঠিকমত বুঝতে হলে অবশ্যই আমাদের জানতে হবে

১) আয়াতটা কোন প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে
২) ঐ আয়াতের আগের, পরের আয়াত
৩) একই বিষয়ে কুরআন বা হাদীসের অন্যত্র কী বলা হয়েছে ইত্যাদি

কোন প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে সেটা জানা, এটাকে বলে Situational Context জানা।

আর একটা আয়াতের আগের, পরের সবগুলো আয়াত বিবেচনা করা, ঐ প্রসঙ্গে কুরআনে অন্য জায়গায় আর কী কী বলা হয়েছে সেগুলো একসাথে করে একটা আয়াত বোঝা, এই এপ্রোচটাকে বলে Textual Context বোঝা।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে।

আমরা অনেকেই ফেসবুকে বা অন্যত্র নিচের আয়াতটা দেখেছিঃ

হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।(৫:৫১)

এখন এই আয়াতটা পড়ে বা এ সংক্রান্ত ওয়াজ শুনে ক্রিস্টান রুমমেট যার সাথে অনেক সুসম্পর্ক ছিলো, এমনকি যে ইসলামের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছিলো, তার সাথে সম্পর্কছেদ করার কাহিনী আমি শুনেছি। যদিও আমার কাছে এটা একটা অবিশ্বাস্য কাহিনী, কিন্তু যার সাথে ঘটেছে তার কাছ থেকেই সরাসরি জেনেছি।

এখন এই আয়াতটাতে কি সাধারণ ইহুদী, ক্রিস্টান যাদের আমরা কলিগ, ক্লাসমেট বা প্রতিবেশী হিসেবে পাই তাদের কথা বলা হচ্ছে? যে দুই ধরণের Context এর কথা বললাম, এবার সেটার আলোকে এই আয়াতটা একটু পর্যালোচনা করি।

এই আয়াতটা কোন প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে?

বনু কাইনুকা-একটি ইহুদী গোত্র, তাদের যখন মদীনা থেকে বহিষ্কার করা হয়, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-মুনাফিক্বদের সর্দার, তাকে উদ্দেশ্য করে। অর্থ্যাৎ একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন কূটনৈতিক বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে কথা বলা হচ্ছে, তখন। যদি আমরা বনু কাইনুকা কে ছিলো, তাদের বৃত্তান্ত, কেনো তাদের বহিষ্কার করা হয়েছিলো সেটা, মানে Situational Context না জানি তাহলে এই আয়াত বোঝা দুষ্কর হয়ে যাবে।

যদি Textual Context হিসেবে চিন্তা করি তাহলে এই আয়াতটা খুব বিভ্রান্তিকর মনে হবে কারণ এই সূরা মায়িদাতেই অন্য অংশে (৫ নং আয়াতে) আহলে কিতাবদের খাদ্য এবং সচ্চরিত্র নারীদের বিয়ে করা হালাল করা হয়েছে। যদি বন্ধু হিসেবে গ্রহণই করা না যায় তাহলে এগুলো কিভাবে হালাল হতে পারে?

এই দুই ধরণের Context না জেনে যদি শুধু এইটুকুও জানতাম যে আরবী কুরআন হচ্ছে কুরআন, তাহলে বুঝতাম যে এখানে যে আরবী শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে সেটা হচ্ছে আউলিয়া-এটাকে ঠিক সাধারণ বন্ধুত্ব অর্থে ব্যবহার করা যাবে না, আউলিয়া মানে Protective friend, Guardian ইত্যাদি।

এখন যদি আমাদের সীরাহ জানা না থাকে তাহলে কিন্তু আমাদের পক্ষে Situational Context বোঝা সম্ভব না, আর তাহলেই ইচ্ছামত কুরআন ব্যাখ্যা করা সম্ভব, যেটা আমরা আজকাল হরদম করছি।
আপনাদের নিশ্চয়ই এতক্ষণে মনে হচ্ছে যে ’সূরা হাশর’ নিয়ে লেখা শুরু করে সীরাহ নিয়ে এত কথা বলছি কেন? আমার ব্যক্তিগত এপ্রোচ হচ্ছে, আমি যদি দেখি কেউ যদি সুন্নাহ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে কিন্তু কুরআন নিয়ে তার মনে কোনো প্রশ্ন নেই, তাহলে তাকে এমন কোনো সূরার কন্টেন্ট নিয়ে প্রশ্ন করি যেটা বুঝতে হলে সীরাহর জ্ঞান একেবারে অপরিহার্য।

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান অনুযায়ী ’সূরা হাশর’ এমন একটা সূরা। এটা এমন একটা সূরা যেটা বোঝার জন্য অনেক ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্য জানা থাকা দরকার। সেই ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্যগুলো যদি আমাদের জানা থাকে তাহলে সুন্নাহ নিয়ে সংশয়ের দ্বার অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

সুন্নাহ নিয়ে সংশয় নিরসনের প্রথম ধাপ হচ্ছে সীরাহ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা। সাধারণত কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে কুরআনের কোন অনুবাদ বা তাফসীর পড়বে, আর আমি অনুভব করি যে সে একদমই Beginner, তাহলে আমি তাকে কুরআন পড়ার আগে বরং সীরাহটা একদম আদ্যপান্ত পড়ে ফেলতে বলি, সম্ভব হলে একাধিকবার।

শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্যই না, এক অসাধারণ আনন্দের অনুভূতি পাওয়ার জন্যও সীরাহ পড়া উচিৎ। আমি যতবার সীরাহর কোনো ঘটনা পড়ি, প্রতিবারই যেন আমি নতুন কোনো শিক্ষা, দৃষ্টিভঙ্গি অনুভব করি! তবে হ্যাঁ, সীরাহ পড়তে গেলে অবশ্যই সেটা একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মন দিয়ে পড়া উচিৎ। এক চিমটি এখান থেকে, আরেক খাবলা ওখান থেকে……এইভাবে পড়লে সেটা বরং লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশী বয়ে আনবে।

কিন্তু পুরোটা একবারে পড়বো করে যদি শয়তানের ফাঁদে পরে পড়া আর শুরু করাই না হয়?
সেটা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল!

তাহলে কোন ব্যাপারে জানাটা একদম অপরিহার্য? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে দুইটা বিষয়, যেগুলো নিয়ে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সবচেয়ে বেশী বিতর্কিত করা হয়। কী সেটা

১) ইহুদীদের সাথে উনার আচরণ
২) উনার বিবাহিত জীবন

আমাদের বর্তমান সিরিজে আমরা মূলত ১ম বিষয়টার উপর আলোকপাত করবো, তবে সীরাহ বোঝার একটা মেথডোলজি নিয়েও কথা বলবো ইনশাআল্লাহ, যেটা জানলে সীরাহর কোনো ব্যাপারে অস্বস্তি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে ইনশাআল্লাহ।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন