পূজা দেখতে যাওয়া, অতঃপর . . . . . . .

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

মুসলিমদের সপরিবারে পূজা দেখতে যাওয়া ইদানীং একটি কালচারে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা হয়তো নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক আধুনিকমনস্ক মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে চাই। কিন্তু অন্যের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে হাসি ঠাট্টা না করা, তাদেরকে তাদের ধর্ম পালনে বাঁধা না দেয়া আর নিজেরাও অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দর্শক হওয়ার মাঝে যে একটা Thin line আছে এটা বোধহয় আমরা আজকাল বুঝতে পারি না। সেই সাথে এটাও অনুধাবন করতে পারি না, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে হাত ধরে পূজামন্ডপে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে আমরা কিভাবে নিজেদের অজান্তেই নিজেদের জন্য গুনাহ জারিয়ার পথ তৈরি করছি। “আমরা তো পূজা করছি না, শুধু দেখতে যাচ্ছি ”—-এই কথা বলে আমরা যতই নিজেদের কাজকে justify করতে চাই না কেন আমাদের এই অপরিণামদর্শী কর্মকান্ড আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শিরকের মতো একটি ভয়াবহ গুনাহ সম্পর্কে অনুভূতিশূণ্য করে দিচ্ছে –এই বোধটা আমাদের মনে কাজ করছে না।
আমরা জানি, শিশুদের brain এমন একটি hard disk যার অনেকটাই এখনও ফাঁকা রয়ে গেছে এবং আশেপাশের বিভিন্ন ঘটনা থেকে এই hard disk এ ক্রমাগত information জমা হচ্ছে । এই information গুলোর ভিত্তিতে তাদের পরবর্তী জীবনের জীবণাচরণ অনেকটাই প্রভাবিত হবে। আমরা হয়তো ভাবছি , আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছি “আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরীক নাই। ” তাই পূজামন্ডপে গিয়ে যতই মূর্তিপূজা দেখুক না কেনো এটা তারা স্রেফ অন্য ধর্মের অনুষ্ঠান হিসেবেই উপভোগ করবে !! তাদের মনোজগতে এটার কোনো দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এতটা আত্মবিশ্বাসী হবার অবকাশ আদৌ কি আছে?? আমাদের পরিণত Hard disk ( যেখানে তেমন আর জায়গা খালি নেই) এর সাথে তাদের অপরিণত Hard disk (যার অধিকাংশই এখনও খালি) তুলনা করাটা কিন্তু মারাত্মক বোকামি !! তাই মূর্তি পূজা দেখে আমাদের তাওহীদের কিশ্বাস হয়তো টলায়মান হয় না, কিন্তু শিশুরাও যে ভবিষ্যতে পথভ্রষ্ট হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই ; বিশেষত যেখানে শয়তান সবসময় তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত করার জন্য সদা তৎপর।

আমরা যদি একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের দুটি জনপ্রিয় সিরিয়াল হলো জয়ী এবং নকশীকাঁথা । জয়ী সিরিয়ালের নায়িকা একজন ফুটবলার এবং নকশীকাঁথা সিরিয়ালের নায়িকা শবনম, যশ নামে একজন হিন্দু ছেলেকে ভালোবাসে। এখন আমাদের দেশের মা, মামী, চাচীরা যখন প্রতিদিন এসব সিরিয়াল দেখেন ,তখন তারা হয়তো এগুলোকে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হিসেবেই দেখেন। এই বয়সে এসে নিশ্চয়ই তাদের মনে ফুটবলার হওয়ার বা অন্য ধর্মের কাউকে ভালোবাসার সাধ জাগে না,, কিন্ত এই মা, মামী, চাচীদের সাথে যখন তার পরিবারের শিশু সন্তানটিও এসব দেখে তখন কি তার মনে একই রকম প্রভাব পড়ে? সে যদি বড় হয়ে ফুটবলার হতে চায় বা অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে চায় তবে কি এই মা, খালা, মামীরাই বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারবেন? এই ধরনের পেশা বা বিয়ে যে মুসলিম মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য না, এই কথাগুলো বোঝানো কি তখন সহজসাধ্য হবে??? তখন যদি আজকের শিশুরা বড় হয়ে আমাদেরকে backdated বলে অভিহিত করে তবে তার জবাব দেয়ার ভাষা কি আমাদের থাকবে?? আসুন সন্তানদের সাথে নিয়ে সিরিয়াল দেখার পূর্বে বিষয়টি ভেবে দেখি।

এবারে আসি ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানের বিষয়ে। পার্শ্ববর্তী দেশের সিরিয়ালগুলোর একটি কমন বৈশিষ্ট্য হলো, সিরিয়ালগুলোতে সারা বছর জুড়েই তাদের কোন না কোন ধর্মীয় আচার -অনুষ্ঠান সম্পর্কিত পর্ব চলতে থাকে। এভাবে ক্রমাগত তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উদযাপন দেখতে দেখতে আমরা কখন যে নিজেদের জীবনেও এসব অনুষ্ঠানের অনুকরণে উদযাপন শুরু করে দিয়েছি তা হয়তো আমরা নিজেরাও জানি না। হয়তো আমাদের অনুষ্ঠানের নাম ভিন্ন, কিন্তু উদযাপনের ধরন একই। যেমন-শিশুদের জন্য অন্নপ্রাশনের অনুকরণে মুখে ভাত, অন্ত:সত্তাদের জন্য গোদ-ভরাইয়ের অনুকরণে সাথ, দোলের সময় হোলি খেলার অনুকরণে রং ছিটানো, বিয়ের সময় আশির্বাদের অনুকরণে এনগেজমেন্ট, মেহেদী সন্ধ্যার অনুকরণে গায়ে হলুদ—-এই জাতীয় অনুষ্ঠান গুলো অলরেডি আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ইসলামিক সংস্কৃতির সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক ।

এরই ধারাবাহিকতায় যখন মহালয়া থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রতিটি সিরিয়ালের পর্বে পূজার বর্নাঢ্য ও আকষর্ণীয় উদযাপন দেখানো হয় তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদেরও ইচ্ছা করে সপরিবারে সুসজ্জিত হয়ে পূজার গেট, আলোক সজ্জা, পূজা মন্ডপ ও দেবী বিসর্জন দেখতে যাওয়ার । আর এই স্রেফ দেখতে যাওয়ার পরিনতি যে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা হয়তো আমরা ধারণাও করতে পারছি না।

আমরা যদি মূর্তি পূজার ইতিহাস অনুসন্ধান করি, তবে জানবো চূড়ান্ত পথভ্রষ্টতা কখনই একদিনে আসেনি। ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন,
প্রতিমার পূজা নূহ্ (‘আ.)-এর লোকদের মাঝে চালু ছিল, পরবর্তী সময়ে আরবদের মাঝেও তার পূজা প্রচলিত হয়েছিল। নূহ (‘আ.)-এর সম্প্রদায়ের কতিপয় নেক লোকের নাম নাসর ছিল। তারা মারা গেলে, শয়তান তাদের কওমের লোকদের অন্তরে এ কথা ঢেলে দিল যে, তারা যেখানে বসে মাজলিস করত, সেখানে তোমরা কতিপয় মূর্তি স্থাপন কর এবং ঐ সমস্ত পুণ্যবান লোকের নামেই এগুলোর নামকরণ কর। কাজেই তারা তাই করল, কিন্তু তখনও ঐ সব মূর্তির পূজা করা হত না। তবে মূর্তি স্থাপনকারী লোকগুলো মারা গেলে এবং মূর্তিগুলোর ব্যাপারে সত্যিকারের জ্ঞান বিলুপ্ত হলে লোকজন তাদের পূজা আরম্ভ করে দেয়। [বুখারী (৪৯২০) তাফসীর ইবনে কাসীর (১৮/১৪২-১৪৪) ]

এভাবেই শয়তান কোন পাপ কাজের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণার অনুভূতি ম্লান করতে করতে তাকে স্বাভাবিকের পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে কয়েক প্রজন্ম ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায় মানুষকে শিরকে লিপ্ত করতে। আমাদের সময়ের প্রেক্ষিতে যদি প্রক্রিয়াটা এরূপ হয় যে,
আমাদের সন্তানরা পূজা দেখতে যাচ্ছে দর্শক হিসেবে——তাদের পরবর্তী প্রজন্ম পূজার কিছু আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে ফান হিসেবে ———তাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিজেরাই পূজা করা শুরু করে দিচ্ছে সিরিয়াসলি ( আল্লাহ মাফ করুন।)

তবে কি আজ হাত ধরে পূজা দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা দায়ী থাকবো না? সাদকায়ে জারিয়ার পরিবর্তে তখন আমাদের সন্তানরা কি আমাদের জন্য গুনাহর জারিয়ার উপলক্ষ হবে না???( রাসূল সা:) তো ভবিষ্যৎ বাণী করেই গেছেন—-
‘অচিরেই আমার উম্মতের কিছু লোক মূর্তিপূজা করবে। আর অতি শীঘ্রই আমার উম্মতের কিছু লোক হিন্দু বা বিজাতিদের সাথে মিশে যাবে’ (ইবনে মাজাহ হা/৩৯৫২, সহীহ হাদীস)।
আমাদের বংশধরদের মধ্যে কে্উ যেন এই জাতীয় গুনাহ না করে সেজন্য আসুন সময় থাকতেই সচেতন হই। পূজার অনুষ্ঠানগুলো যতই চাকচিক্যময় হোক না কেন, সন্তানদের উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নিচের কথাটি সম্পর্কে জানাই-
“মুশরিকরা যখন পূজা করতে থাকে তখন আমরা চাক্ষুষ দেখতে না পেলেও আল্লাহর ক্রোধ তাদের উপর পড়তে থাকে। ঐ সময় ওখানে উপস্থিত থাকলে আমরাও তার সম্মুখীন হবো এটা নিশ্চিত।” (বায়হাক্কী)
সেই সাথে সন্তানদের মনে এ্ই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করি যে,আল্লাহর সাথে শিরক করা এমন পর্যায়ের পাপ যা শত সহস্র অন্য ভালো কাজকে অর্থহীণ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তওবা না করে মৃত্যুবরণ করলে একমাত্র যে পাপ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, তা হল শিরক। আল্লাহ বলেছেন-

নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন। ( সূরা মায়িদা: ৭২)

আমাদের জন্য আরেকটি করণীয় হলো, সন্তানদের জন্য দুআ করা যেমন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম পড়েছিলেন-
হে
পালনকর্তা, এ শহরকে শান্তিময় করে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তান সন্ততিকে মূর্তি পূজা থেকে দূরে রাখুন। ( সূরা ইবরাহিম :৩৫)
সাথে হাদীস থেকে শিখানো আরেকটি দুআ
হে আল্লাহ! আমি জ্ঞাতসারে আপনার সাথে শিরক করা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই এবং অজ্ঞতাসারে (শিরক) হয়ে গেলে তার জন্য ক্ষমা চাই।
[আহমাদ ৪/৪০৩, নং ১৯৬০৬; ইমাম বুখারীর আল-আদাবুল মুফরাদ, নং ৭১৬]

আল্লাহ আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে শিরকের মতো ভয়াবহ গুনাহ থেকে দূরে থাকার তৌফিক দান করুন । আমীন।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন